আপ্রাণ চেষ্টাতেও বাঁধভাঙ্গা চোখের জল চেপে রাখতে পারছেনা রুমু। বাসভর্তি লোকজন, সবার সামনে বসে বসে একটা মেয়ে এইভাবে কাঁদছে এটা নিশ্চয় খুব একটা শোভনীয় দৃশ্য নয়। তবুও ভালো যে পাশের সিটে কোনো যাত্রী নেই। এত মন খারাপের মাঝেও আল্লাহ আল্লাহ করছে রুমু যেন অন্তত ওর পাশের সিটে এই মুহুর্তে কেউ না এসে বসে।
ঠিক সে মূহুর্তেই লাফ দিয়ে বাসে উঠলো কল্প। সোজা এসে বসলো রুমুর পাশেই।ওর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো রুমু।মনে করবার চেষ্টা করলো ঠিক কতদিন পর দেখা হলো ওর কল্পের সাথে। ভেবে দেখলো আজ প্রায় সাত মাস পর কল্পের সাথে তার দেখা। একটু একটু অভিমান জমে উঠছে এখন রুমুর ভেতর। কেনো এতগুলো দিন এইভাবে ডুব দিয়েছিলো কল্প? এতগুলো দিনের একটা মুহুর্তের জন্যও কি রুমুকে একটুও মনে পড়লোনা ওর? কষ্ট, ক্ষোভ আর অভিমানে কান্নার মাত্রা বুঝি বেড়ে গেলো এইবার ওর আরও আর সাথে শুরু হলো আরেক যন্ত্রনা ফোঁপানি আর হেঁচকি।কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছেনা সে নিজেকে ।
লোকজন এবার একটু আধটু উঁকি ঝুকি দিতে শুরু করেছে, বাঁকা চোখে তাকাচ্ছেও কেউ কেউ এদিকে, অনেকেই বহু কষ্টে কৌতুহল দমন করে নিশ্বাস চেপে থাকলেও উৎসুক চাউনী সামলাতে পারছেনা। কিন্তু এমন করে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকা মেয়েটার পাশে বসেও নির্বিকার কল্প। কোনো সান্তনাবাক্য বা নিদেনপক্ষে কোনো কুশল পর্যন্ত জিগাসা করছে না সে। শুধু পরম মমতায় চুপচাপ রুমুর হাতটা ধরে বসে আছে। বনানী বাসস্ট্যান্ডে বাসটা থামতেই সকলের সকল উৎসুক আর কৌতুহলী দৃষ্টি উপেক্ষা করে নেমে গেলো ওরা।
কিছুক্ষনের মাঝেই বনানী ১১ নং এর মাথায় রিকশাতে দেখা গেলো ওদের দুজনকে।ফ্যামিলী নিডস দোকানটার সামনে আসতে কল্পই প্রথমে নীরবতা ভাঙলো।
- চলো রুমু তোমাকে একটা পুতুল কিনে দেই? সেই ছোট্টবেলায় যেমনটা ছিলো তোমার। নীল নীল চোখ আর ব্রাউন কালারের ঝাঁকড়াচুলের ডল পুতুলটা।
সেকথার উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো রুমু-
-এতদিন কোথায় ছিলে?
