চাকুরীর জন্য দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়। কিন্তু সময়ের অভাবে লিখা হয় না। অনেকদিন ব্লগ থেকে দুরে । কিন্তু ভাবলাম লংকাবি নিয়ে না লিখলে এই স্মৃতি ধরে রাখবে কিভাবে? অফিসের কাজে সিঙ্গাপুর আর হংকং ঘুরে শেষে যাত্রা করলাম পাহাড়, সমুদ্র আর সমতল ভূমির চমৎকার এক দেশ মালয়েশিয়া। সেখান থেকে যাবো লংকাবি.......।
স্বপ্নীল দ্বীপ লংকাবি। পর্যটননগরী মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে উত্তর পশ্চিমে থাইল্যান্ড সীমান্ত থেকে মাত্র ৪৫ মিনিট দূরে অবস্থিত দ্বীপটি। প্রতিদিন হাজার হাজার ভ্রমণ পিপাসুর মিলনমেলা এই দ্বীপে।
ভোর ৬টায় সিঙ্গাপুর থেকে বাসে যাবো মালোয়শিয়া। এটা আমাদের আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল। বাস জার্নিটা সত্যিই চমৎকার। আমাকে যারা আগে থকে চিনেন তারা জানেন আমার বাস ভাগ্যে খুব একটা খারাপ না। দুই বন্ধু একসাথে সীট পেলাম না। আলাদা আলাদা সীট। মনটা খরাপ হয়ে গেলে। কিন্তু আমি কি আদৌ জানতাম যে আমার দুই পাশের সীটে অপেক্ষা করছে এক মালোয়শিয়ান আর এক সিংগাপুরী সুন্দরী।এই গল্পটা না হয় অন্য কোনদিন লিখবো।
না গল্পটা শেষ করেই দেই। যারা প্রস্তুত হচ্ছেন রোমান্টিক একটা গল্প পড়ার জন্য তাদের হতাশ করে বলছি………! না ভাই……… কোন কিছুই হয়নি। দুই পাশে দুই সুন্দরী, কার সাথে কথা বলবো কে রাগ করবে? হাই হ্যালো ছাড়া তেমন কিছুই হয়নি। বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়েই ছিলাম।দেখলাম আমার সাথে পাল্লা দিয়ে তারাও ঘুমাচ্ছে। প্রায় ৫ ঘন্টার জার্নি শেষে পৌছলাম কুয়ালালামপুর। নেমেই এয়ারপোর্ট, দেরী হলেই প্ল্যান মিস। টিকেট আগেই কাটা ছিল।
তারপর সোজা লংকাবি। সাথে এক বন্ধু কলিগ আর আর কুয়ালালামপুর অপেক্ষা করছিলেন আর এক কলিগ। তারপর ৩জন রওনা হয়ে গেলাম লাংকাবির উদ্দ্যেশে। কুয়ালালামপুর থেকে ১ ঘন্টার প্লেন জার্নি। নেমেই একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করে রওনা দিলাম খাবারের জন্য। পেটের মধ্যে তখন ক্ষুধার রেলগাড়ী চলছিল।ঢুকে গেলাম ম্যাকডোনাল্ডসে।খাওয়া শেষ করে হোটেলে।
গোসল শেষ করেই বিকাল ৫ টায় বের হয়ে গেলাম লংকাবি দেখতে, শহরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বিশাল আকৃতির ঈগল মূর্তি। টুইন টাওয়ার দেখলে যেমন কুয়ালালামপুর বোঝা যায় এটা দেখলে যে কেউ বলে দিতে পারবে এটা লাংকাবি। পর্যটকদের স্বাগত জানাতে এখানে প্রবেশমুখে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে ওয়েলকাম টু লাংকাবি।
মালয়েশিয়ার অন্যান্য জায়গার তুলনায় এখানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা কিছুটা কম। তবে যতটা শুনেছি ততটা নয়। আসলে এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ভালো অবস্থানে গেছে খুব কম বাংলাদেশি। আর যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই শ্রমিক শ্রেণির। গুটিকয়েক বাংলাদেশি বৈবাহিক সূত্রে কিংবা ব্যবসায়িক সূত্রে এখানে অবস্থান করে নিয়েছেন।
রাতের খাবারের সময় জানলাম ঐদিন রাতেই সেহেরী খেতে হবে। বাংলাদশের একদিন আগেই সেখানে রমজান শুরু। আর এই জন্যই এবার আমার রোজার সংখ্যা ৩১টি। সিদ্ধান্ত নিলাম আবার ঘুরতে বের হবো, হাতে সময় খুব কম। ২দিন পর ঢাকা ফিরত হবে। সেহেরী খেয়ে তারপর ঘুম। রাতের আলোয় লংকাবি দেখতে আরো সুন্দর। অন্ধকার থাকায় সমুদ্র তীরে যাওয়া হলো না।
রুম সার্ভিস এর জন্য ঘুম ভেঙ্গে গেল। সকাল ১০টা। লাংকাবিতে আমাদের দ্বিতীয় দিন। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধুই নীল জলরাশি। সিনাং বিচে আছড়ে পড়া ঢেউ এর শো শো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। দেশি বিদেশি পর্যটকরা এরই মধ্যে সান বাথের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যাওয়ার উপায় নাই। বিকেল যাওয়ার প্ল্যান।
গোসল শেষ করে রওয়া দিলাম লংকাবিতে দর্শনীয় স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্যাবল কার বা ঝুলন্ত গাড়িতে উঠতে। সাথের দুইজন কেউই রাজি নয়, একজন ভয়ে আর একজন আগেই ভ্রমনের অভিজ্ঞতা। শেষে একাই উঠে গেলাম। প্রথম তো ভয়ই পাচ্ছিলাম, আস্তে আস্তে সাহস সঞ্চার করে যাত্রা শুরু করলাম।
