তিন গোয়েন্দা পড়ে বড় হয়েছি বলে কিনা থ্রি শব্দটি শুনলেই রহস্যের গন্ধ পেতে থাকি (থ্রি ফর থ্রিলার, অন্য কোনকিছুর গন্ধ পাবেন না প্লিজ)।তিন গোয়েন্দার সেই সকল থ্রিলার জীবন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে। তাই ড্রামা থ্রিলার উধাও দেখার দিন পুরনো অভিজ্ঞতা ফিরে পাবার আশায় কিছুটা উত্তেজিত ছিলাম। আধোয়া গ্লাসে ময়লা কেন, ফিউজ লাইট জ্বলে না কেন এমন সব বিষোয়গুলো সকাল থেকেই আমার কাছে রহস্যময় লাগতে শুরু করে।ক্যাম্পাসের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) দিকে যাত্রা শুরু করলাম, সেখান থেকে কয়েকজন স্কুলের বন্ধুদের সাথে বলাকাতে যাবো।রহস্যময় ট্রাফিক জ্যামের কারণে আমার পৌছতে খানিকটা দেরী হয়ে গেলো।
হরর মুভির সেট
বাস থেকে ক্যাম্পাসে নেমেই ভয় পেলাম।পুরা ক্যাম্পাস নিস্তব্ধ,গা ছমছমে পরিবেশ যেন হরর মুভির সেট।সেন্ট্রাল লাইব্রেরিটাকে মনে হলো পোড়া বাড়ি আর কলা ভবন যেন ব্রিটিশ আমলের পরিত্যাক্ত জমিদার কুঠি।নিস্তব্ধ ক্যাম্পাসে কিছু ভূত-পেত্নী (কাপল) প্রেম করে বেড়াচ্ছে।প্রেমিক যুগলদের জন্য নিঃস্ব ক্যাম্পাস হলো প্রাণোল্লাস আর আমাদের মত নিঃস্ব মানুষদের জন্য এ ক্যাম্পাস দীর্ঘশ্বাস।ভূতুড়ে ক্যাম্পাসে আমার দুই বন্ধু প্রেতাত্নাদের মত ঘুরোঘুরি করছিলো।তাদের মানুষ বানিয়ে রওনা দিলাম বলাকার দিকে।কথা বলতে বলতে যাচ্ছি এমন সময় হঠাত সামনে উদয় হলেন আমাদের ডিপার্টমেন্ট-এর এক স্যার।ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম।স্যারকে সালাম দিবো নাকি ভয় পেয়ে বুকে থুথু দেবো তা নিয়ে কিছুক্ষন কনফিউজড থাকার পর শেষ পর্যন্ত স্যারকে সালাম দিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উধাও হলাম।
হলের হালহকিকত
হলে যোগ দিলো আমাদের আরেক বন্ধু । হাতে গোনা কয়েকজন দর্শকের সাথে হলে ঢুকে মনে হলো হলে নয় বরঞ্চ আত্নীয়ের বাসার ড্রইংরুমে বসে আছি। দর্শক বলতে আমরা ৪ জন, আমাদের পেছনে বসেছে ছেলেদের আরেকটি বড় গ্রুপ, আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিছু দর্শক বসেছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।সিনেমার শুরুর দিকে পেছনে বসা ছেলেগুলো অল্পতেই চেচামিচি জুড়ে দিয়ে সিনেমায় তেজ আনার চেষ্টা করলো। যেন ক্রিকেট খেলা পেয়েছে,চিয়ার করলেই ডিরেক্টর ছক্কা পেটাতে শুরু করবে।অবশ্য থ্রিলার মুভি একটু-আধটু টি-টিয়েন্টি ক্রিকেটের মতোই হবার কথা।তবে দর্শকদের নিরাশ করে ডিরেক্টর নিজের মতো টেস্ট ম্যাচ খেলে গেলেন।
কাহিনী সংক্ষেপ