-ছিলাম কোথাও.... হাসি হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো কল্প।
-কোথাও মানে? রেগে গেলো বুঝি রুমু
- এতদিন তো আমাকে তোমার কোনো দরকার ছিলোনা রুমুসোনা। তুমি তো খুব খুব ভালো ছিলে। একটা মুহুর্তের জন্যও মন খারাপ হয়নি তোমার। তুমি সারাটাক্ষনই এক ভালোলাগার আবেশে মেতে ছিলে। আর সত্যি বলতে কি জানো সেটা দেখে আমার খুব ভালোও লাগছিলো। আমি সত্যিই চাই তুমি অনেক অনেক ভালো থাকো, আনন্দে থাকো, সুখে থাকো।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো রুমু ওর দিকে। হঠাৎ আবার ওর চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। কোনো প্রশ্ন না করে আবারও ওর হাতটা ধরলো কল্প।আসলেই গত সাতটা মাসে রুমুর প্রতিটা দিন, ক্ষন মুহুর্তগুলো কেটেছে পাখির ডানায় ভেসে ভেসে, একফোটা দুঃখ কষ্ট বেদনার ছায়াও বুঝি ছিলোনা কোনোখানে কিন্তু আজ কিছুক্ষন আগে নানা রঙের স্বপ্ন দিয়ে তিল তিল করে গড়া সেই জগৎটা হঠাৎ তাসের ঘরের মত এক পলকে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই রুমুদের বাসার গেটে রিকশা এসে থামলো। ওদেরকে দেখেই পাশের বাড়ির এ্যলসেশিয়ানটা হঠাৎ বিকট চিল্লাতে আরম্ভ করলো আর তারপর নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে চেয়ে রইল। রিকশা ভাড়া চুকিয়ে ভেতরে ঢুকলো ওরা।
সেদিন বিকেলেই ছাদের দোলনায় বসে চা খাচ্ছে রুমু। একটু দূরেই রেলিং এ হেলান দিয়ে বসে আছে কল্প। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। এতক্ষনে ফ্রেস লাগছে মেয়েটাকে। আজ যথাসময়ে কল্প এসে হাজির না হলে আজই হয়তো ছিল রুমুর জীবনের শেষ দিন। আজ অন্ত এর সাথে কথা কাঁটাকাটি বা চিরবিচ্ছেদের পর ডিসিশন নিয়েই ফেলেছিলো রুমু যে, সে আর এই জীবন রাখবেই না। সে যাইহোক, রুমুই শুরু করলো।
-আচ্ছা কল্প সবাই আমাকে কষ্ট দিয়ে কি মজা পায় বলোতো?আমার জন্মটা কি পাপ? কি দোষ করেছিলাম আমি বিধাতার কাছে? আর কত কষ্ট পেলে আমার পাপের বোঝা শেষ হবে বলতে পারো? জানো খুব ইচ্ছে করে বিধাতার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে ..............
- ছিহ রুমু। তুমি দোষ করবে কেনো? পৃথিবীতে এমন অনেক হয়। তুমি যখন সেই ছোট্টবেলায় নিজেকে একা, বন্চিত অবহেলিত ভেবে কষ্ট পেতে তখনও কিন্তু তোমাদের ক্লাসের আদৃতারও মা ছিলো না। ওর স্টেপ মম ওর সাথে কি প্রচন্ড দূর্ব্যাবহার করতো।তবুও মেয়েটার তাতে ভ্রুক্ষেপও ছিলোনা। আর মনে আছে তোমাদের বাসায় একজন কাজের মহিলা ছিলো তারও একটা মেয়ে ছিলো যে প্রায়ই তোমাদের বাসায় আসতো। ওরও তো বাবা ওকে ফেলে সেইম বস্তিতেই অন্য একজন মহিলাকে বিয়ে করে ওদের চোখের সামনেই থাকতো। এই নিয়ে মেয়েটা প্রায়ই মন খারাপ করতো তোমাদের বাসায় এসে। মনে আছে সেসব তোমার? তো দুনিয়ায় এত এত মানুষ যদি ঠিক তোমার চাইতেও ভয়ংকর কষ্টকর পরিস্থিতিতে থাকতে পারে তবে তুমি নিজেকে এমন বন্চিত ভাবছো কেনো? আরও আরও কি সব একগাদা বক বক করে যায় কল্প। রুমুর সেসব কানেও ঢোকেনা বুঝি। সে হঠাৎ বলে-
- কল্প তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তুমি আমার সেই ছোট্টবেলার সাথী। যখনই আমার মন খারাপ হয়েছে, যখনই কোনো বিপদে পড়েছি, এমনকি কোনো কোনো রাতে দুস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে উঠেও যখন দৌড়ে গেছি মায়ের ঘরে।দরজা বন্ধ পেয়েছি। একা একা ভয়ে ঠক ঠক কেঁপেছি। তুমি সেসব দিনেও ঠিক ঠিক এসে গেছো আমার পাশে। কল্প তুমি না থাকলে জীবনের এতগুলো দিন দুর্বিসহ হয়ে উঠতো আমার কাছে সে আমি নিশ্চিৎ। কল্প কখনও ছেড়ে যেওনা আমাকে প্লিজ................
