সেদিন সন্ধ্যায় শাহবাগ থেকে বিআরটিসি বাসে ওঠেছি। মহাখালী নেমে ময়মনসিংহের বাসে ওঠবো। আমার বাড়ি ময়মনসিংহের ভালুকায়। কিছু পথ যাওয়ার পর শরীরটা হঠাৎ খারাপ করল। সারা দিনের হাঁটাহাঁটিতে অবসন্ন হয়ে পড়েছে। দম নেওয়াও খুব কষ্ট হচ্ছিল। ভাবলাম মাওনায় যাব। সেখানে তৌহিদ নামে জনৈক ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা করাও প্রয়োজন। তার সাথে অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ফোন দিলাম তাকে। তার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, আমার যাওয়ার খবরে সে বেশ খুশি। গাজীপুরের বেশ আগে বাসটা হঠাৎ থেমে গেল। বিশাল এক যানজটে আটকে গেছে! এক ঘণ্টার মতো বসে রইলাম।
যানজট ছাড়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। বাস থেকে নেমে দেখলাম এক বাস আরেক বাসকে ধাক্কা মেরে প্রায় গুঁড়িয়ে দিয়েছে। দুটো বাস রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়ানো! রাস্তা ক্লিয়ার করে বাস ছাড়তে বোধহয় আরও অনেক সময় লাগবে। চালকের সহকারীকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাস কোন পর্যন্ত যাবে?”
উনি বললেন, “সালনা পর্যন্ত।”
পাশেই একটা মাইক্রোবাস দাঁড়িয়েছিল। মাইক্রোবাসের চালক জানতে চাইলেন, আমি কোথায় যাব। যদিও মাওনা যাব, তবুও আমি বললাম, “ভালুকায়।” উনি বললেন, “কিছুদূর যাওয়ার পর গাজীপুর চৌরাস্তা। ওখান থেকে বাস পাওয়া যাবে।”
গাজীপুর চৌরাস্তার দিকে হেঁটে চলেছি আমি। এক-দেড় কিলোমিটার হাঁটার পর ঠিক কী কারণে জানি না, মাওনা যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললাম । তৌহিদকে ফোনে জানালাম, “আজকে আসতে পারছি না।” তাহলে কি আমি ভালুকায় যাব? রাত তখন প্রায় দশটার মতো বেজে গেছে। ভালুকা থেকে বাড়ি যাওয়ার আর কোনো বাহন পাব না। আমার বাড়ির দূরত্ব ভালুকা সদর থেকে ভরাডোবা, চার কিলোমিটার; ভরাডোবা থেকে বাকসাতরা, নিঝুরি, মেদুয়ারি, বগাজান, বনকোয়া পেরিয়ে আরও নয় কিলোমিটার। হঠাৎ এক বন্ধুর কথা মনে পড়ল। তার নাম মনির। কলেজে একসাথেই পড়তাম আমরা। খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। সে গাজীপুরেই থাকে। তার সাথে পাঁচ বছর কোনো প্রকার যোগাযোগ নেই। তাকে ফোন দেব কিনা ভাবছি। আবার চিন্তাও করছি, তার মোবাইল কি খোলা আছে? সে কি আগের নম্বর ব্যবহার করে? তার মোবাইল খোলাই ছিল।
২
বন্ধু মনিরের রুমে শুয়ে ছিলাম। ও আমাদের কলেজ জীবনের জনৈকা বান্ধবী সুমাইয়ার সাথে ফেসবুকে চ্যাট করছিল। চ্যাটের একপর্যায়ে সুমাইয়াকে জানাল, সড়ক দুর্ঘটনায় আমার মৃত্যু হয়েছে। সুমাইয়া প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি, কারণ, ঘণ্টাখানেক আগেই আমি ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছি বইমেলা বিষয়ে। বন্ধু মনির তাকে বলল, “কিছুক্ষণ আগেই দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। বইমেলা থেকে আসার পথেই।”
মনিরকে খুব বকাঝকা করলাম। ভুল বুঝতে পেরে ও সত্যি কথাটা বলে দিতে চাচ্ছিল সুমাইয়াকে। রাগ করে আমি না করলাম, কারণ, কথাটা আমিই সুমাইয়াকে জানাতে চাচ্ছিলাম, যাতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি না হয়। কিছুক্ষণ পর থেকে গণহারে ফোন আসা শুরু হলো আমার ফোনে। ঘটনা বুঝে ফেললাম, আমার মৃত্যুসংবাদ ততক্ষণে ভাইরাল হয়ে গেছে! মনিরকে বললাম, “তুমি যে ভুল সংবাদ দিয়েছ, সুমাইয়াকে এখন তুমিই জানাও।” সে তাই করল। সুমাইয়া তার সাথে খুব রাগারাগি করল, বলল; “এমন মিথ্যে কেউ বলে! আমি তো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দিয়েছি।”
ফেসবুকে ভার্সিটির গ্রুপে স্ট্যাটাস দেওয়া মানে বহুলোক জেনে যাওয়া। ইতোমধ্যে অনেকে জেনেও গেছে। সুমাইয়া সাথে সাথে স্টাটাসটা মুছে দিল। তারপরও বন্ধুদের সংশয় যায় না। সবার সংশয় দূর করতে আমি নিজেই ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে দিলাম এই বলে যে, আমার কিছুই হয়নি। সুমাইয়া আমাকে ফেসবুকে নক করল, “এমন দুষ্টুমি কেউ করে?”
আমি বললাম, “আমি তো কিছুই জানতাম না। তুমি নিশ্চিত না হয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে দিলে কেন?”
সে বলল, “এমন সিরিয়াস বিষয় নিয়ে যে মনির মজা করবে, আমি তা ভাবতেই পারিনি। প্রথমে আমি তো বিশ্বাসই করিনি। আপার সাথেও কথা বললাম তোমাকে নিয়ে। বড়ো ভালো ছেলে ছিল। আজ মারা গেছে। সব শুনে আপাই বলল, ঘটনা বোধহয় সত্যি।”
আমি বললাম, “তোমার আপুকে আমার সালাম দিও।”
সে বললো, “ঠিক আছে। জানাব।”
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৭