মাস্টার সাহেব,
চোখ মেলে দেখি সাদা পরী আকাশী রঙের খাম হাতে দাড়িয়ে আছে । সামনে বিস্তীর্ন জলরাশি । সমুদ্র পাড়ের বেঞ্চে শরীর এলিয়ে শুয়ে আছি । হাতে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর “ সাঁতারু ও জলকন্যা” । সমুদ্রের ঢেউ এর আছড়ে পড়ার শব্দ আর ঝিরি ঝিরি বাতাসে খুব বেশিক্ষন বইটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি নি । কয়েকপাতা পড়তেই চোখের পাতাজোড়া এক হয়ে এসেছে । মাস্টার সাহেব ডাকটা শুনেই তন্দ্রা ভাবকেটে গেলো । আমার এক ছাত্রী আমাকে এই নামে ডাকতো । নীরা । নদীর মত শান্ত । যতটা বিনয়ী হলে একজন অপরিচিত মানুষ কাউকে সন্মান করে, ততটাই সে বিনয়ী । নীরার ধারণা আমি নীরাকে এড়িয়ে চলতাম । পৃথিবীতে অনেক রকমের মানুষ আছে । তার মধ্যে এক রকম আছে যারা অনাকাঙ্কিত ঝামেলা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য বা ঝামেলায় না জড়ানোর জন্য সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে । আমি আপাদমস্তক সেই দলের সক্রিয় সদস্য । যার কারণে নীরা কখনো জানেই নি, তার চলাফেরা, আনাগোনা, উপস্থিতি আমার হৃদস্পন্দনকে অস্বাভাবিক করে তুলতো । আমার ভাবনার বড় একটা জায়গা জুড়ে ছিল নীরা । ভাবাতো ওর ছোট ছোট করে কথা বলা কিংবা নিঃশব্দে হেটে যাওয়া । ও কখন জানেও নি আমি দূর থেকে ওর ফিরে যাবার দিকে চেয়ে থেকেছি । পরীর চুলগুলো সুন্দর করে ক্লিপ দিয়ে আটকানো । সাদা ফ্রক পরনে । বয়স কত হবে । ৭ বা ৮ বছর । পরী আমার হাতে খামটা দিয়ে , আর এক মহুর্ত দাড়ালো না । দৌড়ে চলে গেল । এই খাম আমার খুবই পরিচিত । বছরের একটা নিদির্ষ্ট মাস জুড়ে প্রায় প্রতিদিনই নীরা আমাকে এই খাম দিত । ভেতরে কয়েকটা চকলেট । খামের উপর লেখা থাকতো , হ্যাপি বার্থডে । নীরার বিয়ের পর আমি আর ওর সাথে যোগাযোগ করি নি । এমন না যে আগেও বেশ যোগাযোগ ছিল । ওর বিয়ের পর বেশ কয়েক বছর আমার অফিসের ঠিকানা প্রেরক বিহিন এই খাম এসেছে । তবে এই খামের মুখটা আটকানো না । ভেতরে চকলেট ছাড়াও একটা চিঠির অস্তিত্ব বুঝতে পারলাম । কেন জানি পরীর ফিরে যাবার দিকে তাকাতে ইচ্ছে হল না । মন বলছিল নীরা হয়ত কিছুটা দূরেই দাড়িয়ে আছে । কি মনে হল , নীরা দেখে যাক আমি তাঁর চিঠি পড়ছি । চিঠিটা বের করলাম । গোটা গোটা হাতের লেখা । পরিচিত । বেশ পরিচিত ।
মাস্টার সাহেব,
আমি কে এটা এতক্ষণে আপনার বুঝে যাবার কথা । আপনাকে আমি যতদূর চিনি তাতে করে, আমি কে এটা জানার জন্য আপনার নিউরন গুলো হয়ত খুব বেশি দৌড়াদৌডি করবে না । সকালে আপনি যখন হোটলের কাউন্টারে কথা বলছিলেন, কথার শব্দ শুনে আমার মনে হয়েছিল , এই শব্দ আমার চেনা । তারপর চাবি নিয়ে যখন লিফটের দিকে যাচ্ছিলেন , তখনই নিশ্চিত হয়েছি এটা আপনি । বেশ মোটা হয়ে গেছেন । আগের চেয়ে বেশ ধীর । মোটা ফ্রেমের চশমা নিয়েছেন । আপনার চুল বড় রাখার অভ্যাসটা যায় নি এখন । আমরা সপরিবারে ঘুরতে এসেছি । আজকে আপনার জন্মদিন আমি প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম । আপনাকে দেখে মনে পড়লো । ২০ বছর আগে আপনাকে যে চকলেট দিতাম সেটা এখানে খুজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে । খামটা আমার নিজের বানানো । আপনি যখন এই চিঠি পড়ছেন , আমি বেশ খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আপনাকে দেখছি । জানি , আপনি পিছনে ফিরে তাকাবেন না ।