আমরা বাঙালিরা, যারা এই মার্কিন মুলুকের স্কুল-কলেজে পড়াশুনো করছি, তারা মজা করে বলি, দেবতাদের মিনিস্ট্রিতে এখনই একটা রদবদল দরকার৷ শিক্ষা দপ্তরটা সে ক্ষেত্রে সরস্বতীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে বিশ্বকর্মার হাতে দিয়ে দেয়া উচিত৷ অন্তত আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা দেখে এ কথা বলাই যায়৷ কারণ, এই মহাদেশ দিন-কে-দিন এমন যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ছে যে, শিক্ষকতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের যাবতীয় পরীক্ষার বেশিরভাগটাই হচ্ছে অনলাইনে৷ স্রেফ একটা কম্পিউটার, ট্যাবলেট বা স্মার্টফোন নিয়ে বসে পড়লেই হল৷ তবে এখনও আমরা কিছু বই-পত্তর নিয়ে স্কুল-কলেজে যাই বটে৷ সেগুলি আমাদের পড়তেও হয়৷ কিন্তু সেই বইপত্তর বেশিরভাগই অনলাইনে মেলে৷
আমরা অনলাইনে হোমওয়ার্ক পাই৷ শিক্ষকদের সাহায্য লাগলে, তাও পেয়ে যাই অনলাইনে৷ বেশিরভাগ শিক্ষক গ্রেডেশনও করেন সেখানে৷ গোটা প্রক্রিয়াটায় যাতে অসুবিধা না হয়, তার জন্য রয়েছে বেশ কিছু সফটওয়্যার৷ আমরা একে বলি 'ম্যাজিক মেশিন'৷ আরও কয়েকটা নাম বলি৷ যেমন, 'মেম্বিন', এটা ভোকাবুলারির জন্য৷ প্লেজারিয়াজম (বাংলায় এটাকে নকল করা বলে) ভেরিফিকেশনের জন্য আছে 'টার্নিটিইন', বিবলিওগ্রাফির জন্য 'ইজিবিব' ইত্যাদি৷ অনলাইন ডেটাবেসের ক্ষেত্রে রয়েছে 'স্যরস', 'জেস্টর', 'প্রোকোয়েস্ট' প্রভৃতি৷ আবার অনলাইন মেমোরাইজেশন ফ্ল্যাশকার্ডের জন্য আছে 'কুইজলেট'৷ অনলাইন অ্যাপ টেস্ট প্র্যাক্টিসের জন্য 'লার্নেরেটর'৷
কম্পিউটারের লোকেরা যেমন 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' করে, তেমনই এখানে 'হোমস্কুল' বলে একটা সিস্টেম রয়েছে৷ এ ক্ষেত্রে বাড়িতে বসেই অনলাইনে লোকাল স্কুল বোর্ডের ক্যারিকুলাম ফলো করা যায়, যেটাকে বলে 'ভার্চুয়াল স্কুল'৷ আমি পার্সোনাল ফিনান্সিংয়ে এ রকম একটা ভার্চুয়াল কোর্স করছি৷ পুরো প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাটাই 'সেলফ টট৷' কোথাও আটকে গেলে অনলাইন হেল্প ডেস্ক থেকে আমাদের ইস্যুটা সমাধান করে দেয়া হয়৷ অনলাইনেই আমরা সব শেয়ার করতে পারি বন্ধু বা শিক্ষকদের সঙ্গে৷ অনেক ক্ষেত্রে টেক্সট করেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়৷ তা ছাড়া, সোশ্যাল মিডিয়া তো আছেই৷ সাহায্য দরকার হলেই আমরা সেটা ফেসবুক, টুইটার বা স্ন্যাপচ্যাটে পোস্ট করে দিই৷ কম্পিউটার বা ট্যাব খোলারও দরকার পড়ে না৷ প্রয়োজন মিটে যায় স্মার্টফোনেই৷
অনলাইন ব্যবস্থাটা খুবই স্মুথ৷ কিন্তু এর কয়েকটা খারাপ দিকও রয়েছে৷ প্রথমত, ক্লাসরুমে বসে শিক্ষক-ছাত্র সবাই মিলে ক্লাস করার যে আনন্দ, সেটা একটা যন্ত্রের সামনে একা বসে মোটেই জমে না৷ বরং বেশ একঘেয়ে লাগে৷ দ্বিতীয়ত, আমরা যারা বই পড়তে ভালোবাসি, তারা বুঝি যে পাতার গন্ধ নিতে নিতে পড়ার যে সুখ, সেটা যন্ত্র নাড়াঘাঁটা করলে মোটেই পাওয়া যায় না৷ তা ছাড়া অনলাইনে অন্য সব কিছুর মতোই পড়াশুনোটাও একেবারে হাটে হাঁড়ি খুলে দেয়ার মতো৷ এখানে ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই৷
ধরা যাক, আমি একটা টেস্ট দিচ্ছি৷ সেই সময়ে কোনও শিক্ষক এসে আমার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ বা কোনো বন্ধু আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে৷ অনলাইন স্টাডির ক্ষেত্রে এ রকম একটা অনুভূতি হয়৷ সবচেয়ে বড় কথা, অনলাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে অনেক সময় আপাত ভাবে মনে হয় ছাত্ররা একে অপরকে কপি করছে বা চিট করছে৷ দিন কয়েক আগেই, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতেই শিক্ষক-ছাত্রদের মধ্যে এ রকম একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে৷
অনলাইনের ঠেলায় আমেরিকার ভালো ভালো বইয়ের দোকানগুলো উঠে যাচ্ছে৷ উইকএন্ডে বাবা-মায়ের সঙ্গে কোনও বইয়ের দোকানে গিয়ে কফি খেতে খেতে বই বা ম্যাগাজিন বা সংবাদপত্র নাড়াচাড়া করাটা কমে যাচ্ছে দ্রুত৷ আমেরিকায় বড় হয়ে উঠলেও, এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে না৷ মডার্ন বা সিভিলাইজড মানে কি শুধু যন্ত্র থাকবে, বই থাকবে না? এ কেমন কথা! টলস্টয় বলেছিলেন, 'মানুষের জীবনে শুধু তিনটে জিনিসের প্রয়োজন, বই, বই আর বই!' আমেরিকায় তো দেখছি, মানুষের জীবনে শুধু তিনটেই মন্ত্র, 'যন্ত্র, যন্ত্র আর যন্ত্র৷'
**লগ্নজিতা মুখোপাধ্যায়: ইলেভেন গ্রেডের ছাত্রী, ন্যাশভিল, টেনেসি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৮:১১