(১) পুলিশে চাকুরীর সুবাধে অপরাধ দমন,আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও গোয়েন্দ প্রশিক্ষণ উপলক্ষে ৪(চার) সপ্তাহের জন্য গিয়েছিলাম খাগড়াছড়িতে। গত ৬/০৮/২০১৬ খ্রিঃ তারিখে ডিএমপি,ঢাকা হতে মনোনীত ২০ জন প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে ১৩ জন ঢাকা ফকিরাপুল হতে এস,এ পরিবহনযোগে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওয়না করি। মনে অনেক শঙ্কা/ভয় কারণ আমাদের সিনিয়রদের কাছ থেকে শুনেছি পাহাড়ী এলাকায় ম্যালেরিয়ার ভয়, পাহাড়ী সাপের ভয়, পাহাড়ী ও বাংঙ্গালীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, নিরাপত্ত জনিত ভয় ইত্যাদি আরো অনেক ভয়ের সংবাদ। এ সমস্ত একগাধা ভয় কাঁধে নিয়ে আল্লাহর উপর নিজেকে সপে দিয়ে সমতল হতে প্রথমবারের মত পাহাড়ের উদ্দেশ্য যাত্রা । যাত্রা পথে পাহাড়ী আকা-বাঁকা রাস্তা, উচু-নীচ পাহাড় বেয়ে বাস চলছিল। আমার কেন জানি মনে হল সমতলের কোন ড্রাইভার পাহাড়ী এলাকায় ড্রাইভ করতে পারবে না। পাহাড়ে গাড়ী চালানোর জন্য ঐ সমস্ত ড্রাইভারদের মনে হয় বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ আছে । কারণ একটু অন্যমনস্ক হলেই কেল্লাফতে। সমতলের বাসিন্দা হিসেবে এ প্রথম পাহাড় দর্শন । যাক দীর্ঘ প্রায় ৮ ঘন্টা ক্লান্তিকর জার্নি শেষে অবশেষ খাগড়াছড়ি টাউনের শাপলা চত্ত্বর নামক স্থানে আমাদের বাস থামলো। শাপলা চত্তর হতে টমটম যোগে পাংখাই পাড়া নামক স্থানে এপিবিএন সেম্পশাল ট্রেনিং সেন্টারের গেইটে পৌঁছলাম । মনে যা শংঙ্কা ছিল তাহাই গেইটে পৌঁছে টের পেলাম। প্রধান গেইটে সিসি ক্যামেরা বসানো,তখনই বুঝতে পারলাম এখানে যতদিন থাকতে হবে প্রতিটি ক্ষণ খুবই হিসেব করে এবং অতি সাবধানে চলতে হবে। একটু এদিক-সেদিক হলেই শৃংঙ্খলা ভংগের অপরাধে দন্ডিত হতে হবে। মূল গেইটে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। নিজের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে দৃঢ় মনোবল নিয়ে ভিতরে প্রবেশের উদ্দেশে কদম বাড়ালাম, মূল গেইট হতে ট্রেনিং সেন্টারের প্রশাসিক ভবন বেশ খানিকটা দূরে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। কিছুদূর উঠার পরে বুঝতে পারলাম আমার সমতলে চলার সাথে এখানে চলতে হলে একটু দীর্ঘ দমের প্রয়োজন। এ অবস্থায় আমার পক্ষে উপরে উঠতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল এবং আমি দম হারিয়ে ফেলছিলাম। ৩ বার বিশ্রাম নিয়ে সেই কাঙ্খিত প্রশাসনিক ভবনের সামনের বট তলায় এসে পৌঁছলাম। এখানে এসে দেখলাম আমাদেরকে গ্রহনের জন্য তাদের পূর্ব প্রস্তুুতি ছিল। আমাদের বিস্তারিত বিবরণ শুনে একজন প্রশিক্ষক বলে দিচ্ছেন কে কোন কোম্পানীতে পড়ছে, কার সীট কোথায় এবং কার এসটিসি নাম্বার কত ইত্যাদি।
