ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো এখন কত দূরে,
আর আসে না রাজার কুমার পক্ষীরাজে উড়ে~~এই গানের লাইনগুলো শুনে কি মনে পড়ে ছেলেবেলা! আর সেই গল্প শোনার দিন? এমন কোনো মানুষ নেই যে কিনা ছেলেবেলার গল্প শোনার সেই মধুর স্মৃতি রোমন্থন করতে ভালোবাসেন না! কত রকম গল্প শুনেই না বড় হই আমরা। রুপকথার গল্প, দত্যি-দানো, ভূতের গল্প, হাসির গল্প। একটু বড় হবার পর ভ্রমন কাহিনী কিংবা গোয়েন্দা গল্প। মা বাবা, দাদী, নানী বা স্কুলের শিক্ষক কতজনের কাছেই না গল্প শুনি আমরা আর গল্প শুনতে শুনতেই সেই ছেলেবেলাতেই বেড়ে ওঠে গল্পের বই পড়ার অভ্যেসটিও। পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা প্রতিটা মানুষের জীবনে অতীব জরুরী একটি অভ্যাস আর এই অভ্যাসটি গড়ে ওঠার পিছনে ছেলেবেলায় আমাদের গল্প শোনার বিষয়টি পরোক্ষভাবে কাজ করে।
ছোট শিশুরা পড়তে না শিখতেই যখন গল্প শোনে সেই শোনার মধ্য দিয়েই সে পৌছে যায় কল্পলোকে। এমনকি নানা রকম নৈতিক শিক্ষা, উচিৎ অনুচিৎ বিষয়গুলিও গল্পের মধ্য দিয়ে শিশু মনে গড়ে তোলে এক সুশিক্ষনীয় জগৎ। তাই গল্প বলা বা গল্প শোনা শিশুর শিক্ষনে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যদিও আমাদের দাদী নানী, মা বাবারা তাদের মত করেই গল্প বলে গেছেন আমাদেরকে তবে আধুনিক শিশুশিক্ষায় এই গল্প বলার নানা রকম কলা-কৌশল ও বিষয় নিয়ে গবেষনা চলছে। গল্প দিয়ে শিশু মনে কি কি পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব বা গল্পটাকে কতটা মজাদার বা আকর্ষনীয় করে শিশুদের কাছে পরিবেশন করা যায় তাই নিয়ে কিছুদিন আগে প্রখ্যাত কবি সাহিত্যিক ও গল্প বলিয়ে শামীম আজাদের এক ওয়ার্কশপে গিয়েছিলাম আমি। যদিও গল্প শোনা আর বলাটা আমার আজকের প্রিয় বিষয় না, এ প্রিয় এ বিষয়টির সূচনা আমার মাঝে বেশ আগে থেকেই তবুও ওয়ার্কশপটা করতে গিয়ে নিজেই যেন ছোট বাচ্চা হয়ে গেলাম আবারও আমি। সারাটা দিন যে কেটে গেলো কোন ফাঁকে তা যেন বুঝতেও পারলাম না।
আমার "স্টোরী টেলিং বা গল্প বলা" নিজের ক্লাসের একটি দেওয়াল চিত্র বা জানালা চিত্র
সেদিন ছিলো সারাদিন মজার মজার গল্পের নানা রকম উপস্থাপনা। একেক রকম অঙ্গ ভঙ্গি ও কথপোকথন স্টাইল বা কন্ঠস্বরের তারতম্যের খেলা, কখনও বা ছবি দিয়ে কখনও বা পাপেট বা নানা রকম রিসোর্স দিয়ে গল্পগুলোর মাঝে যেন এক একটি চরিত্র স্পষ্ট হয়েই দেখা দিচ্ছিলো আমাদের সামনে। কখনও কখনও ভুলেই যাচ্ছিলাম আমরাও যে সেসব গল্পের রিয়েল চরিত্র না।
শিশুদের জন্য গল্প বলা বা গল্প শোনাটা কেনো এত জরুরী -
