এক কোপে কল্লা ফেলে দেয়ার মতন মানুষ মজনু।
তা ফেলেও। কল্লা না ফেললেও রোজরোজই হইহল্লা ফেলে দেয় সে। মজনুর বয়স পঁচিশ। সে সারাদিন নদীর ধারে বসে থাকে। ভাটার সময় নদীর পানি হাঁটু সমান হয়। বড় নাও, ছোট ট্রলার সব এখানে সেখানে আটকে যায়। ধাক্কা দিয়ে নামানোর জন্য লোক লাগে। মজনু একাই পাঁচ জনের শক্তি ধরে, সে হেঁইয়ো বলে এক ধাক্কায় ছোট চর থেকে নৌকা-ট্রলার নামিয়ে দেয়। তার কুচকুচে কালো বাহু জুড়ে পেশিগুলো সাপের মতন কিলবিল করে। মানুষের গাছের সুপারি, আম, কাঁঠাল ডাব, তাল পেড়ে দেয় মজনু। বিনিময়ে ডাব, তাল, আম যা পায়, তা নিয়ে বাজারে বসে। তার জিনিস মানুষ কেনেও। মজনুর দিন চলে যায়। মজনু জুয়ার আড্ডায় যায়। তার হাত ভালো। সে নিয়মিত জেতে। তার টাকা পয়সাও কিছু জমেছে। খরচের জায়গা নেই। বউ বাচ্চা নেই, মা বাবা নেই। একা মানুষ। নিশ্চিন্ত স্বাধীন জীবন। মজনু রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মাটি থপথপ করে কাঁপে। মানুষজনও কাঁপে। সে কথায় কথায় চড় থাপ্পর দেয়। তার ভয় নেই, মায়া দয়া নেই। সে নির্দয়, নির্বোধ। কেউ দাঁতের ব্যাথায় কাতরাচ্ছে শুনলে মজনু তাকে অসুরের মতন চেপে ধরে দাঁত টেনে উপড়ে ফেলে, কারো ফোঁড়া হলে, দুই আঙুলের ভয়ংকর চাপে ফোঁড়া গেলে দেয়! লোকজন মজনুকে ভয় পায়, তাকে এড়িয়ে চলে। তবে আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বলে না। বরং বিপদে পড়লেই বলে, 'মজনুরে ডাক, মজনু আইলেই বুঝব কি করতে হইব?'
ফিনিক্স সাইকেল আর সিকো ফাইভ ঘড়ির কারণে হানিফ মৃধার মেয়ের বিয়ের আসর থেকে বরযাত্রী ফিরে যাচ্ছে। হানিফ মৃধা টাকার ব্যবস্থা করতে পারে নি। সে বাদবাকী জিনিসের ব্যাবস্থা করেছে। সাইকেল আর টেপরেকর্ডার ফী বছর দেয়ার অঙ্গীকারেও লাভ হচ্ছে না। ভয়াবহ অবস্থা। মজনু বর এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, 'তুমার সাইকেল আর টেপ আমি দিমু। আমার লগে ট্যাকা আছে, তয় জিনিস কিনতে গঞ্জে যাইতে হইব। অহন সুময় নাই। কাইল পরশু তুমার বাড়ি গিয়া দিয়াসমু'।
বর কিছু বলল না। কেবল ঘোঁত করে শব্দ করল। বরের বাবা বলল, 'আপনে গঞ্জ থেইকা আহেন, আমরা আপনের আহন পর্যন্ত বহি'।
মজনু বলল, 'মুই এক কথার মানুষ। কথার খেলাপ করি না। বিয়া হউক, মুই কাইল পরশু নিজে বাড়িত গিয়া দিয়ামু'।
বর এবারো ঘোঁত করল। তার ঘোঁতের শব্দ এবার প্রবল। সে ঘোঁত শব্দ করে বলল, 'আমনেরে বিশ্বাস করুম ক্যান? হেরপর যদি না আহেন? এরাতো ব্যাকেই মিছা কতা কয়, মিথ্যুক...'
বরের কথা শেষ হল না। তার মাথার পাগড়ী গিয়ে পড়ল উঠানের কাদার মধ্যে। মজনু থাপ্পর মেরেছে জোরে! বর ছিটকে পড়েছে দুয়ারের কাছে। সে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে, নতুন বরের সাথে এই আচরণ? হানিফ মৃধা কাঁপতে কাঁপতে ছুটে এল, সে মজনুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু নড়াতে পারল না। মজনু পাহাড়ের মতন অনড়। হানিফ মৃধা জামাইয়ের পা চেপে ধরে মাফ চাইতে লাগল, কাঁদতে লাগল। সময় কেটে যাচ্ছে, স্থীরচিত্রের মতন স্থীর। অনড়। অবশ। শেষ পর্যন্ত বর উঠল, সে উঠে বলল, সে বিয়ে করবে, কিন্তু সকলের সামনে মজনুকে তার পা ধরে বসে থাকতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ না হবে ততক্ষন পর্যন্ত। হানিফ মৃধা কি করবে! সে কাতর চোখে মজনুর দিকে তাকিয়ে রইল। মজনু তাকিয়ে রইল বরের দিকে। বরের চোখে স্পষ্ট ক্রোধ, প্রতিহিংসা, আসন্ন বিজয়ের উল্লাস। মজনু পরাজিতের মতন তার দিকে হেঁটে গেল। ধীরে। খুব ধীরে। তারপর পা ধরার জন্য নিচু হল। কিন্তু দ্বিতীয় থাপ্পড়ের শব্দটা হল আরও জোরে, আরও শব্দে! বর ঘরের বাইরে কাদায় মাখামাখি হল। মজনু তার কলার ধরে তুলে এনে পুকুরের পানিতে চুবাল। তারপর শামিয়ানার নিচে বসাল। তারপর কাজীকে ডাকল। ডেকে বলল, 'বিয়া পড়ান। আর কোন কথা না, একটা কথাও না'।
বিয়ে হয়ে গেল। জনা পচিশেক বরযাত্রীর লোক বিয়ে খেয়ে চলে গেল। কেউ কোন উচ্চবাচ্চ্য করল না। মজনু তারপর দিন সাইকেল আর টেপরেকর্ডার কিনে দিয়ে আসল। বর সরু চোখে কম্পমান গলায় বলল, 'মিয়া ভাই, এইগুলান লাগব না। আপনে আমার বড় ভাই, আপনের বইনেরে দিছেন আর কিছু লাগব না'।
মজনু দরাজ গলায় বলল, 'আরে নাও মিয়া, এইগুলা না নিলে থাপ্পরের কথা ভুইল্যা যাইবা। থাপ্পরের কথা মনে থাকনের দরকার আছে। এইগুলান দেখলেই মনে পড়ব। লাইফ টাইম গ্যারান্টি...'