ওর পাশে এসে বসে কল্প। সন্ধ্যা নেমেছে ধরিত্রীতে। রুমু একা একা বক বক করে যাচ্ছে। চুপচাপ শুনছে কল্প। আকাশে গোল থালার মত চাঁদ উঠেছে। রুমুর মনে আর এক ফোটা দুঃখও নেই। এ ছোট্ট জীবনটায় কম তো পেলোনা আর সে! কম তো শিখলোনা! এই কল্পই ওকে বার বার দিয়েছে বেঁচে ওঠার প্রেরনা। কখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রী নেমেছে। রুমুর সেদিকে কোনো খেয়ালও বুঝি নেই।কাজের মেয়েটা ডাকতে এলো রুমুকে।ওকে হিমে বসে থাকতে দেখে একটু বকাও দিলো,
-একা একা ঠান্ডায় বসে কি করেন আপা? সেই কখন টেবিলে খাবার দেওয়া হইছে! ফুপুআম্মা আপনাকে ছাড়া রাতে খায়না জানেন না? সারাবাড়ি খুঁজে পেলাম শেষে আপনাকে ছাঁদে এসে!
- এবার যাই। ঠিকঠাক ডিনার করে ঘুমুবে রুমু। কাল সকালে ক্লাস আছে তোমার।
মাথা নেড়ে সন্মতি জানালো রুমু লক্ষী মেয়ের মত।
ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রুমু।হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে উঠে মনটা আরও বেশী খারাপ হয়ে গেলো ওর।স্বপ্নে অন্তকে দেখেছে, হেসে হেসে গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছে পাশে একটা অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে।বালিশের তলা থেকে সেলটা টেনে বের করে রুমু। মোবাইল স্ক্রিনে সময় দেখে। রাত পৌনে তিনটা। ঘুম পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে ওর।জানালায় এসে দাঁড়ায় ।বিজলী চমকাচ্ছে আকাশের কোনে।নিস্তব্ধ রাত্রীর নিরবতা ছুঁয়ে হিম হিম ঠান্ডা হাওয়া বইছে চারিধারে। জানালার গ্রীলে মাথা রেখে হুহু করে উঠলো মনটা আবারও ওর। হঠাৎ ওর কাঁধে হাত রাখলো কল্প। মুখ তুলে চাইলো রুমু।
- চলো রুমু বৃষ্টিতে ভিজি।
মাথা নেড়ে সন্মতি জানালো রুমু।
চুপিচুপি নিঝুম নিশুথ রাতে ভুতের মত ছাঁদে উঠে এলো ওরা দুজন। ঝিরঝিরি গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে এরই মাঝে। রুমু চোখ বুজে মুখে মেখে নিচ্ছে সে নিশীথরাতের সুশীতল বাদল ধারা। দূরে দাঁড়িয়ে আছে কল্প।
- রুমু নাচ করবে? সেই যে ছোট্টবেলায় নাচতে বর্ষারাণী সাজেরে।
- ওহ ! হা হা হা কল্প সেই নাচটা আমার জীবনের প্রথম স্টেজ পার্ফরমেন্স ছিলো। কল্প সব মনে রেখেছো তুমি। কি করেছিলাম মনে আছে? হা হা স্টেজ এ উঠে ভয় পেয়ে হঠাৎ নাচ ছেড়ে মাথা চুলকুতে শুরু করেছিলাম হা হা হা হা । সব দুঃখ ভুলে হাসতে থাকে রুমু। ওর মনটা ভালো হয়ে যেতে দেখে ভালো লাগছে কল্পেরও।
ধীরে ধীরে নাচতে শুরু করে রুমু। এসো নীপবনে ছায়াবিথী তলে এসো করো স্নান নব ধারা জলে। তুমুল বৃষ্টি নেমেছে আকাশ ভেঙ্গে। টবে ফুটেছে হাস্নাহেনা, বেলী আর যুঁই। বৃষ্টিস্নাত ফুলেল মৌমিতাল গন্ধে চারিপাশ মৌ মৌ আর তারই মাঝে ঝুম বৃষ্টিতে নেচে চলেছে রুমু। ছোট্টবেলার মত! নাহ এখন তো সে অনেক বড়। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে কল্প। ওর একমাত্র দুঃখদিনের সাথী। সকল বেদনার বন্ধু। দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ, পরো দেহ ঘেরি মেঘ নীলবেশ...... বুঁদ হয়ে নেচে চলেছে রুমু, ঘোরমগ্ন, নৃত্যরতা স্বর্গ হতে নেমে আসা কোনো এক বাদল অপ্সরী।
খুব ভোরে ছাঁদ ঝাড়ু দিতে এসে হইচই বাঁধিয়ে দেয় কাজের মেয়েটা।ছাদের কোনে বিশাল হাস্নাহেনা টবটার পাশে অচেতন পড়ে আছে রুমু। রিতীমত ভয় পেয়ে চিল্লাচিল্লি হইচই বাঁধিয়ে সবাইকে জড়ো করে সে। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে রুমুর শরীর। খুব তাড়াতাড়ি ওকে ভর্তি করানো হয় ইউনাইটেড হসপিটাল এমার্জেন্সী বিভাগে।
দুদিনের মাঝেই মোটামুটি সু্স্থ্য হয়ে উঠেছে রুমু। বিকেলবেলা স্যুপের বাটি হাতে খাইয়ে দিচ্ছে ওকে নার্স।
- ধ্যাৎ এমন করে বোকার মত জ্বর বাঁধিয়ে বসে কেউ? অদূরে বসে আছে কল্প। মুখ গোমড়া করে অনুযোগের সূরে সে জিগাসা করে রুমুকে।রুমু বলে,
- তুমি আমাকে নিষেধ করলেনা কেনো সেদিন রাতে।কখন যে মাথা ঘুরে পড়ে গেছি, নিজেও জানিনা কল্প। তুমি আমাকে ধরনি কেনো?
