প্রফেসর জাহিদ হাসান নিজের রুমে বসে আছেন। তার সামনে তার ছাত্র শরিফুল।
ছেলেটার বয়স খুব একটা বেশি না, সবে সেকেন্ড-ইয়ার, সেকেন্ড-সেমিস্টার পার করছে। অত্যন্ত সাধারণ চেহারার নিরীহ ভঙ্গিতে বসে থাকা ছেলেটি- ছাত্র হিসেবে অসাধারণ। প্রফেসর হাসান তার দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে এতো শার্প স্টুডেন্ট দেখেছেন বলে মনে করতে পারেন না।
সেই ফার্স্ট ইয়ারেই তিনি শরিফুলদের কোয়ান্টাম ফিজিক্স-১, ২ কোর্সদু’টি পড়াতেন। আর সে কোর্সগুলোর সুবাদেই শরিফুলের সাথে তার জানাশোনা; সেই সময় থেকেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতন এতো ‘এবস্ট্রাক্ট’ একটা বিষয়ে ছেলেটির দক্ষতার পরিচয় পেয়ে তিনি বিস্মিত। বলা বাহুল্য- অন্য কোর্সগুলোর অবস্থাও অনেকটা একই রকম; প্রফেসর হাসান অতটা বিস্তারিত না জানলেও এটুকু অন্তত জানেন যে- বাকি শিক্ষকদের মাঝেও শরিফুলকে নিয়ে বেশ ভালো রকমের উচ্ছ্বাস আছে।
তবে আজকে নিজের রুমে ছাত্রকে ডেকে পাঠানোর কারণটা ঠিক উলটো! এই সেমিস্টারে তিনি তাদের স্ট্যাটিস্টিকাল মেকানিক্সের প্রাথমিক কোর্সগুলো করাচ্ছেন। ফার্স্ট-সেমিস্টারে শরিফুলের পার্ফরমেন্স আগের মতই ছিলো, কিন্তু গত দুই সপ্তাহে চেনা-পরিচিত সে শরিফুল যেনো হঠাতই পালটে গেলো। তিনি জানেন- বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এ সময়টাতে ছেলেপিলেদের পা হড়কে যাওয়াটা খুব সহজ। মেয়ে সহপাঠীদের সাথে সম্পর্কের টানা-পোড়েন, হল জীবনের স্বাধীনতা কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষমতার রাজনীতির হাতছানি- বিশ-বাইশ বছরের এক যুবকের সামনে দিগন্ত বিস্তৃত কোন প্রলোভনের বাজার খুলে বসতে পারে। যে বাজার মানুষের কাছ থেকে শুধুই নেয়, বিনিময়ে ধোকা ছাড়া আর কিছু দেয় না।
প্রফেসর হাসানের সন্দেহ- শরিফুল তেমনই কোন এক সমস্যায় ইদানীং হাবুডুবু খাচ্ছে। গত দুই সপ্তাহে তিনি যে কয়টা এসাইনমেন্ট/ হোম ওয়ার্ক দিয়েছেন, তার একটিও ছেলেটি জমা দেয় নি; যে ক্লাশ টেস্টটি নেয়া হয়েছে, তাতে তার নাম্বার শূণ্য! সব থেকে আশংকার কথাটি হোল, শুধু যে তার নিজের কোর্সেই ব্যাপারখানা এমন- সেটাও নয়! তিনি অন্য শিক্ষকদের সাথে আলাপ করে দেখেছেন, তাদের কোর্সেও শরিফুল ঠিক একই রকমের অধঃপতন দেখাচ্ছে।
“বল, তোমার কি খবর!”
ডিপার্টমেন্টের অন্য সিনিয়র প্রফেসররা এভাবে কথা বলেন না, তাদের বেশিরভাগের নাকই থাকে আকাশের দিকে তাক করা। ছাত্রদেরকে তারা মনে করেন বিবর্তনে পিছিয়ে থাকা মানবপ্রজাতি। ব্যতিক্রম শুধু হাসান স্যার; শরিফুল সেটা জানে দেখেই স্যারের কথা বলা ভঙ্গিতে অবাক হোল না।
“এই তো স্যার....”
