হঠাৎ করেই আব্বার বড় রকমের অসুখ ধরা পড়লো। কিডনিতে সমস্যা। ডায়ালাসিস করানো শুরু করতে হবে। ফুসফুসে পানি জমেছে। ডাক্তার সময় ও বেধে দিয়েছেন। সব কিছু এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে সেটা কেউ ধারণা করে নাই। আব্বা আমাদের সবাইকে ডাকলেন। এক সপ্তাহের ভেতরেই বড় ভাইয়ের বিয়ে দিতে হবে। আব্বা চাইছেন, ডাক্তাদের বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই তাঁর উপর বর্তিত দায়িত্ব গুলো শেষ করতে। তাড়াহুড়ো করেই এক সপ্তাহের মধ্যেই বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেলো। ভাইয়ের বিয়ের একদিন পরেই, বড় ভাই আমাকে ডেকে বললেন, যদিও এই সময়টা এই বিষয় নিয়ে কথা বলার যৌক্তিক সময় না। তারপর ও বলতে হচ্ছে। আব্বা চাচ্ছেন তোর বিয়েটাও দিয়ে দিবে। তোর কোন মতামত জানাস। এক দুই দিন সময় নিয়ে ভেবে দেখ।
---না ভাইয়া , ভাবা লাগবে না। তোমরা যেটা করবা সেটাই হবে। আমি ও চাই আব্বা এটা দেখে অন্তত শান্তি পাক, যে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি কোন ভাবেই চাই না, আব্বা এই মহুর্তে মনে কষ্ট পাক।
বাড়ির ছোট মেয়ে আমি। এমবিএ শেষ করেছি মাত্র। ছোট একটা চাকুরি শুরু করেছি। আব্বা সাথে আমার এত বেশি বোঝাপাড়া, যেটা মায়ের সাথেও আমার নেই। আব্বা মাগরিব শেষ করে প্রতিদিনই কিছু কিছু না নিয়ে আসতেন। বুদ্ধি হবার পর থেকে আমার সব আবদার আব্বার কাছেই ছিল। এমনি আমি বড় হবার পরও জ্বর আসলেও, আব্বা সারারাত আমার পাশে বসে থাকতেন। এমন অনেক কথাই থাকতো যেগুলো মা বা ভাইয়া জানতো না।
কোথায় আমার বিয়ে হচ্ছে, কার সাথে হচ্ছে , ছেলে কি করে , ছেলে দেখতে কেমন এই প্রশ্নগুলো আমার মাথায় আসেই নি। শেষ মুহুর্তে আব্বার মুখের একটু হাঁসিই আমার কাছে অনেক বড় ছিল। সিদ্ধান্ত হলো সামনে শুক্রবারই বিয়ে। আমি আব্বার পাশে গিয়ে মাথায় হাত বোলাচ্ছি। আব্বার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
--আব্বা, আমার বিয়ে হচ্ছে, আপনি খুশি তো?
-- ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় আব্বা বললেন , দেখ মা, বাবা হিসাবে আমার দায়িত্ব ছিল নিজ হাতে তোর বিয়ের সব কাজ করা। নিয়তির কি ইচ্ছা, আজ আমার হাটার অবস্থাও নেই। আর তোর বিয়ের বয়সও তো হয়েছে। আমি বেঁচে থাকতে তোর বিয়ে দেখে যেতে পারছি, এতে আমার আত্না শান্তি পাবে ।
২
রাতুল। আমার ফুফাতো ভাই। বয়সে আমার চেয়ে বছর তিনেকের বড়। একটি বেসরকারি কোম্পানির উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা। মাধ্যমিক পর্যন্ত আমাদের এখানে থেকেছেন। অসম্ভব বিনয়ী একজন মানুষ। সাবাই রাতুল ভাইকে খুব পছন্দ করতো। একই স্কুলে পড়তাম আমরা। স্কুলে যাওয়া আসা সময় ভাইয়া প্রায়ই মাথা নিচু করে হাটতেন। এটা নিয়ে আমার বান্ধবীরা প্রায়ই মজা করতো। আমাদের পরিবার ছিল যৌথ। তিন দিকে তিন চাচার বাড়ি। মাঝখানে উঠান। একই বাসায় থাকা সত্বেও ভাইয়ার সাথে আমার খুবই কম দেখা হতো। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হতেন না। স্কুলের সময় বাদ দিয়ে বাকি সময় নামায আর পড়ালেখা নিয়েই থাকতেন। অংক বা ইংরেজির কোন সমস্যা হলে ভাইয়াকে দেখাতাম। সেটাও কদাচিৎ। আমি ক্লাস নাইনে। ভাইয়া এস এস সি পরীক্ষা দিবে। পরীক্ষার পর ভাইয়া নিজের বাড়ি চলে যাবে। এই ভেবে আমার প্রায়ই খারাপ লাগতো। ভাইয়া ছিল আমার চোখে জীবন্ত আইডল। ভাইয়া যে আমাকে পছন্দ করতো সেটা আমি বুঝতে পারতাম। কিন্তু বলার সুযোগ হাতে তুলে দিলেও কখন সে কিছু বলবে না। লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন ভাইকে জানালাম যে, আমি তাঁকে পছন্দ করি। ভাইয়া বললো, দেখ তুলি, মামী আমাকে খুব আদর করে। মামাও আমাকে তাঁর নিজের ছেলের থেকে আলাদা করেন না। আমি কোন ভাবেই চাই না, আমার পরম নির্ভরতার এই জাইগাটা নষ্ট হোক। তাঁরচেয়ে ভাল তুই তোর মত থাক, আমি আমার মত থাকি। আমি কলেজে ভর্তি হই, তারপর এটা নিয়ে ভেবে দেখা যাবে। আমি খুশিতে আটখান। ভাইয়া অন্তত না বলে নি। পরীক্ষা শেষ করে ভাইয়া নিজের বাড়ি চলে গেলেন। কলেজে ভর্তি হবার পর, মায়ের ফোনে ভাইয়া সাথে কথা হত। সেটাও কদাচিৎ। সপ্তাহে একবার। এভাবে সবই ঠিকঠাক চলছিল। মাস চারেক পর মা হঠাৎ একদিন আমাকে ডেকে বলে,
--তুই রাতুলের সাথে কথা যোগাযোগ করবি না। আমাদের একটা মান সম্মান আছে। আমি রাতুলকেও বলে দিব।
--কিন্তু মা,
--কোন কিন্তু না।
--মা
--এই ব্যাপারে তুই আর কোন কথা বলবি না। আমি তোর পেটে হয় নি, তুই আমার পেটে হয়েছিস।
মা রাতুল ভাইকে কি না কি বলে এটা নিয়ে খুব মন খারাপ হচ্ছিল। ভাইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর সপরিবারে ঢাকায় চলে যায়। আমি অনার্সে ভর্তি হবার পর ব্যক্তিগত মোবাইল নিই। ভাইয়াকে কখন ফোন দেবার সাহস করে উঠি নি। প্রতি সপ্তাহেই এস এম এস পাঠাতাম। সেই ধারাবাহিকতা চলেছে আমার মাস্টার্স শেষ হবার আগ পর্যন্ত। কোন বিপদের সংবাদ ছাড়া ভাইয়া কখন এস এম এস এর রিপ্লে বা কল দেয় নি। মাঝে মাঝে খুব কান্না পেত। তাঁর পরে ভাবতাম, আমার মনে হয়েছে আমি তাই আমি পাঠিয়েছি, কে পড়লো বা না পড়লো তাতে আমার কোন যায় আসে না। এতে মনকে সাময়িক স্বস্তি দেওয়া গেলেও কয়েকদিন পর আবার খারাপ লাগতো।
৩
আজ আমার বিয়ে। বিয়ের একদিন আগ থেকেই আব্বার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে শুধু পানি ধরছে। বিয়ে হচ্ছে ঘরোয়া পরিবেশে। ঢাকাতে আমার মামা থাকে । মামা এসেছেন। রাতুল ভাইয়েরা গাজীপুরে থাকেন। ফুফুর আসার কথা। ছোট খালা পাশেই থাকেন। খালা এসেছেন। খালা আমাকে সাজাচ্ছেন। কারোর ভেতরেই যেন কোন প্রাণ নেই। মনে হচ্ছে না এটা বিয়ে বাড়ি। খুব বিশেষ প্রয়োজন না হলে কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। যা একটু কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে সেটা বাচ্চাদের কথার শব্দ। সকাল থেকে আমি আব্বার ঘরে যায় নি। বিয়ে নিয়ে মেয়েদের অনেক জল্পনা কল্পনা থাকে। মাস ছয়েক আগে বান্ধবী নীলার বিয়েতে গিয়েছিলাম। বিয়ের আগের রাতে বান্ধবীরা সবাই গল্প করে কাঠিয়েছিলাম। মনে রাখার মত কয়েকটা ঘটনার মধ্যে এটাও একটা। কোথায় আমার বিয়ে হচ্ছে সেটা এখন পর্যন্ত আমি জানি না। কাউকে জিজ্ঞসে করবো সেই করবো সেই মন মানসিকতা বা পরিবেশ কোনটাই নেই। বড় ভাই যখন বিয়ের কথা বলেন, তখন ভাইয়াকে বলেছিলাম, বিয়ের পর আব্বা থাকাকালীন সময়টা আমি এখানেই থাকতে চাই। সেই ব্যবস্থা যেন করা যায়। ভাইয়া আমার কথা রেখেছেন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে এশার নামাযের পর। বারবার মনে হচ্ছিল রাতুল ভাইয়ের সাথে ১টা মিনিট কথা বলতে পারলে হতো। অন্তত এতটুকু শান্তনা পেতাম যে, শেষ বারের জন্য হলেও তাঁকে আমি জানিয়েছিলাম। আমার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়েও আমি রাতুল ভাইয়ে নাম্বারে কল দিতে পারলাম না। আমার হাত এবং মস্তিস্ক দুই রকম কাজ করছে। পরে ভাবলাম থাক, নিজের কপালের উপর তো কারো হাত থাকে না। কতদিনেরই বা জীবন । নদীর মত এক ভাবে বয়ে যাবে। অল্প সময়ের মধ্যেই বিয়ের আনুষ্ঠিকতা শেষ। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবার আগে, সাজগোজ শেষ করে একবার আব্বার রুম গেছিলাম। আব্বা দেখুক তাঁর মেয়েকে বিয়ের সাজে কেমন লাগছে। আব্বার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