আকবর রহমান ইলেকশনে দাড়িয়েছেন।অনেক কাজ তিনি স্থগিত রেখেছেন ইলেকশনে জেতার পর করবেন বলে।তার গুন্ডারা তাকে বলে “বস একটু গোলাগুলি করি?, তিনি বলেন, “ইলেকশনে জিততা লই তারপর যা ইচ্ছা করিস”, তার হাবভাব দেখলে মনে হয় তিনি টয়লেটও চেপে রেখেছেন, ইলেকশনে জেতার পর করবেন। তবে স্ত্রীকে আদর করার ক্ষেত্রে তিনি ইলেকশন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নন।তার পোষা খুনী রাজ (অনিমেষ আইচ) সর্বদা আশেপাশে ঘুরঘুর করে, সেটা আবার তার স্ত্রীর পছন্দ নয়।এদিকে ভ্যান চালক বাবু আকবর রহমানকে কিডন্যাপ করার জন্য সুযোগ খুজতে থাকে। কিডন্যাপ করে বাবু তাকে নিয়ে যেতে চায় আকবরের আসল পরিবারের কাছে যেখান থেকে তিনি উধাও হয়েছিলেন।
অবাস্তব বনাম ব্যাতিক্রম
বাংলা সিনেমা হিসেবে উধাও-এ বেশকিছু ব্যাতিক্রম দৃশ্য দেখতে পেলাম।যেমন-
১. আকবর রহমানের স্ত্রীর জন্য বাবু এক টাইপরাইটারকে দিয়ে একটি নোট টাইপ করাতে থাকে, নোট টাইপ হবার মাঝেই আকবর রহমানের কিডন্যাপ দেখানো হয়। এখানে ব্যাতিক্রমীভাবে দুটি দৃশ্যের সন্নিবেশ একসাথে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে ডিরেক্টরকে সফল বলা যায়।
২. বাংলা সিনেমাতে সম্ভবত এই প্রথম ব্যাবহার করা হলো বাংলা Rap গান।ব্যাকগ্রাউণ্ডে লাল মিয়ার Rap চলার সময় দৃশ্যায়ন হতে থাকে রাতের ঢাকার অন্ধকার জগত, যৌনকর্মীরা দাড়িয়েছে খদ্দেরের আশায়, ভবঘুরেরা ধুকছে নেশায়।এরকম দৃশ্যায়ন বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে নতুনই বটে।
তবে ব্যাতিক্রম এরকম আরো কিছু দৃশ্যের সাথে কাহিনীতে ঢুকে পড়েছে কিছু অবাস্তব দৃশ্য।যেমন-
১.আকবর রহমানকে বাবু তার ভ্যানের ভেতর বেঁধে নিয়ে যায় পুরনো এক মন্দিরে।সেখান থেকে ঝুলন্ত ঢালাই-এর চাই-এর সাথে গলা ও হাত বাধা থাকা অবস্থায় আকবর একটি দোকানে গিয়ে স্ত্রীকে ফোন করে তার অবস্থান জানানোর চেষ্টা করে ।পেছন থেকে বাবু এসে লাঠি দিয়ে মাথায় বাড়ি মেরে তাকে অজ্ঞান করে নিয়ে যায়। লোক সমাগম হওয়া একটি বাজারের ভেতর এরকম ঘটনার অবতারণা কতটুকু বাস্তব?
২. ভ্যানগাড়ির ভেতর বেঁধে রেখে আকবরকে শহর থেকে গ্রামে নিয়ে যেতে থাকে বাবু।সেই ভ্যানগাড়ির ভেতর একটি পলিথিনে রাখা ছিলো কিছু কৈ মাছ, বাবু তা কিনেছিলো তার স্ত্রীর জন্য।আকবর নিজের চিহ্ন হিসেবে রাস্তায় একটি একটি করে কৈ মাছ ফেলে যেতে থাকে।সেটার সুত্র ধরে শহর থেকে গ্রামে বাবুর পিছু নেয় আকবরের পোষা খুনী রাজ। হিসাবটা ঠিক মিললো না ডিরেক্টর সাহেব।
ইন্টারমিশন
সিনেমার ইন্টারমিশনে বেশ কিছুক্ষন ধরে চললো হলিউড মুভি চার্লিস এঞ্জেলস-এর ট্রেইলার। আমাদের পেছনে বসা গ্রুপটি অনেক গাইগুই করেও সিনেমার প্রথম ভাগে চিয়ার করার মত কিছু পাচ্ছিলো না। আমি ভেবেছিলাম চার্লিস এঞ্জেলস-এর সংক্ষিপ্ত বসনা নায়িকাদের দীর্ঘায়িত ট্রেইলার দেখে হয়তো তারা নিজেদের ফিরে পাবে।কিন্তু তারা টু শব্দ করলো না, ডিরেক্টরের স্লো রান রেটে প্রত্যেকেই নেতিয়ে পড়েছে।