আর, অনেকটা সেই ভরসাই দাড়িয়ে আছি । পরী , আমার মেয়ে । আমার চেয়ে বেশি শান্ত । আপনার অনেক গল্পই পরীর জানা । প্রথম দিকে পরী ভাবতো , মাস্টার হয়তো অন্য কোন প্রজাতি । ওকে বোঝাতে বেশ সময় লেগেছে । ওর কথা , মাস্টার কেন? টিচার নাহয় স্যার বলবা । ওকে বুঝিয়েছি আমার মাস্টার সাহেব একজনই । বাকীরা শিক্ষক । আপনাকে শেষ দেখেছিলাম প্রায় ৮ বছর আগে । আপনার সাথে কথা বলার ইচ্ছে টা খুব কষ্টে সংবরণ করেছি । আপনার মনে আছে, একবার আমি খুব জিদ করেছিলাম নৌকা করে ঘুরবো বলে (যদিও এ ছাড়া আপনাকে কোথাও যেতে রাজি করাতে পারি নি ।) , আপনি নদীর পাড় পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছিলেন । খুব কান্না করেছিলাম । পরে আমার রুমমেট কে নিয়ে গেছিলাম । আপনাকে ছবি পাঠিয়েছিলাম । আপনি শুধু বলেছিলেন ভাল । আমি জানতে চেয়েছিলাম , কেন আমাকে নৌকা করে ঘুরিয়েছিলেন না । আপনি বলেছিলেন, স্মৃতি বাড়িয়ে লাভ কি । এগুলো বেশ কষ্ট দিবে । কি জানি আপনি আগেই জানতেন আজকে এই দিন আসবে হয়ত । আপনি যখন পড়াতেন মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে থাকতাম । কতটা সহজ , সাবলীল । মাঝে মাঝে ভাবতাম আপনি বোধহয় আমাকে এড়িয়ে যান, তাই পড়ানোর সময় আমার দিয়ে খেয়াল করতেন না । পরে বুঝতাম, ক্লাসে আপনি আপনার সর্বোচ্চটা দিতেন । তাই সবার দিকে সমান ভাবে লক্ষ রাখতেন । আর সেজন্যই হয়ত ছাত্রদের মধ্যে আপনার এত জনপ্রিয়তা ।
খুব ইচ্ছে হয় আপনাকে ফোন দিয়ে বলি, মাস্টার সাহেব , কেমন আছেন । পড়ানোর আগে সিগারেট খেয়ে চুইঙ্গাম চিবাতেন , সেগুলো এখনও করেন কি না । এখন একা একা খুব সকালে নদীর পাড় ধরে হাটেন কি না । বিবেকের তাড়নায় সেটা আর হয়ে উঠে না । পেরে উঠি না । সেদিন নাকি আব্বার সাথে আপনার দেখা হয়েছিল । আব্বা এসে গল্প করছিল । মা প্রায়ই আপনার কথা জিজ্ঞেস করে । ভাল লাগে এই ভেবে যে , এই মানুষগুলোর কাছে আপনাকে অসম্মানিত করি নি । সবাই আপনাকে এখন ছেলের মতই জানে । অনেক কথা বলার ছিল । বলতে পারলাম না । কথা গুলো কেমন জানি সব অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। দোয়া করি সুস্থ থাকেন ভাল থাকেন ।
নীরা
বিস্তীর্ন জলরাশির ওপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছে । সামনে ছোট বড় সব বয়সের মানুষ দৌড়াদৌড়ি করছে । কেউ ছবি তোলায় ব্যস্ত । কোন এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা ছেলে মেয়েরা গলা মিলিয়ে গান গায়ছে , “আবার এলো যে সন্ধ্যে” । আমি বসে আছি । হাতে নীরার চিঠি । “সাঁতারু ও জলকন্যার” মাঝে চিঠিখানা রেখা , বইটা দুইহাতে বুকে ধরে সমুদ্রের কিনারে এসে দাড়িয়েছি । নীরার সামনে দাড়িয়ে বলতে পারলে ভাল লাগতো , ভালো থেকো ।অনেক অনেক ভালো থেকো ।
২৪শে মাঘ, ১৪২৬।
নাজমুল ইসলাম সাদ্দাম
[ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত ।]
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:০৮