“মনের ভিত্রে জ্বালা নি, ভালা নি?ভালা নি?”- ধড়ফড় করে উঠে এই লাইনটাই শুধু শুনতে পেল সুমাইয়া। এটা আবার কেমন গান! একঘেয়ে নারীকন্ঠ গেয়ে চলেছে। সস্তা টাইপের সুর, সস্তা টাইপের কথা। চোখ খুলে দুই মিনিট মাথা জমে গেল। যখন বুঝতে পারল ও কোথায়, ভয়ের ঠান্ডা স্রোত ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে, সারা মাথায়।
ও বাসে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ও একা বাসে। একদম পিছনের দিকে একটা সিটে। চারদিকে আলোর বন্যা, শুধু বাসের ভেতর কবরের অন্ধকার। মশার কামড়ে পা ফুলে গেছে। শীত ও ভীষণ। বাইরে অনেক লোক, আট-দশজন হবে। হাহা হোহো করে হাসছে, বিড়ি টানছে, আর সস্তা ক্যাসেটপ্লেয়ারে গান বাজছে,“মনের ভিত্রে জ্বালানি, ভালানি?ভালানি?”...
ওর নামার কথা ছিল বিবিরহাটে, বাসস্ট্যান্ড এর আরো তিনটা স্টপেজ
আগে। প্রথম এসেছে এ এলাকায়, সরকারি চাকরি, কাল জয়েন করার কথা। সাথে বড়ভাই এর আসার কথা ছিল, শেষ মুহূর্তে সুরাইয়া, ওদের ছোটবোন, পা ভেঙ্গে ফেলল। ফোন করেছিল, এখানকার বসকে, কয়দিন পর জয়েন করি স্যার? “মেয়েদের চাকরি দেয়াই জ্বালা! এখনো শুরুই করলনা, আর ছুটি!” খুব জোরে না বললেও সুমাইয়া বুঝতে পেরেছিল কথাগুলো। “আমি কালই আসব স্যার। স্লামাইলেকুম” । আর কী বলত? এখনকার যুগে জাতীয় ভার্সিটি থেকে পড়ে সরকারি চাকরি, এই তো অনেক।
সুমাইয়া নিজেও জানেনা, এমন অবস্থায় এইসব কথা কেন মনে পড়ছে! ভাই বারবার রাস্তা বুঝিয়ে দিয়েছিল। “বাসস্ট্যান্ড রামগতি, কিন্তু তুই নামবি বিবিরহাট। হেল্পার ডাকলেই নেমে যাবি। খবরদার মাইজদীর পর ঘুমাবিনা, একদম না” “আপুর যে ঘুমের বাতিক!” ভাঙ্গা পা নিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়েও সুরাইয়া ফোঁড়ন কাটে। সুমাইয়া ফোন খুঁজতে নেয়, নিজেকে দোষ দেয়, ঘুমিয়ে পড়ার জন্য। কিন্তু ফোন কই? ব্যাগ কই! অজ্ঞানপার্টি?? কিন্তু ও তো কারো দেয়া কিছু খায়নি! তখন মনে পড়ে পাশের মধ্যবয়সী লোকের কথা। বারবার যার শাল মুখের ওপর পড়ছিল, খুব বিরক্ত হলেও কিছু বলেনি তখন।
কিন্তু কেউ ওকে ডাকলোনা কেন? যাত্রীরা যদি আগেও নেমে পড়ে, বাসের কেউ দেখবেনা? নাকি এরাও জড়িত? কথাটা মনে আসা মাত্র জানালা দিয়ে বের করা মাথাটা ভেতরে নিয়ে আসল। ও যে ডাকতে যাচ্ছে গোল হয়ে থাকা লোকদের, তারা আসলে কারা? হয়ত ও ঘুমিয়ে আছে জেনে অপেক্ষা করছে, রাত বাড়লে...না! আর ভাবতে পারছেনা! ভয়ে এই শীতের রাতেও ঘেমে উঠল সুমাইয়া। হাত পা নাড়াতে পারছেনা আর, ঝিম ধরে গেছে, কিছু ওষুধের প্রতিক্রিয়া, বাকিটা ভয়। হঠাৎ ক্ষুধাও লাগল। আর বুঝতে পারল, মাসের এ সময়টায়... শিট! শুধু এটুকুই উচ্চারণ করতে পারল। লোকগুলোকে যদি ডাকতে চায় ও, এভাবে! কান্না আসল এবার হুহু করে। “আম্মা, আমারে বাসায় নিয়া যাও, আমি বাসায় যামু...আম্মা, আম্মা, আমারে নিয়া যাও”।
বাইরের লোকদের আসর ভেঙ্গে গেছে। একজন উঠে আসছে বাসের দিকে। চিনতে পারল সুমাইয়া, বাসের হেল্পার। কান্না কী, সামান্য আওয়াজও গিলে ফেলল ও, নিঃশ্বাস বন্ধ। দুপুরে যে ম্যাডাম ম্যাডাম করছিল, তাকেই এখন সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষ মনে হচ্ছে। বাসে উঠে লোকটা কোনদিকে তাকালোনা, মাঝের দিকে মেঝেতে শুয়ে পড়ল চাদর বিছিয়ে। এর মানে এরা জানেনা, ও বাসে আছে! লোকটাকে ডিঙ্গিয়ে বের হওয়া সম্ভব না। বাইরে আরো কয়েকজন আছে। এক কাজ করা যায়, যদি জানালা দিয়ে লাফ দিতে পারে, তাহলে...তাহলে রাত আরো বাড়লে, লাফ দিয়ে...কিন্তু তারপর? এই এলাকা বিন্দুমাত্র চেনেনা, এই শীতের রাতে কই যাবে? বাসস্ট্যান্ড এটা, ট্রেনস্টেশন না, কোন অথরিটি নেই। রাগে, দুঃখে, ভয়ে এবার ওর মরে যেতে ইচ্ছা করছিল।
“আফা, আফা, ওডেন, ওডেন! হায় হায়! আমনে নি সারা রাইত হিয়ানে আছিলেন? ঘুমাইয়া আছিলেন নি কোনো? অজ্ঞানপাট্টি নি? অই ফইন্নির পুত ফরহাইদ্দা, তরে আঁই কয়বার কইছি বার বার দেহি লইবি কিছু আসেনি বাসও! করস কি তুই!! ফইসা দি তোঁয়ারে রাখসি আঁই ইঁয়ার লাগি??” সুমাইয়া চোখ মেলে আবছা আবছা শুনতে পায়। বাসের ড্রাইভার ঝুঁকে আছে, পাশে কাঁচুমাচু সেই হেল্পার। “ভাইয়া! আমি...” এটুকুই শুধু বোঝা যায় হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা সুমাইয়ার কণ্ঠে ।