(২) আমি আলফা কোম্পানীতে পড়িয়াছি এবং সীট পড়িয়াছে প্রশাসনিক ভবনের ৬ তলায়। দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমন, প্রথম বারের মত পাহাড় বেয়ে উপরে উঠার ক্লান্তিতে শরীর চলছিল না। এবার ৬ তলায় থাকতে হবে জেনে শরীরের একপ্রকার অবসাদ নেমে এলো এবং মনটাই খারাপ হয়ে গেল। যাক ট্রেনিং সেন্টারের নিয়ম বলে কথা । অনিচ্ছা সত্বেও আমার নির্ধারিত সীটে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ নিয়ে সংগীয় একজন প্রশিক্ষণার্থী (ক্যডেট) মোতালিবের সহযোগিতায় পৌঁছলাম। মোতালেব আমার ব্যাসমেট সে আমার পূর্বের রাত্রে এখানে আসিয়াছে। উপরে উঠে তার কাছে জানতে পারলাম এখানে পানির খুবই সমস্যা। পানি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় জার, বালতি,মগ ইত্যাদি প্রয়োজন। আশে পার্শ্বে কোন খাবার স্থান নেই, নিজেদেরকে ম্যাস করে খেতে হবে । এপিবিএন এর নিজস্ব যে ক্যান্টিন আছে ঐ ক্যান্টিনে প্রথম দিনে খাবার খেলাম। খাবার খেয়ে বিশ্রাম ও অপেক্ষার পালা । কর্তৃপক্ষ রাত্রে রোলকলে আমাদেরকে ট্রেনিং সেন্টারে থাকাকালীন করনীয়/বর্জনীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিবে।
(৩) এখানে এসে জানতে পারলাম সারা দেশ হতে এ প্রশিক্ষণে ২৫০ জন্য ক্যাডেট (প্রশিক্ষণার্থী) আসার কথা কিন্তু হাজির হয়েছে মাত্র ১৫০ জন। এ ১৫০ জনকে নিয়েই কর্তৃপক্ষ আমাদের ৪ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সাজিয়েছেন। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম খুবই টাইট শুধু কাজ আর কাজ এবং পড়ালেখা ছাড়া অন্য কোন চিন্তুা করার কোন সময়ই আমাদের নেই। ০৬/০৮/২০১৬ তারিখ রাত্রি ০৮:০০ টায় আমাদের প্রথম রোলকল হয়েছে। এ রোল কলে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা আমাদের সাথে পরিচয় হয়েছেন এবং নিয়ম কানুন ও নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদেরকে খুবই গুরত্বের সাথে বুঝিয়েছেন। নিরাপত্তার ঝঁকির বিষয়টি আমাদেরকেও ভাবিয়েছে। আমরা মনে করেছি সমতল হতে পাহাড়ে আসিয়াছি এখানে যে কয়দিন থাকবো এখানকার দর্শনীয় স্থান সমূহ দেখে যেতে পারবো কিন্তু নিরাপত্তা ঝুকির কারনে ইচ্ছা থাকা সত্বেও আমরা প্রশিক্ষণার্থী ক্যাডেটরা বাহির হতে পারিনি-এ জন্য মনে একপ্রকার দুঃখ রয়েছে। যাক ০৭/০৮/২০১৬ তারিখ সকাল ৯:০০ ঘটিকায় মাননীয় কমান্ডার মহোদয় প্রশিক্ষণের উদ্ধোধন করবেন জানিয়ে প্রয়োজনীয় টার্ণ আউট পোষাকে আমাদেরকে কনফারেন্স রুমে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে ঐ দিনের মত রোলকল সমাপ্ত করেছেন।
০৭/০৮/২০১৬ তারিখ উদ্ধোনী অনুষ্ঠান:
