আমরা পাগলটাকে চিনতাম। মধু পাগলাকে।
আমি একটু বেশিই চিনতাম। সে আমার বিড়ি খাওয়া বিদ্যার গুরু। তার মতো করে সেই ছেলেবেলায়ই কত বার শেলফ মেইড বিড়ি বানিয়ে আড়ালে আবডালে টেনেছি! রাস্তায় পড়ে থাকা বিড়ি সিগারেটের টুকরোগুলো থেকে যত্ন করে তামাক বের করে জড় করত মধু পাগলা। পুরনো পত্রিকার দুই পাটের কাগজে সেই জড় করা তামাক মুড়ে নিত সে। তারপর সেই শেলফ মেইড বিড়ির মাথায় আগুন ধরিয়ে চোখ বন্ধ করে লম্বা টান দিত। প্রতি টানে প্রাণভরে কাশত! কাশির দমকে ঝনঝন করে বাজত মধু পাগলার অকেজো শরীরের বিদ্রোহী কলকব্জা!
মধু পাগলা রাস্তায় বেরুলে আমরা ছেলে ছোকরার দল তার পিছু নিতাম। ঢিল ছুড়তাম। মধু পাগলা মা বাপ তুলে গালাগাল দিত। আমরা সেসব গায়ে মাখতাম না। 'হৈ হৈ ছাগলা, যায় মধু পাগলা' বলে ছড়া কাটতাম, মধু পাগলা তেড়ে আসতো, আমরা দৌড়ে সরে যেতাম খানিক, তারপর আবার ফিরে আসতাম। সে এক আনন্দের দিন বটে!
মধু পাগলাকে আমরা চিনতাম!
তার গাঁয়ের রঙ কুচকুচে কালো। থুঁতনির নিচে এক গোছা দাড়ি। খালি গাঁয়ের মধু পাগলার পরনে দুই ভাঁজ করে পড়া হাঁটু অবধি লুঙ্গী। বা পায়ের বুড়ো আঙুলের নখখানা মড়া। আঙ্গুলটা থেঁতলানো। সেই থেঁতলানো আঙুল থেকে পুঁজ পড়ে। মধু পাগলা ইশকুলের বারান্দার একপাশে সারাক্ষণ বসে থাকে, ঝিমায়, আর বা হাত নেড়ে হুশ হুশ করে মাছি তাড়ায়। তার পায়ের আঙুলের পুঁজে মাছিদের রাজ্যের লোভ!
মধু পাগলাকে আমি চিনতাম।
সে ছিল মস্তবড় চোর। বাজারে দোকানীদের সামান্য অসতর্কতায় চোখের পলকে সে বিস্কুটের বয়াম খুলে বিস্কুট, চিনির বয়াম থেকে চিনি, মুড়ির টিন থেকে এক মুঠো মুড়ি কিংবা খানিক গুঁড় নিয়ে হাওয়া হয়ে যেত। কলা, মুলা, মাছ, গরুর হাড্ডি, ঢেঁকী শাক অবধি তার চুরির লিস্ট থেকে নিস্তার পায় নি। সেবার মধু পাগলা কাজী বাড়ির পাঁটা পুতা পর্যন্ত চুরি করেছিল
মধু পাগলাকে সবচেয়ে ভালো চিনত আমাদের পাশের বাড়ির পিনু।
মধু পাগলার পাগলামির সাথে চাঁদ সূর্যের কি জানি সম্পর্ক ছিল! জোয়ার ভাটায় পাগলামিটা বেড়ে যেত। পিনু সেবার রাতের অন্ধকারে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমানো মধু পাগলার সামনে গিয়ে চুপিচুপি দাঁড়ালো। সে কেবল তার লিকলিকে ডান হাতখানা মধু পাগলার থুঁতনির দাঁড়ি পর্যন্ত নিয়েছে, অমনি তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল মধু পাগলা! অন্ধকারেও তার চোখ দুখানা জ্বলে উঠলো আগুনের মতন। হিশহিশ শব্দে মধু পাগলা কষে এক লাত্থি বসাল পিনুর বুকের পাঁজর বরাবর। পিনু ছিটকে পড়লো ইশকুলের মাঠে। মধু পাগলা ষাঁড়ের মত তেড়ে এসে পিনুর বুকের উপর চেপে বসলো। তারপর পাগল পরিচয়ের স্বার্থকতা পূরণ করে উন্মত্ত মধু সপাটে কিল ঘুষি বসাতে লাগলো পিনুর বুকে। পিনুর তখন মৃতপ্রায় অবস্থা! সে দম আটকে মরেই যাচ্ছিল। তাকে বাঁচালও ইশকুলের অংক শিক্ষক আলিম স্যার আর ছাত্ররা। কিন্তু পিনু আর ভালো হল না। চিরস্থায়ী হাঁপানির রোগী হয়ে গেল! আর ঘরের মানুষ ছাড়া বাইরের কাউকে দেখলেই সে তীব্র আতংকে চিৎকার করে ওঠে।
মধু পাগলাকে আমরা চিনতাম। আমরা সবাই। আমি, পিনু, কাজী বাড়ির লোক। মুড়ি, গুঁড়, চিনি, বাদাম, কলা, মুলা, মাছ, শাকের দোকানীরা পর্যন্ত মধু পাগলাকে চিনত। সবাই চিনত। আমাদের পাড়ার সোবহান মাস্টারের পোষা কুত্তাটা অবধি তাকে চিনত। দেখলেই তীব্র চিতকারে ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে আসতো! আমরা সকলেই মধু পাগলাকে চিনতাম।
