মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে
তুমি যাচ্ছো পালকীতে মা চড়ে................
রবিঠাকুরের শিশুমনের সেই ভাবনার মত ঘুরে আসলাম আমরা ছোট্ট এক সাংস্কৃতিক দল আর অবশ্যই শিশুদের সাথে।যদিও তাদের সাথে মা বাবারা ছিলোনা, ছিলো আমাদের মত কিছু শাসন বারণহীন দিদিমনিরা ......
ভ্রমন- ঢাকা টু ব্যাংকক-
টিকেট হাতে পেয়ে অবাক হলাম! আমি জানতাম না সেই সূদূর ব্যাংককেও এমনই এক এয়ারপোর্ট আছে যার নাম শুনে আমাকে অবাক হতে হবে। এয়ারপোর্টের নাম সূবর্ণভুমি! এ নাম তো শুধু বাংলা বা সংস্ক্বত শব্দ ছাড়া মানায়ই না। কারণটা কি এমন নামের?
যাই হোক শুরু হলো বাংলাদেশ শাহজালাল এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের যাত্রা। চেকইন এর পর ওয়েট করছি আমরা। ঐশ্বর্য্য পিচ্চিটা তো কোনো বাছ বিচার না মেনেই এয়ারপোর্টের এ্যালকোহলের দোকানে ঢুকে পড়লো আইপ্যাডে ওয়াইফাই কেমনে অন করবে জানতে। হঠাৎ পায়ে জ্বলুনী শুরু হলো। ওমা তাকিয়ে দেখি এত বড় বড় মশা! বাপরে এইসব মশার কামড়ে যদি এইডস হয়। নাকি ইবুলা ভাইরাসই ধরে কে জানে। এক লাফে দুই পা চেয়ারে তুলে বসে রইলাম আমি, কোনো ম্যানার ফ্যানারের তোয়াক্কা না করে।
থাই এয়ার লাইন্সে যাত্রা ছিলো আমাদের। এয়ারহোস্টেসরা আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালো, সয়াদিখা...সয়াদিখা
সয়াদিখা, সয়াদিখা শুনতে শুনতে আমি শেষ। আরে কি বলে এরা । প্রথমে শুনে আমার কানে আসছিলো সারিহা...... আর আমার মত আমাদের দলের পিচ্চি সারিহাও বার বার সে ডাকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলো এয়ারহোস্টেসদের দিকে। সে যাইহোক সয়াদিখার অর্থ বা ইতিহাস পরে জানিয়েছিলো আমাদের পুকেট সিটি ট্যুর গাইড বেলা। বেলা মানে সুন্দরী। এটা ইটালিয়ান নাম । আমার ইটালিয়ান বন্ধুর কাছে আগেই জেনেছিলাম বেলা নামের মিনিংটা। বেলার কথায় আসছি পরে।
তো শুরু হলো যাত্রা। মেঘের উপরে ভেসে চললো আমাদের পঙ্খীরাজ। দুপুর ১টা ৪০ এ ফ্লাইট ছিলো। খানা পিনা করে একটু গুছিয়ে বসতে না বসতেই পৌছে গেলো বিমান আমাদের গন্তব্যে। লেমন চিকেন আর বাসমতী রাইস সাথে সফ্ট কেকের টুকরো খুব মজা করেই খেয়েছিলাম আমরা।
এয়ারপোর্টে নেমেই আমরা এয়ারপোর্ট থেকেই পরেরদিনের সিটি ট্যুর ঠিক করে ফেললাম। মেয়েটার নাম ছিলো সারাহ। সে বললো আমাদের হোটেলে পরদিন সকাল ৯টায় পৌছে যাবে গাড়ি। সাথে থাকবে ইংলিশ স্পোকেন গাইড ন্যান্সি।
যাইহোক টিকেট কেটে আমরা মিটার ট্যাক্সি করে হোটেলের দিকে রওয়ানা দিলাম। তখন আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। আসলে আমরা বেশ কিছুটা ক্ষন এয়ারপোর্টে কাটিয়েছিলাম। পিচ্চি রিহানের কাজই হলো যেখানেই স্ক্রিন দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে যাওয়া। স্ক্রিনে কি সব ছাইভস্ম লেখে যে সে কে জানে!
আমাদের সবার মাঝেই এক অজানা আনন্দ কাজ করছিলো। ঝকঝকে তকতকে একটা দেশ কিন্তু ট্যাক্সি করে যাবার সময় মনে হলো আমাদের ঢাকাও কম সুন্দর নয়। সৌন্দর্য্যে আমার ঢাকাও এটার কাছাকাছিই বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেনো বেশি সুন্দর!!!!