“তুমি কি অসুস্থ নাকি?”
শরিফুল আমতা আমতা করে জবাব দিলো- “জ্বি না স্যার। অসুস্থ না ...”
“অসুস্থ না হলেও কোন একটা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছ তো অবশ্যই! তেমন অস্বস্তি না হলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো।“- প্রফেসর হাসান হালকা গলায় বলেন।
“মানে কিছুটা অসুস্থ অবশ্য ছিলাম স্যার। মানে ঐ একটু ঠান্ডা, জ্বর আর কি....”
প্রফেসর হাসান কিছুক্ষণ নীরবে চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নরম গলায় বললেন- “বাবারে, আমি তো স্টুডেন্টদের সাথে খুবই ফ্রেন্ডলি। তারপরো আমার সাথে মিথ্যা কথা বলার দরকারটা কি? যদি বলতে কোন সমস্যা থাকে, সেক্ষেত্রে সরাসরি, সুন্দরভাবে আমাকে সেটা বলে দিলেই হয়! আমি নিশ্চই জানার জন্য জোরাজুরি শুরু করবো না। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক কত রকমের গোপনীয় সমস্যা থাকতে পারে- তাই না....”
শরিফুল কিছু বললো না, মাথা নীচু করে বসে রইলো।
প্রফেসর হাসান একটা নিঃশ্বাস ফেলে নরম গলায় আবার বললেন- “তোমাকে যে আমি কতটা পছন্দ করি- সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। আমার দীর্ঘ বিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তোমার মত এত ব্রাইট ছাত্র আমি আজ পর্যন্ত দেখি নি। সেই তুমি যদি আজ আমার চোখের সামনে এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে থাকো- তাহলে এর থেকে দুঃখের ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না।
তাই শিক্ষক হয়েও আমি তোমার কাছে রিকুয়েস্ট করছি- প্লিজ আমাকে একটা সুযোগ হলেও দিও! যদি মনে কর- আমি আর্থিক, মানসিক কিংবা অন্য কোনভাবে তোমাকে সহযোগীতা করতে পারি- তাহলে উইদাউট এনি হেজিটেশন- আমাকে জানিও।
এ কথাগুলো বলার জন্যই ডেকেছিলাম তোমাকে আসলে....“
ছাত্র- শিক্ষক দু’জনই চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলো। নীরবতা ভাঙ্গলো শরিফুল, সে খড়খড়ে গলায় বললো- “স্যার, আজকে ল্যাবের পর আমাকে দশ-পনেরো মিনিট টাইম দিতে পারবেন? তখনই আপনার সাথে এ নিয়ে কথা বলি?”
“এখনি বলতে পারো তোমার সমস্যা না থাকলে। আমার শিডিউল আগামী আধা ঘন্টা ফাকা আছে।“
শরিফুল একটু মাথা ঝুকিয়ে নীচু গলায় বললো- “স্যার, আমার সমস্যাটা আসলে মানসিক....
যতদূর মনে পড়ে ক্লাশ সিক্স থেকে সমস্যাটা প্রথম শুরু হয়। আপনি তো অলরেডি জানেন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। তারপরো ইন্টারে পড়ার সময় একবার টিউশানির টাকা জমিয়ে আমি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছিলাম। তিনি কিছু ওষুধও দিয়েছিলেন আমাকে, দুর্ভাগ্যবশত কোন কাজ হয় নি তাতে....
