মনমাঝি আইসা বৈঠাডারে ধরে, বৈকালে বইসা বৈঠা ধইরা সে বইকালিক কথা কয়। ভাঙ্গা বারবার পিছন ফিরা চায়। তার খ্যাতাডা এখনো শুকায় নাই। বুড়ির নাতজামাইটারে কই শুইতে দিবে ভাইবা পায়না সে। তার চেয়ে বড় কথা ভাঙ্গার বাপে বাড়িত নাই। খাওন রোজগার কিছু নাই দেইখা উনি বাড়ি ছাইড়া চইলা গেছে। নদীর বানে ভিটা ডুইবা যাওয়ার পরই সে চইলা যায় আর তখন থেইকা এই ছইওলা নৌকাডারে ঘর বানাইয়া তার ভিতরে ভাঙ্গা থাকে। ভাঙ্গার মনে অশান্তি লাগে। জোয়ান শরিরটা নিয়া সে খুব সাবধানে রইচান্দের বাড়িতে যট্টুক পারে কাজ-কাম খাটে আর যা জোটে তাই খায়। এখন এই সময় কোত্থেইকা এই জ্ঞানী মেমান আইলো আর দাদীর বাপের বাড়ির নাতি কইয়া গল্প শুরু করলো সে কিছু বুঝতাছেনা।
লোকটার কথা বলার এমন বাহার আর দাদীর সম্পর্কে অনেক কিছু এত শুদ্ধ কইরা বলতাছে যে ভাঙ্গা জোর গলায় কিছু বলার সাহসও পাইতাসেনা। খারাপ ব্যাবহারের কিছু কথা মুখে আইসাই মিলায় যাইতাসে। লোকটার নাম নাকি মনমাঝি। ভাঙ্গা জীবনেও এমন নাম শুনে নাই। মনমাঝি কয়, ' ভাঙ্গা, তুমি কি জানো, তোমার দাদীর সঙ্গে যে আমার দাদার দারূন প্রেম ছিলো, দাদা বেঁচে থাকতে আমাকে গল্প শুনিয়েছিলেন।' ভাঙ্গা উত্তর দেয়, ' ছিঃ মরা মানুষদের নিয়া খারাপ কথা কইতে নাই, হুনতেও নাই ।'
মনমাঝি একটু অবাক হইয়া তাকাইলো, তারপর হাসি দিয়া কইলো, ' খারাপ কথা হবে কেন, প্রেমের চেয়ে সুন্দর এবং পবিত্র পৃথিবীতে কিছু নেই। ওই যে দেখ, পানিতে ডুবতে থাকা সূর্যটার কি চমৎকার লাল দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, একটু পরে ঝলমলে চাঁদও উঠবে দারূন প্রেম মাখিয়ে নিয়ে। চাঁদ সূর্য একসাথে থাকেনা কিন্তু দুজনার মধ্যে প্রেম আছে বলেইতো চাঁদ সূর্যের আলোয় এত ঝলমল করে'। ভাঙ্গারে যেন জ্বিনে ধরসে, সে জাদুমন্ত্রের মত মনমাঝির কথাগুলি শোনে আর দাদীর কথা ভাবতে থাকে। তার দাদী খুব সুন্দর গান গাইতে পারতো। কত প্রেমের গান যে দাদী সুর কইরা গাইতো, সেইসব গান ভাঙ্গা আর কোথাও শোনে নাই। এখন তার মনে হইতেসে দাদী নিজে সেইসব গান বানাইসে। ভাঙ্গার মনে কি জানি হইলো। সে মনমাঝিরে কইলো, ' রাইতে না ঘুমাইলে কি আপনের বেশি অসুবিদা হয় ?' চোখ দুইডা একটু ছোট কইরা মনমাঝি কইলো, ' না, কেন বলতো?' ভাঙ্গা হাসি দিয়া কইলো, ' একটু দূরে নদীর মধ্যে একটা চর আছে, রাইত নিশুতি হইলে দাদী মাঝেমইদ্দে সেই চরের ফকফকা জোসনা দেখতে যাইতো, আমি নাও বাইয়া লইয়া যাইতাম। এতক্ষনের মধ্যে এই প্রথম ভাঙ্গা একটু হাসি দিছিলো। লোকটা চরে যাওয়ার কথা কিছু না বইলা কইলো, ' তোমার হাসিটা অনেক সুন্দর ভাঙ্গা, কেন সবসময় মেজাজ এত তিরিক্ষ রাখো?' ভাঙ্গা সেই কথা শুইনা লজ্জা পাইলো কিন্তু মুখে কিছু বললোনা। মনে মনে বললো, যদি মেজাজ তিরিক্ষি না রাখতাম অবলা পাইয়া এই জোয়ান শরীর কবেই ছিড়া ফালাইতো শিয়ালগুলা।
ভাঙ্গা আজ রইচান্দের বাড়িতে একটু পোলাও এবং একটুকরা মুর্গীর মাংস পাইছিলো। কিন্তু এইসব ভালো লাগেনা বইলা সে শুধু একবাটি বাসি ভাত নিয়া আসছিলো আর নৌকায় আইসা কুপির আগুনে শুঁটকি পোড়া দিয়া হাতে কচলাইয়া ভর্তা বানাইছিলো। মুখ নিচু কইরা সেইটাই আগায় দিলো মনমাঝির দিকে। মনমাঝি বাটিটা হাতে নিয়া ভাঙ্গার দিকে তাকাইয়া আবসা একটা হাসি দিয়া কইল, ‘ লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই ভাঙ্গা, এমন ধরনের শুঁটকি ভর্তা খাওয়ার ইচ্ছা আমার অনেকদিন থেকে ছিল, দাদার মুখে তোমার দাদির হাতের ভর্তার গল্প শোনার পর থেকে। আজ তুমি সেটা করে দিলে'। ভাঙ্গা লোকটার যত কথা শোনে ততই অবাক হয়। খাওয়া শেষে ভাঙ্গা মনমাঝিরে নিয়া চরের দিকে যায়। ভাঙ্গা শুধু দিক বইলা দিতাছিল আর বৈঠা মনমাঝির হাতেই আছিল।