১.গল্প দিয়ে শিশুর মাঝে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। যেমন আমি যখন গল্প বলি পিনোকিও বা লিটিল মিস চ্যাটারবক্স। তখন আমার উদ্দেশ্য থাকে শুধু গল্পছলে গল্পটা বলে চলাই না। এ গল্পের মাঝে মিথ্যে বলা স্বভাবের বাচ্চাটি যেন মিথ্যে বলা বাজে অভ্যাসটাকে ত্যাগ করার অনুপ্রেরণা পায় বা জায়নামনির মত লিটল মিস চ্যাটারবক্স মেয়েটি তার বক বক করার কুফলতা একটু হলেও বুঝতে পেরে নিজেকে সামলায়।
২. একই গল্প বার বার শুনতে শুনতে শিশুমনে স্থায়ী কোনো বিষয়ে প্রভাব ফেলা সম্ভব। তবে অবশ্যই তা হবে না ভুত প্রেত বা দৈত্যি দানোর গল্প। গল্প যদিও শিশুদের জন্য কল্প কাহিনী নিয়েই বেশি লেখা হয়ে থাকে তবুও এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে কল্পলোকের গল্পের সাথে সাথে বাস্তবতা সম্পৃক্ত গল্পগুলিও বিশেষ জরুরী তাই শুধু স্লিপিং বিউটি বা তুষারকন্যার গল্পই নয় বাস্তব সন্মত বাস্তব জীবনের গল্পগুলিও যেমন যেখানে সেখানে কলার খোসা ফেলার বিপদ বা হেলপিং ইচ আদার এমন সব নন ফিকশনাল বিষয়গুলি নিয়ে লেখা গল্পগুলিও থাকতে হবে শিক্ষক বা অভিভাবকের গল্প বলার ঝুলিতে।
৩. শুধু গল্পের বইই থেকেই গল্প নয় । শিশুদের সাথে নিজেদের ছেলেবেলা, নিজেদের ফেলে আসা দিনের গল্পও বলতে হবে। এসব গল্প শিশুদেরকে অনেক কিছু শিখতে সাহায্য করে। আমি যখন গল্প বলি তখন তো মনে পড়ে যায় আমার ছেলেবেলা। মায়ের বকুনী উপেক্ষা করে সেই চকখড়ি বা ইটের টুকরো দিয়েও এঁকে চলার দিন বা প্রথম সেই চার বছর বয়সে হারমোনিয়ামে ইষ্টিকুটুম, মিষ্টিকুটুম গান তুলে ফেলার কথা। আর সেসব যখন আমি বাচ্চাদেরকে বলি তখন তারা যেমনই মজা পায় তেমনই বুঝতেও পারে ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছু থেকেই কাউকে দমানো সম্ভব না। পেতেই হবে কাগজ, পেন্সিল, ক্রেয়ন বা প্যাসটেল এমন কোনো কথা নেই। শিক্ষনের যুদ্ধে অস্ত্র বা হাতিয়ার নিজেকেই আবিষ্কার করতে হবে। যেমন ছিলো আমার ইটের টুকরো বা কয়লার কালি দিয়ে দেওয়াল, বাড়ি, দরজা, জানালার ক্যানভাসগুলোও।
৪. একটি দিনের আবহাওয়া, পরিস্থিতি, বিশেষ স্মৃতি নিয়েও গল্প বলা যেতে পারে - যখনই বর্ষাকাল আসে। জানালা দিয়ে মেঘ কালো আকাশের গায়ে ঝমঝম বৃষ্টির সুর আমার মনে পড়ে ছেলেবেলা।আমি তখন গল্প বলি আমার ছেলেবেলার গল্প। বৃষ্টি পড়লে আমি কেমন কাগজের নৌকা, আজ যা তাদেরকে অরিগ্যামী বলে শিখাই আমি সেটাই ভাসিয়ে দিতাম জানালার পাশের নর্দমায় ভেসে যাওয়া আমার ছোট্ট কল্পনার নদীতে। তারা কখনও সেটার অনুমতী পাবে কিনা জানিনা আমি কিন্তু আমি জানি আমার মনের তরনী দিয়ে আমি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারি আমি তাদেরকে কিছুখনের জন্য হলেও।
