কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘অলৌকিক আনন্দের ভার/ বিধাতা যাহারে দেয়, তা’র বক্ষে বেদনা অপার,/ তা’র নিত্য জাগরণ; অগ্নিসম দেবতার দান/ ঊর্ধ্বশিখা জ্বালি চিত্তে অহোরাত্র দগ্ধ করে প্রাণ।’
যিনি স্রষ্টা, সৃষ্টির মধ্যেই তাঁর অলৌকিক আনন্দ-বেদনা। সৃষ্টিতেই তাঁর জন্ম, তাঁর বেঁচে থাকা। প্রকৃত স্রষ্টার তো মৃত্যু নেই, প্রকৃত স্রষ্টা মরতে পারেন না! তাই জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদেরও মৃত্যু নেই! হুমায়ূন আহমেদ মরতে পারেন না! কেননা তিনি তাঁর নন্দিত সৃষ্টিগুলোর মধ্য দিয়ে, নতুন জন্মের সাধ নিয়ে বেঁচে থাকবেন, জেগে থাকবেন তাঁর অগুনতি পাঠকের হৃদয়ে, তাঁদের হাসি-কান্নায়, বাংলা বর্ণমালায়, উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে।
জীবনের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসের নাম রেখেছিলেন ‘নন্দিত নরকে’। আর এর মধ্য দিয়েই পাঠককে নিজের সম্ভাব্য শক্তিমত্তার জানান দিয়েছিলেন তিনি। কী কাহিনী, কী অসাধারণ জীবনবোধের প্রকাশই না ঘটেছে উপন্যাসটিতে। এরপর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ থেকে দুই-তিনশ বইয়ের সিঁড়ি অতিক্রম শেষে ‘দেয়াল’ উপন্যাস পর্যন্ত তাঁর যে পরিভ্রমণ, তা তো রীতিমত বিস্ময়ের! দীর্ঘ এই যাত্রাপথে তিনি মানুষের জীবন ও জগতের ছদ্মবেশ দেখে, অসংগতি দেখে যেমন বারংবার উপহাসে হাস্যরসে মজেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি জীবন ও জগতের অসীম দুর্জ্ঞেয় রহস্য গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে, বিজ্ঞানের যুক্তিতে অনুসন্ধানও করেছেন। তিনি তাঁর লেখায় একইসঙ্গে হিউমার, একইসঙ্গে প্রগাঢ় জীবনদর্শন ও বর্ণিল চিন্ত্বার গাম্ভীর্যের মিশেল ঘটিয়েছেন; এখানেই আসলে তাঁর মুন্সিয়ানা, এখানেই তিনি অন্য অনেকের চেয়ে হয়েছেন আলাদা।
শুধু উপন্যাস নয়, তাঁর ছোটগল্প, তাঁর নাটক, তাঁর গদ্যরচনা, তাঁর চলচ্চিত্র, তাঁর চিত্রকলা, তাঁর গান- সবই তো হুমায়ূন আহমেদীয় বৈশিষ্ট্য নিয়েই শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে। জীবনে এত এত লেখা লিখেছেন, কিন্তু নিজস্বতা ধরে রেখেছেন সব সময়ই। যদিও তাঁর প্রসঙ্গে অনেক সমালোচক বলে থাকেন, তিনি যদি এত বেশি না লিখে কিছু কম লিখতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্য তাঁর কাছ থেকে আরও বেশি মাস্টারপিস বই পেতে পারত। সেই শক্তি তাঁর কলমে ছিল। এখানেই প্রশ্ন, তবে কি তিনি যে বিশাল সৃষ্টির ভাণ্ডার রেখে গেছেন, তা বাংলা কথাসাহিত্যের গৌরব কম বাড়িয়েছে! তা তো নয়।
যদি প্রশ্ন করা হয়, একজন হুমায়ূন আহমেদ কেন আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়? মনে হয় অনেকেই একমত হবেন যে, তাঁর প্রয়োজন, আমাদের সময়ের প্রয়োজনে। কেননা তাঁর সৃষ্টিকর্মের বড় অংশজুড়েই রয়েছে বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রেম-বিরহ, ব্যক্তি ও সমাজসম্পর্কের টানাপড়েন, সুখ-দুঃখের মর্মকথা। বাঙালি শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মধ্যবিত্তের আবেগকে তিনি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারতেন। ফলে তাঁর প্রায় রচনারই ভাষা, সংলাপ ও চরিত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে মধ্যবিত্তীয় ধ্যানধারণাকে কেন্দ্র করে। আর এ কাজে বলা যায় তিনি সফলও হয়েছেন।
তাঁর ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, নক্ষত্রের রাত’, ‘আজ রবিবার’ ইত্যাদি নাটক দেশের টেলিভিশন নাটকে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এসব নাটকের কাহিনী ও চরিত্র আজও দর্শকদের মনে গেঁথে আছে। তাঁর চলচ্চিত্রগুলোও তো অতুলনীয়। ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামলছায়া’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ কিংবা ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র কথা বাদ দিয়ে কি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস ভাবা যায়!
