ঢাকাইয়া চলচিত্র অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম সালমান শাহ । পুরো নাম চৌধুরী শাহরিয়ার ইমন । জন্ম সিলেট জেলার জকিগঞ্জে ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ।
১৯৮৮ সালে হানিফ সংকেতের গ্রন্থনায় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান "কথার কথা" এর মাধ্যমে মিডিয়ায় তার আগমন । ‘নামটি ছিল তার অপূর্ব’ নামের একটি গানের মিউজিক ভিডিও পরিবেশিত হয় কোন এক পর্বে । হানিফ সংকেতের স্বকন্ঠে গাওয়া এই গান এবং মিউজিক ভিডিও দুটোই অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত । একজন সম্ভাবনাময় সদ্য তরুণ তার পরিবারের নানা রকমের ঝামেলার কারণে মাদকাসক্ত হয়ে মারা যায়, এই ছিলো গানটার থিম । গানের প্রধান চরিত্র অপূর্বের ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমেই সালমান শাহ মিডিয়াতে প্রথম আলোচিত হন । তখন অবশ্য তিনি ইমন নামেই পরিচিত ছিলেন ।
এরপর বেশ কয়েকটা খন্ড নাটকে অভিনয় করেন তিনি । যেমনঃ পাথর সময়, ইতিকথা, আকাশ ছোঁয়া, স্বপ্নের পৃথিবী, সব পাখি ঘরে ফেরে, সৈকতে সারস, নয়ন, দোয়েল ইত্যাদি । তিনি কয়েকটা বিজ্ঞাপন চিত্রেও অভিনয় করেন । যেমনঃ মিল্ক ভিটা, জাগুরার, কেডস, গোল্ড স্টার টি, কোকাকোলা, ফানটা ইত্যাদি ।
১৯৯৩ সালে কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার মাধ্যমে চলচিত্রে অভিষেক হয় সালমানের । প্রথম সিনেমাতেই বাজিমাত, সুপারহিট! তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন চিত্রনায়িকা মৌসুমী, প্লেব্যাক করেন আগুন । তারপর অারও চারটি সিনেমায় মৌসুমীর সাথে জুটি বাঁধেন সালমান । কোন এক কারণে মৌসুমীর সাথে তার মনোমালিন্য হয় । তারপর সালমান একে একে জুটি বাঁধেন শাবনুর, শাবনাজ, লিমা, শাহনাজ, শিল্পী, শ্যামা, বৃষ্টি সহ অারো অনেক নায়িকার সাথে । শাবনুরের সাথে সবচেয়ে বেশি (চৌদ্দটি) সিনেমায় অভিনয় করেন সালমান ।
বাংলাদেশের চলচিত্রে সালমানই একমাত্র নায়ক, যার সব কয়টি সিনেমাই চরমভাবে ব্যবসা সফল হয় । কয়েকবছরে সালমান প্রায় ২৭ টি চলচিত্রে অভিনয় করেন । অকালে মারা যাওয়ায় বেশকিছু ছবি অালোর মুখ দেখেনি ।
সালমানের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ দেনমোহর, মায়ের অধিকার, চাওয়া থেকে পাওয়া, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, অন্তরে অন্তরে, প্রেমযুদ্ধ, জীবন সংসার, প্রিয়জন, অানন্দ অশ্রু, স্বপ্নের পৃথিবী, তুমি অামার, তোমাকে চাই, স্বপ্নের নায়ক, বিচার হবে, সত্যের মৃত্যু নেই, স্নেহ, এই ঘর এই সংসার, অাশা-ভালোবাসা, কন্যাদান, শুধু তুমি, আঞ্জুমান, মহামিলন, বিক্ষোভ, সুজন সখি, প্রেম পিয়াসী, বুকের ভেতর আগুন (শেষ ছবি) ইত্যাদি ।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সালমান শাহ এর মৃত্যু হয় । প্রচার করা হয়েছিলো তিনি ফ্যানে ঝুলে অাত্মহত্যা করেছিলেন । খ্যাতির তুঙ্গে থাকা একটা লোক হঠাৎ করে কেন অাত্মহত্যা করবে; এটা ভাবনার বিষয় । সালমানের গলায় যে দড়ি পাওয়া গিয়েছিলো, ফ্যানে ঝুলানো দড়ির সাথে তার মিল ছিলোনা । সালমান যে ব্রান্ডের সিগারেট খেতেন, যেদিন রাত্রে তার মৃত্যু হয়, অন্য ব্রান্ডের সিগারেট ছিলো সেখানে । প্রতিবেশিরা জানান, ঐ রাত্রে তারা নাকি ধস্তাধস্তির শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন ।