৫. শিশুদের সাথে দেশের গল্প, ইতিহাস বা সংস্কৃতি নিয়ে গল্প বলাটাও বিশেষ জরুরী - আমাদের দেশের গল্প, স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের গল্প এত ছোট বাচ্চাদেরকে বললে বুঝবে না হয়তো এমনটা মনে করেন অনেকেই। কিন্তু কি যাদু আছে সে গল্পে কে জানে আমি যতবারই তাদেরকে বলেছি আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা সহজ করে, সুন্দর করে, কত লাখো মা তার সন্তান হারিয়েছে যার বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা, আমি অবাক হয়ে দেখেছি, পিন পতন নীরবতা ছোট ছোট বাচ্চাদের ক্লাসেও। তাদের ব্যাথাতুর মুখ। কষ্ট পাওয়ার বেদনার অনুভুতি সে বুঝি অনেক বড় মানুষেরও অনুভব করা সম্ভব না।
এছাড়াও -
৬. শিশুদেরকে সারা বিশ্বের গল্প, ইতিহাস জানানোর দায়িত্বও কিন্তু আমাদেরই।
৭. বিজ্ঞান, ধর্ম, মূল্যবোধ, সামাজিক সচেতনতা এসব নিয়েও গল্প বলা যেতে পারে।
৮. ইশপের গল্প যেমনই মজার হতে পারে তেমনি দেয় নানা রকম নৈতিক জ্ঞানও।
৯. বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা যেতে পারে। শিশুর আশ পাশ বা শিশুকে নিয়েই। তার নাম দিয়ে বা কর্মকান্ড বা ভুল কিংবা সঠিক কাজগুলো নিয়ে গল্প বললে তাদের মনোযোগ বেশি পাওয়া যায়।
১০. বাবা মা দাদা নানা বা পূর্ব পুরুষদের জীবনের বিভিন্ন অর্জন, প্রচেষ্টা, ব্যার্থতার গল্পও শিশুদের যেমনই জানা প্রয়োজন, ঠিক তেমনই তা তাদেরকে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠাতেও সাহায্যও করে।
আমার নিজের ক্লাসের আরও একটি ডিসপ্লে বোর্ডের ছবি আর ছবিতে চেরাগ হাতে আলাদীন, জেসমিন আর জিনি।
যাইহোক-
গল্প শোনা বা গল্প পড়া নিয়ে মার্কিন বিশেষজ্ঞদের কিছু পরামর্শ-
১. বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে, যেসব শিশুর বাসায় বেশি বই আছে এবং শিশুকে বেশি বই পড়ে শোনানো হয়, তাদের মস্তিষ্কের বাঁ অংশ উল্লেখযোগ্য হারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পেরিয়েটাল-টেম্পোরাল-অক্সিপেটাল অ্যাসোসিয়েশন করটেক্স নামে অভিহিত মস্তিষ্কের এই অংশে শব্দ ও চোখে দেখার অনুভূতির সংমিশ্রণ ঘটে।
২. একটু বড় শিশুরা জোরে শব্দ করে পড়লে মস্তিষ্কের এই অংশ উদ্দীপিত হয়। কিন্তু শিশু চিকিৎসাবিদেরা লক্ষ করেছেন, খুব ছোট বাচ্চাদের বইয়ের গল্প পড়ে শোনালেও একইভাবে মস্তিষ্কের এই অংশ উদ্দীপিত হয়।
৩. মায়ের মুখে গল্প শোনার সময় বাচ্চারা মনে মনে কল্পনার জাল বোনে। যেমন, মা বললেন, ‘একটা কাক গাছের ডালে বসে কা কা করছে।’ সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা মনে মনে তার একটা চিত্র এঁকে ফেলল। এভাবে কথার সঙ্গে কল্পনার একটা যোগসূত্র স্থাপনের দক্ষতা সে অর্জন করে।
৪. আমরা যখন শিশুকে গল্প পড়ে না শুনিয়ে শুধু ভিডিও দেখালে শিশুর চিন্তাশক্তির বিকাশ ততটা হবেনা গল্প শুনালে যা হবে।
৫. বইয়ের গল্পে অনেক বেশি ও নতুন নতুন শব্দ থাকে। তাই বই থেকে গল্প পড়ে শোনালে বাচ্চাদের শব্দভান্ডার বাড়ে ও কল্পনাশক্তি অনেক বেশি হয়। এরা স্কুলে বেশি মেধার পরিচয় দেয়। বইয়ের সংস্পর্শে ও বই পড়ে শোনানোর মধ্য দিয়ে বড় করে তোলা শিশুদের সঙ্গে পরে তাদের সহজে ভাষা শেখা ও স্কুলে সাফল্যের সংযোগ রয়েছে।