অসুখটা যতবার আসে, ততবার মানসিকভাবে আমাকে সাঙ্ঘাতিক নাড়া দিয়ে যায়। আমার স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন হওয়ার এটিই আসলে প্রধান কারণ।“
“শেষ কবে হয়েছিলো সেটা?”- প্রফেসর হাসান জিজ্ঞেস করলেন।
“মোটামুটি দুই সপ্তাহ আগে, সম্ভবত সেটা মাসের ৩ তারিখ ছিলো। সমস্যাটার বিষয়ে আরেকটু বিস্তারিত বলি স্যার আপনাকে, জানি না কতটুকু বোঝাতে পারবো...”- শরিফুল জিহবা দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে নিলো।
“বিষয়টা শুরু হয় ধীরে ধীরে। ভোল্টেজ ওঠানামার সময় আলোর তীব্রতা যেরকম বাড়ে-কমে, সেরকমই একটা অনুভূতি হয় প্রথমে; এমনকি রাত থাকলেও মনে হয় অন্ধকার বাড়ছে কমছে! তারপর চারপাশের শব্দ কমতে থাকে, আশেপাশে কোন মানুষ থাকলে তাদের মুভমেন্ট স্লো হতে থাকে- যেনো ব্যাটারিতে চলা খেলনা সবাই, যেনো ব্যাটারি দুর্বল হয়ে পড়েছে সবার! একসময় আমার আশেপাশে সব ধরণের প্রাণের চিহ্ন মুছে যায়, একটু আগেও যারা জীবনের স্পন্দনে ছিলো উচ্ছ্বল, সতেজ, তাদেরকে দেখে মনে হয় যেনো নিষ্প্রাণ কিছু খড়ের পুতুল! সে মানুষগুলোর নির্জীব চোখ যারা না দেখেছে, তাদেরকে বোঝানো যাবে না- কি অশুভ সে দৃষ্টি.... শব্দ নেই, প্রাণ নেই- এ পুরো বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডে মনে হতে থাকে আমিই বুঝি একমাত্র জীবিত ব্যক্তি! বড় ভয়ানক সে অনুভূতি...”
কথা শেষ করে শরিফুল রীতিমত হাপাতে লাগলো, কাপ কাপা গলায় বললো- “স্যার একটু পানি খাবো।“
প্রফেসর হাসান নিজেই তার ফিল্টার থেকে পানি ভরে এনে দিলেন। শরিফুল এক ঢোকে পানির গ্লাস শেষ করে শান্ত হোল কিছুটা।
অধ্যাপক হাসান তার ছাত্রকে ধাতস্থ হতে আরেকটু সময় দিলেন। তারপর নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন- “তুমি কি আগে থেকে টের পাও যে- অমুক দিন কিংবা অমুক তারিখে আবার তোমার এ সমস্যাটা হতে পারে?”
“জ্বি না স্যার।“
“একবার শুরু হলে এটা কতক্ষণ থাকে?”
“বেশিক্ষণ না। পনেরো মিনিটের মত হবে। তবে আমার কাছে মনে হয় অনন্তকাল....“
“হুম। আচ্ছা, পনেরো মিনিট পর আবার কি মানুষগুলো প্রাণ ফিরে পায়?”
“জ্বি স্যার। সব আগের মত হয়ে যায়, কিন্তু তাদের কিছু মনে থাকে না- এই যা পার্থক্য। ইন ফ্যাক্ট- তারা বুঝতেও পারে না- তারা কিসের মধ্য দিয়ে গিয়েছে কিংবা আদৌ কোন সময় পার হয়েছে কি না!“
প্রফেসর হাসান প্রায় জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলেন- “আমাকে কি এই অবস্থায় কখনো দেখেছো?”, শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালেন। এম্নিতেই ছেলেটাকে তার অসুস্থতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি মানসিকভাবে যথেষ্ট দুর্বল করে ফেলেছেন, তার ওপর এখন যদি আবার এ জাতীয় বিব্রতকর জেরা শুরু করেন- সেটা ভালো দেখায় না। তিনি টেনে টেনে বললেন- “ঠিক আছে শরিফুল। আমাকে একটু ভাবতে দাও। আমার পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার, আমি করবো। তুমি শুধু সাহস হারিয়ো না। এতোদিন যেহেতু এটা নিয়ে বেচে থাকতে পেরেছো, ভবিষ্যতেও পারবে। আর তোমার ক্লাশ টেস্ট/ এসাইনমেন্টগুলোর ব্যাপারে আমি দেখছি কি করা যায়.....”