আমি খুবই হিংসুটে আর পসেসিভ সেটাই বুঝলাম যখন প্রতি পদে পদে তুলনা করে মনে মনে বেশি মার্কটাই দিতে চাইছিলাম আমার দেশকে।
ট্যাক্সি গিয়ে পৌছুলো আমাদের হোটেলে।হোটেল এ্যাম্বাসাডর। ক্রিস্টমাস আর নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে চারিদিক ঝকমক করছিলো আলোক সজ্জায়। আমাদের হোটেলটাও জ্বলছিলো যেন রংধনুর মত। বিশাল ঝাড়বাতি গুলির নীচ দিয়ে রুপোলী আলোর ঝাঁকে ঝাঁকে রেইন ডিয়ার, সে এক রুপকথার রাজ্য।
রুমে ঢুকেই আমরা ফ্রেস হয়ে নিলাম । ডিনার করতে বের হলাম তারপর। কোথায় ডিনার করবো কোনো ঠিক ছিলোনা। ভাবলাম বের হয়ে যা মনে চাই সেটাই খাওয়া যাবে। এ্যাম্বাসাডর হোটেলের চারিধারে ইন্ডিয়ান আর বাঙ্গালী খানা। কিন্তু আমরা সেসব না খেয়ে আজ ম্যাকডোনাল্ডস খাবো ডিসিশান নিলাম। হেঁটে হেঁটে চললাম আমরা ফুটপ্যাথ ধরে লাইন করে। আমাদের দেশের ফুটপ্যাথ আর কি দখল করে হকারেরা। সে দেশে তো হাঁটাই যায়না এই অবস্থা। খাবারের দোকান হতে জামা, কাপড়, জুতা, জু্যেলারী, স্যুভেনিয়র কি নেই সেখানে। তবে লজ্জা পেলাম যখন দেখলাম উন্মুক্ত খোলা আকাশের নীচেই তারা পশরা সাজিয়ে বসেছে নানারকম আদি পন্যের। আমাদের সাথে বাচ্চারা ছিলো । তারা আমার থেকেও হাজারগুন চালাক। আমি যা দশ মিনিটে বুঝি তারা তা বুঝে এক সেকেন্ডে। তারা একে অন্যকে গুঁতাগুতি করে, ফিস ফিস করে সেসব দেখাতে লাগলো।
সে যাই হোক ম্যাকডোনাল্ডসে বার্গার, কমলা রঙের অরেন্জ জ্যুস আর সবুজ এ্যাপেল জ্যুস দিয়ে ডিনার সারলাম। আমাদের মাঝে হুজুর প্রকৃতির আরিফ সাহেব মেয়েদের নাউজুবিল্লাহ টাইপ ড্রেস দেখে আকাশের তারা গোনা শুরু করলেন।
যাইহোক ফিরে আসলাম যখন হোটেলে তখন রাত ১২টা। পরের দিনের জামাকাপড় গয়না গাটি সাজসজ্জা ঠিকঠাক করে তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।
ফেরার পথে একটা জিনিস দেখে অবাক হয়েছিলাম। ফুটপ্যাথে বসে আছে আমাদের দেশের মতই বহু ভিখারীরা। আমাদের দেশের মতই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুমুচ্ছে পথের ধারে। শুধু পার্থক্য আমাদের ভিখারীদের জামাকাপড় ধুলি ধুসরিত আর ওদেরগুলো চকচকে। আরও একটা মজার ব্যাপার দেখলাম আমাদের ভিখারীদের হাতে থাকে থালা। ব্যাঙ্গাত্বক কথাতেও আমরা তাই বলি সব শেষ হলে তো থালা হাতে পথে নামতে হবে। কিন্তু ওদের ভিখারীদের হাতে থাকে কাগজ বা প্লাসটিকের গ্লাস।
একখানে দেখেছিলাম এক অপার্থীব দৃশ্য। দুটি ছোট ছোট ভিখারী শিশু অঘোরে ঘুমুচ্ছে পথের ধারে। দুদিকে পড়ে আছে দুটো শেষ হয়ে যাওয়া দুধের বোতল আর ছোট্ট একটা কুকুরছানা ওদের পায়ের কাছে। পাহারা দিচ্ছে ওদেরকে। এমন অপার্থীব সৌন্দর্য্যের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করছিলো অনেকেই । আমি পারলাম না। আমার মানবিকতায় আর বিবেকে বাঁধা দিলো ..........শুধু মনের পর্দায় তুলে রাখলাম সে ছবি সারাজীবনের জন্য।
টেম্পল এ্যান্ড ক্রিসটেলা
পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো আমার। তখন প্রায় ভোর সাড়ে পাঁচটা। ১০তলার বিশাল জানালায় দেখলাম ভোরের ব্যাংককের আকাশ। সুবিশাল ভবনগুলির ফাঁক দিয়ে আমাদের হোটেলের অর্ধচন্দ্রাকৃত স্যুইমিং পুল দেখা যাচ্ছিলো। এক বৃদ্ধ সেখানে স্যুইমিং করছিলো। একে এক সবাই ঘুম ভেঙ্গে উঠলো।
সবাই আমরা সেদিন হলুদ কমলা কম্বিনেশনের পোষাক পরেছিলাম। তৈরী হয়ে আমরা গেলাম ডাইনিং এ। বিভিন্ন রকম সিরিয়াল থেকে শুরু করে ফ্রায়েড রাইস, চিকেন কারী, ব্রেড, জ্যাম জেলী, নান কোনো রকম ব্রেকফাস্টেরই অভাব ছিলোনা সেখানে। দ্রুত খাওয়া শেষ করতে হলো কারণ ৯টায় সিটি ট্যুরের গাড়ি আসবে।
গাড়ির জন্য খোঁজ করতে গিয়ে আমরা খুঁজছিলাম ন্যান্সি নামের কোনো তরুনী গাইড। তার বদলে দেখি মোটা সোটা বুড়ো মতন এক গাইড যার নাম কাকা। সে বল্লো তাদের কোম্পানীর মালিক নাকি সবাইকে এই উপাধী দিয়েছে। কি আশ্চর্য্য কথা ! সে যাইহোক,
শুরু হলো আমাদের যাত্রা। পথে যেতে যেতেই ছবি তুলছিলাম আমি গাড়ির কাঁচের ভেতর দিয়েই। সবচেয়ে মজা লাগছিলো ওদের বর্ণালী ময়ুর শোভিত ও রাজারাণীর ছবি সম্বলিত নানা রকম তোরনগুলো।
আমরা প্রথমে গিয়ে পৌছুলাম Wat Traimit( The temple of solid gold buddha) মন্দিরে। অসংখ্য ট্যুরিস্টদের ভীড় ছিলো সেখানে। স্নেক বুদ্ধা বা কালো সাপের ফনার মাঝে স্বর্নালী বুদ্ধ মূর্তীও মুগ্ধ করলো আমাকে। আমি এই সুযোগে একটু প্রার্থনাটাও সেরে নিলাম সেখানে।
দ্বিতীয় মম্দিরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার আগেই আমাদের গাইড কাকা পলিব্যাগে করে কাঁচা আম কিনে আনলো। সে বললো তাদের ফ্রুট জগৎবিখ্যাত। আমরা খেয়ে দেখতে পারি। তার অনুরোধে এক টুকরো আম মুখে দিলাম। মোটেও টক নয় আমাদের কাঁচা মিঠা আমের মত স্বাদ। তবে আমাদের দেশের কাঁচামিঠা আমের মত সেই মন ভুলানো গন্ধ কি আর তারা পাবে? তাই কি হয়?