শিশুদেরকে মজাদার পদ্ধতিতে আরও আরও মনোমুগ্ধকরভাবে গল্প উপস্থাপন বা পরিবেশনের উপায়গুলো কি কি এই নিয়েই ছিলো আমাদের সেই গল্প বলা ওয়ার্কশপ। আর সেটার পরিপ্রেক্ষিতেই আমার এ লেখনী। এবং সেটা নিয়েই আমার যে চিন্তাটা মাথায় এলো মানে এই বিষয়গুলো নিয়ে লেখালিখি করে একটু হলেও মা বাবা তথা অভিভাবকদেরকে একটু ভাবানো। এছাড়াও যারা ছোট বাচ্চাদের টিচার তাদেরও যদি একটু উপকার হয় সেটাও ভাবনায় ছিলো।
সে যাইহোক দেখি গল্প বলার আগে কিছু প্রয়োজনীয় শর্তাবলী -
১।কোন স্টোরীটা বলবো সেই গল্প বা বইটা প্রথমেই নির্বাচন করতে হবে।
২। গল্পটাকে নিজের মত করে বলতে নিজেই নিজের ভাষায় লিখতে হবে বা ভেবে নিতে হবে।
৩। এরপর নিজে নিজে জোরে জোরে বলাটা অভ্যাস করতে হবে। তবে স্টোরীতে অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বাদ দেওয়া যেতে পারে।
৪। নিজে নিজে বলাটাটা অভ্যাস করতে হবে। এক্ষেত্রে আমি মিরর মেথড ইউজ করি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গল্পটা বলা এবং নিজের অঙ্গ ভঙ্গি বা ভাবের প্রকাশ দেখে নিজেকেই শেখানো।
৫। কোনো বন্ধুকে শোনানো যেতে পারে।
৬। গল্প বলার সময় নানাস্থানে নানা রকম কন্ঠস্বরের পরিবর্তন গল্প বলাকে আকর্ষনীয় করে।
৭। পরিস্থিতি বর্ণনায় ইমোশন এড করতে হবে।
৮। আত্নবিশ্বাস বা কন্ফিডেন্স নিয়ে কথা বলতে হবে।
৯। গল্পে যে বিষয়টিকে ফোকাস করতে চাই বলার সময় তাতে বিশেষ প্রাধন্য দিতে হবে।
১০।সবশেষে আমার টিপস, গল্প বলে বলে রেকর্ড করে নিজের রেকর্ডিং শুনে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ বা কোথায় ইমপ্রুভ করা যায় এটা বুঝা যেতে পারে।
গল্প বলার, গল্প শোনার বা তা থেকে শেখার কিছু মজার বৈশিষ্টাবলী-
১। টাং টুইস্টার - মনে আছে পাখি, পাকা পেপে খায় বা কাঁচা গাব পাঁকা গাব কাঁচা গাব পাঁকা গাব কাঁচা গাব পাঁকা গাব । নির্ভুল ভাবে কে কত দ্রুত বলতে পারে সেসব খেলার দিন। সেসব খেলা আবার খেলি আমাদের শিশুদের সাথে বা ক্লাসরুমেই। এতে যেমনই শিশু মুখের জড়তা কাঁটে তেমনি শিশু আত্মবিশ্বাসী হতে শিখে তেমনি বৃদ্ধি পায় কনসেন্ট্রেশন বা মনোযোগ। শিশুদের মুখের জড়তার কাটাবার এই শিক্ষনটা কিন্তু আমরা যারা ভালো গল্প বলিয়ে হতে চাই তাদের জন্য মানে আমাদের মত বড়দের জন্যও যথেষ্ঠ জরুরী।
২। রিপিটেশন - একই কথা, একই বাক্য বা একই গল্প। বার বার পুনরাবৃত্তির ফলে আমরা শিশুর মনে এর শিক্ষনীয় দিক বা কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ানোর ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করতে পারি। যতই মানুষ আকাশ কুসুম কল্পনাকে হেসে উড়িয়ে দিক না কেনো কল্পনা ছাড়া এ জগতে আজও কোনো আবিষ্কার হয়নি কাজেই শিশুর মনোজগতে কল্পনার বিকাশও যথেষ্ঠ প্রয়োজনীয় বিষয়।