“থাংকিউ স্যার।“
প্রফেসর হাসান মৃদু হেসে বললেনঃ “দ্য প্লেজার ইজ অল মাইন! এ ব্যাপারে করণীয় নিয়ে খুব শিগগিরই তোমার সাথে আবার বসবো”
“জ্বি স্যার। এখন উঠছি তাহলে।“
“ওকে। আর শোন-“ প্রফেসর ঝকঝকে চোখে তার ছাত্রের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ “একদমই চিন্তা করো না শরিফুল। অধ্যাপক জন ন্যাশ স্কিতজোফ্রেনিয়ার মত ভয়াবহ এক মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন, তারপরো নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। এ বিউটিফুল মাইন্ড ছবিটা পারলে দেখো।“
শরিফুল দাত বের করে বললো- “জ্বি স্যার দেখেছি”
প্রফেসর হাসানও হাসলেন- “ওকে তাহলে, ভালো থাকো।“
“আস-সালামু আলাইকুম স্যার।“
ছাত্রের সালামের জবাবে তিনি হাসিমুখে মাথা ঝাকালেন।
২
শরিফুলের কথাটা প্রফেসর হাসান ভুলেই গিয়েছিলেন প্রায়, রাতে আবার মনে পড়লো খুব অদ্ভূত উপায়ে।
তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু- প্রফেসর বাহার এখন আছেন আমেরিকায়। সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে শিক্ষকতা করেন তিনি। প্রফেসর বাহার এবং হাসান দু’জন সে ছোটবেলা থেকেই একসাথে- একই স্কুল, একই কলেজ, একই বিশ্ববিদ্যালয়... শুধু ডিপার্টমেন্ট ছিলো আলাদা- হাসান সাহেব ছিলেন এপ্লাইড ফিজিক্সের স্টুডেন্ট অন্যদিকে প্রফেসর বাহার ছিলেন থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে। পড়াশোনা শেষে দু’জনই পিএইচডির জন্য যান আমেরিকা। এবার দু’জন অবশ্য দু’প্রান্তের ইউনিভার্সিটিতে। তখন থেকেই যোগাযোগ কমতে থাকে ধীরে ধীরে। পিএইচডি শেষ করে প্রফেসর হাসান দেশে ফেরেন, অন্যদিকে বন্ধু বাহার থেকে যান সেখানেই। আজ অব্দি তিনি সেই আমেরিকাতেই আছেন।
যে দুই বন্ধু একসময় একজন আরেকজনকে টানা দুই-তিন দিন না দেখে থাকতে পারতেন না, আজ তাদের দেখা হয় কালে-ভদ্রে। কথা অবশ্য হয় মাঝে মাঝেই ভাইবার-স্কাইপের কল্যাণে। আজও তিনি বাসায় ফিরে দেখলেন স্কাইপেতে মিসড-কল উঠে আছে বাহারের।
একটু ফ্রেশ-টেশ হয়ে নিয়ে তিনি নিজেই কলব্যাক করলেন। অল্প বাদেই ওপাশ থেকে প্রফেসর বাহারের স্বভাবসুলভ উচ্ছ্বসিত গলা শোনা গেলো-
“কিরে ব্যাটা। কেমন আছস?”
“আছি ভালোই। আপনার কি খবর? বহুদিন পর....”
“একটু ঝামেলায় আছি রে। নাসায় একটা প্রোগ্রামে যেতে হচ্ছে গত কয়েক মাস ধরে, সেটা আরো দুই মাসের মত চলবে। এম্নিতে ইউনিভার্সিটির প্রেসার তো আছেই, সাথে উটকো ঝামেলা হিসেবে নাক গলাচ্ছে নাসা.... হা হা হা”
“ভাবী বাচ্চারা কেমন আছে?”
“আছে ঠিকঠাক দোস্ত। তোর বাসার খবরাখবর সব ভালো? ছোট মেয়েটা শুনেছিলাম হাত পুড়ে ফেলেছে, এখন কি অবস্থা?”
“আছে ভালোই। ঐটা অতটা সিরিয়াস ছিলো না আল্লাহর রহমতে।“
“ভেরিগুড। তোর আর কি খবর বল? ইউনিভার্সিটিতে দেখলাম টিচারেরা তোরা আন্দোলন করছিস, আবার কি হোল?”