এরপর গেলাম আমরা Wat pho ( reclining Buddha)
সুবিশাল গোল্ডেন বুদ্ধা ও তার পায়ের তলার অসংখ্য সব বাণী। মুগ্ধ হলাম আমরা। মন্দিরের বাইরের বাগান, মূর্তী সবকিছুতেই ছিলো স্বর্গীয় পরিবেশের ছোঁয়া। অসংখ্য ট্যুরিস্টদের ভীড় ছিলো সেখানেও।
এরপর কাকা আমাদেরকে নিয়ে চললো Wang Talan and Crystela shop
এ। এত মনোমুগ্ধকর জ্যুয়েলারী দেখে আমি তো মুগ্ধ! জ্যুয়েলারী গুলোর আকাশছোঁয়া দাম ছিলো। আর তাছাড়া জ্যুয়েলারী কেনার কোনো ইচ্ছে বা শখও ছিলোনা আমার।তারচাইতে গোল্ড প্লেটেড ক্রিস্টাল বসানো হাতীগুলিই পছন্দ হলো বেশী আমার। ছোট্ট এতটুকুন হাতী একেকটা ১১০০ বাথ। ফিক্সড প্রাইজ কোনোভাবেই কমাবেনা তারা। কি আর করা !
এরপর কাকা আমাদেরকে নিয়ে চললো থাই সিল্কের শপে। যেতে যেতে নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়লো সে গাড়িতে। আমরা অবাক ! কোনো গাইড কখনও ঘুমায় আমরা জানতাম না।
Madame Tussaud Museum in Bangkok
পরদিন আমাদের গন্তব্য ছিলো Madame Tussaud Museum।সিয়াম প্যারাগনে নামলাম আমরা। আমি জানতাম বাচ্চারা খুব মজা পাবে তাই এখানে আসার ইচ্ছেটা আমার মাঝে কাজ করছিলো ভীষনভাবে। আমরা একই সাথে madame tussaud museum আর ওশান ওয়ার্ল্ডের টিকেট কিনেছিলাম।
প্রথমেই চোখে পড়লো Leonardo DiCaprio। ইরফান তো দৌড়ে গিয়ে ছবি তোলা শুরু করলো। আমার অবশ্য একটু লজ্জা লজ্জা লাগছিলো । তবুও আমিও ছবি তুল্লাম তার সাথে কিন্তু আমার সাথের অন্যরা তাকে পাত্তাই দিলোনা কেনো যেন। ছবি তোলা তো দূরের কথা।
মহাত্মা গান্ধী তিনি আমার একজন আইডল পারসন। কিন্তু বাচ্চারা তাকে চেনেই না । এই বুড়া মানুষটার উপর আমার এই অগা্ধ শ্রদ্ধায় তারা বিস্মিত। লেডি ডায়না , Aung San Suu Kyi, বারাক ওবামা তাদের কাছে বিশেষ আকর্ষনীয় ছিলোনা। তাদের পছন্দ Jackie Chan, ব্রুসলি। কুইন এলিজাবেথকে না চিনলেও অনেকেই ক্রাউন আর কিংরোবটা নিয়ে ঠিকই সিংহাসনে রাজা সেজে তার পাশে ছবি তুলছিলো। আর আইনস্টাইনকে তো পারলে তারা ব্লাকবোর্ডে অংক শিখিয়েই ছাড়ে।
আমি ফুটবল বা ক্রিকেট প্রেমি নই তবুও রোনাল্ড এর পাশে বসতেই ভ্রু কুচকে ভীষন বিরক্ত হয়ে তাকালো সে আমার দিকে। ঐশ্বর্য্য তো মহা খুশী সে নাকি বড় ভাই এর জিমে কখনও ওয়েট লিফ্টিং এর ডামবেলগুলো উঠাতেই পারেনা আর এখানে ফোমের তৈরী ডামবেলগুলি অনায়াসে উঠিয়ে মহা খুশি সে। লেডি গাগার সাথে ঝাঁকড়া চুল পরে নাচলো কেউ কেউ কিছুক্ষন।
নিজেদের ক্যামেরায় ছবি তুলবার সময় ওখানেও কিছু ক্যামেরাম্যান ছবি তুলছিলো। মিউজিয়াম ঘুরে শেষে এসে দেখলাম আমরা সেই ছবি সুন্দর ফ্রেম বন্দী হয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। এক এক ছবিতে রাখবেন উনারা ৩০০ বাথ করে । কি আর করা হাজার হোক এত সব গন্যমান্য ব্যাক্তিদের সাথে ছবি বলে কথা। ৩০০ বাথ তো তুচ্ছ সেই সৌভাগ্যের কাছে। যে কারখানায় বানানো হয় সেসব মোমের মূর্তী। সেটাও দেখলাম আমরা। এরপর খানাপিনার পালা।
সিয়াম প্যারাগনের রুফটপে খেতে গেলাম এরপর। বিফ আর চিকেন স্টেক
দিয়ে দুপুরের খানা পিনা শেষ হলো। তারপর গেলাম ওশান ওয়ার্ল্ডে।
সে আরেক অপার্থীব জগত অপেক্ষা করছিলো সেখানে আমাদের জন্য।
ওশান ওয়ার্ল্ড-
ওশান ওয়ার্ল্ডের মাটিতে পা দিতেই ভয় পাচ্ছিলাম আমি। সমুদ্রের নীল জলরাশীতে বুঝি অতলে তলিয়ে যাবো এইবার। এমনই মনোমুগ্ধকর অঙ্কন। সাধ্য কি তার হঠাৎ বুঝা যায় যে এটা সত্যিকারেই পানি নাকি ছবি?
বাচ্চারা ছবি তুলছিলো সেখানে। কেউ কেউ সেলফি অথবা হেল্পীই....ভেতরে ঢুকতেই প্রথমেই দেখা গেলো বিশাল বড় গোলাপী এ্যকুরিয়ামে বিশাল সব গোলাপী কাঁকড়া। এরপর অপূর্ব সুন্দর নীল নীল মাছ।
অদ্ভুত সব কোরাল আর ছোট্ট ছোট্ট সি হর্সগুলো তাদের বাঁকানো লেজে ঝুলে ঝুলে দোল খাচ্ছিলো সব গাছের ডালে। আশ্চর্য্য হলাম দেখে যে প্লাস্টিকের মত ঝাঁউপাতা রঙ্গিন মাছ।একটু করে না নড়লে জীবনেও বুঝতামই না আমি সে সেগুলো আবার মাছ!