- আপা, কার সাথে কথা বলেন একা একা? নার্সের কথায় সম্বিৎ ফেরে রুমুর।কল্প ঠোটে আঙ্গুল চেপে ইশারায় চুপ করতে বলে ওকে।
কাউকে বলা যাবেনা কল্পের কথা।ওর চিরদিনের একমাত্র দুখের দোসর। ওর সকল বেদনার সাথী। অনেক অনেক ভালোবাসার মানুষেররা হারিয়ে গেছে রুমুর জীবন থেকে। একমাত্র কল্প সে কখনও ছেড়ে যায়নি ওকে। সেই ছোট থেকেই ওর যে কোনো দরকারে, বেদরকারে কল্প এসে হাজির হয়েছে যথা সময়ে। একটা জিনিস খেয়াল করেছে রুমু ওর জীবনে খুব স্বল্পস্থায়ী সুখের সময়গুলোতে কল্প কখনও আসেনি ওর কাছে। কল্প শুধু ওর দুখের সাথী। ওর বেদনার পথ চলার সহযাত্রী।তবুও খুব অবাক লাগে ওর যে শুধু রুমুই দেখতে পায় কল্পকে। অন্য কেউ দেখতে পায়না ওকে। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার।কল্পকে এ ব্যাপারে যতবার জিগাসা করেছে রুমু। ততবারই রহস্যময় হাসি হেসেছে কল্প। শুধু বলেছে
-রুমু আমি শুধু তোমার বন্ধু।আমার জন্মই হয়েছে তোমার জন্য। তোমার কোনো কষ্ট আমি সইতে পারিনা।আমি আর কারো কথা ভাবিনা।আমি শুধু তোমার জন্য এ পৃথিবীতে এসেছি। আমি চাই তুমি সবসময় ভালো থাকো। তোমার হাসিমুখের জন্য আমি পারিনা এমন কোনো কাজ নেই রুমুসোনা। আমি তোমার জন্য সব পারি...এনে দিতে পারি মেঘ থেকে বৃষ্টির ঝিরিঝিরি জল অথবা ঝিলমিল রঙধনু...... তুমি চাইলে পৃথিবীর সবগুলো শঙ্খচিলকে করে দিতে পারি তোমার বন্ধু অথবা তুমি যদি চাও হিমালয় থেকে পেঁজা তুলোর মত বরফের মালা, তাও তাও এনে দিতে পারি তোমাকে আমি................ সেসব শুনে হাসতে থাকে রুমু আর আনন্দ জ্বলে কল্পের চোখে।
আজ দীর্ঘ তেরো মাস চিকিৎসা চলছে রুমুর। মানষিকরোগ বা মনোবৈকল্যের চিকিৎসায় বেশ পসার পাওয়া বিখ্যাত ডক্টর শরীফুল্লা মজুমদারের চেম্বারে বসে আছে রুমু।
- তাহলে রুমু।বেশ বুঝতে পারছো কল্প বলে কেউ কোথাও নেই।কখনও ছিলোনা। সে ছিলো তোমার খেয়ালী মনের নিছক কল্পনা। তুমি মোটেও দূর্বল নও, তুমি কিছুতেই ভীত নও আর। তুমি যথেষ্ঠ বড় হয়েছো। নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছো। তুমি নিজেই নিজের সব সমস্যার সমাধান করতে পারো। ছোট থেকেই যখনই তুমি একা থেকেছো, ভয় পেয়েছো, কোনো বিপদে পড়েছো কল্প বলে কখনও কেউ আসেনি। তুমি তাকে নিজেই সৃষ্টি করেছো তোমার নিজের মাঝেই। আসলে সে তোমাকে সেসব দুঃখের দিনে বা বিপদের দিনে সাহায্য করেনি। তুমি নিজেকে নিজেই সাহায্য করেছো রুমু। তুমি যে কোনো বিপদ কষ্ট বা দুঃখকে মোকাবেল করতে যথেষ্ঠ সক্ষম, তাইনা বলো? কোনো কল্পলোকের কল্পের দরকার নেই তোমার আজ আর।
ডক্টরের প্রতিটা কথায় হুম হুম করে যায় রুমু। সে বেশ বুঝতে পারছে ডক্টরের প্রতিটা কথার সত্যতা, আসলেই কল্প বলে কোথাও কখনও কেউ ছিলোনা।