(৪) আমরা সবাই টার্ন-আউট পোষাকে সকাল ৯:০০ টায় প্রশাসনিক ভবনের নীচ তলার কনফারেন্স রুমে নিজ নিজ আসনে উপবিষ্ট হয়েছি। ঠিক ৯:৩০ মিনিটে মাননীয় কমান্ডেন্ট জনাব আওরঙ্গজেব মাহবুব সাহেব আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন। ছোট-খাটো গড়নের ব্যাটালিয়নের পোষাক পরিহিত কমান্ডেট মহোদয়কে খুবই আত্যপ্রত্যয়ী ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন দেখাচ্ছিল। উনাকে দেখেই আমরা বুঝতে পেরেছি এখানে নিয়মের বর্হিঃভূত কিছুই করা যাবে না। স্যার আমাদের সবার সাথে একে একে পরিচিত হয়েছেন এবং আমাদের ল-ক্লাস/মাঠ প্রশিক্ষণের স্যারদের সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন। উদ্ধোধনী বক্তব্যে দেশের বর্তমান পেক্ষাপটে পুলিশের উচ্চতর প্রশিক্ষণ কেন প্রয়োজন তা খুবই পরিস্কার ও সাবলীল ভাষায় আমাদের জানিয়েছেন। যেহেতু প্রশিক্ষণ মাত্র ৪ সপ্তাহের সেহেতু প্রশিক্ষণ সিডিউলও কেন টাইট করা হয়েছে তাও জানিয়েছেন। নিরঅংহকারী এ মানুষটির বক্তব্য আমরা খুবই মনোযোগসহকারে শুনেছি। ইতিপূর্বে চাকুরীর সুবাধে বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ আমার হয়েছিল কিন্তু সংশ্লিষ্ট কমান্ডেটদের গদ বাঁধা বক্তবের চাইতে এপিবিএন স্পেশাল ট্রেনিং সেন্টারের কমান্ডেট স্যারের বক্তব্য ভিন্ন মাত্রার। উনি অত্যান্ত আন্তরিক ভাবে ঠিক একজন উপযুক্ত গার্জিয়ানের মত আমাদের বুঝিয়েছেন এবং আমরাও সমস্বরে ওয়াদা দিয়েছি যে, আমরা মনোযোগসহকারে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করবো এবং নিয়মশৃঙ্খলা বর্হিভূত কোন কিছুই আমরা করবো না। জনাব আওরঙ্গজেব স্যারের যে বিষয়টি আমাদেরকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষন করেছে তা হলো তিনি প্রটোকলের নিয়ম না মেনে সরাসরি আমাদের সাথে মিশেছেন আমাদের কথা শুনেছেন এবং আমাদের সাফল্য কামনা করেছেন। যা সত্যি আমাদেরকে উৎপল্ল করেছে। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে তিনি ডিসিপ্লিনের বিষয়টিতে খুবই জোড় দিয়েছেন। কারণ প্রশিক্ষণের পূর্ব শর্তই হলো ডিসিপ্লিন। সময়মত সব কিছু সম্পন্ন করা এবং সময় মেনে চলাই প্রশিক্ষণকালীন সময় সবচেয়ে বেশী কষ্টের।
(৫) স্যারের বক্তব্যের পর ঠিক ১০:৩০ ঘটিকায় আমাদের আইন ক্লাসের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আইন ক্লাসের পরিবেশটি খুবই মানসম্পন্ন। আইন ক্লাসে ডুকেই মনে করেছিলাম যে, স্যারদের লেকচারের ফাঁকে ইচ্ছামত একটু ঝিমিয়ে নিবো। ক্লাস শুরু হয়েছে আমরাও আগ্রহ সহকারে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলো নোট করছিলাম। হঠাৎ দেখি কোন ম্যাসেজ ছাড়াই কমান্ডেট স্যার প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে পেছনের সারিতে বসে আছেন এবং মনোযোগসহকারে বাধ্য ছাত্রের মত বসে বসে লেকচার শুনছেন এবং নোট নিচ্ছেন। কমানডেন্ট স্যারকে এভাবে ক্লাসে আমাদের সাথে দেখতে পেয়ে আমাদের ঝিমুনী যে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে তা বলতে পারবোনা। দীর্ঘ ৪ সপ্তাহ অবস্থানকালে ল-ক্লাসে আমাদের আর ঝিুমুনী আসেনি, মনে ভয় ছিল যে কখন কমান্ডেট স্যার এসে আমাদের সাথে ক্লাসে বসে পড়েন ।