৯৮ সালের ভয়ংকর বন্যা।
বন্যায় সব তলিয়েছে। রাস্তা ঘাট, বসতবাড়ি, হাঁট-বাজার সব। গ্রামের মানুষ আশ্রয় নিয়েছে স্কুল ঘরের পাকা ছাদে। এতো মানুষ অতটুকু ছাদে কি করে ধরবে! গাদাগাদি করে নাভিশ্বাস অবস্থা! তাতেও নিস্তার কি? দূর দূরান্ত থেকে নৌকা করে মানুষ আসছেই। কি হবে কে জানে? সেদিন সারাদিন মুষলধারে বৃষ্টি। হুহু করে তীব্র স্রোতে বাড়ছে নদীর পানি। সেই স্রোত দেখলে গা হিম হয়ে আসে। নৌকার পর নৌকা মানুষ আসছে।
সন্ধ্যা বেলা বৃষ্টির সাথে সাথে শুরু হল ভয়ংকর বাতাস। নদীর পানি যেন মুহূর্তেই হয়ে গেল খুনী উন্মাদিনী। নৌকাটা আসছিল নদীর ওপার থেকে। তিন চারেক গৃহস্ত পরিবার জবুথবু হয়ে বসে আছে নৌকার পাটাতনে। শক্ত করে ধরে আছে পাটাতনের তক্তা। ঠিক এই মুহূর্তে ঝড়টা উঠলো, প্রবল ঝড়। কিন্তু ডুবিডুবি করেও নৌকাটা শেষমেশ ভালোয় ভালোয় মাঝ নদী পার হয়ে তীরের কাছে চলে এলো। তীরের হাত দশেক দূরে থাকতই বিশাল ঢেউটা আছড়ে পড়লো নৌকার গায়ে। বিশাল ঢেউ। পরপস্পরকে জড়িয়ে ধরে জবুথবু হয়ে নৌকার পাটাতনে বসে আছে মানুষগুলো। কিন্তু সবুঝ শাড়ী পড়া মাঝবয়সী মহিলাটা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, 'আমার ময়না, ও ময়নার বাপ, আমার ময়না! আমার ময়না কই? ময়নারে ঢেউ লইয়া গ্যাছে, গাঙ্গের ঢেউ লইয়া গ্যাছে, ও ময়নার বাপ, ও ময়না, ও ময়না মা, মাগো, ও মা, মা-রে'।
ময়না নামের সাত আট বছরের মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিল নৌকার গলুইয়ের কাছে। প্রবল ঢেউয়ে সে কোথাও ছিটকে গেছে! নদীতে একই সাথে তীব্র স্রোত, ভয়ংকর ঢেউ। সেই ঢেউয়ের ভেতর মেয়েটাকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কোথাও না। ময়নাকে গিলে নিয়েছে নদী। নৌকা ততোক্ষণে তীর ছুয়েছে। কিন্তু ময়নার মায়ের তীব্র চিৎকারে যেন কেঁপে উঠছে সন্ধ্যার আকাশ। নদীর দুইপাশে ক্রমশই জড় হতে থাকল বন্যাক্রান্ত অসংখ্য অসহায় শুকনো শীর্ণ মুখ। কিন্তু কে নামবে এই মৃত্যুর জলে? কার এতো সাহস? এখানে নির্ঘাত মৃত্যু!
ময়নার মা হাঁটু জলে নেমে বুক চাপড়ে চিৎকার করে কাঁদছেন। তার কান্নার জলে হয়তো দু ফোঁটা জল বাড়ছে বন্যার জলে। কিন্তু এতোটুকু সাহস বাড়ছে না কারো বুকে। কে নামবে এই সাক্ষাত মৃত্যুর জলে? এই ভয়ংকর মৃত্যুর স্রোতে?
কিন্তু কেউ একজন নামলো। ঝুপ শব্দে মানুষটা ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রবল স্রোতে। তীব্র ঢেউয়ে। সেই ঢেউ মানুষটার কুচকুচে কালো শরীরটা নিমিষেই গিলে নিল। আমরা সবাই তাকিয়ে রইলাম। সেখানে জলের স্রোত আর ঢেউ ছাড়া কিছু নেই। কিচ্ছু না।
কেবল খানিক আগে লাফিয়ে পড়া মানুষটার শব্দ ভাসছে কানে।
কেবল ঝুপ করে পড়া শব্দ!
মধু পাগলাকে পাওয়া গেল একদিন বাদে।
ঘন কাশবনের ভেতর আটকে আছে তার কুচকুচে কালো শরীর। ফুলে ঢোল হয়ে আছে। বুকের কাছে দুহাতে জাপটে ধরা মৃত ময়নার শরীর। আমরা সেই মৃত শরীর দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি, পিনু, কাজী বাড়ীর লোকেরা। দোকানীরা। সবাই। আমরা তাকিয়ে রইলাম। তাকিয়েই রইলাম। নিস্পলক। নির্জীব। নির্বাক। আচ্ছা, আমরা কি এই মানুষটাকে চিনি? এই যে কালো শরীরের কুচকুচে এই মানুষটাকে?
কে সে?
কে জানে কে সে?
আমরা শুধু মধু পাগলাকে চিনতাম
এই মানুষটাকে না।
-------------------------------------------------
মানুষ/সাদাত হোসাইন
১৮.০২.২০১৪