স্ত্রী সামিরার সাথে সালমানের সম্পর্ক মোটেও ভালো যাচ্ছিলো না । মৃত্যুর আগের দিন সালমান তার মামাকে বলেছিলেন, "অামি একে তালাক দিয়ে দেব ।" আজিজ মোহাম্মদ ভাই নামের এক প্রযোজক পরিচালকের সাথে নাকি সামিরার পরকিয়া সম্পর্ক ছিলো, অথচ এই বার্মিজ মেয়েটাকে (শরিফুল ইসলাম হীরার মেয়ে) ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সালমান । সালমানের মৃত্যুর পর যে মামলা করা হয়েছিলো, সেখানে সামিরা, অাজিজ, ডন এর নাম ছিলো । তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সালমানের মা নীলা চৌধুরীর কাছে গিয়েছিলেন । তিনি সান্ত্বনা দিয়েছিলেন অতি শীঘ্রই বিচার হবে । অাজ ২০ বছর হতে চললো, কোন তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হলোনা । কয়েকদিন অাগে র্যাবকে দায়িত্ব্য দেওয়া হয়েছিল । হঠাৎ সব থেমে যায় ।
সালমান শাহ এতো জনপ্রিয় ছিলেন যে, তার মৃত্যুতে চলচিত্র অঙ্গন থমকে দাঁড়িয়েছিলো । সবার সাথে তার সুসম্পর্ক ছিলো । এরপর অনেক পরিচালক কলাকুশলী মিডিয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন । বিভিন্ন জায়গা হতে সালমানভক্ত তরুণ-তরুণীদের অাত্মহত্যার খবর অাসতে থাকে । পৃথিবীতে এমন অভিনেতা বোধহয় অার খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যার মৃত্যুশোক সইতে না পেরে ভক্তরা নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছে । আজকে যে ছেলেটা সবচে স্টাইলিশ, সালমান বিশ বছর আগেই তারচে এগিয়ে ছিলো (জাফর ইকবালের পর তিনিই সবচে স্টাইলিশ নায়ক ছিলেন) । আজও তাকে অনুসরণ করা হয় ।
সালমানের প্রতি অামার অদ্ভুত ভালো লাগা সেই শৈশব থেকেই । তার ছবি দেখে দেখে বড়ো হয়েছি । তার স্থানে আর কাউকে বসানো কঠিন । তার অভিনয়, ছবির গান অামাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো । এখন যে সব সিনেমা হয়, না থাকে ভালো গল্প, না থাকে ভালো অভিনয়, আর না থাকে ভালো গান; অথচ আগের গল্প আর গানগুলো কী সুন্দরই না ছিলো । আগে সিনেমা দেখতাম সালমানকে দেখার জন্য, তার অভিনয় দেখার জন্য, তার ছবির গান উপভোগ করার জন্য; এখন বাণিজ্যিক ধারার ছবি তেমন একটা দেখা হয়না । ছবি দেখতে হলে প্রথমে পরিচালকের নাম সন্ধান করতে হয়, কাহিনী শুনতে হয়; অতঃপর ভালো লাগলে দেখি । সালমান শাহর শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয় । সালমান বেঁচে থাকবেন লাখো ভক্তের হৃদয়ে । আজকে তার মৃত্যুদিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৫:১৪