(৬) মাঠের প্রশিক্ষণ সম্পর্কে না বললেই নয় । আমাদের সবচেয়ে কষ্টের এবং কঠিন বিষয়টি ছিল মাঠের প্রশিক্ষণ। সত্যিকারে সোলজার হতে হলে শারীরিক ফিটনের তার পূর্ব শর্ত । ফোর্সের নাকি সূর্য কখনও অস্তিমিত হয় না এবং ফোর্স কখনও বুড়া হয় না। এ স্লোগানটি কার্যকর ভাবে প্রয়োগ ও সফলের জন্য শারীরিক ফিটনেস আবশ্যক। আমাদের মাঠটি ছিল প্রশাসনিক ভবন হতে খানিকটা দূরে একটি পাহাড়ের উপরে। ভোর ৫:১৫ মিনিট হতে সকাল ৮:৪৫ মিনিট পর্যন্ত আমাদের মাঠের কার্যক্রম চলতো। উচু-নীচু,আকা-বাঁকা পাহাড় বেয়ে আমরা প্রশিক্ষণ মাঠে যেতাম। প্রথম দিন মাঠে ঢুকেই দেখি অভাষ্টিকেল দেয়ালে লেখা রয়েছে ’’কঠোর প্রশিক্ষণ সহজ জয়’’। তাতেই বুঝতে পারলাম এখানে ফাঁকি দেয়া যাবেনা কঠোর প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আমাদের ১৫০ জন প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে প্রায় ৮০% প্রশিক্ষণার্থীর বয় সয় ছিল প্রায় ৪৮ বৎসর এর উর্ধে। বয়সই আমাদের কঠোর প্রশিক্ষণের অন্তরায়। মাঠের স্যারের খুবই আন্তরিক ও সহযোগী মনোভাবাপন্ন ছিলেন। উনারা যদি আন্তরিক না হতেন তাহলে আমারদ্বারা এ কঠোর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে সার্টিফিকেট নিয়ে আসা সম্ভব হতো না। কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে থেকে মাঠের স্যারেরা আমাদেরকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন এ জন্য আমি ব্যক্তিগত ভাবে উনাদের নিকট অত্যান্ত কৃতজ্ঞ ।
(৭) সবচেয়ে বেশী ভয় পেতাম যে দিন রোড রাণ থাকতো সে দিনকে। কারণ আমাদের প্রশিক্ষণের স্থান হতে জিরো পয়েন্টে নামক স্থানের দূরত্ব বেশী না মাত্র ১৪ কিলোমিটার এ ১৪ কিলোমিটার মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যে দৌড়ে যেতে হবে এবং আসতে হবে। রোড রাণ হতে এসে ১ পিরিয়ড প্যারেডে মিলতে হতো। যে দিন রোড রাণ থাকতো সেদিন আমাদের কলিজা পানি শুন্য হয়ে যেত কষ্টের কারণে। আর শুধু দোয়া করতাম বৃষ্টির জন্য। আল্লহর অশেষ মেহেরবানীতে বৃষ্টির কারণে আমাদের কোম্পানী ২টি রোড রান হতে রেহাই পেয়েছে। রোড রানের বিষয়টি কষ্টের হলেও উপভোগ্য ছিল। কারণ আমরা ছিলাম গোয়ালে বন্দি গরুর ন্যায়। হঠাৎ ছাড়া পেলে যা হয় আমাদেরও সে অবস্থা হতো। মোট কথা কষ্ট এবং আনন্দের মধ্যে আমাদের রোড রান শেষ হতো। আমাদের সাথে এপিবিএন স্পেশাল ট্রেনিং সেন্টারের একজন প্রশিক্ষণার্থী ছিল নাম মোঃ শফিকুল ইসলাম। আমরা মনে করেছিলাম যেহেতু শফিক এখানকার সে আমাদের চাইতে একটু বেশী সুযোগ পাবে। কিন্ত্ যখন মূল কার্যক্রম শুরু হলো তখন দেখলাম আমাদের ধারণ ভূল। আমরা যদিও একটু-আধটু ফাঁকি দিতে পারতান শফিক কিন্তুও তাও পারতোনা। তার দিকে স্যারদের নজর ছিল খুবই কড়া। বেচারার জন্য আমাদেরও কষ্ট হতো। আমাদের চাইতে তার পরিশ্রম বেশী হয়েছে । প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে সে ছিল খুবই আন্তরিক, সে ঐখানকার হওয়া সত্বেও কোনদিন আমাদের সাথে সে রকম কোন আচরণ করেনি। সব সময় আমাদেরকে অনুস্মরণ করেছে এবং আমাদের সাথে থেকে সব কিছু শেয়ার করেছে।