দিন চলে যায়, মজনু মজনুই থাকে। একই জীবন, একই রুটিন। বয়সও যেন থেমে আছে। স্থীর। আচমকা একদিন ডাকাবুকা মজনু বিয়ে করে ফেলল। বউ দেখতে ভালো। গাঁয়ের রং শ্যামলা। সে মজনুকে বাঘের মতন ভয় পায়। এই ভয় মজনু তাড়াতে পারে না! রাত দুপুরে সে যখন বউকে বুকের ভেতর জাপটে ধরে, বউ তখন ভীত পাখির মতন কাঁপে। মজনু চায় বউও তাকে ভালবাসুক, শুষে নিক, চাক। কিন্তু তা হয় না, সে সন্ত্রস্ত হরিণীর মতন কাঁপে।
সেই সন্ত্রস্ত হরিণীর মত বউটা হঠাৎ মা হবে! দিন ঘনিয়ে আসছে। এতদিন কিছুতেই কিছু যেতে আসতো না যেই মজনুর, সেই ডাকাবুকো মজনু সেবার হঠাৎ ধান কাটতে গেল। তার ঘরে খোরাক দরকার, হাতে পয়সা দরকার। সে ধান কাটতে গেল সুদূর হাওর অঞ্চলে। কিন্তু তার দিন যেন আর কাটে না। সে রোজ দিন গোনে। রোজ। কোন কিছুতেই তার মন বসে না। কিছুতেই না। মজনু বাড়ি ফিরল মাস দুই পর। দুই মাস। উঠোনে পা রাখতেই মজনু থমকে দাঁড়াল। বাড়ীভর্তি মহিলারা গিজগিজ করছে। পাশের বাড়ির আমেনা বু দৌড়ে ছুটে এলো, 'পোলার বাপ আইছে, পোলার বাপ আইছে। আজান দে মজনু, আজান দে, তুই পোলার বাপ হইছস'!
মজনু কি করবে ভেবে পেল না। সে তাকিয়ে রইল খোলা বারান্দার কাপড় ঘেরা জায়গাটার দিকে। কেউ একজন কাঁদছে। সদ্যজাত শিশুর কান্না। কি তীব্র চিৎকার! কি তীব্র! রহিমা দাই কাপড়ের পুঁটলিটা নিয়ে বের হয়ে এল, 'মজনু, আগুনে গা সেইকা নে, তারপর এইহানে আয়, দ্যাখ, দ্যাখ, কে আইছে, দ্যাখ?'
মজনু সেই কাপড়ের পুঁটলির দিকে তাকিয়ে রইল। তার হঠাৎ মনে হল রহিমা দাইর কোন বিচার বুদ্ধি নেই, সে কি শক্ত হাতে কঠিন করেই না বাচ্চাটাকে ধরে রেখেছে! এতো শক্ত করে কেউ ধরে? এমন কঠিন করে! বাচ্চাটা এমন করে কাঁদছে কেন? ওর কি কোন কষ্ট হচ্ছে? প্রচণ্ড গরম পড়েছে চারপাশে। সে দাঁড়িয়ে ঘামছে। মজনুর মনে হল বাচ্চাটাকি গরমে কষ্ট পাচ্ছে, সে খানিক এগিয়ে ঠোঁট গোল করে বাচ্চাটাকে ফুঁ দিতে লাগল। যেন তার ফুঁয়ের বাতাসে বাচ্চাটার গরম দূর হয়ে যাবে। সে অদ্ভুত চোখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে রইল। কি তুলতুলে হাত-পা, চামড়া গুলো কি নরম, পাতলা! ইশ, রহিমা দাই এভাবে কেন ধরে রেখেছে! এমন শক্ত করে! বাচ্চাটা কাঁদছে! কি কষ্ট পেয়েই না কাঁদছে!
মজনু হঠাৎ আবিস্কার করল, সেও কাঁদছে! তার চোখের কোল বেয়ে উষ্ণ জলের ধারা। কিন্তু সেই জলের ধারা ছুয়েও মজনু আবিস্কার করতে পারল না, সেই নির্মম, নির্দয়, নির্বোধ, ডাকাবুকো এক কোপে কল্লা ফেলে দেয়ার মতন মানুষটা হঠাৎ কখন বাবা হয়ে গেছে!
মুহূর্তেই বাবা হয়ে গেছে!
~ বাবা/ সাদাত হোসাইন
০২/০৫/২০১৫