বর্নীল সব মাছগুলোর মাঝে জেলীফিস এর নানা রকম রঙের খেলা ও তারই সাথে মিলিয়ে সুরের যাদু জীবনে ভুলবোনা আমি। মনে হচ্ছিলো হালকা রঙিন রঙের টিস্যু কাপড়ের ব্যালরিনা ড্রেস পরে নেচে চলেছে কোনো পারদর্শী ফরাসী নর্তকীরা।
পেঙ্গুইনের সাতার আর বরফের মাঝে বসে বসে মাছ খাওয়া দেখা সেও এক মজার অভিজ্ঞতা। হঠাৎ দেখলাম বিশাল ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে সাঁতরে চলেছে এক ডুবুরী। ইয়া বড় এক মাছকে ধরে ধরে খাবার খাওয়াচ্ছে সে।
এই অতল জলের নীচে সারাটাদিন বসে থাকলেও বুঝি আঁশ মিটবেনা এমনই মনে হচ্ছিলো তখন। জলের মাঝে বিশাল বুদ্ধের প্রতিকৃতি সেও এক মন ছুঁয়ে যাওয়া স্মৃতি।
ওশান ওয়ার্ল্ড থেকে বের হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। এরপর আমরা চললাম এম, বি, কে শপিং সেন্টারে। কিন্তু আমার সঙ্গীসাথীরা ছিলো শপিং এ নাখোশ হৃদয়। কাজেই তাদের মাঝে কারো পা ব্যাথা শুরু হলো, কারো বা মাথা ঘোরা, একজন তো জিহাদ ঘোষনা করে বসেই পড়লেন বেঞ্চিতে। কি আর করা সেদিনের মত ভ্রমনে বিরতি দিয়ে হোটেলে ফিরে আসতে হলো।
ব্যাংকক টু পুকেট- ডে ইন ব্যাংকক এ্যান্ড ফার্স্ট নাইট ইন পুকেট- সেদিনের ড্রেস কালার ছিলো ব্লাক এ্যান্ড হ্যোয়াইট কালার কম্বিনেশন। সবাই রেডি হয়ে ডাইনিং এ গেলাম।
আমাদের এম্বাসাডার হোটেলের লাগোয়া এক বার্ড পার্ক ছিলো। সেখানে যে কত মনোহরণকারী পক্ষিকূল!!! দেখে চোখ জুড়ায়! মন ভরায়!!পিচ্চিরা সব গ্লাসে নাক লাগিয়ে পাখিদের কলকাকলী দেখে, তাদের ঝগড়াঝাটি, মারামারি উপভোগ করে সাথে আমিও।
সেদিন দুপুরে থাই এয়ারলাইনসে আমাদের পুকেট যাবার প্লান। সকালের বাকী সময়টুকু আমরা পাশেই শপিংমলগুলোতে যাবার প্লান করলাম। নতুন দেশে হেঁটে হেঁটে আবিষ্কার, সে এক দারুন মজার ব্যাপার।মূল্যবান দোকান রবিনসনের পরে ঘুরে ঘুরে পেয়ে গেলাম এক হোলসেল জুয়েলারী শপ। আমি মনের আনন্দে দুল মালা চুড়ি, ব্যাগ যা পারা যায় কিনে ফেললাম। সই ৬ পর্যন্ত যাবার প্লান ছিলো আমাদের। কিছু দোকানে মন হরণকরা সব ঝলমলে পোষাকের পুতুল, স্টাচু।আমি আটকে গেলাম কিছুতেই নড়তে পারলাম না সেখান থেকে কিছু মিছু না নিয়ে। খুব সংবেদনশীল পুতুলের বক্স নিয়ে যখন হোটেল রুমে ফিরলাম। বুঝলাম এর জন্য আরও একটা স্যুটকেস লাগবে এবার আমার।
সবকিছু গোছগাছ করে বড় স্যুটকেসগুলি হোটেলের সেইফ এ রেখে আমরা এয়ারপোর্ট যাবার জন্য রেডি হলাম। তার আগে ম্যাকডোনাল্ড থেকে কিনে নিলাম কিছু বার্গার আর আমাদের অতি প্রিয় ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ।
যখন পুকেট পৌছালাম আমরা। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। কিছু পরে একটু গোছগাছ করে আমরা বের হলাম খানা খেতে। পুকেটের সন্ধ্যা দেখে মনে হলো চারিদিকে যেন বিয়ে বাড়ি উৎসব, হই হই রই রই রব। সে যাইহোক আমরা গিয়ে ঢুকলাম এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে। একটা মহা স্মার্ট ইন্ডিয়ান ছেলে ঐ রেস্টুরেন্টে কাজ করে সে এগিয়ে এলো। দাদা দিদি করে বাংলায় কথা বলা সেই ছেলে আমাদেরকে খাওয়ালো তন্দুরী চিকেন আর হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানী। এ হোটেলের সবচেয়ে আকর্ষনীয় ব্যাপারটাই ছিলো ওদের ঘটি করে পানি খেতে দেওয়াটা।
কিছুপরে বাচ্চাগুলোকে হোটেলে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আমরা বড়রা সিবিচের দিকে গেলাম। পাতঙ বিচের বাংলা রোডে ঢুকে আমার হা্র্ট এ্যাটাক হবার অবস্থা। তখন রাত বারোটা কিন্তু সেইখানের রঙিন আলোকিত জগতে মনে হলো এই রাত দুপরে দিন নেমে এসেছে। সব ছোট ছোট নাই নাই পোষাকের মেয়েরা সবাইকে তাদের নানা রকম শো দেখবার আমন্ত্রন জানাচ্ছিলো। টেবিলের উপর উঠে নৃত্য করছিলো তারা। চারিদিকে এত রকম মিউজিক কিন্তু কে শুনছিলো কার গান, কার বাদ্য জানা নেই আমার।
জার্নি টু ফি ফি আইল্যান্ড---
সকাল ৭টার মধ্যে ফিফি আইল্যান্ড যাবার গাইডের গাড়ি আসবে। তড়িঘড়ি ডাইনিং এ খেতে গেলাম ব্যাংকক রেসিডেন্স হোটেলের হলরুমে। কোনো মতে ব্রেড বাটার আর কমলার জ্যুসে খানাপিনা শেষ করে নীচে নামতেই চিকনা চাকনা করিৎকর্মা একজন ড্রাইভার কাম গাইড এসে পৌছালো। তার গাড়িতে করে আমরা ভোরের পুকেত দেখতে দেখতে পাহাড়ী উঁচুনীচু উপত্যকা বেয়ে গিয়ে পৌছুলাম ফিফি আইল্যান্ড যাবার সমুদ্রের তীরে।সমুদ্রের নাম আন্দামান।
সেখানে আরও একজন নির্দেশক নির্দেশনা দিচ্ছিলো। সে বলছিলো এখানেই পানি কিনে নেন, এখানেই স্যান্ডেল, স্যুইমিং কসটিউম যার যা দরকার কিনে ফেলেন কারণ ফি ফি আইল্যান্ডে সব জিনিসের দাম দ্বিগুন। সবাই ভয় পেয়ে কেনাকাটা শুরু করে দিলো। কেনাকাটার ধুম পড়ে গেলো বটে কিন্তু পরে দেখলাম সেটাও তাদের এক ব্যাবসায়িক ধান্দাবাজি বুদ্ধি। কারন পানি ফ্রি ছিলো চা, কফি সবই ফ্রি ছিলো শীপে। আমাদের ক্রুজের নাম ছিলো সি এ্যান্জেল।
সি সিকনেসের কারণেই হোক বা কোনো অকারনেই হোক আমার মাথা কেমন যেন ঘুরছিলো। কাজেই ডেকের উতল হাওয়া বা অবারিত সমুদ্রের নীল জলরাশী কোনোটাই ঠিক মত উপভোগ করতে পারছিলাম না আমি।
দুই ঘন্টা জার্নী শেষে দেখা পাওয়া গেলো সমুদ্র ফুড়ে উঠে আসা এক আশ্চর্য্য পর্বতমালা। আমাদের ক্রুজ সেখানে এসে থামলো। টুরিস্টদের জন্য সেখানে মাছেদের জন্য খানা খাওয়ানোর ব্যাবস্থা ছিলো। ঝাঁকে ঝাঁকে মাছেরা নির্ভয়ে ভীড় জমাচ্ছিলো ক্রুজের ধার ঘেষে খাবারের আশায়।
এর পর এলো চোখে চশমা এঁটে লাইফ জ্যাকেট পরে সমুদ্রের তলদেশ ঘুরে দেখবার এ্যাডভেঞ্চার। আমার অবশ্য তাতে কোনো শখ ছিলোনা। কিন্তু আমাদের দলের দুঃসাহসী বাচ্চাগুলো ধড়াচুড়া পরে ঠিকই নেমে গেলো জলে।
যদিও আমি চোখে দেখিনি তবে তাদের চোখে যা দেখলাম ও জানলাম , সে নাকি এক অপার্থীব দৃশ্য। ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন অজানা অচেনা সব মৎস্যদল আর ররং বেরং পাথর শৈবাল আর প্রবালের ভীড়ে ভেসে চলা জীবনের এমন দূর্লভ মুহুর্ত নাকি আসেনা কখনও।
এরপর গন্তব্য ফি ফি আইল্যান্ড। খুব মজাদার খানা পিনা শেষে আমরা বসলাম সমুদ্র সৈকতে। প্যারাস্যুটে করে মানুষ উড়ছিলো সমুদ্রের উপর।
কিছুক্ষন সেখানে কাটিয়ে ফিরে এলাম আবারও আমাদের সি এ্যাঞ্জেল ক্রুজে।
এইবার সারাদিনের ধকল আর কিছু বাচ্চাদের কুলালোনা । কেউ কেউ সিটে হেলান দিয়ে নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়লো। আমারও আর সমুদ্র দর্শন ভালো লাগছিলোনা। আমিও অপেক্ষা করলাম তীরে পৌছাবার। তবে তীরে পৌছে মুগ্ধ হলাম।
থরে থরে সাজানো রয়েছে নীল সবুজ সমুদ্র, প্রবাল আর রঙ্গিন মাছেদের ছবি আঁকা গোল গোল কাঁচের প্লেটে আমাদের সবার ছবি। মনে পড়লো আজ সকালে ক্রুজে উঠবার সময় তারা তুলে রেখেছিলো এইসব ছবি। তড়িঘড়ি ছবিগুলি নিয়ে আমরা আমাদের গাড়ির সন্ধানে গেলাম।
সেখানে সারে সারে দাঁড়ানো ছিলো বিভিন্ন ট্যুর কোম্পানীর গাইড ও ড্রাইভার। তারা কেউ ইংলিশ জানেনা। আমি হতাশ হতে যাবো এই ভেবে যে কি করে বুঝাবো তাদের আমাদের গন্তব্যস্থল, ঠিক তখনি চোখে পড়লো একজন ইংলিশ জানা লিডার সে সবাইকে খুঁজে দিচ্ছে যার যার গাইড ও ড্রাইভার। মুগ্ধ হলাম এই সিস্টেমে। ফিরে চললাম হোটেলের দিকে।
গ্রেট মেমোরিজ ইন ফুকেত-
পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে ওয়েট করছি ফুকেত সিটি ট্যুরের গাড়ির জন্য। খুব শিঘ্রী আসলো হ্যাংলা পাতলা চেহারার একটা মেয়ে নাম তার বেলা। বেলা নামটা শুনেই আমি তাকে বললাম এই নামের মিনিং জানি আমি। এটা ইটালিয়ান নেম আর এর মানে হলো সুন্দরী। বেলা বললো যে আমি ১০০% রাইট এবং ওর ইটালিয়ান মা এই নাম রেখেছে ওর। বেলাকে আমার খুব ভালো লাগলো তবে বেলার মত বেলা সে ছিলো না মোটেও। তবুও খুবই সাদামাটা সাধারণ চেহারার বেলা তার চটপটে স্বভাবে খুব শিঘ্রী মন জয় করে নিলো আমাদের।