(৮) অলফা কোম্পানী- এ কোম্পানীর কমান্ডার জনাব দীনেশ স্যার, সিএসআই জনাব মোঃ মজিবুর রহমান স্যার, তাঁর সহকারী ছিলেন সর্বজনাব (১) জরিফুল স্যার, (২) রশিদ স্যার,(৩) আহসান স্যার। আমার আলফা কোম্পানী অন্যান্য ৩টি কোম্পানীর চাইতে একটু ভিন্ন ছিল। তার কারণ ট্রেনিং সেন্টারের নিয়মানুযায়ী এ কোম্পানীকেই যাবতীয় কার্যক্রমে সবার আগে থাকতে হবে। কোম্পানী কমান্ডার আমাদের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক ছিলেন সবকিছু সহজ সরল ভাবে নেয়ার জন্য আমাদেরকে সবসময় পরামর্শ দিতেন । আর সিএসআই স্যার যদিও কড়া ছিলেন কিন্তু আমাদের শিক্ষার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক ছিলেন। আমাদের প্রতি তাঁর পরিস্কার বার্তা ছিল মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব কাজেই আপনারা ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবেনা, আমি যা শিখাবো তা শিখে নেন এ সুযোগ আর নাও আসতে পারে এবং এ শিক্ষা আপনার চাকুরী জীবনে কাজে লাগবে। যদি তাৎক্ষনিক ভাবে তার কথাগুলো আমাদের শুনতে ভাল লাগতোনা কিন্তু কথা সত্য যা এখন বুঝতে পারছি । যখন সিএসআই স্যারের পরিবর্তে জরিফুল স্যার ও রশিদ স্যার আসতেন তখন মনে করতাম এখন একটু রেষ্ট পাওয়া যাবে, কিন্তু না উনারও আমাদের শিক্ষার ব্যাপারে কোন ছাড় দিতেন না। প্রশিক্ষক হিসাবে উনাদের কোন তুলনাই হয় না । খব্ইু আন্তরিকতার সাথে আমাদেরকে সব কিছু বুঝাতেন-সত্যি উনাদের মত প্রশিক্ষক পেয়ে নিজেকে ধন্যমনে করি। প্রশিক্ষণের মাঠে আমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশী প্রত্যাশিত ছিল আহসান স্যারের আগমন তিনি আসলেই আমরা খুশি হতাম। তিনি মিষ্টি-কটু কথার মাধ্যমে আমাদেরকে আনন্দিত রাখতেন কিন্তু শিক্ষার ব্যাপারে কোন ছাড়া দিতেন না। আরো মজার বিষয় ছিল তিনি যে দিন আমাদের সাথে রোড রাণে যেতেন সে দিন। আমরা কি উনার মিষ্টি-কটু হাসির কথা শুনবো না দৌড়াবো তা ভেবে পেতাম না, এভাবে কখন যে আমরা আমাদের নির্ধারিত স্থানে পৌছে যেতাম তা টের পেতামনা। আহসান স্যারসহ আলফা কোম্পানীর সকল স্যারকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন। আমার আলফা কোম্পানীর ক্যাডেট ও অফিসিয়ালগণ হচ্ছে যথাক্রমে- (১) জনাব দীনেশ-কোম্পানী কমান্ডার, (২) জনাব মোঃ মজিবুর রহমান-সিএসআই, (৩) জনাব জরিফুল ইসলা-প্রশিক্ষক, (৪) জনাব আব্দুর রশিদ-প্রশিক্ষক, (৫) জনাব মোঃ আহসান-প্রশিক্ষক । প্রশিক্ষনাথীগণ হচ্ছেন-প্রভাস, বাবর আলী, কুদ্দুস, রফিক, আমিনুল, সিদ্দিক, আফজাল, রহমান, আতাউর, আজাদ, সাইফুল, হেলাল, মোতালেব, সোহেল, মিজান, ফোরকান,আজিজ, শাহজাহান, কাউচার, দুলাল, ফজলু, হারুন (কাকু), শহিদ, বেলাল, সাইফুল-২, শহিদ-২, বেলাল, এমদাদ, তাহের,শফিক ও শহিদ সানু প্রমূখ ।
