71 সালের মাঝামাঝি কোন একটা সময়। আমার স্মৃতিশক্তি বিট্রে করছে ইদানিং আমার সাথে, নাহলে তারিখটা সহ-ই বলা যেতো। আমাদের মাধবদী এলাকায় যুদ্ধে লিপ্ত আছে কয়েকটা মুক্তিসেনার গ্রুপ। তেমনি এক গ্রুপের কমান্ডার আনোয়ার। ভীষন সাহসী আর নির্ভিক। আলগী নামক গ্রামে এক অপারেশনে আসে। এই আলগী গ্রামের অবস্থান মাধবদী বাজার থেকে খুব বেশী দূরে নয়। মাধবদী বাজারে অপারেশন চালানোর জন্য কান্দাপাড়া আর আলগী গ্রামের অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।
নুরালাপুর হয়ে আনোয়ারের গ্রুপ আলগী ভুঁইয়া বাড়িতে অবস্থান নেয়। পাক-হানাদারদের ভয়ে আলগী গ্রাম প্রায় ফাঁকা তখন। আলগী গ্রামে তখন ইতস্ততঃ ঝোপঝাড় আর জঙ্গল। একটা বড়, মাটির রাস্তা এঁকে বেঁকে মাধবদী বাজারের দিকে চলে গেছে।
ভুঁইয়া বাড়ির দোতলা দালানটিতে গড়ে ওঠে আনোয়ারদের আস্তানা। উদ্দেশ্য, এখান থেকেই আস্তে আস্তে মাধবদী বাজার মুক্ত করে সামনে পাঁচদোনার দিকে এগুবে তাঁরা।
সব প্ল্যান ঠিক হয়। কবে অপারেশন হবে, কে কোথায়, কোনদিক দিয়ে অতর্কিতে হামলা চালাবে, সবকিছু। অপারেশনের আগের রাতে, যখন সবাই গভীর ঘুমে। তখনই হঠাৎ বুটের ধুপধাপ আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আনোয়ারদের। কিছু বুঝার আগেই বাড়িটি তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে পাক সেনারা। বাকি একদিকে কাঁটাবন। লম্বা চাবুকের মতো লতার সারা গায়ে কাঁটা। ঐ কাঁটার ঘন জঙ্গল ছিলো সেদিকটায়। কয়েকজন ঝুপ ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ে সেই কাঁটায়। কোন মতে সারা শরীর ছিলে বের হয়ে দৌড়ে চলে যায় ডৌকাদীর দিকে। পালাতে পারে না আনোয়ার সহ কয়েকজন। আটকা পড়ে তারা।
ঘরে ঘরে তল্লাশী হয়। পাওয়া যায় যুদ্ধের নানা সরঞ্জাম। "সাক্ষাৎ মুক্তি"- প্রমাণিত। এগিয়ে আসে রশীদ, রাজাকার রশীদ নামে যিনি এখন সর্বাধিক পরিচিত। মাধবদীর অদূরে বাগবাড়ি নামক জায়গায় যার বাড়ি। তার নির্দেশে বেঁধে ফেলা হয় আনোয়ার আর তাঁর সঙ্গীদের। আনোয়ার শুধু একবার বলে, "আপনে না আমার চাচতো ভাই...! আপনে এই জালিমগো হয়া আমারে মারোনের লাইগ্যা লইয়া যাইতাছেন, রশীদ ভাই? অহনো সময় আছে আমরা ইচ্ছা করলেই এগোরে শ্যাষ কইরা দিতাম পারি...।" রাজাকার রশীদ তখন আনোয়ারকে ধমক দিয়ে বলে, "দেশের লগে গাদ্দারী করছস তুই। এহন তোরে মায়া কইরা আমি মরমু নিহি"?
বাড়ির নিচে কাঁঠাল গাছের সাথে বাঁধা হয় তিনজন মুক্তি সেনানী কে। তারপর রাজাকার রশীদের নির্দেশে তাঁদের বুক বরাবর চালানো হয় গুলি। গুলির ধাক্কায় দেহ গুলো লাফিয়ে ওঠে, রক্তে ভেসে কাঁঠাল গাছের তলা...। রশীদেরা ফিরে যায় একসময়। আনোয়ারদের লাশ ফেলে রেখে যায় রক্তের নালায়।
আমি যতোবারই ঐ বাড়িটির সামনে দিয়ে যেতাম, ততবারই মনে হতো- হয়তো ঠিক এখানটাতেই পড়েছিলো আনোয়ারের মুক্তিকামী শরীরটি, হয়তো এখনো তিনি ঘোলা চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে এক জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে। আমি, স্বাধীনতা-উত্তর এক প্রজন্ম, কী-ই বা করতে পেরেছি আনোয়ারদের জন্য?
কিছু যে করিনি তাও তো নয়। যখন সেভেনে পড়ি তখন রশীদ রাজাকারের ছোট ভাই আমাদের বাড়িতে আসে। আমি সবার সামনেই চিৎকার দিয়ে বলেছিলাম, "তোমার ভাই একটা রাজাকার..."। প্রবল শাসনের ভেতর রাখা আমার মা আমার এমনতর 'ঔদ্ধত্বে' সেদিন কিছুই বলেনি। কেউ যদি ঢাকা থেকে সিলেট গেলে পাঁচরূখী বাজারের পর একটা জায়গায় 'উট মার্কা ঢেউটিন'-এর কারখানা দেখতে পাবেন। জায়গাটার নাম বাগবাড়ি। লোকাল বাসের এখানে একটা স্টপেজ আছে, "রশীদ রাজাকারের বাড়ি"। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর মনে হয় স্টপেজটা ঐভাবে আর বলে না কেউ।
লোকটি এখনো জীবিত যে!
====================================
কিং অফ জি্বনস- আমার এখানে মার্চ মাস বিদায় নিতে এখনো পুরো দুই ঘন্টা ঊনত্রিশ মিনিট বাকি!