৩। হ্যোয়াটস কামস নেক্সট বা এরপর কি হবে বলোতো?- এক লাইন গল্প বলে পরের লাইন কি হতে পারে বলতে বলা বা ভাবতে বলা। এতে চিন্তাশক্তি, মনোযোগ ও গল্প বলার বা গল্প বানাবার দক্ষতা বাড়ে। শিশু নিজেই চিন্তা করে, কল্পনা দিয়ে নিজের মস্তিস্কে তৈরী করে দৃশ্য কল্প।
৪। ভয়েস প্রজেকশন- গল্প বলিয়েদের গলার য্ত্ন বিশেষ প্রয়োজন। গল্প বলার সময় নানা পরিস্থিতি বর্ণনায় নানা রকম কন্ঠের শব্দ প্রকাশের তারতম্য গল্পের শ্রোতাদের মাঝে এক বিশেষ আকর্ষন আনে। ভয়ের পরিবেশ, আনন্দোচ্ছাস, রাগ ক্ষোভ, দুঃখ সকল ইমোশন এবং পরিস্থিতি বর্ণনায় কন্ঠস্বর এক বিশেষ ভূমিকা রাখে।
৫। রোল প্লে - গল্পের বই পড়ে শোনানো সাথে শিশুদের দিয়ে সেটার অভিনয় করানোটা শিশুদের জন্য গল্প বলা বা শোনা বা গল্পের যে উদ্দেশ্য তা শিশুদের মাঝে পৌছে দেবার ব্যাপারটাকে আরও সহজ করে।
৬। অনুমান বা জানার পরিধি যাচাই করে নেওয়া- গল্প বলার সময় গল্পের ফাঁকে ফাঁকেই শিশুদেরকে পরবর্তী ধাপ সম্পর্কে অনুমান করতে বলা যায়। নানা রকম প্রশ্নোত্তর সহযোগে গল্প বলাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেমনই শিশুর মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়তা করে তেমনি সক্রিয় শিক্ষাদান বা স্টুডেন্ড সেন্টারড একটিভিটির পরিবেশ সৃষ্টি করে।
রেড রাইডিং হুড গল্প পড়ার পরে আমার এক বেবির করা ক্রাফট ওয়ার্ক
৭। পিকচার রিডিং- খুব ছোট বাচ্চারা আক্ষরিক পড়াশোনা পড়তে শেখার আগেই ছবিগুলো পড়তে শিখে যায়। তারা ছবি দেখে গল্পের অনেক কিছুই বুঝতে পারে বা নিজের মত করে ভেবে নিতে পারে। তাই গল্পের বই এর ছবিগুলি বিশেষ জরুরী। এই ছবিগুলি নিয়ে প্রশ্ন করে করে শিশুদের গল্প বলার ও বুঝার দক্ষতাও বাড়ানো সম্ভব।
৮। প্রেজেনটেশন - প্রেজেনটেশন বা উপস্থাপন। গল্প শোনা বা পড়ার পর সেটা শিশুদের জন্য নিজের মত করে উপস্থাপন করবার সুযোগ করে দিতে হবে। খুব ছোট শিশুরা ছবি এঁকে এবং পরবর্তীতে সেটা গল্প বলায় বুঝিয়ে তা যেমনি বর্ণনা করতে পারে তেমনি একটু বড় বাচ্চারা সেটাই ছোট ছোট প্যারা লিখে বা নিজের ভাষায় লিখে সকলের সামনে উপস্থাপন করতে পারে। তবে ছবি আঁকা হোক বা ছোট প্যারায় লিখিত গল্পই হোক মা বাবা এবং শিক্ষক সকলেরই উচিৎ সেসব সকলের জন্য ডিসপ্লে বোর্ড বা অন্য যে কোনো উপায়ে আকর্ষনীয় ভাবে সকলের মাঝে উপস্থাপন করা। এতে শিশুরা আরও বেশি উৎসাহিত হবে।
আমার গল্প বলা ক্লাসে ৩ বছর বয়সী শিশুদের গল্পের চরিত্র অঙ্কন চিত্র-
৯। গল্পের বই এর ছবি - আগেই বলেছি গল্পের বই এর ছবিগুলি শিশুদের শিক্ষনে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে । গল্প পড়া, শোনানো বা বলার পর গল্পের বই এর ক্যারেকটার বা চরিত্রগুলির ছবি আঁকতে উৎসাহিত করলে গল্প বলা, শোনা বা বুঝার ব্যাপারটি আরও বেশি কার্য্যকরী হবে।
