খেলাধূলাটা এক ধরনের নেশার মতো। কেউ ঘনিষ্ঠভাবে এর সংস্পর্শে এলে তার বন্ধন কাটানো সহজে সম্ভব হয় না। দূরে সরে গেলেও বুকের মধ্যে কোথাও না কোথাও তার রেশ থেকেই যায়। আবার কেউ কেউ জীবনটাই কাটিয়ে দেন খেলার মাঠে। ক্রীড়াঙ্গন থেকে সরে থাকতে পারেন না। এটা তাদের জীবনযাপনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। কখনো খেলোয়াড় হিসেবে, কখনও রেফারী হিসেবে, কখনও কোচ হিসেবে কিংবা সংগঠক হিসেবে জড়িয়ে থাকেন খেলাধুলার সংগে। কোন না কোনভাবে মাঠের সংগে সর্ম্পটা অটুট রয়েই যায়। যে কারনে ক্রীড়াঙ্গনে কিছু মুখ আছেন যারা চিরপরিচিত। ক্রীড়াপ্রেমী এই মানুষগুলো আছেন বলেই সবসময় ক্রীড়াঙ্গন সরগরম থাকে। ক্রীড়ায় নিবেদিত প্রাণদের মধ্যে এমনই একজন হচ্ছে আমার প্রিয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব জনাব মোঃ মনিরুল হক। এ অঙ্গনের সাথে মনিরুল হকের সম্পর্ক অর্ধশতাব্দী কালেরও বেশী। জীবনের শুরুতেই সেই যে খেলাধুলার সঙ্গে নিবিড় বন্ধন গড়ে তুলেছিলেন তা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। যতই দিন গেছে ঘনিষ্ঠতা ততই বেড়েছে।
মনিরুল হকের জন্ম চাঁদপুরে ১লা জানুয়ারী ১৯৪৪ সালে । ১৯৫০ সালে ঢাকায় এসে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। ঢাকায় ৬ষ্ঠ শ্রেণী পযন্ত পড়ালেখা করে ১৯৫৩ সালে চাঁদপুরে মতলবে ফিরে যান এবং সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন মতলব স্কুলে। তিনি ছিলেন স্কুল ফুটবল দলের অধিনায়ক খেলতেন লেফটইন, রাইট ইনে। ১৯৫৮ সালে ঢাকার কায়দে আজম কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে পড়ার সময় খেলেন ইন্টার কলেজ ফুটবল।
১৯৬২ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে বছয় ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের ক্যাম্প হয়। ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারীদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের একটি প্র্যাকটিস ম্যাচ হয়। ঢাকায় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এ ম্যাচে তিনি খেলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার আগে তিনি ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে ১৯৫৮-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস দলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। ১৯৬৫ হতে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত রহমতগঞ্জ ফুটবল ক্লাবে ফুটবল খেলেছেন। ১৯৬৭ সালে তিনি পুনরায় মাদার ক্লাব ফায়ার সার্ভিসে ফিরে যান এবং ঐ ক্লাবে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত খেলে অবসর নেন।
তিনি ১৯৫৮ সাল হতে নিয়মিত ভাবে আগা খান গোল্ডকাপ ও রোনাল্ড শিল্ড খেলেছেন। ১৯৬০ হতে ১৯৬৬ পর্যন্ত চট্রগ্রাম লীগে চট্রগ্রাম ফায়ার সার্ভিসেস হয়ে এবং ১৯৬৩ হতে ১৯৬৬ পর্যন্ত কুমিল্লা লীগে ইষ্ট বেঙ্গল ক্লাবের পক্ষে নিয়মিত খেলেন। ১৯৬৩-১৯৬৪ সালে কুমিল্লার হয়ে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে খেলেন। তার দীর্ঘ ফুটবল খেলা জীবনে তিনি বিভিন্ন স্মরণী খেলা উপহার দেন।
আমার খুবই প্রিয় ব্যক্তিত্ব মনিরুলক স্যারের উজ্জল ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলেও তিনি কিন্তু বেশী পরিচিত ভলিবলের লোক হিসেবে। কারণ তিনি ভলিবলে ছিলেন আরো বেশী দীপ্তিময় ও জনপ্রিয়। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভলিবল দলের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৫৮ সাল থেকে তিনি ফুটবলের পাশাপাশি ঢাকা প্রথম বিভাগ ভলিবল লীগে খেলেন। ১৯৫৮ হতে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি শান্তিবাগ ক্লাবে খেলেন। এ সময়ে শান্তিবাগ ক্লাব লীগে ২ বার রানার্স-আপ হয়। ১৯৬৩ সালে ইষ্ট এন্ড ক্লাবে যোগদেন এবং ঐ বছর ইষ্ট এন্ড ক্লাব রানার্স আপ হয়। ১৯৬৫ হতে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে ভলিবল খেলেন। ১৯৬৫, ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে ভলিবল লীগে মোহামেডান ক্লাব হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করে। তিনি ১৯৬৬ সালে ইষ্ট পাকিস্তান ভলিবল দলের হয়ে লাহোরে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ণশীপে অংশগ্রহণ করেন।
রেফারীং ক্যারিয়ার ঃ-
১৯৬৯ সাল হতে তিনি ভলিবলের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে রেফারী হিসেব তার দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ভারতের পাতিয়ালায় ভলিবলের উপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন এবং এক বছরের প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭৪ সালে দেশে ফিরে আসেন ঝুকে পড়েন ভলিবল খেলা পরিচালনায়। ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ সফরকারী কিরঘিজস্তান ভলিবল দলের খেলা পরিচালনা করেন এবং ঐ বছরই তিনি রেফারী বোর্ড, সিলেকশন ও কোচিং কমিটির সেক্রেটারী মনোনীত হন। সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৭৮ সালে এশিয়ান গেমসের জন্য তিনি জাতীয় দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে ভলিবলের রেফারী ও জাতীয় দলের সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন ঐ গেমসে তিনি ৬টি আন্তর্জাতিক খেলায় রেফারীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৮০ সালে ভারতের মাদ্রাজে এশিয়ান ভলিবল কনফেডারেশনের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিতব আন্তর্জাতিক ভলিবল রেফারীজ প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করে সফলতার সাথে কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৮৬ সালে ভারতের হায়দারাবাদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ভলিবল খেলা পরিচালনা করেন। তিনি একধারে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দেশে ও দেশের বাহিরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খেলা পরিচালনা করেন। রেফারী হিসেবে সাফল্যজনকভাবে দায়িত্ব পালন শেষে তিনি বিভিন্ন রেফারীজ কোর্স পরিচালনা করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি সেরা রেফারী হিসেবে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি কর্তৃক মনোনীত হন।
কোচিং ক্যরিয়ার ঃ
মনিরুল হক ১৯৭৮ সালে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন। এখানেও তিনি সফল। ১৯৮০ হতে ১৯৮২ পর্যন্ত তিনি তৎকালীন ওয়াপদা, ১৯৮৩ সালে হিসাবরক্ষণ, ১৯৮৪/১৯৯৫ সালে তৎকালীন বিডিআর, ১৯৮৬ সালে বিমান বাহিনী, ১৯৮৭ হতে ১৯৯২ পর্যন্ত নৌবাহিনী ভলিবল দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে মিয়ানমারের রেঙ্গুন সফরকারী বাংলাদেশ জাতীয় দলেল কোচ এবং ১৯৯১ সালে শ্রীলংকার কলম্বোতে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে বাংলাদেশ জাতীয় ভলিবল দলের দলনেতা ও চীপ কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সাংগঠনিক ক্যারিয়ার
প্রিয় মনিরুল হক ফুটবলার, ভলিবল, রেফারী, প্রশিক্ষণ যেখানেই যে ভূমিকায় বিচরণ করেছেন সেখানেই সাফল্যের ছোয়া লেগেছে। ১৯৭৬ সালে তিনি প্রথমবারের মত বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য হন। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান যুব ফুটবলের টিকেট ও গেইট কমিটির সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে ভারতের হায়দারাবাদে আন্তর্জাতিক ভলিবল প্রতিযোগিতায় তিনি জাতীয় ভলিবল দলের সহকারী ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৮ সালে ভলিবল ফেডারেশনের যুগ্ম-সম্পাদকন হন। ১৯৮৯ সালে ব্যাংক সফরকারী জাতীয় ভলিবল দলের দলনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে শ্রীলংক সাফ গেমসের দলনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সালে ঢাকা সাফ গেমসে ভলিবলের সাংগঠনিক কমিটির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালে হতে ১৯৯৭ পর্যন্ত বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৯৮ সালে প্রথম বারের মতো ভলিবল ফেডারেশনের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হন। তার কার্যকালীন সময়কেই ভলিবলের স্বর্ণ যোগ বলা হয়ে থাকে।
১৯৯৭ সালে ফিলিপাইনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান কনফেডারেশনের জেনারেল কাউন্সিলে যোগদেন।
১৯৯৮ সালে জাপানের টোকিওতে আন্তর্জাতিক ভলিবল ফেডারেশনের জেনারেল কাউন্সিলে যোগ দেন।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশেনের সদস্য নির্বাচিত হয়।
২০০১ সালে অলিম্পিকের কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন একই সাথে ভলিবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ও কারাতে ফেডারেশনের কোষাধ্যক্ষ হন।
১৯৯৯ সালে সিঙ্গাপুর এসোসিয়েশন অব ন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির সেমিনারে অংশ নেন।
২০০৪ সালে পাকিস্তান সাফ গেমস, ২০০৬ সালে শ্রীলংক সাফ গেমসে এনসিও ডেলিগেট হিসেবে যোগদেন। ২০০১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে অলিম্পিক কমিটি অব এশিয়ান জেনারেল কাউন্সিল এবং ২০০২ সালে ম্যাঞ্চেষ্টার কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশের ডেলিগেট ছিলেন। সর্বশেষ ২০১৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সিজেডসি আন্তর্জাতিক ভলিবল প্রতিযোগিতায় সাংগঠনিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
এ প্রথিযশা ক্রীড়াবিদ ক্রীঙ্গনের যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানে সাফল্যের স্বর্ণালী সফলতা পেয়েছেন। তিনি ৩ সন্তনের জনক। তন্মধ্যে বড় মেয় অধ্যাপনা, মেঝো মেয়ে-আমেরিকা প্রবাসী এবং ছোট ছেলেকে নিয়ে তার সুখের সংসার। আমার এ ক্রীড়াবিদের জীবনী হতে আমরা শিক্ষাগ্রহণ করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে খেলাধুলায় উৎসাহিত করি। আমি এই বর্ষিয়ান ক্রীড়াবিদের সর্বাংগীন মঙ্গল কামরা করছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার সহায় হোন-আমিন।
তথ্যসূত্র-প্রথিযশা ক্রীড়া সাংবাদিক জনাব দুলাল মাহমুদ সম্পাদিত ’’স্মৃতির অন্তরালে কৃতী ক্রীড়াবিদরা’’ পুস্তক হতে সংগৃহিত।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪১