এই প্রাসাদে আসল-নকল মিলে এক হাজার দরজা আছে বলে এটাকে হাজার-দুয়ারী বলা হয়। সাধারণ জনগণ এর ধারণা এটা নবাব সিরাজউদ্দৌলার নির্মিত। সিরাজের নিজ প্রাসাদ ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে হীরাঝিল। এটা অনেক আগেই ভাগীরথীর ভাংগনে বিলীন হয়ে গেছে। সিরাজের মৃত্যুর ৮০ বছর পর নবাব হুমায়ুন জা নামের এক সৌখিন নবাব হাজার দুয়ারী প্যালেস নির্মাণ করেন ভাগীরথীর পূর্ব তীরে। হুমায়ুন জা ছিলেন মীরজাফর প্রতিষ্ঠিত নবাবীর অষ্টম উত্তরাধিকারী এবং বংশধর হিসেবে পঞ্চম। স্থপতি ডানকান ম্যাকলিয়দের পরিকল্পনায় ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের ধাঁচে প্রায় নয় বছর সময়ে এই প্রাসাদে নির্মাণ সম্পন্ন হয়। হাজার দরজার এই প্রাসাদের ৯০০টা দরজা সত্যিকারের। বাকি ১০০টা, শত্রুর চোখে ঝিলমিল লাগানোর জন্য।
এর এক তলায় অস্ত্রাগার গ্যালারিতে প্রায় ২৬০০টি অস্ত্র সজ্জিত আছে, তার মধ্যে এমন অস্ত্রও রয়েছে, যা পলাশি যুদ্ধে ব্যবহার হয়েছিল। এছাড়াও আলিবর্দি খাঁয়ের ব্যবহার করা তলোয়ার ও বহু নল বিশিষ্ট বন্দুক, নাদির শাহের শিরস্ত্রাণ, মীরকাশিমের ছোরা, বিভিন্ন ধরণের কামান ও ছোরা এমনকী যে ছোরা দিয়ে সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়েছিল, সেটিও ওই গ্যালারিতে ঠাঁই পেয়েছে। দোতলায় বিভিন্ন আর্ট গালারিতে মুর্শিদকুলি খাঁয়ের মার্বেল পাথরের সিংহাসন, সিরাজদ্দৌলার রূপার পালকি, পানপাত্র, চিনামাটির বিভিন্ন রকমের ফুলদানি, হাতির দাঁতের সোফাসেট ও পালকি, রূপার পালকি, নবাবদের ব্যবহার করা বিলিয়ার্ড বোর্ড, ম্যাজিক আয়না, মমি করা দুষ্প্রাপ্য পাখি। দরবার কক্ষে রয়েছে ভিক্টোরিয়ার উপহার দেওয়া ১০১টি বাতির সুদৃশ্য ঝাড়বাতি। হারুণ অল রশিদের স্বহস্তে লিখিত ১০ ইঞ্চি লম্বা ও ৬ ইঞ্চি চওড়া একত্রিশ পাতার কোরান ও আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীর পাণ্ডুলিপি। ক্যামেরা বা মোবাইল নিয়ে ঢোকা নিষেধ বলে ভেতরের কোন ছবি দিতে পারলাম না।
(২) টিকেট কেটে হাজারদুয়ারি প্রাসাদে ঢোকার মুখেই কাধের ব্যগ ক্যামেরা মোবাইল সব কিছু রেখে যেতে বলল, মনটা চরম খারাপ। কি আর করা মনের ক্যামেরায় ইতিহাসের ছবি তুলে রাখার প্রত্যয় নিয়ে ঢুকে গেলাম প্রাসাদে।
(৩) প্রাসাদের ভেতরে ঢোকার মুখেই রাখা আছে এই কামানটা, নিশ্চয়ই কোন ইতিহাস আছে এর পেছনে, সেটা অজানাই থেকে গেছে।
(৪) কয়েক ঘন্টা ভেতরে ঘুরে বাহিরে এসে দেখলাম অনেকেই ছবি তুলছে, যখন বুঝতে পারলাম শুধু প্রাসাদের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ, তখন ছুটে মেইন গেইটে গিয়ে ক্যামেরা নিয়া ক্লিকবাজীতে মত্ত হলাম।