প্র্থমেই আমরা গেলাম কাতা ভিউ পয়েন্ট। সুউচ্চ পর্বতের উপর থেকে মনোহরণকারী চারিদিকের নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য যে কতই না সুন্দর না দেখলে হয়তো তা কখনো কারো জানাই হবেনা।আমরা ছবি তুলতে শুরু করলাম তবে একটা কারণে হঠাৎ আমার ভীষন মন খারাপ হলো। ওভার এক্সাইটেড এবং আমাদের দলের সবচাইতে দুষ্টু আর চঞ্ছল ইরফান আমার ছবি তুলতে গিয়ে পেছন ফিরতে গিয়ে আর একটু হলেই হয়তো সুউচ্চ পর্বত থেকে নীচেই পড়ে যেত। আমার চিৎকারে থেমেছিলো সে। যদিও তাতে তার কোনো বিকার ছিলোনা কিন্তু এরপর বেশ কিছুক্ষন স্তম্ভিত ছিলাম আমি। সে কথা ভাবলে এখনও আমার হাত পা হীম হয়ে যায়।
কাতা ভিউ পয়েন্ট থেকে বিগ বুদ্ধার মূর্তী দেখা যাচ্ছিলো। সাদা ঝকঝকে মেঘমালার সাথে আকাশের গায়ে মিশে ছিলো মহান বুদ্ধা। সেখানে এক ম্যাকাও পাখিওয়ালা বসেছিলো। চেইনে বাঁধা বিশাল ম্যাকাও ঘাড়ে বা হাতে নিয়ে ছবি তুলছিলো অনেকেই।
কাতা ভিউ পয়েন্ট থেকে আমরা গেলাম ফুকেত সাফারী। গ্রাম গ্রাম চালাঘরের মত দেখতে এই সাফারীতে কতইনা মজার স্মৃতি জমে থাকলো আমাদের।
মাংকি শো- প্রথমেই আমরা গেলাম পর্দাঘেরা এক ছোট্ট ঘরে মাংকি শো দেখতে।মাংকিটাকে কেনো যেন মোটেই উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলোনা। তবে দারুন দক্ষতায় সে তার মাস্টারের সকল নির্দেশনা মানছিলো। গুড মরনিং থেকে শুরু করে ট্যুরিস্টদের কোলে বসা, তাদেরকে কিস করা প্রত্যেকটা কাজই সে করছিলো দারুন দক্ষতায় ও ম্যানারড ওয়েতে। আমাদের অনেকেই সেই মাংকির সাথে খেলাধুলায় ও ছবি তোলায় মেতে উঠলো কিন্তু আমি বীর সাহসীর সাহসে সেই সাহসটুকু কুলালোনা কাজেই আমি দূরেই থাকলাম। মাংকিটার হ্যাসব্যান্ড নাকি সিক আর বাচ্চাটারও শরীর খারাপ আর তাই সে মন খারাপ করেই তার কর্তব্যগুলি পালন করে যাচ্ছিলো। সে তার রেস্ট টাইমে স্ট্র দিয়ে জ্যুস খেলো ও নারকেল পেড়ে দেখালো । এই দুঃখী মাংকিটার জন্য মন খারাপ হচ্ছিলো আমার আবার অবাকও হলাম তার কর্মনিষ্ঠতা আর দায়িত্বশীলতা দেখেও।
এ্যালিফেন্ট ট্রেকিং-বিশাল হাতীর পিঠে করে গভীর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে উঁচু পর্বতচূড়ায় ঘুরে বেড়ানো! আমার কোনোই শখ নেই বাবা। তবে অনেকেই সেই দুঃসাহসিক অভিযান শেষে ফিরে এসে সুন্দর কাগজের ফ্রেমে মোড়ানো ছবি দেখাতে লাগলো।
প্লে উইথ বেবি এ্যালিফ্যান্ট- বাবু হাতীর সাথে খেলাধুলা। সত্যিই এক মজার অভিজ্ঞতা আমি যদিও ভয় পাচ্ছিলাম তার গায়ে হাত দিতে কিন্তু অন্যান্যরা বিশেষ করে দুঃসাহসী ইরফান ও তার কিছু সঙ্গীরা হাতীকে জড়িয়ে থাকলো যেন সে তাদেরর কত দিনের বন্ধু ওই বাবু হাতীটা। হাতী বাচ্চাদেরকে চকাস চকাস করে চুমু দিচ্ছিলো। তাদের হাতে কলা খেয়ে আর পাউরুটি খেয়ে ভীষন খুশী হলো সে।
মিনি অর্কিড ফার্ম- অপরূপা বেগুনি, সাদা গোলাপী অর্কিড ঝুলছিলো অর্কিড ফার্মেয সেখানে দেখলাম এক জ্ঞানী কাকাতুয়া। এত চকচকে রঙ আর হলুদ প্লাসিকের মত তার ঠোঁট যেন মনে হচ্ছিলো সেটা কোনো সো পিছ।
স্নেক শো-ও মাই গড!! এত কাছে কোনো রকম বন্ধনহীন বা সাপের ঝুড়ি খাঁচাবিহীন ইয়া বিশাল বিশাল সাপ দেখে আমি গ্যালারী ছেড়ে দৌড়ে পালাবো কিনা ভাবছিলাম। অনেক ভেবে চিন্তে ও মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ রেখে কষ্ট করে বসে রইলাম তবুও সেই ৩০ মিনিটস। ৩০ মিনিটস ছিলো ৩০ বছরের সমান। সেই সাপের গুহায় ছিলো তিনজন সাপুড়ে। একজন নানা রকম বর্ণনা দিচ্ছিলো সাপগুলির নাম ধাম পরিচয় ও স্বভাব সম্পর্কে। আর একজন খেলেছিলো শান্ত ও বন্ধুবৎসল পাইথন নিয়ে আর আরেকজন ধূর্ত তড়িৎ আর পাকা সাপুড়ে শুধু ভয়ংকর কিং কোবরার সাথে খেলাধুলাই করেননি তিনি সাপের ঠোঁটে চুমু খেয়েও দেখালেন এই সাপ যে তার প্রেমিকাও বটে। তারা গ্যালারী থেকে ডাকলেন কারা সাপ নিয়ে, গলায় বা শরীরে জড়িয়ে ছবি তুলতে চায় আমি তো কোটি টাকা দিলেও টা চাইনা কিন্তু একে একে ঠিকই ছুটলো সারিহা, মনিকা, রিহান আর ফারদিন। আমি সাপ ওদেরকে একে একে গিলে খেয়ে ফেলার মুহুর্তটুকু ভেবে চোখ বন্ধ করেই ছিলাম। কিন্তু তিনারা নির্বিঘ্নে ও নিশ্চিন্তে একের পর এক হাসি হাসি মুখে সাপ জড়িয়ে ছবি তোলার পোজ দিয়ে যাচ্ছিলেন।