“আরে ধুর বাদ দে। একটা না একটা ইস্যু তো লেগেই আছে। এইসব পলিটিক্যাল ঝামেলা আর চাটুকারিতার কারণেই তো দেশের চাকরি ভালোলাগে না, তোদেরকে হিংসা হয় মাঝে মাঝে.....”
“হা হা হা, তাই না! চল তাহলে এক্সচেঞ্জ কর। আমার জায়গায় তুই আয়, তোর জায়গায় আমি চলে যাই। এই বালের দেশ আর ভাল্লাগে না! নিজের দেশে চলে যাইতে মনে চায়, বয়স হয়েছে দেখেই হয়তো...”
ওদিকে মনে হোল বাহার একটু মন খারাপ করেছে। হাসান সাহেব তাই কথা ঘুরানোর জন্য বললেন-
“তোর রিসার্চ কেমন চলছে? নাসায় তোর কাজটা কি এখন?”
প্রফেসর বাহার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর নীচু গলায় বললেন- “দোস্ত, আমি মোটামুটি টপ সিক্রেট একটা প্রজেক্টে কাজ করছি। প্লিজ ডোন্ট শেয়ার ইট উইথ এনিবডি ফর ইট ইজ হাইলি কনফিডেন্সিয়াল; একচুয়ালি ইট হ্যাজ বিন...
গত প্রায় এক শতাব্দী যাবত পৃথিবীতে একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটছে। বছরের কিছু কিছু সময়ে একটা রহস্যময় সিগনাল ধরা পড়ছে নাসার বিভিন্ন প্রোবে। সিগন্যালটার র্যানডম নেচারের কারণে প্রথম দিকে কেউ সেটাকে অত গুরুত্ব দিয়ে নেয় নি, ইনফ্যাক্ট এখনো সেটাকে ব্যাকগ্রাউন্ড-নয়েজ হিসেবেই ধরা হচ্ছে। তবে কাজ শুরু হয়েছে সিগন্যালটা নিয়ে। সেরকমই একটা প্রজেক্ট এখন আমি যেটাতে আছি- সেটা!”
“ইন্টারেস্টিং। শেষ কবে দেখা গেছে এই সিগন্যাল?”
“এ মাসের তিন তারিখে। তার আগে দেখা গিয়েছিলো গত ২০১৪ সালের মার্চ মাসে, অর্থাৎ প্রায় দুই বছর চার মাস আগে।“
‘তিন তারিখ’ শব্দ দু’টো শুনে প্রফেসর হাসানের আবার শরিফুলের কথা মনে পড়লো। দু’টো ঘটনা সম্পূর্ণই কাকতালীয় নিঃসন্দেহে, তাই শরিফুলের প্রসঙ্গটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে তিনি আবার বন্ধুর কথায় মন দিলেন।
“বুঝলি, সিগন্যালটা র্যান্ডম হলেও ওভারঅল তার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। একটা অদ্ভূত বৈশিষ্ট্যের কথা শুধু উল্লেখ করি। আমরা ধারণা করছি- মানুষের ব্রেনের ইলেকট্রিক্যাল-এক্টিভিটির সাথে সিগন্যালটার দুরবর্তী কোন সম্পর্ক আছে। মাঝে মাঝে সিগন্যালটা দেখে কারো মনে হতে পারে- সেটা বুঝি কোন মানুষেরই চিন্তার, চেতনার এক বৈদ্যুতিক প্রকাশ। তবে নিঃসন্দেহে সে চিন্তা অনেক বেশি জটিল এবং দুর্বোধ্য....”
প্রফেসর হাসান বন্ধুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন- “আচ্ছা। সিগন্যালটার স্থায়িত্ব কি দশ-পনেরো মিনিটের মত?”
স্কাইপের ওপাশে বাহার সাহেব অসম্ভব অবাক হলেন, বললেন- “তুই কিভাবে জানলি?”
