ডিসেম্বর এর ১২ তারিখ, বসের কিডনিকাটা এক্সপ্রেসন উপেক্ষা করে, রবি-সোম ছুটি নিয়ে রওনা দিলাম সিলেটে। বিজয় দিবস মিলিয়ে বিরাট ছুটি। বোনের শ্বশুরবাড়ি থাকবো, আর ঘুরবো ইচ্ছামত। লাউয়াছড়া-শ্রীমঙ্গল-রাতারগুল-গোয়াইনঘাট...কত্ত প্ল্যান, এত্ত ছবি রাখার জন্য ডাটা কেবল, মেমরি কার্ড, পেনড্রাইভ...ফিরে এসে ব্লগে লিখব বিস্তারিত বিবরণ...কিন্তু সব গেল পালটে, আম্মা হঠাৎ অসুস্থ, সোজা হাসপাতালে, আর আমি? সোজা ফিরতি বাসে...
বোন-দুলাভাই আরো কয়দিন থাকবে। একা মেয়েমানুষ যাবে, সিট তাই বাসের একদম সামনে, ‘মামা ইঞ্জিনের গরম লাগবেনা?’ ‘ইতান আপনেগো লোকাল গাড়ি নায় বা, ইউনিক গাড়ি!’ রীতিমত অভিমানি গলা। ‘অকে’। আরেক মহিলার সিট পাশে, ভালো। বাসে ওঠামাত্র গানের ধাক্কা, হেভি মেটাল, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ!! বোন ফোন দিল, ‘কই আছিস?’ উত্তর দিলাম ‘লুল’ বোন বিরক্ত হয়ে বলে, ‘জায়গা চিনিসনা, ঠিক আছে, কিন্তু আশেপাশে কী দেখা যায়?’ ‘ধানখেত দেখা যায়, ধান নাই, উঠায় ফেলছে!’ এইবার বোনও বলে ‘লুল’!শান্ত হয়ে বসলাম, পাশের আপা ফোনে কথা বলেই চলছেন।‘আমি ই বাজারে আছুইন’, ‘আমি উ রাস্তায় আছুইন’। শঙ্কিত বোধ করলাম, ঢাকা পর্যন্ত কি এই চলতে থাকবে? তখন মেটাল ছেড়ে গান আরেফিন রুমির দিকে টার্ন নিয়েছে।
জানা গেল, আপা যে সে লোক নন, রীতিমত উকিল, এক কাজে ঢাকায় যাচ্ছেন, পথে কোন এক বাজারে ওনার এক বোনের সাথে মুখদেখা পর্ব সারলেন। বাসের জানালা উঁচু হওয়ায় বাচ্চারা দেখতে পেলনা, আহারে! বাসে তখন ‘এক জীবনে এত প্রেম পাবো কোথায়?’
সিলেট থেকে বাস হবিগঞ্জের দিকে যাচ্ছে, মন উদাস, আহারে এইসব জায়গায় আজ ঘোরার কথা ছিল! রাগ করে ঘুমাতে চাইলাম। অশেষ ধন্যবাদ নতুন দিনের সঙ্গীত পরিচালকদের, মনে হচ্ছিল, ঘণ্টা ধরে এক গানই শুনছি, কথা-সুর-আমি-তুমি সব এক, সফটওয়্যার ও মনে হয় একটাই, অটো টিউনার থাকায় সবার গলাও এক! আরাম করে ঘুমপাড়ানি গান শুনলাম।
বাস থামল নাস্তা খেতে। দিগুন উৎসাহে চলল বাস, আর তিনগুন উৎসাহে গান। ‘এই দিন-সেই দিন-কোনদিন, তোমায় ভুলবনা’ আনন্দে বললাম এই তো! চোখের সামনে তখন সালমান শাহ-শাবনূর, ভাবলাম, এই জীবনে কত ছায়াছন্দ দেখেছি! ‘এ জীবনে যারে পেয়েছি’ ‘স্বপ্নের নায়ক’ ‘আমি যে তোমার কে’ ‘আমার কানের দুল বলে রে’...আহা, এই এ্যালবাম দিয়েই ঢাকা পৌঁছানো যাবে। ‘একাত্তরের মা জননী’ বাজার সাথে সাথে হেলপার ভলিউম বাড়িয়ে দিলেন। ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ মেটালের মাজেজা বোঝা গেল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হলদে শর্ষেখেতের পাশ দিয়ে বাস যাচ্ছে, আর গান বাজছে, ‘আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’।
কিন্তু বিধিবাম, এন্ড্রু কিশোর-কনকচাঁপা-আব্দুল হাদী-সাবিনা ইয়াসমিনের ঝুলি না ফুরালেও নরসিংদী এসে যাত্রীদের ধৈর্য ফুরিয়ে গেল। ‘আরো জোরে বাজান!!!’ বেচারা ড্রাইভার যেইনা ভলিউম আরো বাড়িয়ে দিল, চিৎকার ঠেকায় কে! আমি আর কি করি, মনখারাপ করে বসে রইলাম।
কিন্তু এ যাত্রায় গানের কিছু তখনও বাকি ছিল। গান তো শুধু শব্দে না, গান রঙ এ, আলোয়-আঁধারে। তাই নারায়ণগঞ্জে এসে সারি সারি রঙ্গিন কাপড়, শাড়ি, বাটিকের লাল-নীল-বেগুনি-হলুদ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। আর তারপর? ধুলোওড়া রাস্তা, ধুলোমাখা ছোলাবুট। আর তার ও পরে, ঢাকা শহরের প্যাঁপোঁ হর্নের সঙ্গীত... সিলেট ভ্রমণটা তাই ইউনিক না হলেও, ফেরাটা ইউনিক হল।