ঘড়ির কাটায় ১১টা আমি আমার রুমে বসে আছি। এই মহুর্তে আমার চিন্তা করার কথা ছিল, মানুষটা কেমন হবে, দেখতে কেমন, আমাকে তাঁর ভাল লাগবে নি না । কিন্তু এই মহুর্তে আমার মাথার চিন্তাশক্তির নিউরন গুলো থেমে আছে বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে চোখমুখে অন্ধকার দেখছি। গণিতের জটিল জটিল সমীরকরণ গুলো সমাধান করা গেলেও অনেক সময় জীবনের খুব সহজ সমীকরণের সমাধান অনেক সময় করা যায় না। কি চেয়ে ছিলাম, আর কি হয়ে গেলো। একজন মেয়ের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দুটো হলো, বিয়ে এবং মা হওয়া। এই দুটো ঘটনাতেই মেয়ের থাকে পূর্ণ পূর্ব প্রস্তুতি। বোধ বুদ্ধি হবার পর থেকে স্বভাবতই একজন মেয়ে আনমনে এগুলো নিয়ে স্বপ্ন সাজায়। ছোট ছোট করে নিজের স্বপ্নের জগত রাঙ্গিয়ে তোলে। কারো কারো জীবনে সেই স্বপ্ন পরিপূর্ন ভাবে প্রতিফলিত হয়। কারো বা কিছুটা । কেউ কেউ পুরোই হতাশ হয়। তারপর পরিবর্তিত অবস্থার হাতে নিজেকে শপে দেয়। তিলতিল করে গড়ে তোলা নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করে নতুন মানুষ নতুন পরিবারের কাছে নিজেকে মানিয়ে নেবার।
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো। সেদিকে তাকানোর ইচ্ছে হলো না। আমার নাম ধরে ডাকলেন “তুলি”। এই নামে শুধু আমার মা ডাকতেন । আর কালে ভদ্রে ছোট বা বড় চাচা। আব্বা আমাকে শামীমা বলেই ডাকতেন। এবার আমি চোখ তুলে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি বরের বেশে রাতুল ভাই। আমার স্পাইনাল দিয়ে ঠান্ডা প্রবাহ বয়ে গেলো। এত ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশের মধ্যেও আমার কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে। এক ধরনের নিশ্চয়তার অনুভূতি। ভাল লাগার অনুভূতি। অপেক্ষার কষ্ট শেষ হবার অনুভূতি। বিয়ের সময় মেয়েরা বাবা মা কে ছেড়ে যাবার জন্য কান্না করে। আমারও এখন কান্না পাচ্ছে। সে কান্না কষ্টের কান্না নয়। সুখের কান্না। মনে হচ্ছে মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি এলে বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে কান্না করতাম। রাতুল ভাই পরিবেশ বুঝতে পেরে আমাকে হালকা করার জন্য প্রশ্ন করলেন,
--- সেদিন মামী আমাকে কি বলেছিল জানো?
---কবে?
--- যেদিন তোমাকে আমার সাথে যোগাযোগ করতে নিষেধ করে।
---না তো।
--- মামী বলেছিল, দেখ রাতুল, তোমাকে আমরা আমাদের নিজের ছেলের মতই জানি। তুলি এখনও অনেক ছোট। আবেগের বশে কখন কি করে ফেলে সেটা বলা যায় না। আমি জানি তুমি তুলিকে পছন্দ করো। তুমি লেখাপড়া শেষ করো। একটা চাকরী করো। তুলিও লেখাপড়া শেষ করুক। আল্লাহতালা চাইলে আমি নিজে দায়িক্ত দিয়ে তোমাদের বিয়ে দেব। তুলিকে এ ব্যাপারে কিছু বলার দরকার নেই। আর তুলির সাথে যোগাযোগ করো না।
--চল বারান্দায় যায়, আজ পূণির্মা।
আমরা দুজন বারান্দায় দাড়িয়ে আছি। বৃত্তাকার আলোকউজ্জ্বল চাঁদের দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবন্ধ। আমার বার বারই মনে হচ্ছে “আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম”।
নাজমুল ইসলাম সাদ্দাম
৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
মিরপুর, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০২১ রাত ৮:০৯