ভাত খেতে বসেছি। ডিম একটা, কিন্তু মানুষ দুইজন। আমি আর আমার ছোট ভাই জামান। সেই মুহূর্তে জগতের সবচেয়ে বড় সংকটের নাম এই ডিমের সুষম বণ্টন! আমি তেরছা করে ডিম মাঝখানে ছিঁড়লাম। আঁকা বাঁকা দুটি খণ্ড দুই প্লেটে রাখলাম। আমার ছোট ভাই জামান বলল, 'তোমার ভাগতো বড়'
আমি বললাম, 'কই বড় হইছে? ভাগতো সমান'।
জামান বলল, 'সমান হইলে ঐ ভাগ আমারে দাও।'
আমি বললাম, 'ভাগ করলে একটু ছোট বড় হয়ই, এইটা ধরতে হয় না'।
জামান বড় মানুষের মত গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল, 'শোন, বড় হইছ ভালো কথা, এইজন্য সবখানে অন্যায় করবা এইটা ঠিক না। আমি যদি তোমার জায়াগায় থাকতাম, আমি যদি ডিম ভাগ করতাম, তাইলে কিন্তু নিজে ছোট ভাগ রাইখা, তোমারে বড় ভাগ দিতাম, বুঝছ?'
আমি বললাম, 'তাইলে আর সমস্যা কি? তুই যেইটা করতি, আমিতো সেইটাই করছি, আমি তো বড় ভাগই নিছি। তারপরও আবার এতো কথা কস ক্যান?'
জামান হতাশ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল!
২.
রাতে ঘুমানোর সময় অদ্ভুত অবস্থা। আম্মাকে ঘুমাতে হয় সটান মুখ করে। ডানে বায়ে কাঁত হয়ে ঘুমানোর সুযোগ নেই। ডানে মুখ করে ঘুমালে বা পাশের ছেলে আকাশ পাতাল এক করে চেঁচায়, 'মুই হইছি তোমার হতি (সৎ) পোলা, তুমি ওরে বেশি আদর কর, বড় মাছ দেও, ডিমের বড় ভাগ দেও, অর দিকে মুখ কইরা ঘুমাও, সব বুঝি, সব'।
আম্মা বাম পাশে ঘুরে তার ছোট ছেলের দিকে মুখ করে ঘুমালেন, সাথে সাথে তার বাম পাশে শোয়া বড় ছেলেরও একই অভিযোগ। সে জোর করে মায়ের মুখ তার দিকে ফেরায়, ছোট ছেলে আবার তার দিকে ফেরায়, এই ফেরাফেরি চলতেই থাকে। আম্মা অতিষ্ঠ হয়ে বিছানা থেকে নেমে মাটিতে মাদুর পেতে শুয়ে থাকেন। আমি তখন জামানের গালে সপাটে চড় বসিয়ে বলি, 'দেখছত? তোর লইগ্যা, তোর লইগ্যা আম্মায় নিচে গিয়া ঘুমাইছে'।
জামান আমাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে চেপে ধরে বলে, 'তোর লইগ্যা, তোর লইগ্যা আম্মায় নিচে যাইয়া ঘুমাইছে'। এই অভিযোগ পর্ব শেষ হয় না, বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে। সাথে বাড়তে থাকে পরস্পরের মল্লযুদ্ধও। সেই নিস্তব্ধ মাঝরাতে শুরু হয় ভয়ংকর কুরুক্ষেত্র। আম্মা হঠাৎ কালবোশেখীর উন্মত্ততায় ছুটে আসেন, তারপর দুই ভাইয়ের পিঠ জুড়ে চলতে থাকে দুপদাপ বৈশাখী ঝড়। সাথে চলতে থাকে আম্মার মুখও, 'আল্লায় বেকটির (সবার) ঘরে দিছে পোলা, আর আমার ঘরে দিছে দুইখান শেমোর, এই দুইখান রে লইয়া আমি কি করমু আল্লাহ! ও আল্লাহ! ভাইর লইগ্যা ভাইর মায়া দয়া নাই, এরা বড় হইয়া...'
আমরা দুই ভাই তখন সুর করে কাঁদতে কাঁদতে একসাথেই বলি, ' মুই হইছি তোমার হতি (সৎ) পোলা, ও হইছে তোমার আপন পোলা, এইর লইগ্যা ওরে ঠিকই আস্তে মারো, আর মোরে মারো জোরে, মুই সব বুঝি, সব বুঝি, নেও মারো, মারো, মারতে মারতে মাইরা ফালাও, তোমার ধারে আর ঘুমামু না, কবরে যাইয়া একলা একলা ঘুমামু'। আম্মা অবশ্য আমাদের এই অতি আবেগিক অভিযোগে কান দেন না, দুপদাপ চলতেই থাকে। তারপর সব চুপচাপ। নিঃশব্দ। বাদ বাকী রাত আমরা দুই ভাই আম্মার দুই পাশে তার দুই হাত বালিশ বানিয়ে ঘুমিয়ে থাকি। আম্মা কারো দিকে আর ফেরেন না। তিনি ঘুমান উপরের দিকে ফিরে। আমরা ঘুমাই তার আঁচলের ঘ্রাণ মেখে। মমতার ঘ্রাণ মেখে। পরদিন ভোর থেকে দুই ভাইয়ের অসমাপ্ত যুদ্ধ আবার শুরু হয়। আবার শুরু হয় আম্মার উন্মাদিনী তাণ্ডব। এই ঘটনা চলতেই থাকে, আমাদের শৈশব, আমাদের কৈশোর। আমাদের দিন কেটে যায়, দিন কেটে যায়।
সেই সকল দিনের ভেতর কি অদ্ভুতভাবেই না মিশে থাকে জগতের শুদ্ধতম ভালোবাসারা, শ্রেষ্ঠতম অনুভূতিরা। ।