ক্যাবল কারটি তিনটি স্তরে ভাগ করা। বেজ স্টেশন বা মূল স্টেশন, মিডল স্টেশন বা মাঝের স্টেশন এবং টপ স্টেশন বা সর্বোচ্চ স্টেশন।ক্যাবল কারে টিকেট মূল্য ৩৫ রিংগিত। বেজ স্টেশন থেকে টিকেট কেটে ক্যাবল কারে চড়তে হয়। প্রতিটি ক্যাবল কারে ৬ জন করে বসা যায়। বেস স্টেশনে আরও মিলবে স্যুভেনির শপ। এখানকার কর্মচারীরা পর্যটকের ছবি তুলে দেয় যা পরে স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখা যায়।
মাঝের স্টেশন অতিক্রম করে পরবর্তী স্টেশনে বেয়ে উঠবে যা শেষ হয় আরেকটি পাহাড়ে। আর এখান থেকে দেখা যায় স্কাই ব্রিজ এবং পুরো লংকাবি। মাঝে মাঝে মেঘ ছুঁয়ে যায়। একপাশে নীল সাগর এবং অপর পাশে সবুজে ঘেরা পাহাড়। পাশেই স্কাই ব্রিজ। স্কাই ব্রিজে যেতে হলে খরচ হবে অতিরিক্তি ৫ রিংগিত।
ক্যাবল কারের পুরো পথ হল ৯৫০ মিটার যা পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে লম্বা পথ। আর পুরো পথ যা অতিক্রম করতে হয়, তা প্রায় ১,৭০০ মিটার। নিচু থেকে প্রায় ৪২ ডিগ্রি কোণে উপরে উঠবে। ভীষণ রোমহর্ষক এক অনুভূতি।
রোজা থাকায় তৃষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে। সেখান থেকে রওনা দিলাম লংকাবি বার্ডস প্যারাডাইসে। ছোট একটা চিড়িয়াখানা। তবে ঢাকার থেকে অনকে পরিছন্ন, অনেক পরিস্কার। সরাসরি ঢুকে গেলাম পাখির খাঁচায় হাতে খাবার নিতেই সব পাখি উড়ে এসে হাতে মাথায় বসে পড়লো। নানা রং এর পাখি। ভালোই কাটতেছিল। কিন্তু ইফতারির তাড়া থাকায় তাড়াতাড়ি বের হতে হলে, তাছাড়া সমুদে যাওয়া হয়নি এখনো।
চলে গেলাম সমুদ্রে।খুব একটা ঢেউ নেই। নেই লম্বা সমুদ্রসৈকতও। এবং সৈকত আমাদের কক্সবাজারের কাছে কিছুই না। তবে এটা অনেক পরিকল্পিত, যার কারণে এখানকার চারপাশ খুবই সুন্দর। পরিকল্পনার ছোঁয়া লাগলে আমাদের কক্সবাজারও এর সৌন্দর্যকে হার মানাবে।
কক্সবাজারের উত্তাল ঢেউ, বিশাল সৈকত কোনোটাই নেই এখানে। তবে এখানে যেটা আছে তা হচ্ছে নীল জলরাশির মাঝে আকাশ, পাহাড় আর সমুদ্রের দারুণ একটা সমন্বয়। পরিকল্পনা আর পরিচ্ছন্নতার ছোঁয়া সমুদ্রসৈকতের কোণায় কোণায় খুঁজে পাওয়া যায়।
ঘন্টা খানেক থাকার পর ইফতার করতে গেলাম বাঙ্গালী একটা দোকানে, সেখানে সব বাঙ্গালী ইফতার বুট, মুড়ি, পিয়াজো, শসা, গাজর, জুস, আম, আপেল সবই পেলাম।
ইফতার শেষে শরীরটা আর নিতে পারলো না। হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাতে বের হলাম সীফুড খেতে । লংকাবি নাম করা তেলেগা সীফুড রেষ্টুরেন্ট । অল্প আলোতে গানের তালে তালে সবাই বিভিন্ন সীফুড খাচ্ছে। আমরাও শুরু করলাম। স্কুইড ফ্রাই। জীবেন প্রথম স্কুইড খেলাম । সাথে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ।
খাওয়া শেষ। তারপর শুরু হলো মার্কেটিং। পরদিন সকালের ফ্লাইডে কুয়ালালামপুর যেতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি মার্কেটিং শুরু করে দিলাম। সারা রাত ঘুরে সেহেরী খেয়ে হোটেলে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে সকাল ৭টায় চলে গেলাম এয়ারপোর্ট।
মনে মনে বললাম আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে কোনো একদিন। তোমার ৯৯টা সৌন্দর্যের বড়জোর ২/৩টা আমি দেখেছি। পরেরবার এসে যে সুন্দর ও দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখা হয়নি সেগুলো দেখব। মন ভরে উপভোগ করব। অনেক সময় নিয়ে আসব। বিদায় লাংকাবি। নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিয়ে এভাবেই বিদায় নিলাম।
সকাল ১০ টায় কুয়ালালাম নামলাম। মালয়েশিয়ার সৌন্দর্য খুঁজতে লাংকাবি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বলা যায়, দেশটির সবখানেই সৌন্দর্যের ছোঁয়া লেগে আছে। তবে আমার দেখা লাংকাবির সৌন্দর্য সম্পূর্ণ অন্যরকম।
এয়ারপোর্ট থেকে টেক্সি করে টাইম স্কায়ারে, কিছু কেনাকাটা শেষ করে আবার এয়ারপোর্ট। রাত ১০টার ফ্লাইটে ঢাকা।
ক্যামেরা- এলজি জি৩ ফোন।
ছবির হাত- লেখক নিজে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ৮:০৩