(৯) এ প্রশিক্ষণ হতে কি পেলাম- প্রথমেই আমি আমার কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাকে এ ধরনের একটি প্রশিক্ষণে মনোনয়ন দেয়ার জন্য । কোন প্রশিক্ষণই বিফলে যায় না এর একটা উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। এ প্রশিক্ষণের কারণে আমার শারীরি ফিটনেস পূর্বাপেক্ষায় বহুগৃন বৃদ্দি পেয়েছে। আমার দৃষ্টিভংগি, মনমানষিকতা বৃদ্দি পেয়েছে। অন্যদের তুলনায় এখন আমি আরো বেশী কার্যকরী ও পারফেক্ট পুলিশিংয়ের জন্য উপযুক্ত মনে করি। এ প্রশিক্ষণ হতে সবচেয়ে বেশী যা অর্জন করেছি তা হলো অস্ত্র চালনা করা। আমাদের কাজই হলো অস্ত্র নিয়ে অথচ এ অস্ত্র সম্পর্কেই আমরা অজ্ঞ ছিলাম। যার কারণে বিভিন্ন সময় আমাদের অনেক সহকর্মির হাতে অস্ত্র থাকা সত্বেও তারা তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত হীনতার কারণে মারা গিয়াছে অথবা অস্ত্র তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়াছে যা আমাদের জন্য অত্যান্ত লজ্জাসকর বিষয়। কমান্ডেট জনাব আওরঙ্গজেব মাহবুব স্যার নিজে উপস্থিত থেকে পুলিশ বিভাগীয় যত প্রকার অস্ত্র আছে সবুগলো আমাদের হাতে খুলিয়েছেন এবং জোড়া লাগিয়েছেন, প্রতিটি অস্ত্রের পার্সের নাম মুখস্ত করিয়েছেন যা আমার দীর্ঘ চাকুরী জীবনে পূর্বে কখন সম্ভব ছিলনা বা হয়নি। পরীক্ষা নেয়ার সময় তিনি নিজে উপস্থিত থেকে এক একটি অস্ত্রের যাবতীয় যন্ত্রাংশ একত্রিক করে একটি ড্রামে রেখে সময় বেঁধে দিয়ে আমাদেরকে পূনরায় জোড়া লাগানোর পরীক্ষা নিয়াছেন যা সত্যিকারের পুলিশিংয়ের জন্য প্রয়োজন।
(১০)কষ্টের অনুভূতি- ০৭/০৮/২০১৬ হতে ০৩/০৯/২০১৬ তারিখ পর্যন্ত স্পেশাল ট্রেনিং সেন্টারে থাকাটাই ছিল আমাদের জন্য অত্যান্ত কষ্টের, প্রতিটি মুহুর্ত মনে হয়েছে এক একটি বছর। কারণ এখানে আমি আমার ইচ্ছা মত কিছুই করতে পারতাম না। কর্তৃপক্ষের সময়সূচী মত সব কিছু করতে হতো। যা পালন করা খুবই কষ্টের ছিল। রোড-রাণ ও প্যারেড করার পর মনে হতো এখান থেকে ট্রেনিং শেষ করে যেতে পারবোনা। কারণ ছিল পাহাড়, প্রশিক্ষণ সূচী, বয়স ইত্যাদি। পাহাড়ী জীবন যে কত কঠিন তা পাহাড়ে না গেলে বুঝা যাবেনা। পাহাড়ে উঠা খুবই কষ্টের ।
(১১)আমাদের মাঝে যে কথাটি বেশী প্রচলিত ছিল- “মনে হয় ওরা আমাকে আর বাঁচতে দিবে না। কারণ আমার বয়স ৪৮,আমার শরীর বলছে তুমি যুবক নও, ধীরে চল, কিন্তু কঠোর নিয়ম কানুনের মধ্যে থেকে আমার পক্ষে ধীরে চলা সম্ভব নয়। দীর্ঘ ২৭ বছর চাকুরী করার পর অবশেষে বুঝতে পারলাম পুলিশ হওয়া এতো সহজ বিষয় নয়’’।