(৫) হাজার দুয়ারির ঠিক বিপরিত পাশেই ভারতের সব চেয়ে বড় ইমামবাড়াটি। মহররম মাসের এক থেকে দশ তারিখ পর্যন্ত এটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়, তখন উপমহাদেশের বিভিন্ন যায়গা থেকে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে আসেন। মহররম মাসের শেষ দিন সকাল বেলা এখান থেকে শোভাযাত্রা বের হয়।
(৬) মদিনা। ইমামবাড়া ও হাজার দুয়ারি প্রাসাদের মধ্যিখানে রয়েছে এই মদিনা মসজিদটি। এর আকার একেবারেই ছোট। আসলে এটি মসজিদের আকৃতি বিশিষ্ট একটি ছোট্ট ভবন। এটি মূলত হযরত মুহম্মদ (সঃ) মদিনা রওজা মোবারকের অনুরূপ একটা প্রতিকৃতি। নবাব সিরাজ নিজে এই 'মদিনা'র জন্য কারবালা থেকে পবিত্র মাটি নিয়ে এসেছিলেন। মায়ের প্রতিজ্ঞা পালনে এটি করেছিলেন বলে কথিত আছে।
(৭/৮) বাচ্চাওয়ালি কামান। হাজার দুয়ারি প্রাসাদের উত্তর দিকে মদিনার পাশেই রয়েছে এই কামান। ১৬৪৭ সালে ঢাকার বিখ্যাত কর্মকার জনার্দন এটি তৈরি করেন। এর দৈর্ঘ ১৮ ফুট ও প্রস্থ ২২ ইঞ্চি। এর ওজন আনুমানিক ৭ হাজার ৬শত ৫৭ কেজি। এ কামানটি দাগার জন্য ১৮ কেজি বারুদ লাগত। শুধু একবারই এই কামান দাগা হয়েছিল। এর তীব্র আওয়াজে তখন বহু গর্ভবতী মহিলার গর্ভপাত ঘটে। সেই কারণেই এর নাম দেওয়া হয় বাচ্চাওয়ালি কামান বা তোপ। এই ঘটনায় নবাব ব্যথিত হন এবং পরে এটি আর ব্যবহৃত হয়নি।
(৯) হাজার দুয়ারি প্রাসাদ আর ইমামবাড়ার মাঝখানে বিশাল ময়দান, আর তাতে দর্শনার্থীদের বসার জন্য রয়েছে অনেক চেয়ার।
(১০) এছাড়া ইমামবাড়া ও হাজার দুয়ারি প্রাসাদের মধ্যিখানে মদিনার বিপরিতে রয়েছে একটা উঁচু টাওয়ার ঘড়ি যা এখন সচল নেই। আগে বিরাট শব্দ করে এটা সময় জানান দিত। সেই সাথে নবাব বা ইংরেজ শাসকরা এলে ঘন্টাও বাজানো হতো।
(১১) উত্তর পশ্চিম পাশ থেকে তোলা হাজার দুয়ারি প্রাসাদের ছবি।
(১২) প্রাসাদের উত্তর পশ্চিম কোনে থাকা এই কামানটার ইতিহাসও অজানা।
(১৩) একটা উৎসুক ভাট শালিক আমাদের যেন দেখছিল।
(১৪) হাজার দুয়ারির ঠিক বাইরেই ভাগীরথীর তীর ঘেষে দাঁড়িয়ে এই হলুদ মসজিদটি।
(১৫) হাজার দুয়ারির পশ্চিম দিক থেকে তোলা ছবি এটি।
(১৬) প্রাসাদের পেছনের অংশ, মানে দক্ষিণ পাশ থেকে তোলা।
(১৭) ইতিহাস খ্যাত ভাগীরথী নদী, কতো ইতিহাসের সাক্ষী এই নদী কে জানে?
(১৮) আমাদের ফুল ল্যান্টানা। দেখলে কতো আপন মনে হয়, ফুটে আছে ভাগীরথীর তীরে।
(১৯) হাজার দুয়ারির সামনে বাচ্চাওয়ালি কামানের পাশে আমি নিজে
(২০) অনেক তো হলো এবার ভাগীরথীর তীরে বসে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৪৪