বিগ বুদ্ধা-
বিগ বুদ্ধা-বিগ বুদ্ধার কাছে প্রপার ড্রেস ছাড়া মেয়েরা যেতে পারবেনা তাই একমাত্র আমি ছাড়া সবগুলো হাফড্রেস মেয়েদেরকে লুঙ্গির মত নানা রঙের দুই টুকরো কাপড়ে ঢেকে ঢুকে যেতে হলো সেই বিশাল বুদ্ধার মূর্তীর কাছে। সে এক বিশালতার প্রতীমা। এ বুদ্ধা যেন সফেদ পবিত্রতা। আলগোছেই মাথা নত হয়ে আসে শ্রদ্ধায়।
চালোং টেম্পল- সে যেন এক সোনায় মোড়ানো রাজ্য!!! এত সুন্দর ঝকঝকে রাজ্যের চকচকে পথের ধুলিকণাগুলোতেও যেন মিশে আছে সোনা। বিশাল জায়গা জুড়ে এই চালোং মন্দিরের বাগান আর কারুকার্য্যে মোহিত হলাম আমি।
কেস্যুনাট ফ্যাক্টরী-কেশ্যুনাট যে এত বড় আপেলের মত দেখতে তা আমার জানা ছিলোনা। আর তার প্রসেসিং ও হয় হাতে ম্যানুয়ালী। নানা রকম নাট চারিদিকে থই থই করছে। আর এমন ক্রিসপি জিভে জল আসে। যত ইচ্ছে খেয়ে খেয়ে টেস্ট করা যেতে পারে তারপর ইচ্ছে হলে কেনো নইলে নো প্রবলেম। আমিও তাই প্রাণ ভরে খেয়ে চলেছিলাম যদিও আমি প্রায় প্রতিটাই কেনার চেষ্টা করছিলাম। খেতে খেতে এমন শাস্তি হলো!!!!! ইয়াক থু!!! নাটের পরে থরে থরে সাজানো ছিলো ড্রাই ফ্রুট। বাহ সেসবও মজা কিন্তু টেস্ট করে করে মজা পেতে গিয়ে মুখে দিলাম চিপস টাইপ একটা কিছু যা ভেবেছিলাম আরও মজা। মাই গড!!! যেন পঁচা পঁচা গন্ধের শুটকি মাছ মুখে দিলাম। কোথায় ফেলবো বিন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার বিকৃত চেহারার মুখভঙ্গী দেখে এগিয়ে এলেন একজন সহৃদয় কর্মী। তিনি আমাকে দেখিয়ে দিলেন বিনটা। শেষে বিনা পয়সায় খাওয়া নাট আর ড্রাইফ্রুটের মজা বের হলো। সেটা ছিলো ড্রাই ফিস চিপস। ইয়া আল্লাহ সেটা তারা কেমনে খায় কে জানে!!!!!! থু থু থু আমার এখুনি বমি আসছে মনে করে সেই কথা।
হানি ফ্যাক্টরী- খাঁটি মধু চাষের খামারে গেলাম আমরা। আবারও একমাত্র দুঃসাহসী ইরফানেরই সাহস হলো এক ঝাঁক মৌমাছিদের সাথে ছবি তোলার। হানির তৈরী চকলেট, আইসক্রিম ছিলো সেখানে এবং ছিলো বিশাল এক বি হাইভ।
স্যুভেনিয়র শপ- হীরা, মনি, মুক্তা, নীলা, রুবি, চুনী খচিত রাজকীয় স্যুভেনিয়র শপ পরিদর্শন শেষে কফি ব্রেকে এসে আমি নিলাম প্রাণ জুড়ানো কোল্ড কফি। এরপর আমরা ফিরে আসলাম হোটেলে।
সাইমন ক্যাবারেট- ফুকেতে পা দেবার পরপরই সেই এয়ারপো্র্ট হতেই দৃষ্টিকাড়া সাজসজ্জা ও রাজকীয় গহনা শোভিত কিছু নৃত্যশিল্পীদের বিশাল বিশাল পোস্টার দেখে আমি হচ্ছিলাম বিমোহিত। ভেবেছিলাম নিশ্চয়ই সেটা এদের ট্রেডিশনাল ড্যান্স টান্স হবে। কাছেই এক ট্যুরিস্ট স্টলে সেই ব্যাপারে জিগাসা করতেই তারা জানালো সেটা ট্রেডিশনাল ডান্স না তবে বড়ই মনোমুগ্ধকর এরোটিক ড্যান্স কাজেই সাথে শিশুরা থাকলে না দেখাই ভালো। কি আর করা সে আশা ছাড়তে হলো।
আবার ব্যাংকক ফিরবার পালা- ফুকেট টু ব্যাংকক, এবারের ফ্লাইট ছিলো নক এয়ার। থাই এয়ার ছাড়া আমার ভয় ভয় করছিলো একটু তবুও প্লেইনে উঠে হলুদ জামা পরা সুন্দর সব এয়ার হোস্টেসদেরকে দেখে আমার মন ভরে গেলো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছিলো তখন। বাইরে আকাশে বিদ্যুৎ চমকে যাচ্ছিলো। আমি আয়াতুল কুরসী পড়তে পড়তে শেষ। আবার এয়ার এশিয়ার মত সলিল সমাধি হয় কিনা সে ভাবনায় মরেও যাচ্ছিলাম আমি। আরও কিছুদিন বাঁচার ইচ্ছা আমার। কত কাজ বাকী রয়ে গেছে এখনও।
যাই হোক সেদিন রাতে সহি সালামতে ব্যাংকক ফিরে বাংলাদেশি খানা খেতে গেলাম আমরা। আমাদের হোটেলের নীচেই ছিলো সেই বাংলা খানার রেস্টুরেন্ট। উপরের রেস্টুরেন্টটার নাম মনে আছে আমার মেজবান কিন্তু আমরা যেটায় খেলাম সেটার নাম কিছুতেই মনে করতে পারছিনা। হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানী খেয়ে এক এক প্লেটের দাম নিলো তারা ৩০০ বাথ করে। যদিও তেলে ভরা মশলাদার সেই বিরিয়ানী আমার একটুও ভালো লাগেনি।