১০।ফ্লাশ কার্ড - ফ্লাশ কার্ড বা বিভিন্ন ছবির ছোট ছোট টুকরোর পর্যায়ক্রমিক বর্ণন অর্থাৎ ছবি সম্বলিত বিভিন্ন ফ্লাশ কার্ড সহযোগে গল্পের উপস্থাপন গল্প বলাকে দেয় এক ভিন্ন মাত্রা।
১১। পাজেল- গল্পের চরিত্র বা দৃশ্যাবলীকে নানা রকম টুকরো ছবি দিয়ে মিলিয়েও গল্পের উপস্থাপনাকে নান্দনিক করে তোলা যায়।
আমার করা পাপেট শো বা পুতুল নাচের ছবি
১২।পাপেট গল্প - পাপেট বা পুতুল নাচের পুতুলগুলো যখন গল্পের বই থেকে উঠে এসে নিজেরাই হেঁটে চলে বেড়ায়। কথা বলে, গান গায় তখন কতই না মজার হয়। তাই সারা বিশ্বে পাপেট গল্প বা পাপেট শো সর্বজন নন্দিত। পাপেট দ্বারা সৃষ্ট চরিত্রগুলির সকল কর্মকান্ডই তাই শিশু মনে প্রায় চিরস্থায়ী আসন গড়ে তোলে।
আমার করা একটি বাংলা পাপেট শো এর চিত্র
১৩। ড্রেস এজ ইউ লাইক বা যেমন খুশি তেমন সাজো- গল্পের প্রিয় চরিত্রে শিশুদেরকে সাজিয়ে তোলার জন্য ইদানিং পোষাক দোকানগুলোতে দেখা যায় নানা রকম কস্টিউম। পুলিশের ইউনিফর্ম, মিলিটারীদের ইউনিফর্ম, স্পাইডারম্যান বা স্নোহ্যোয়াইটের কস্টিউম। এসব পোষাক শিশুদেরকে নিয়ে যায় সেসব শিশুতোষ গল্পের মাঝেই যেখানে কল্পনার রাজ্যে ভেসে গিয়ে শিশুদের মনোজগতে তৈরী হয় এক আলাদা আবহ। তবে শুধু পোষাক কিনে দিয়েই দায়িত্ব শেষ না করে যদি অভিভাবক ও শিক্ষকমন্ডলী সেই চরিত্রের ইতিবাচক দিকগুলি নিয়ে গল্প করে বা তাদেরকে সেসব চরিত্রের অনুকরণীয় দিকগুলি নিয়ে ভাবতে সাহায্য করে তবেই তা বিশেষ কার্য্যকরী হয়ে ওঠে। তবে আবারও বলছি ফিকশনাল চরিত্রের গল্পগুলির পাশাপাশি ননফিকশনাল বা বাস্তব চরিত্রের গল্পগুলিও শিশুর জন্য বিশেষ জরুরী।
আমার গল্প বলা ক্লাসের বাচ্চাদের নিজেদের তৈরী স্মল স্টোরি বুকস
১৪। বুক মেকিং একটিভিটি- গল্পের বই লেখালিখির অভ্যাস বা নিজের জন্য ছোট্ট একটি গল্পের বই বানাবার সাধ ছোট বয়স থেকেই পূরণে সাহায্য করা সম্ভব। ছোট শিশুরা যারা লিখতে জানেনা তারা ছবি এঁকে বানাতে পারে পিকচার বুক। যারা কেবলি লেখা শিখছে তারা এক এক লাইনে বানাতে পারে কয়েক পাতার বই। বুক কাভার বা কনটেন্ট এসব পরিকল্পনায় অভিভাবক ও শিক্ষকগণের সহায়তা প্রয়োজন।
১৫। কোয়েশ্চেন এনসার - গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বা গল্প শোনানোর পর অবশ্যই শিশুদের জন্য প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকা প্রয়োজন। এই প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষক বা অভিভাবক মন্ডলী ক্লোজ এন্ডেড কোয়েশ্চেনের পাশাপাশি কিছু ওপেন এন্ডেন প্রশ্নও রাখতে পারেন। একই ভাবে শিশুদের জন্যও বড়দেরকে প্রশ্ন করার সুযোগ রাখতে হবে।
হাতে বানানো স্পুন পাপেট।