স্লিম ফিগারের ভিলেনঃ
সিনেমার পোস্টারে অনিমেষ আইচের ছবিটা দেখে ভেবেছিলাম সিনেমায় এই চরিত্রটির বিশেষ ভূমিকা থাকবে।তা চার্লিস এঞ্জেলস-এর নায়িকারাও যেরকম ফিগার দেখলে ঈষায় ভুগবে, সেরকম একটা ফিগার নিয়ে ভিলেন হতে পারাটা বিশেষ কিছুই বটে।সিনেমার একটা দৃশ্যে দেখা যায় অনিমেষ এক লোককে বেদম পেটাচ্ছে, ঐ ব্যাটা নায়িকাদের জিরো ফিগারধারী অনিমেষকে বাধা দেবার কোন চেষ্টাই করলো না বরং মারার আগেই পশ্চাদ্দেশে হাত দিয়ে ককিয়ে উঠলো যেন দেখিয়ে দিলো কোথায় তাকে মারতে হবে, এরপর অনিমেষ পশ্চাদ্দেশ বরাবর লাথি মারলো।বাবুকে ধরতে গিয়ে সিনেমায় বেশ কয়েকবার ডলা খেয়েছে অনিমেষ।ডায়েট কন্ট্রোলে থাকা ‘চিকনি চামেলী’ ভিলেন তাগড়া ভ্যানচালকের কাছে ডলা খাবে সেটাই স্বাভাবিক।এক্ষেত্রে ডিরেক্টর অবশ্য বাস্তবতারই আশ্রয় নিয়েছেন।তবে বলতেই হচ্ছে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ‘রাজ’ চরিত্রটিকে বিকশিতে হতে দেয়া হয় নাই।
প্রশংসা ও সমালোচনা
উধাও ছবির জন্য কিছু প্রশংসা ও সমালোচনা সাজিয়ে নিতে চাই পাশাপাশিভাবে।
প্রশংসাঃ উধাও ছবিতে কোন নায়ক-নায়িকা নেই।প্রত্যেকেই এক একটি চরিত্র এবং প্রত্যেকেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলেছে বেশ সাবলীলভাবে।
সমালোচনাঃ হল থেকে বেরিয়ে আসার পরেও আপনার কানের ভেতর গিয়ে চুলকোবে এমন কোন ডায়ালগ চরিত্রগুলোর জন্য বরাদ্দ নেই।ফলে কয়েকটি চরিত্রের বিচরণ অল্পতেই থেমে গিয়েছে।
প্রশংসাঃ টুইস্টের মধ্যে দিয়ে সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়াটা থ্রিলার মুভির জন্য অত্যাবশ্যকীয়। উধাও সেই শর্ত পূরন করতে পেরেছে।
সমালোচনাঃ আগেই বলেছি ডিরেক্টরের গল্প বলার ভঙ্গি অনেক ধীর।এই ধীর গতির কারণে টুইস্টগুলো যখন সামনে আসে তখন নড়েচড়ে বসা গেলেও বিস্মিত হতে ঠিক ইচ্ছে হয় না।
উপলব্ধি
হলে দর্শকসংখ্যার দৈন্যদশা দেখে মনে হলো নাচ-গান-ভালোবাসার সিনেমা ছাড়া অন্য কিছু দেখতে আমাদের দর্শকেরা প্রস্তুত নয়।এমন অবস্থা চলতে থাকলে প্রযোজকেরাও ভবিষ্যতে ব্যাতিক্রমী কিছুর বদলে গতানুগতিক কিছুতে টাকা ঢালতে উতসাহী হবেন।আর আমার নিজের ক্ষেত্রে উপলব্ধি হলো, বাসায় বসে ভেঙ্গে ভেঙ্গে নাটকের মতো পর্ব ভাগ করে সিনেমা দেখলেও হলে গিয়ে সিনেমা দেখার ধৈর্য্য আমার নেই।তাই জোর করে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার মানসিকতা তৈরীরও কোন মানে হয় না।আপাতত উধাও হচ্ছি সিনেমা হল থেকে।তবে আপনি গিয়ে দেখে আসতে পারেন, ভালো লাগুক বা মন্দ লাগুগ, অন্তত বাংলা সিনেমার বিবর্তনের সাক্ষী হবার সান্ত্বনা জুটবে।
ব্লগে আমার আরেকটি মুভি রিভিউ পোস্ট চোরাবালি