রাতে ফিরবার সময় দলে দলে বসে থাকা ফুট ম্যাসাজগার্লরা ম্যাসাজের আহ্বান জানাচ্ছিলো কিন্তু আমরা সেসব উপেক্ষা করে হোটেলে ফিরে এলাম।
The Grand Palace and The Emerald Buddha Temple (Wat Phrakaew)
সকাল সকাল রেডি হয়ে গেলাম। আজ কোনো গাইড ট্যুরের গাড়ি নয় আজ ব্রেকফাস্ট সেরেই আমরা ছুটবো গ্র্যান্ড প্যালাসে। গ্রান্ড প্যালেসের ছবি সন্মলিত জামা কাপড় কেনা হয়েছিলো তার আগেই কাজেই সেসব পরা হলো।
ব্রেকফাস্ট সেরে ট্যাক্সিক্যাব ডেকে সেটাতে উঠতেই ড্রাইভার বললো সে মিটার অন করবেনা । যাইহোক ফাজিল ড্রাইভার মিটার অন না করার শর্ত মেনে নেবার পরেও সে গ্র্যান্ড প্যালেসের মেইন গেইটে না নামিয়ে তার সাথে চুক্তি করা এক বোটওয়ালা দাঁড়িয়ে থাকা গেইটে নামালো আর নামার সাথে সাথেই বোটওয়ালা এসে বলে এখন তো গ্রান্ড প্যালেসে ঢোকার টাইম হয়নি। আরও দেড় ঘন্টা পর টাইম হবে কাজেই ততক্ষনে উনার সাজেশন আমরা বোটে করে প্যালসের চারিধার ঘুরে আসতে পারি। কেনো যেন তার কারসাজিটা আমরা ধরে ফেল্লাম আর একটু সামনে এগুতেই দেখি গেইটও খোলা এবং দেড় ঘন্টা পর বলে কিছু নেই।
গ্র্যান্ড প্যালেসের স্বর্ণখচিত বিশাল প্রাসাদসম স্থাপনাগুলি থেকে চোখ ফেরানোই ছিলো দায়।
ধপধপে সাদা প্রাসাদগুলির ওপর নানা বর্ণিল রঙের কারুকার্য্য সেও ছিলো মনো মুগ্ধকর। প্রাসাদগুলির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সোনার প্রতীমারা। অদ্ভুত কারুর ড্রাগনমুখো সিড়ির উপর বসে আমার নিজেকে রাজকুমারীই মনে হচ্ছিলো যেন। বিশাল বিশাল সুসজ্জিত ডিমুন আর মন্দিরের চূড়ো দেখে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না তাদের সৌন্দর্য্য থেকে।
গ্রান্ড প্যালেস হতে আমরা গেলাম যাদুঘরে এবং নানারকম প্রাচীনকাল হতে একালের অলঙ্কারাদি দর্শন শেষে এমারেল্ড বুদ্ধা দর্শন করে এমবিকে মার্কেটের পথে পা বাড়ালাম আমরা। কিন্তু সে আরেক ঝামেলা কোনো ট্যাক্সিই যাবেনা এমনি এমনি এম বিকে যাবার পথে নাকি আমাদেরকে যেতে হবে জেমস গ্যালারী ।ওকে তাই সই। গেলাম আমরা সেখানেই। আবারও মনি মানিক্য হীরা রত্নে চোখ ধাঁধালো, মন ভরালো।
লাঞ্চ শেষে আমরা একটু শপিং এ গেলাম। যদিও ক্লান্ত শ্রান্ত ছিলাম তবুও যা হোক ব্যাগ ট্যাগ হাবিজাবি কিনে বোঝা বাড়ালাম। স্টারবাক কফিশপে কফি খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। কিন্তু আমরা রাতটুকুও নষ্ট করতে চাইলাম না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। এত ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে খেয়াল করলাম ব্যংকক শপিং নগরীতে আসলে আমাদের ঠিক ঠাক শপিংই করা হয়নি। কাজেই আবার ছুটলাম শপিং এ আর এইবার আর ভুল করলাম না। সব ভুলে কিনলাম আমি মনের মতন সব পুতুল।
ওদের ট্রাডিশন্যাল নাচের পুতুলগুলিকেই সবচাইতে ভালো লেগেছিলো আমার । এছাড়াও কিনলাম ওদের পল্লীবালিকা, সাজুগুজ করা মেছুনি, আর নৌকো করে ভেসে চলা ফলওয়ালী।
রাতের খানা ছিলো ইন্ডিয়ান হোটেল বাওর্চিতে। নানা রকম কাবাব এ ভুরিভোজন শেষে ঘুমাতে গেলাম আমরা।
ফুরিয়ে গেলো আমাদের সাত দিনের ভ্রমন কাহিনী ।
পরদিন সকালে সুসজ্জিত এয়ারপোর্টে পৌছে যত পারলাম টবলারন, মলটেসারস, স্নিকার দিয়ে ব্যাগ বোঝাই করলাম। সুসজ্জিত দেশ ব্যাংকককে গুডবাই জানিয়ে ফিরে এলাম নিজের শস্য শ্যামল দেশের মাটিতে ।
আমারও দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন
শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া যে নেই কিছু প্রয়োজন........
লেখাটা আমার ইবনে বতুতা, মান্থ অব রোজ জুন আপুকে উৎসর্গ করছি-
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:১৮