বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে পা রাখতেই আমার আমূল পরিবর্তন হলো। আমি নিয়মের বাইরের একজন মানুষ। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাসগুলোতে কখনো নিয়মিত গেছি এ রকম রেকর্ড নেই। বলা হতো ফার্স্ট বেঞ্চার, সেকেন্ড বেঞ্চার, লাস্ট বেঞ্চার। সেই হিসাবে আমার কোনো বেঞ্চই ছিল না। তবে ছাত্র হিসেবে একেবারেই খারাপ ছিলাম না। বরাবরই বার্ষিক পরীক্ষায় বেশ ভালো করতাম। এমন অনেক বার হয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় গণিতে ৩ বা ১০ পেয়েছি। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষায় দিব্বি ৭০ বা তার বেশি পেয়েছি। গ্রামের স্কুল হওয়ায় কী ফলাফল হয়েছে সেটা তখন খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। যেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা হল রোল নং। মাধ্যমিক নির্বাচনি পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যায় পড়তে বসে বই হাতে নিয়ে দেখি চোখে সর্ষে ফুল দেখছি। ঐ যে সন্ধ্যায় পড়তে বসলাম, দেখি ফজরের আযান হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু রাতের খাবার খেয়েছিলাম। মা তো রীতিমত অবাক। যাকে এত মেরে বকে টেবিলে বসানো যায় না, সে আজ স্বেচ্ছায় টেবিল বসেছে। ফজরে মা ঘুম থেকে উঠে আমার কপালে হাত দিয়ে বলে তোর জ্বর আসেনি তো। মাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো। এবার আমিও বেশ অবাক হলাম। সপ্তাহের খুব কম দিনই গেছে এমন যে কাঁচা কঞ্চি দেখিনি। আমার মনে হলো বোধহয় মায়ের মাথায় খারাপ হয়ে গেছে। নির্বাচনি পরীক্ষার সেই ১১ দিন সন্ধ্যা থেকে ভোর অবধি এভাবেই চলত। এরপর আর এইভাবে পড়ালেখা করেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে পা রাখতেই আমার এই আমূল পরিবর্তনের কারণ আমি উদঘাটন করতে পারলাম না। ক্লাসে আমার পরিচিত হল আঁতেল। ক্লাস থেকে কখনো রুমে ফিরেই নোট করতে বসা অথবা লাইব্রেরিতে গিয়ে বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা। কিভাবে কিভাবে যেন সবার কথা উপেক্ষা করে এগুলোই আমার রুটিন হয়ে গেল। এমন কি বন্ধুদের কোনো আড্ডায় আমাকে পাওয়া যেত না। সব কিছু ভালোভাবেই চলছে। তাক লাগানো ফলাফল করলাম প্রথম বর্ষে। সেদিন চৈত্র মাস ছিল কি না মনে পড়ে না তবে এক জীবনানন্দীয় চোখে চোখ পড়ে আমার সর্বনাশ ঠিকই হয়েছিল। এক নিমিষেই সব কিছু উল্টে গেল। গল্পের মতো পাল্টে গেল আমার জীবন। শুরু হলো আমার ক্লাস মিস দেওয়া। ক্লাসের সময় আমাকে দেখা যেত বনলতার সাথে ফুসকার দোকানে দাঁড়িয়ে আছি। আমার বান্ধবীরা অনেকেই আমার কাছে জোর করে ফুসকা খেতে চাইত। আমি ওদের বলতাম তোরা আইস্ক্রিম খা। ফুসকা কোনো সুস্থ মস্তিকের মানুষের খাবার হতে পারে না। সেই আমি ওদের কাছে হাসির পাত্রে পরিণত হলাম। মধ্যরাতে যখন বন্ধুদের সমস্যা সমাধান করতাম, সেই সময় আমাকে দেখা যেতে শুরু করল বনলতার হলের সামনে। যেখানে একশ পঞ্চাশ থেকে দুইশ টাকার ফোন বিলেই মাস চলে যেত, সেখানে আমার ফোনের বিল তিন সংখ্যা ছাড়িয়ে চার সংখ্যায় পৌঁছে গেল। টং এর দোকানে এক কাপ চা ভাগাভাগি করে খাওয়া কিংবা বৃষ্টির মধ্যে রিক্সার হুড তুলে বনলতার শরীরে উষ্ণতা খুঁজে ফেরা কিংবা পাগলামি করা খালি পায়ে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ানো। মনে হতে লাগল আমি আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো