মুর্শিদাবাদে গিয়ে ইতিহাস স্পর্শ করে শিহরিত হয়েছিলাম বারে বার। মনে হচ্ছিল আমার চারপাশের আকাশে বাতাসে এমনকি রাস্তার প্রতিটা ধূলিকণায় ও শুধু ইতিহাস আর ইতিহাস। তাদের মধ্যে খোশবাগে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের সমাধি অন্যতম। মুর্শিদাবাদের ভাগীরথী নদীর উপারে খোশবাগে যিনি ঘুমিয়ে আছেন অসীম নিঃশব্দতায়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী মুর্শিদাবাদ এর পলাশী নামক প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ ঊদ্দৌলার সাথে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ বণিক সংগঠন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁন এর বিশ্বাসঘাতকতা তথা বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার ইতিহাসকে হাতে ছুয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আসুন আজকে আপনাদের নিয়ে যাই আমার ছুয়ে দেখা কিছু ইতিহাসের ভেতর।
(২) মুর্শিদাবাদের সদর ঘাট থেকে এমন ফেরি দিয়া ভাগীরথী নদী পার হয়ে যেতে হয় খোশবাগের ঘাটে।
(৩) ঘাট থেকে অটো রিক্সায় করে এমন গ্রামীন রাস্তা দিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার গেলেই মিলবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমাধি।
(৪) বাম পাশে একটা বড় বটবৃক্ষ, তার নিচে ছোট্ট একটা গ্রামীন দোকান, তারই ডান পাশে খোশবাগের প্রধান গেইট। খুবই সাধারণ আর নির্জন।
(৫) ঢোকার মুখে সাধারণ একটা কাঠের বেঞ্চি, তারপর সোজা পথ চলে গেছে সমাধীগুলোর দিকে।
(৬/৭) সোজা গেলে প্রথম যে ছাদ খোলা দেয়াল ঘেরা কবরস্থানটা সামনে দেখা যায় এখানে কাদের কবর জানা হলোনা, আমরা যখন ওখানে ঢুকেছি কোথাও কোন লোকজন ছিলনা বলে তথ্য জানার কোন উপায় ছিল না।
(৮) এটা পার হয়ে আরো কিছু দূরে এগিয়ে গেলে আরো একটা কবরস্থান, এটা ছাদ দিয়ে ঢাকা। এখানেই ঘুমিয়ে আছে আলিবর্দি খাঁ, সিরাজদ্দৌলা, লুৎফাউন্নিসা সহ নবাব পরিবারের বিশিষ্টজনেরা।
(৯/১০) সামাধীক্ষেত্রের বাউন্ডারির ভেতরে পুরোটাই সুনসান সবুজে ভরপুর।
(১১) একেবারে শেষাংশে রয়েছে এই মসজিদটি, অবশ্য এখানে এখন আর নামাজ পড়া হয় না।
(১২) এই সাইবোর্ডে লিপিবদ্ধ আছেঃ নবাব আলিবর্দি খাঁ দিল্লির জামা মসজিদের অনুকরণে ৭.৬৫ একর জমির উপরে 'খোশবাগ' বা গার্ডেন অব হ্যাপিনেস তৈরি করেন। এটি চারদিকে ২৪৭১ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানকার সাজানো সুন্দর বাগানের মাঝে নবাব আলিবর্দি খাঁ, আলিবর্দি খাঁ-এর মা, সিরাজ-উদ-দৌলার বেগম লুৎফউন্নিসা এবং নবাব পরিবারের অন্য সদস্যদের সমাধি রয়েছে। তাছাড়াও, এখানে চারদিকে কারুকার্য খচিত বারান্দা দিয়ে ঘেরা চৌকাকৃতি সমতল ছাদ বিশিষ্ট ঘরের মধ্যে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সমাধি রয়েছে। এখানে চারদিকে দেয়াল বিশিষ্ট চত্বরের মধ্যে বৃটিশদের গুলিতে নিহত দানিশ ফকিরের সমাধিও রয়েছে, যিনি নবাবের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে সিরাজ-উদ-দৌলার গুপ্ত স্থান বৃটিশদের দেখিয়ে সিরাজকে হত্যা করতে সাহায্য করেছিলেন। সিরাজের মৃত্যুর পর তার বেগম লুৎফউন্নিসা ঢাকা থেকে ফিরে আসেন এবং মৃত্যুর আগে বেশ কয়েক বছর এই খোসবাগে ছিলেন, যেখানে পরে তাকে গোলাপ বাগানে সমাধিস্থ করা হয়। এই বাগানে ১০৮ প্রকার গোলাপ পাওয়া যায়। ১৭৮৬ খৃষ্টাব্দে লুৎফউন্নিসার মৃত্যুর পর তাঁকে সিরাজের পাশেই সমাধিস্থ করা হয়। বাগানের একেবারে দূরবর্তি প্রান্তে রয়েছে খোসবাগ মসজিদ। ১৭৪০ খৃষ্টাব্দে এই মসজিদ নির্মিত করা হয়। বর্তমানে আর্কিওলোজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া খোসবাগের রক্ষণাবেক্ষণ করে।
(১৩) ছাদ দিয়ে ঘেরা সমাধিগুলোর মাঝে এটাই সব থেকে বড় সমাধি দেখে আমরা ভেবেছিলাম এটাই সিরাজউদ্দৌলার সমাধি। কোন সমাধি ফলক না পেয়ে মনের ভেতরটা খচখচ করছি। সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এটাই কি জিরাজের সমাধি? উনি ১০১ পার্সেন্ট নিশ্চয়তা দিলেন, ছবি তুলে বেড়িয়ে এসে একটা ১২/১৩ বছরের বাচ্চার দেখা পেয়ে ওর কাছে তথ্যটা না পেলে আজকে হয়তো আমার ভুল ব্লগ লেখা হতো। এটা আসলে নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা আলিবর্দি খাঁ-র সমাধি।
(১৪) এটা হলো সিরাজউদ্দৌলার সমাধি, পাশেরটা সম্ভবত বেগম লুৎফউন্নিসার সমাধি।
(১৫) মাথার পাশে থাকা এই সমাধি ফলকটা দেখে মনে আর কোন সন্দেহই রইল না।
(১৬) এক সাথে নবাব সিরাজের সমাধি আর শেষাংশে থাকা মসজিদ।
(১৭) পাশের বিশাল আম গাছটায় ফুলে থাকা পরগাছা ফুলগুলো যেন এই নির্জনে আমাদেরকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল।
(১৮/১৯) খোলা যায়গায় উঁচু বেদীর উপর বেশ কিছু কবর রয়েছে, যাদের সম্পর্কে কোন তথ্যই জানা হলো না।
(২০) নবাব পরিবারের সমাধি ছেড়ে আসার সময় তোলা শেষ ছবি।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৭ সকাল ৯:২৭