সবসময়ই গ্রগতিশীলতার পক্ষে ছিল তাঁর অবস্থান। দেশের যেকোনো সংকটে-সংগ্রামে উচ্চকণ্ঠ না হয়েও নীরবে-নিভৃতে লেখনীর মাধ্যমে তিনি নিজের সমর্থন দিয়ে গেছেন সত্য, ন্যায় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, গণমানুষের পক্ষে। ১৯৮৮ সালের দিকে স্বৈরাচার শাসনামলে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তিনি তাঁর নাটকে পাখির কণ্ঠ দিয়ে ‘তুই রাজাকার’ সংলাপ বলিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ জানাতে ভুলেননি। তাঁর গল্প-উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্রের অনেকাংশজুড়েই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরে বাবার শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেন তাঁর রক্তে মিশে গিয়েছিল। তাই তো দেখি, তিনি শুধু একজন লেখকই ছিলেন না, ছিলেন একজন নীরব সমাজবিপ্লবীও। নিজের অবস্থান থেকে সমাজ বিনির্মাণেও নিরলস কাজ করে গেছেন।
গ্রামের শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার সুযোগ তৈরি করে দিতে নিজের ঘাটের টাকা খরচ করে কেন্দুয়ায় নিজের গ্রামে ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’ নামে স্কুল নির্মাণ করেছেন। স্কুল পরিচালনাও করেছেন নিজের টাকায়ই। ভালবাসতেন গাছপালা, নির্মল প্রকৃতি। তাই গাজীপুরে তাঁর গড়া নুহাশপল্লীতে লাগিয়েছেন অসংখ্য জাতের ফলজ, ওষুধি ও ফুলের গাছ। অন্যরকম এক আবহে সাজিয়েছেন তাঁর প্রিয় নুহাশপল্লীকে। নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে যাপন করতেন নিজের অবসর মুহূর্তগুলো।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি দেশে একটি অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুবিধাসংবলিত ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথাও গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল, দেশে অত্যাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি হলে দেশের গরিব মানুষদের জমিজমা বিক্রি করে এত টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে না। কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছা তিনি পূরণ করে যেতে পারলেন না।
মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৯ জুলাই রাত ১১টা ২০ মিনিটে অন্য ভুবনে চলে গেলেন তিনি। জ্যোৎস্নাপ্রেমিক এই লেখকের ইচ্ছা ছিল, কোনো এক চাঁদনি পসর রাতে যেন তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে আকাশে ছিল না কোনো চাঁদ, জ্যোৎস্না। তবু তিনি চলে গেলেন, অন্ধকারে, নীরবে, কোন অভিমানে!
আসলেই কি তিনি চলে গেলেন! তা আমরা বিশ্বাস করি না। তিনি আছেন, আমাদের মধ্যেই মিশে আছেন; নেত্রকোনার কতুবপুরে, ধানমণ্ডির দখিনা হাওয়ায়, গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, বাংলা একাডেমীর বইমেলায় কিংবা অন্য কোথাও; হয়তো হিমু হয়ে, হয়তো মিসির আলি হয়ে, শুভ্র হয়ে, নয়তো শৈববের কাজল হয়ে।
আলোচিত ব্লগ
ভারতীয় পতাকার অবমাননা
বাংলাদেশের ২/১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় পতাকার অবমাননা আমার কাছে ছেলেমী মনে হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার কারণে বাংলাদেশের মানুষের মনে প্রচন্ড রকমের ভারত বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে।
কিন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভিসা বন্ধ করায় ভারতকে ধন্যবাদ।
ভারত ইদানীং ভিসা দিচ্ছেনা; তারা ভিসা না দিয়ে আমাদেরকে শিক্ষা দিতে চায়! তাদের করদ রাজ্য হাতছাড় হওয়া খুবই নাখোশ, এতোই নাখোশ যে মোদী মিডিয়া দিনরাত বয়ান দিচ্ছে এই দেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতের চিকিৎসা বয়কট এবং
ভারতের এক হাসপাতাল ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের কোন রুগিকে তারা চিকিৎসা দিবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে হাসপাতাল থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল দেশ
চামচা পুঁজিবাদ থেকে দেশ চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মিলে চোরতন্ত্র করেছে।
সোমবার... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত পাঠাবে তবে............
শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে বিচারের জন্য ভারতের কাছে ফেরত চাইতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশকে প্রতিহিংসামূলক বিচারপদ্ধতি বাদ দিতে হবে। বিচারে শেখ হাসিনা যাতে ন্যায় বিচার পান বাংলাদেশকে আগে তা নিশ্চয়তা... ...বাকিটুকু পড়ুন