“দোস্ত, তুই এই সপ্তাহের মাঝে আমাকে একটা ইনফর্মেশন পাঠা, সেটা হোল- গত দশ/বিশ বছরে ঠিক কবে কবে এ সিগন্যালটা নাসার প্রোবিং-সিস্টেমে ধরা পড়েছে? ট্রাস্ট মি, এ সম্পর্কে আমি ছাড়া কেউ জানবে না। আর আমার সন্দেহটুকু আমি তোকে এখনি বলতে চাচ্ছি না, কারণ বিষয়টা এখনো, একেবারেই আমার দুর্বল অনুমানের পর্যায়ে আছে। এর মধ্যে আমি নিজেও কিছু রিসার্চ-টিসার্চ করি- ইনশাল্লাহ নেক্সট-টাইম তোর সাথে যখন আমার কথা হবে- তখনই আমার চিন্তা-অনুমানগুলো সব ক্লিয়ার করবো....“
“ওকে, এজ ইউ উইশ! তাহলে রেখে দেই এখন, আশা করি- কালকের মাঝেই তুই আমার কাছে যেটা জানতে চেয়েছিস, সেটা জেনে যাবি।“
“থ্যাংস দোস্ত। ভালো থাক!”
কল কেটে প্রফেসর হাসান কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলেন। কি হচ্ছে এসব? আজ সকালেই তিনি যাকে মনে করেছিলেন- তৃতীয়-বিশ্বের এক বাচ্চা ছেলের ব্যক্তিগত সমস্যা, সেটা কি আসলে আরো ব্যাপক কিছুর সাথে যুক্ত? মহাজাগতিক কোন ঘটনার সাথে কি নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়েছে তার ছাত্র শরিফুল? নাকি এ মিলগুলো সব কাকতালীয়?
বাহারের কাছে যা শুনলেন- তাতে অস্পষ্টভাবে মনে হচ্ছে যেনো- কেউ মানুষের মাথার ভেতরকার ইলেকট্রিক্যাল এক্টিভিটি নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের চেতনাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। আর এটারই হাতিয়ার হোল রহস্যময় সে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক-সিগন্যাল। তবে বেশিরভাগ মানুষের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলেও শরিফুলের মত কিছু(!) মানুষকে টিউন করতে পারছে না সে সিগন্যাল.....
প্রফেসর হাসান দ্রুত চিন্তা করলেন- এতো তাড়াতাড়ি, এতো কম এভিডেন্সের ওপর ভিত্তি করে বড় কোন সিদ্ধান্ত নেয়াটা ঠিক হবে না। প্রচুর তথ্য লাগবে তার। বন্ধু বাহারের কাছ থেকে তথ্য, শরিফুলের অসুস্থতা সম্পর্কে তথ্য; এমনকি দেশের, দেশের বাইরের কিছু সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে যোগাযোগ করতে হবে তাকে যে কোন উপায়ে; খোজ নিতে হবে- শরিফুলের মত কেইস আরো আছে কি না, থাকলে কি পরিমাণে! এরপর হাতের সব তথ্য-উপাত্ত মিলিয়ে দাড়া করাতে হবে যুক্তির প্রসাদ। তবে সত্যিই যদি তার অনুমান সত্য হয়ে থাকে, তবে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়- শরিফুল ছেলেটি সাধারণ কোন ছেলে নয়, সে নিঃসন্দেহে এক্সেপনশাল।
ভেতরে ভেতরে চাপা একটা উত্তেজনা নিয়ে সেদিন রাতে ঘুমাতে গেলেন তিনি।
----------------------------------------------------------------------------------
ত্রিশ বছর পরের কথা।
প্রফেসর শরিফুল ইসলামের ইন্টারভিউ প্রচারিত হচ্ছে সিএনএন এ। ইন্টারভিউ নিচ্ছেন লিন্ডা কিনকেইড নামের এক ভদ্রমহিলা।
টিভিতে শরিফুলকে বলতে শোনা যাচ্ছে-
“.... সিগন্যালটার অর্থ উদ্ধার করতে না পেরে বিজ্ঞানীরা এক সময় মনে করে বসেন- এর বোধহয় আসলেই কোন অর্থ নেই! বোধহয় সত্যি সত্যিই সেটা র্যানডম-ব্যাকগ্রাউন্ড-নয়েজ!