প্রায় তিন বছর কেঁটে গেছে। একটা মাল্টি ন্যাশন্যাল কোম্পানীতে বেশ ভালো একটা জব করছে রুমু। ভুলতে ভুলতে প্রায় ভুলেই গেছে এখন সে কল্পকে। আর সেতো খুব ভালো করেই জানে কল্প বলে কেউ নেই, কখনও কোথাও কেউ ছিলোনা।তবুও কথাটা যখনই ভাবে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর। অন্ত বিয়ে করেছে। এর মধ্যে বার তিনেক দেখাও হয়েছে ওর সাথে রুমুর, একদম মুখোমুখি। একবার এক বিয়ে বাড়িতে আরেকবার এক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আর একবার কে এফ সিতে কিন্তু সেসবও রুমুকে এখন আর কোনোরকম কষ্ট বা আনন্দের অনুভুতি কোনোটাই দেয়না শুধু কল্প নামের কল্পনাটাকেই সে কেনো যেন মিস করে মাঝে মাঝে যখন সন্ধ্যা নামে পাখির ডানায় অথবা অফিসের জানলা দিয়ে ঝিরঝির বৃষ্টি নামা কোনো ঝুম দুপুরে। আনমনা হয় রুমু। মনে পড়ে কোনো এক জনমে কল্প নামে তার খুব ভালোবাসার, খুব কাছের একজন বন্ধু ছিলো কোথাও কোনোখানে............নাহ! ডক্টর বলেছে সে তারই মনের খেয়ালী কল্পনা। কল্প বলে কোথাও কেউ নেই...........................
এমনই এক সন্ধ্যায় বাসে করে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ চমকে ওঠে রুমু। এক সিট সামনে চোখ আটকে যায় ওর। । সেই চিরচেনা আনসেভড গালের একসাইড, ঘন ভ্রুর একপাশ। এলো মেলো চুল। হালকা সবুজ পান্জাবী আর জিন্স, এমনকি পায়ের জুতোটা পর্যন্ত সেই একই টাইপ। ঝট করে উঠে দাঁড়ায় রুমু। ছুটে যায় সামনে। সেই মুখ, সেই ঠোঁট, সেই কপাল, জোড়া ভ্রু, সেই চিরচেনা চাউনীতে চমকে তাকায় কল্প ওর দিকে। রুমু খুব খুশী হয়ে চিল্লিয়েই উঠতে চায় বুঝি এতগুলো দিন পর কল্পকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে। কিন্তু একরাশ অপরিচিতি ছেলেটার চোখে।অচেনা অবাক চোখে চেয়ে আছে কল্প রুমুর দিকে।ওর দিকে তাকিয়ে থমকে যায় রুমু। কল্পের পাশে বসা নীল শাড়ি পরা, খোঁপায় বেলী ফুলের মালা জড়ানো মেয়েটাকে এতক্ষনে দেখতে পায় সে।মেয়েটাও অবাক চোখে চেয়ে আছে রুমুর দিকে।
চোখ নামিয়ে নেয় রুমু।হয়তো কান্নাটাই আড়াল করতে চায় সে। তবে সে চোখে কান্না, বিষাদ, বিষন্নতা কি বিস্ময় তা ঠিক বোঝা যায়না স্পষ্ট করে। ধীরে ধীরে ফিরে যায় সে নিজের সিটে।ঝুপ করে বসে পড়ে একরাশ অবষন্নতায় । ক্লান্তিতে চোখ ভারী হয়ে আসছে ওর। জানালার কাঁচে মাথা রাখে আলগোছে। প্রকৃতিতে তখন গাঢ় ফাগুনের বিষন্ন সন্ধ্যা। চাপ চাপ অন্ধকার নামছে চারিদিকে। কুলায় ফেরা পাখির দলের কিচিমিচি ।অব্যাক্ত বেদনায় বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে রুমুর। নিজেকেই বুঝি প্রবোধ দেয় সে, নিজেকেই বলে, কল্প বলে কোথাও কেউ নেই। কখনও কেউ ছিলোনা....... কোথাও কোনোখানে.........