সময় পার করছি। এর মাঝে ডিপার্টমেন্টের এক জুনিয়র আমার রুমে উঠেছে। আজম। হালকা পাতলা শরীর। আমার মাসখানেকের কাছাকাছি রুমে ওঠা হলেও আমার সাথে কথা হয়নি। আজম যখন ক্লাসে বা বাইরে যায় আমি তখন ঘুমে। আমি যখন রুমে ফিরি তখন গভীর রাত ও তখন ঘুমে । একদিন সকালে ঘুম থকে উঠে দেখি আজম ক্লাসে যায়নি। কাতরাচ্ছে। ওর কপালে হাত দিয়ে দেখি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে নিচ থেকে ওষুধ নিয়ে এসে খাওয়ালাম। মাথায় পানি দিয়ে দিলাম। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আজম সুস্থ হয়ে উঠল। এর পর আজম ক্লাসে যাবার আগে প্রতিদিনই আমার জন্য টেবিলে নাস্তা রেখে যেত। রাতে আমার ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করত। এক সাথে খাবে বলে। মাঝে মাঝে বনলতার নুডলস কিংবা পিঠার বাটি রুমে এনে আজমের সাথে খেতাম। হঠাৎ দেখি একদিন আজমের মা ফোন দিয়েছে। “বাবা তুমি অনেক ভালো। তোমার জন্য দোয়া করি, আল্লাহতাআলা তোমাকে ভালো রাখুন। আজমকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা হতো। তোমার কথা শুনে আর সেই চিন্তা হয় না। আজমকে তুমি নিজের ছোট ভাইয়ের মতো দেখ। আর ঈদে অবশ্যই আমাদের বাসায় আসবা।" আন্টি অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। আজমের খরচ ওর কাছে দেবার পরেও আমার কাছে কিছু টাকা পাঠিয়ে বলতেন, ও টাকা চাইতে লজ্জা পায়। কখন দরকার হলে তুমি নিজেই দিও। একদিন আজম হঠাৎ ফোন দিয়ে বলে ভাইয়া “মা” নেই। আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারিনি।
বেশ কিছুদিন পর আজম ক্যাম্পাসে ফেরে। আমিও আবেগি প্রেমিক থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছি। দেখতে দেখতে খুবই খারাপ ফলাফল নিয়ে তৃতীয় বর্ষের ফাইনালের মুখোমুখি। এরই মধ্যে বনলতার সাথে টুকিটাকি ঝামেলা হতে শুরু হয়। একটা ঝামেলা মেটাই তো আরেকটা শুরু হয়। হঠাৎ করেই বনলতা আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আবারও আমার সবকিছু কেমন জানি উল্টে যেতে শুরু করে। সিনেমাটিক পরিবর্তন শুরু হয় আমার জীবনে। হয়ে পড়ি নেশাগ্রস্ত। কোনো দিন ঘুম ভাঙে বিকেলে। আবার দুইদিন টানা ঘুমিয়েছি এমন হয়েছে। বাসা থেকে ফোন দিয়ে আমাকে না পেয়ে আজমকে ফোন দিত মা। আজম বলত জরুরি কাজে ভাইয়া বাইরে আছে। আজম মাঝে মাঝে ক্লাস বাদ দিয়ে রুমেই থাকত। আমার কোনো কিছু লাগে কি না। আমার স্বাভাবিক হতে বেশ একটা সময় লেগে গেলো।
সকাল ১০টা। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। সারা রাত জার্নি করে এসেছি। রাতভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। ভোরের দিকে বেশ ঝাপটা দিয়ে বৃষ্টি হয়েছে। আমি আর আজম দাঁড়িয়ে আছি। আজমদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। সামনে একটা কামিনী ফুল গাছ। রাতে ফোটা বৃষ্টির সাথে কিছু ঝরে পড়েছে। এখন ফুলের মাতাল করা সুগন্ধে চারপাশটা ম ম করছে। আবার মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। অবলীলায়। কোনো ব্যস্ততা নেই। নেই ফেরার কোনো তাড়া। আজম কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। চিৎকার করে। আমাকে জড়িয়ে ধরে। বৃষ্টির ফোঁটার সাথে আজমের চোখের জল একাকার আমার কাঁধ বেয়ে নেমে যাচ্ছে।
১৫ চৈত্র, ১৪২৬ ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৮:১৪