আকর্ষনীয়ভাবে গল্প বলার উপকরণ বা রিসোর্সেস বা সাজ সরঞ্জাম-
১। ছবি
২। ফ্লাশ কার্ড
৩। পাজেল
৪। খেলনা
৫। ক্যারেক্টার কসটিউম
৬। অডিও ভিডিও ক্লিপস
৭। প্রজেক্টর
৮। ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটার
৯। গ্লপের বই
১০। বোর্ড
১১। ডিসপ্লে বোর্ড
১২। মিউজিক
১৩। সাউন্ড এফেক্ট
১৪।পাপেট( ফিংগার পাপেট, স্পুন পাপেট, মাপেট ইত্যাদি ইত্যাদি ও ইত্যাদি)
১৫।প্রাকটিক্যাল অবজেক্টস বা বাস্তব থেকে পাওয়া নানবিধ সরঞ্জামাদি।
মোট কথা গল্প বলার সময় আমরা শিশুর সকল মালটিপল ইনটেলিজেন্সীকেই কাজে লাগাতে চেষ্টা করবো। এতে অডিও ভিজ্যুয়াল স্ট্রাটেজী থেকে শুরু করে Kinesthetic বা বডি স্মার্ট ইনটেলিজেন্সীকেও কাজে লাগাতে চেষ্টা করবো। মোট কথা গল্পের মাধ্যমে দেখা যায় শিশুর Linguistic /word smart অর্থাৎ ভাষা দক্ষতা, Logical-mathematical / Number smart (গণিত/ যুক্তিবিদ্যা) Spatial / picture smart শিল্পজ্ঞানের বিকাশ, Kinesthetic/body smart ( খেলোয়াড়/ নৃত্যশিল্পী বা শাররীক দক্ষতা) Musical/music অর্থাৎ সঙ্গীত বিলাসী মনোভাবের বিকাশ Interpersonal/people smart ,Naturalist/nature smart প্রায় সকল বৈশিষ্ঠেরই বিকাশ সম্ভব।
কিভাবে গল্পের বই সংগ্রহ করা যায়-
(১) লাইব্রেরী: সদস্য হয়ে যাওয়া, ছোটদের গল্পের বই বাসায় এনে পড়ে শোনানো যেতে পারে।
(২) মজার মজার গল্প বা ইউটিউব লিঙ্কও পাওয়া যায় সেসব গল্প ডাউনলোড করা যেতে পারে।
(৩) নতুন বই কিনে দেওয়া।
গল্প বলার সময় মানে সারাদিন কর্মব্যস্ততার মাঝেও কখন একটু সময় করে নেওয়া যায় শিশুদেরকে গল্প বলার জন্য এ বিষয়টি ভাবতে হবে। শিশুদের জন্য রোজ একটি গল্প ক্লাসরুমে থাকা অতি অতি জরুরী বলেই আমি মনে করি আর তাই
(১) ঘুমের আগে গল্প বলার যেমন উপকারীতা মানে সারাদিন পরে ঘুমুতে যাবার সময় শিশুদেরকে গল্প বলার অভ্যাস গড়ে সেটি নাকি বেশ কার্য্যকরী হয় তাই তো প্বথিবীতে রয়েছে শত শত বেড টাইম বা স্লিপ টাইম স্টোরী বুকস! ঠিক তেমনি হোম টাইম বা বাড়ি যাবার ঠিক আগ দিয়েই শিশুদেরকে গল্প শুনাতে আমি দারুন ভালোবাসি। তারা বাড়ি গিয়েই নিজেরাই গল্প শুনায় তাদের বাবা মা ভাইবোনদেরকে।
(২) আজকাল যা জ্যাম। রাস্তায় গাড়িতে বসে থাকার কষ্ট বা বিরক্তি দূর করতে আমি সব সময় আমার গাড়ির ড্যাসবোর্ডে কবিতার বই রাখি। ঠিক একইভাবে আমরা যদি শিশু থাকলে তাদেরকেও গল্প শুনাই তো এই বিরক্তিকর বোর হবার সম্ভাবনা তার জন্য যেমন কমে যাবে নিজেরও তেমনি সময়টুকু উপভোগ্য হবে।
(৩) খাওয়াবার সময় গল্প বলা।
(৪) বিভিন্ন উৎসবে, বিশেষ দিনগুলোতে সে সব দিবসের তাৎপর্য্যতা নিয়ে সেদিন গুলোতে গল্প শোনানো বিশেষ প্রয়োজন।
বাচ্চাদের জন্য বই লেখা-