গল্পটা শুধুই গল্প না .................
সত্যিকারেই রুমুর মত ইমাজিনারী ফ্রেন্ড অনেকেরই আছে এই পৃথিবীতে।সে সত্য প্রমানিত। এই পৃথিবীর অনেকের কাছেই সেই পরম বন্ধুর কোনোই মূল্য না থাকলেও কারো কারো কাছে তার মূল্য অপরিসীম!
কাল্পনিক বন্ধু বা ইমাজিনারী ফ্রেন্ড কাল্পনিক বন্ধু বা কাল্পনিক সঙ্গ এক ধরনের মানষিক এক্সপেরিয়েন্স যেখানে বন্ধুত্ব বা অন্য যেকোনো রকম সম্পর্ক স্থায়ীত্ব পায় ব্যাক্তি কল্পনায় যার কোনো কায়িক সত্যতা নেই।Imaginary friends are fictional characters created for improvisational role-playing. They often have elaborate personalities and behaviors. They may seem real to their creators, though they are ultimately unreal, as shown by studies.[1] The first studies focusing on imaginary friends are believed to have been conducted during the 1890s.
কাল্পনিক বন্ধু বা কাল্পনিক স্বপ্ন মনোবৈকল্য সৃ্ষ্টি হয় সাধারনত শৈশবে কখনও কখনও বয়ঃসন্ধিক্ষনে আর পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় খুবই কম। শৈশবে খেলার মুহুর্তে, ভয়ের সময়গুলোয় শিশুদের কথা বার্তায় আচরণে কাল্পনিক বন্ধুর অস্তিত্ব বুঝতে পারা যায়। শিশু যখন বলে সে তার কাল্পনিক বন্ধুকে দেখতে পারছে মূলত তা তার মগজ প্রসূত। কিছু ক্ষেত্রে শিশু কাল্পনিক বন্ধুকে দেখতে পায়না শুধুই তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারে।বিভিন্ন ধরণের ভয়ার্ত মুহুর্তে, একাকীত্বে ও বিষন্নতায় ইমাজিনারী ফ্রেন্ডের অস্তিত্ব অনুভব করে।লোনলী চাইল্ডদের মাঝে এ সিন্ড্রোম প্রবনতা বেশী দেখা যায়।
References
Taylor, M. Imaginary Companions and the Children Who Create Them.
Klausen, Espen; Richard H. Passman "Pretend companions (imaginary playmates): the emergence of a field".
Kutner, Lawrence (n.d.). Insights for Parents: Midnight Monsters and Imaginary Companions.
এ্যাস্পার্জার সিন্ড্রোম
এস্পার্জার সিনড্রোম- যে শিশুদের অটিজম আছে তাদের মধ্যে কারও কারও বুদ্ধিবৃত্তি স্বাভাবিক শিশুদের মতো থাকে। এদের বলা হয় 'হাই ফাংশনিক অটিজম' বা 'এসপারজার সিনড্রোম'।
এস্পার্জার সিনড্রোমে আক্রান্ত মানুষেরা কিছু ক্ষেত্রে ইমাজিনারী ফ্রে্ন্ড বা কাল্পনিক বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করে।
এস্পার্জার সিন্ড্রোম
এস্পার্জার সিন্ড্রোম
এস্পার্জার সিন্ড্রোমে আক্রান্ত বিখ্যাত ব্যাক্তিরা
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৪৬