(১২) স্পেশাল ট্রেনিং সেন্টারের পরিবেশ ও অবকাঠামো ঃ আমার স্বল্পজ্ঞানে এ ট্রেনিং সেন্টারের পরিবেশের বিষয়টি তুলে ধরা সম্ভব নয়। পাহাড়ী ঘেরা,কোলাহল মূক্ত, প্রাকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য্য মন্ডিত স্থানের একখন্ড পাহাড়ী ভূমিতে এ ট্রেনিং সেন্টারটি অবস্থিত। যা বস্তবে চোখে না দেখলে শুধামাত্র কল্পনা বা লিখে এর সৌন্দর্য্যরে কথা বর্ণনা করা যাবেনা। কমান্ডেট স্যারের কাছ থেকে শুনেছি এটির বয়স মাত্র দেড় বছর। আমাদের আমলাতান্ত্রিক বিভিন্ন জটিলতা কাটিয়ে কমান্ডেট স্যার তাঁর সুযোগ্য নেত্তৃত্বে এখানে একটি ৬ তলা বিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন ও প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য আবাসন ভবন তৈরী করেছেন। আমাদের লজিষ্টিক বিভিন্ন সীমাবদ্ধের মাঝেও তিনি এখানে জেনারেটরের মাধ্যমে সার্বক্ষনিক বিদ্যুৎ, পানিয় জলের ব্যবস্থা, একটি অপরুপ সৌন্দর্য্য রেষ্ট হাউজ, মাঠে গমনাগমনের পাহাড়ী রাস্তা কার্পের্টিং করেছেন। আমরা থাকতেই দেখে আসছি একটি উপযুক্ত ও যুগোপযোগী ট্রেনিং সেন্টার তৈরীর অবকাঠামোগত কার্যক্রম দ্রুতগতিতে চলছে।
(১৩) সীমাবদ্ধতা-এ বিষয়টি খুবই জটিল আমরা মাত্র ২৮ দিনের জন্য গিয়াছি এখানে সমতলের চেয়ে জীবন যাত্রার মান খুবই কঠিন । কারণ বিদ্যুৎ একটি বড় ফেক্টর। জেনারেটর আরো ব্যয়বহুল বিষয়। এখানে সমতলের মত যখন যা মনে চায় তা পাওয়া খুবই কঠিন। আমাদেরকে খাওয়ার জন্য সব সময় ম্যাসের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। তবে ম্যাস কর্তৃপক্ষ খুবই আন্তরিক ছিলেন আমাদেরকে পর্যাপ্ত এবং মান সম্পন্ন খাবার পরিবেশন করেছেন। ম্যাস কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার কারণে আমাদের খাওয়ার কষ্ঠ আমরা অনুভব করতে পারিনি। আমি আমার পক্ষ হতে ম্যাস পরিচালনা কর্র্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি । ট্রেনিং সেন্টারের ক্যান্টিনটি আরো আধুনিকায়ন করা উচিত। ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষ আমাদের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন । কিন্তু ভুগৌলিক কারণে আমাদের চাহিদামত সবকিছু পরিবেশন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা।
(১৪) প্রস্তবনা ঃ
আমাদের প্রশিক্ষণ সূচীতে শারীরিক ফিটনেসকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। শারীরিক ফিটনেস প্রয়োজন আছে তার সাথে সাথে অন্যান্য ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রয়োজন। শারীরিক প্রশিক্ষণের কারণে ব্যবহারিক ও ত্বাত্তিক ক্লাসে আমরা বেশী মনোনিবেশ করতে পারিনি-কারণ ছিল ক্লান্তি। শারীরিক প্রশিক্ষণ সূচী কিছুটা কাঁটছাট করে ব্যবহারিক ক্লাস বৃদ্দি করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তাছাড়া