কত কবিতাই তো লিখি আমরা। নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগা ভালোবাসা বা বিরহ নিয়ে। দেশ সংস্কৃতি বা পারিপার্শ্বিক পরিস্তিতি নিয়েও তো কম লিখি না তবে শিশুদের জন্য সেই আদ্দিকালের গল্পগুলিই আজও চলছে। তূলনামুলকভাবে কম কম লেখা হচ্ছে শিশুদের জন্য কিন্তু চাইলেই লিখে ফেলা যায় শিশুদের জন্য মজাদার ও শিক্ষামূলক গল্প কবিতা। বাস্তবতার সাথে কল্পনার ইচ্ছে মতন মিশেলে লেখা যায় একটা শিশুতোষ বই।
শিশুতোষ গল্পের বই লিখবার সময় কয়েকটি বিষয়ে মন দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন-
চরিত্র
গল্পের চরিত্র বা ক্যারেকটার এক বা একাধিক হতে পারে। হতে পারে মানুষ, পশু, পাখি, কাল্পনিক জীব-জন্তু অথবা যে কোনো কিছুই।
বয়স
গল্প লেখার আগে কোন বয়সী পাঠকের জন্য লেখা হচ্ছে তা মাথায় রাখতে হবে। বাচ্চাদের এইজ লেভেল অনুযায়ী শব্দচয়ন, বাক্য গঠন সহজ থেকে জটিল হবে।
রাফলি গল্পটা লেখা বা খসড়া তৈরি
খসড়া তৈরী বিশেষ প্রয়োজন। সূচনা, মধ্যবর্তী অংশ এবং উপসংহার কি হবে তা আগেই ভেবে নিতে হবে।
এন্ডিংটা হ্যাপী হোক বা স্যাড হোক সেখানে যেন মোরালটা থাকে। শিশুর জন্য শিক্ষনীয় কোনো দিক থাকে সেদিকে অবশ্য লক্ষ্য রাখতে হবে।
বাচ্চাদের বই এর বিশেষ বৈশিষ্ঠ গল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ছবিগুলি। তারা যেহেতু পড়তে পারেনা। ছবিগুলি তাদেরকে গল্প বুঝাতে বিশেষ ভুমিকা রাখে।
আমার জীবনের প্রথম পাপেট শো- রাখার ছেলে ও বাঘ
গল্প বলার কিছু অনলাইন লিঙ্ক আছে যা থেকে সহজেই গল্প বলার মজাদার কৌশলগুলো শেখা যায়-
How To Tell A Story: Quick-Learn Storytelling Techniques!
Sisimpur
Bhootu - Episode 119 - July 29, 2016 - Webisode
Bedtime English Story Telling Contest 2013 (Upper Kindergarten) - Kwok Wing Yan 郭穎欣
Dionne - Champion-Storytelling Contest.AVI
The Hungry Caterpillar Play
Bengali Kids Stories
আমার নির্মিত পাপেট গল্প
মাই ফিংগার পাপেট শো ইন ক্লাসরুম
রাখাল ছেলে ও বাঘ (খন্ডাংশ)
শিশুদের জন্য আমার এই গল্প বলার কলা ও কৌশলের লেখনীটি আমি যেই এইজ লেবেলটার জন্য লিখেছি সেটা হলো ২.৫ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য কার্য্যকরী। এ লেখাটি শামীম আজাদের গল্প বলা ওয়ার্কশপের কিছু নোট থেকে এবং বেশি ভাগটাই আমার বাস্তব জীবনের গল্পে গল্পে মজার শিক্ষা অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছি।
তবে শেষ হইয়াও হইলো না শেষ-
আমার এত কথকথার পরেও এই প্রায় পৌনে এক ঘন্টার স্টোরী টেলিং ট্রেইনিং ভিডিওটা দেখলে যে কেউই হয়ে উঠতে পারেন এক একজন সেরা গল্প বলিয়ে

কাজেই আর দেরী নয়। শিশুদের জন্য মজাদার গল্প বলার কলা কৌশল আয়ত্ব করুণ এবং আনন্দময় শিক্ষা পেতে সহায়তা করুন।


সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:২৭