তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসটা মাত্রই শেষ করলাম। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ এর পর আমার সবচেয়ে ভালো লাগা উপন্যাস এটা। শ্রীকান্ততে যে অসম্পূর্ণতা ছিল, এখানে সে অসম্পূর্ণতা নেই- বাড়তি যোগ হয়েছে বিরহ, বুকফাটা আর্তনাদ।
চোর-ডাকাত বংশের ছেলে নিতাইচরণের কবিয়াল হিসেবে আত্ম-প্রকাশ ঘটে। এলাকাতে তার কবি-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন মেলায় সে গান করে। এতে তার মন ভরে না। তার স্বপ্ন- সে অনেক বড় কবি হবে।
এক বাড়িতে সে কাজ করে। সেখানে অনৈতিক কাজ তার ভালো লাগে না। কাজ ছেড়ে পালিয়ে যায়। হঠাৎ বন্ধু রাজার কথা মনে পড়ে। রাজার কাছেই গিয়ে ওঠে নিতাই। রাজা রেলস্টেশনে কুলির কাজ করে। নিতাইও কিছুদিন এই কাজে থাকে। কিন্তু এতে তার মন বসে না। সে গানের পালা খুঁজতে থাকে। এ ক্ষেত্রে রাজা তাকে সাহায্য করে।
রাজার শ্যালিকা ঠাকুরঝিকে তার ভালো লাগে। তার জন্য মন কেমন কেমন করে! ঠাকুরঝি নিতাইকে দুধ দেয়। পয়সা ফুরিয়ে যাওয়ায় নিতাই দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিতে বলে। কিন্তু ঠাকুরঝি দুধ দেওয়া বন্ধ করে না। তাকে বিনে পয়সায় দুধ খাওয়ায়।
রাজা ঝুমুরের দল নিয়ে আসে, তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে; জলসার আয়োজন করে। বসন্ত, ললিতা, নির্মলা, বেহালাবাদকসহ অনেকের সাথে পরিচয় হয় নিতাইয়ের, তাদের সাথে গানও করে সে। ললিতা, নির্মলা নিতাই ও বসন্তকে নিয়ে মশকরা করে। ঝুমুরের দল একসময় চলে যায়।
ঠাকুরঝির খুব অসুখ করে। রাজা ও নিতাই তাকে দেখতে যায়। ঠাকুরঝি ঘুমের ঘোরে বলে সে নিতাইকে ভালোবাসে। এ নিয়ে হুলস্থূল কাণ্ড বেঁধে যায়। নিতাই ঠাকুরঝির মঙ্গল কামনায় রাজার আশ্রয় ত্যাগ করে। রাজা বাধা দিয়েও তাকে ফেরাতে পারে না।
বসন্তের কাছে চলে আসে নিতাই। কবিয়ালের অনুপস্থিতিতে সে-ই ঝুমুর দলের কবিয়াল হয়। বসন্তের সাথে তার সম্পর্ক হয়। ঠাকুরঝির জন্যও মন কাঁদে তার।
বসন্ত খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। নিতাই দিনরাত তার সেবা- শুশ্রুষা করে। বসন্ত সুস্থও হয়। কিন্তু একসময় মারা যায় বেচারি।
নিতাই ঝুমুরের দল ছেড়ে কাশী চলে যায়। সেখানে এক মহিলার সাথে পরিচয়। মহিলা তাকে আদর-যত্ন করেন। মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে পথে পথে গান গায়। একমাস সেখানে অবস্থান করে। সেখানেও তার মন বসে না। দেশে চলে আসতে মনস্থির করে। ট্রেনে চড়ে কত কথাই ভাবে। সে-ই গ্রামের কথা, মায়ের কথা, রাজার কথা, ঠাকুরঝির কথা।
রেলস্টেশনে এসে দেখে ভিড় জমে গেছে। বিপ্রপদ মারা যায়। তার জন্য নিতাই কাঁদে, কাঁদে এত পরিচিত মানুষ দেখেও। বটতলায় বসে রাজার কাছে ঠাকুরঝির কথা জানতে চায় নিতাই। রাজা জানায় ঠাকুরঝির মারা যাওয়ার কথা। নিতাই চলে যাওয়ার পর ঠাকুরঝি নাকি খুব কেঁদেছিল, পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল।
নিতাই রাজাকে দেবীর কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। দেবীর কাছে তার প্রশ্ন, "জীবন এত ছোট কেনে?
এই খেদ আমার মনে-
ভালোবেসে মিটল না সাধ; কুলাল না এ জীবনে।
হায়, জীবন এত ছোট কেনে
এ জীবনে"!