প্রশিক্ষণকে আরো আধুনিকয়ান ও বিজ্ঞানসম্মত করা প্রয়োজন এর সাথে পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা থাকলে প্রশিক্ষণার্থীরা আরো বেশী মনোনিবেশ করতে পারবে বলে আমার মনে হয়। প্রশাসনিক ভবণ পৃথক করে আবাসনের জন্য পৃথক ভবন তৈরী করা হলে প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য সময় কিছুটা লাগব হবে। আবাসন ভবনেই গোসলের ব্যবস্থা রাখা।
(১৫) যাদেরকে মিস করছি-প্রথমেই একজন যোগ্য গার্জিয়ান (কমানডেন্ট মহোদয় স্যার), এএসপি জনাব প্রশান্ত স্যার, উপ-কমাডেন্ট স্যার,ল-ইন্সপেক্টর..............(নাম মনে আসছেনা), ল-ক্লাসের হারুন স্যার, শওকত স্যার ও অন্যান্য ল-স্যারগণ। কোম্পানী কমান্ডার দীনেশ স্যার ,ব্যাটালিয়ন মেজর-মাজাহার স্যার, মজিবুর স্যার, জরিফুল,রশিদ ও আহসান স্যারসহ অন্যান্য সকলকে। প্রশিক্ষনার্থী-ইমাম,সিরাজ, নাছির,ফোরখান, মোতালেব,শফিকুল, রুস্তম,তৈয়বুরসহ নামজানা অজানা সকল প্রশিক্ষনার্থীবৃন্দ ।
(১৬) ভয় পেতাম-প্রশিক্ষণ মাঠে যখন ডিউটি পড়তো কারণ আবাসন ভবন হতে প্রশিক্ষণ মাঠের দূরত্ব অনেক। রাত্রি বেলায় যাওয়ার সময় পাহাড়ী রাস্তা, সাপের ভয় এবং ভুতেরও ভয় ছিল। লোক মূখে শুনেছি মাঠে যাওয়ার সময় বটতলা নামজ জায়গাটি নাকি খারপ। এখানে ডিউটি করাকালে নাকি একজন পাগল হয়ে গিয়েছিল ইত্যাদি। এ স্থানটি পার হওয়ার সময় গাঁ ছম-ছম করতো।
(১৭) বর্তমান অনুভূতি- সমতল মানে নিজ কর্মস্থল ঢাকায় এসে মনে হচ্ছে ৪ (চার) সপ্তাহ খুবই ভাল ছিলাম। এখানে এসে ব্যাসমেটদের সাথে দেখা হয়েছে দীর্ঘদিন পরে। আমরা ১৫০ জন ছেলে যেন একটি পরিবারের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম। সকলের সুখ-দুঃখের অনুভূতিগুলো একসাথে শেয়ার করতে পেরেছি। এখানে সাংসারিক কোন চিন্ত ছিলনা বরং সংসারই আমাকে নিয়ে চিন্তা করেছে। আমি কিছু দিনের জন্য যেন আমার সেই ছোটবেলায় চলে গিয়েছিলাম। এখন আমাকে খুবই একা মনে হয়, সিদ্ধান্তগুলো একাই নিতে হচ্ছে। মনের কোন বিষয় কারো সাথে শেয়ার করতে পারছি না। আবারো সেই যানজট যুক্ত শহর, কর্মব্যস্থ জীবন, সকাল-বিকাল ডিউটি ইত্যাদি নিয়ে রোবটিক জীবনে প্রবেশ। নিজেকে যেন যান্ত্রিক যান্ত্রিক মনে হচ্ছে। মনে হয় আবারও সেই পাহাড় ঘেরা চির সবুজ স্পেশাল ট্রেনিং সেন্টার আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে । যদি সুযোগ থাকতো তাহলে আরো কিছুটা দিন কাটিয়ে আসতে পারলে ভাল হতো। অবশেষ বলবো আমার প্রিয় এপিবিএন স্পেশাল ট্রেনিং সেন্টার তুমি ভাল থেকো-খোদা হাফেজ।
লেখক-মোঃ শহিদুল ইসলাম
প্রশিক্ষনার্থী
আইনশৃঙ্খলা অপরাধ দমন ও গোয়েন্দা তথ্য ১ম ব্যাচ/২০১৬
এসটিসি নং-১৮
এপিবিএন স্পেশাল ট্রেনিং সেন্টার খাগড়াছড়ি।
০৭ আগষ্ট-০৩ সেপ্টেম্বর/২০১৬ খ্রিঃ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:৩২