সত্যি চরে ফকফকা জোসনা নামছে। আইজ পূর্ণিমা মনমাঝি সেইটা জানতো কিন্তু ভাঙ্গা জানতোনা। সে আন্দাজে নিয়া আইছিলো, যদ্দুর জোসনা থাকে থাকবো। এখন ভরা জোসনা দেইখা মনডা খুশি হইয়া গেলো। চরের মাঝখানে একটুখানি সাদা কাশফুল ফুইট্টা রইছে। সাদা জোসনার মইদ্দেও সাদা রঙ বোঝা যাইতাছে। ভাঙ্গা ভাবে আল্লাহর দুনিয়ায় এক রঙের যে কত ঢং হইতে পারে। সে পিছনে তাকায় দেখে মনমাঝি নাই। এদিক ওদিক তাকাইতেই দেখে ডাইনদিকে নদীর ধারে গিয়া মনমাঝি কি জানি দেখতাসে। সেও আগায় যায়, কয়, কি দেখেন? মনমাঝি কইল, ‘ দেখো ভাঙ্গা, পানিতে কি সুন্দর গোল চাঁদ দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে ওটা পানির ভেতরেই আছে, হাত দিয়ে তুলে আনা যাবে'। সত্যি স্থির পানিতে কি সুন্দর দেখা যাইতাসে। ভাঙ্গা নৌকায় থাইকা আগে কতবার চাঁন দেখসে কিন্তু আজকা ক্যান জানি লোকটার কথা শুইনা বেশি ভাল্লাগতাসে। তারা নদীর পার ধইরা হাটতে শুরু করল। মনে হইতাসে চাঁনটাও তাগো লগে যাইতাসে।
মনমাঝি হঠাৎ ভাঙ্গার হাত ধরল। সাথে সাথে ভাঙ্গার শরীরে কি জানি হইয়া গেলো। একা থাকে দেইখা এর আগে বহু শেয়ালই তার গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু নিজের তিরিক্ষি মেজাজের সাথে সবচেয়ে খারাপ গালিগালাজ আর দাও বটি দিয়া সে তাদের খ্যাদাইসে। তার গায়ের জোরও কম না। কিন্তু আইজ ভাঙ্গার শরীর যেন এক্কেবারে নরম হইয়া গেলো, সে কিছুই বলতে পারলনা, কোন বাঁধাও দিতে পারলনা। এমনভাবে মনমাঝি ভাঙ্গার দিকে তাকাইসে, ভাঙ্গা তাকায় থাকতে পারলনা, চোখ নামায় নিল। ভাঙ্গার মনে হইতাসে এই লোকটা সত্যি তার মনের মাঝি। মনমাঝি জড়ায় ধরল ভাঙ্গাকে। ভাঙ্গার জীবনে কোনোদিন এত ভালো লাগে নাই। সেই রাতে তারা গভীর মিলনে ভাইসা গেলো। ছোডবেলা থেইকা ভাঙ্গার এই ভাঙ্গা জীবনে সে কোনোদিন এত সুখ পায় নাই। ভোর হইতে বেশি দেরি নাই। মনমাঝি কইল, তারে তাড়াতাড়ি গিয়া ট্রেন ধরতে হইব। ভাঙ্গার প্রশ্নভর্তি চোখের দিকে তাকাইয়া সে কইল, বাড়িতে গিয়া সবকিছু ঠিক কইরা সে ভাঙ্গারে আইসা নিয়া যাইব খুব তাড়াতাড়ি। ভাঙ্গার মন কেমন জানি করতাসে, তবু সে মনমাঝিরে বিদায় দিলো।
এরপর দিনের পর দিন যায় মনমাঝি আর আসেনা। প্রতি পূর্ণিমায় ভাঙ্গা পানির ভিতরে চাঁন দেখে আর ভাবে, চাঁন-সুরুজ একলগে থাকেনা কিন্তু তারা প্রেম করে বইলাই চাঁন এত সুন্দর। ভাঙ্গা বোঝে মনমাঝির মত জ্ঞানী মানুষের সাথে তার স্বামী-স্ত্রীর মত থাকা এই সমাজে মানায় না, তাই হয়তো মনমাঝি আর আসে নাই। কিন্তু তাদের এক রাতের প্রেম মিছা আছিলনা। মাঝে মইদ্দে কষ্ট লাগলেও তাই ভাঙ্গার কখনো রাগ হয়না। সে এখন বোঝে ভালবাসা কি, মানুষের সঙ্গে নরম কইরা কথাও বলে। এই সেদিন কলিম্মুদিন তারে বিয়ার প্রস্তাব দিসে। খুব তাড়াতাড়িই হয়তো তারা বিয়া করবো এবং তারপর ভাঙ্গা তার দাদির মত আপন মনে গান ভাইজ্জা সংসার কইরা যাইব।
বিঃদ্রঃ- গল্পটা ২০১৪ তে লেখা আমার প্রথম গল্প আর ছবিটা আমার তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৫৮