পড়ন্ত বিকেলের আকাশে আজ আবীরের রঙের ছোঁয়া নেই। আকাশের বড্ড মন খারাপ আজ। একমুহুর্তের জন্য আজ বৃষ্টি থামেনি। ঠিক যেন আশাহত হওয়া কোন কিশোরীর মত কাঁদছে সে। রাস্তায় কখন থেকে সিগনালে আটকে আছে গাড়িগুলো, একচুলও নড়ার অবকাশ নেই। আরোহীদের চোখে-মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। সবাই কাজ শেষে নিজের গন্তব্যে পৌছানোর জন্য ছটফট করছে।আমিও নিজের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছি।
হাটছি আমি। বিশাল জনসমুদ্রের মধ্যে নিজেকে মাঝে মাঝে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়। কাঠখোট্টা ঢাকা শহরে এই একটা জিনিস একই সাথে উপভোগ্য এবং বিরক্তিকর। এই জনসমুদ্রে সবাই হাটায় ব্যস্ত। কেউ হাটে দ্রুত, কেউ ধীরে, কেউ আরামে, কেউ অস্থিরচিত্তে, কেউ ধনী, কেউ গরীব। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই একলাইনে হাটে। কেউ কারো অপেক্ষা করে না।
আমিও হাটছি। একসময় মনে হয় অনন্তকাল ধরে এভাবে হেটে গেলে খারাপ হত না। আজ রাস্তার পাশের কুকুর দুটো নেই। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে কোথাও আশ্রয় নিয়েছে হয়তো। ওভারব্রিজে উঠতে উঠতে হঠাত খেয়াল করলাম বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশের সোনালী রোদ চারিদিকে স্বর্ণরেণুর মত ছড়িয়ে পরেছে। আরে! ওই তো রংধনু দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই রংধনু যে আমার বড্ড অচেনা! আমি খেয়াল করলাম আমি আর ঢাকার সেই ফুট ওভারব্রিজের উপর নেই। হাটতে হাটতে চলে এসেছি কোন অন্য কোথাও। এতো আমার শহর নয়! হলুদ ইটে মোড়ানো রাস্তায় হাটছি আমি? এতো সেই ওজের রাজ্য! ছোটবেলায় বই পড়েছিলাম সেই ওজের রাজ্য না এটা? পাগল হয়ে গেলাম নাতো? ভালোমতো চোখ কচলালাম। আরে;ওইতো টিনম্যান আর স্কেয়ারক্রো একসাথে আড্ডা দিচ্ছে। একটু দূরেই ডরোথি খেলা করছে টোটোর সাথে। একটুও বড় হয়নি ওরা। আরে, টিংকারবেল এখানে কি করে? ও তো পিটারপ্যানের গল্পে ছিল। এখানে কি করে? ওর কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করবো ঠিক এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো, " এমারেল্ড সিটিতে স্বাগতম, আফরিন! "
আমি চমকে পিছনে ঘুরে তাকালাম;
- আপনি গ্লিন্ডা না? দক্ষিণের ডাইনি!
- হ্যা, কি অবস্থা তোমার?
- এইতো আছি। খারাপ না। বাসায় যাচ্ছিলাম, ভুলে এখানে চলে এসেছি।
- ভালোই করেছো। চল একসাথে একটু বেড়াই।
- আরে নাহ। রবিবার মিডর্টাম পরীক্ষা। সিজিপিএ এমনেই আলোর গতিতে নিচে নামতেসে। পড়তে হবে বাসায় গিয়া।
- এত পড়াশুনা করে কিইবা উল্টায় ফেলবা শুনি? জীবনে মরার আগে একটু বাঁইচা যাও নিজের জন্য। নিজের স্বপ্নগুলাকে একটু উপভোগ কর, বুঝচ্ছো?
- আছেন তো শান্তিতে। পড়াশুনা নাই, চাকরি- বাকরি করার চিন্তা নাই। খালি সারাদিন আরামে ঘুরেন আর সিংহাসনে বইসা টুকটাক কাজ করেন।
- তা ঠিক,চলো একটা জিনিস দেখাই তোমাকে।
- কি?
- উপরে তাকাও!
আমি দেখলাম নীল আকাশে মেঘের পরিবর্তে ভাসছে আমার স্বপ্নগুলো! আচ্ছা, ওরা না মরে গেছে? আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। একপর্যায়ে স্বপ্নগুলো আকাশ ছেড়ে আমার চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগলো...
গ্লিন্ডা হাসিমুখে বললো, " ওরা মরে নাই। পথভ্রষ্ট হয়ে এখানে চলে আসছে। নিয়ে যাও তোমার সাথে ওদের, তোমার কাছে।"
আমি বললাম, " কিন্তু কিন্তু... আমার কাছে যে এখন সবার স্বপ্ন থাকে! কিভাবে নিবো ওদের? আর স্বপ্ন রাখার তো জায়গা নাই!"
- কিছু তো নিয়ে যাও!
- সম্ভব না।
- কেন?
- সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নাই।
- ধুর বোকা মেয়ে! নিজের জন্য বাঁচো, ভালো থাকবা।
- নিজে তো শান্তিতে আছে তাই আরেকজনরে উপদেশ দেয় ( মনে মনে আমি)
গ্লিন্ডা বললো:
- আপা, এর পরে আর বাস যাইবো না। নামেন।
সম্বিত ফিরে পেলাম আমি। নিজেকে আবিষ্কার করলাম তুরাগ সিটিং সার্ভিস বাসে আর গ্লিন্ডার জায়াগায় দাঁড়িয়ে আছে বাসেরই হেল্পার। আচ্ছা, আমি না হাটছিলাম, বাসে উঠলাম কখন? যাই হোক, বাস থেকে নেমে হাটা শুরু করলাম। গন্তব্যে পৌছাতে হবে। এখনো অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে।আর কাছেই কোথাও বাজছে অর্থহীন ব্যান্ড এর গান-
" বৃষ্টি নেমেছে আজ আকাশ ভেঙে,
হাটছি আমি মেঠোপথে..."
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৯