কিন্তু বিষয়টা নিয়ে নতুন করে সায়েন্টিফিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার মরহুম শিক্ষক প্রফেসর জাহিদ হাসান। তিনি বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করে দেখান- সিগন্যালটা আসছে আসলে অতি-বুদ্ধিমান কোন সভ্যতা থেকে! তাদের বুদ্ধিমত্তার একটা নমুনা হোল- সে সিগন্যাল এতোটাই ওয়েল-ডিজাইনড ছিলো, যে তা দিয়ে সাময়িক নিয়ন্ত্রণ নেয়া যেতো মানবজাতির মত উন্নত, গোটা একটা প্রজাতির! হাতে গোণা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মানুষের ব্রেনে ইলেকট্রিক্যাল-সিগন্যাল-ইনডিউস করার মাধ্যমে তারা সে কাজটি করতো; দশ-পনেরো মিনিটের জন্য চেতনাহারা করে রাখতো পৃথিবীবাসীদের!
তবে মানুষকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের টেকনোলজি নিজেদের হাতে থাকা সত্বেও কিন্তু তারা কখনোই আমাদের স্বাধীন ইচ্ছায় হস্তক্ষেপ করে নি- এ থেকে অনুমান করা যায় মানুষকে দাস বানানোর উদ্দেশ্য তাদের ছিলো না। বরং তারা চেয়েছিলো আমাদের একটা মেসেজ দিতে.....
তো কি সেই রহস্যবার্তা? আমি এবং আমার গ্রুপ আসলে সে সিগন্যাল-প্যাটার্নের অন্তর্নিহিত অর্থটুকুই উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। রেজাল্ট যেটা পেয়েছি, সেটাও যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং!
যে প্রাণীরা এ সংকেতটি পাঠিয়েছেন, তাদের অবস্থান সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছু জানি না। তবে এটুকু নিশ্চিত যে তারা মহাবিশ্বের অচিন্ত্যনীয় বিশাল এক জায়গা জুড়ে নিজেদের কলোনি স্থাপন করেছিলো। আরো ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা হচ্ছে- এখন আর তাদের কোন অস্তিত্ব নেই; তাদের সে সভ্যতা উন্নতির শিখরে পৌছে যাবার পরও পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে বহু আগে!
বুদ্ধিমান প্রাণী মাত্রই তার জ্ঞান সংরক্ষণ করতে চায়, আর সে চাওয়া থেকেই তারা উত্তরাধিকার হিসেবে বেছে নিয়েছিলো আমাদের। ‘থিওরি-অফ-এভরিথিং’ বলে পৃথিবীর সায়েন্টিস্টরা এতোদিন যেটাকে খুজে বেড়াচ্ছিলেন, আইনস্টাইন তার শেষ জীবনে যে আশায় দিনরাত কাজ করেছেন- সেই ‘থিওরি-অফ-এভরিথিং’ এরই মৌলিক বিষয়গুলো সযতনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাদের পাঠানো সিগন্যালটিতে!
তবে একটা বিষয় এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে- সংকেতটাতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মানুষকে একটা বার্তা বারবার দেওয়া হয়েছে। আর তা হোল- এই ‘থিওরি-অফ-এভরিথিং’ এর নাকি আসলে কোন মূল্য নেই! এধরণের দাবী কেনো করা হোল, সেটাই এখন আমাদের কাছে প্রশ্ন......”
ইন্টারভিউয়ের আরো কিছু অংশ বাকি ছিলো, কিন্তু শরিফুল টিভিটা বন্ধ করে তার সিয়াটলের বাসার জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালেন। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, আকাশে মেঘ করে এসেছে ঠিক দেশের মত। ত্রিশ বছর আগে অনেকটা এরকম আবহাওয়াতেই তাকে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন হাসান স্যার। শুনিয়েছিলেন আশার কথা, বলেছিলেন নিজের ওপর বিশ্বাস না হারাতে। এরপরো অনেকবার স্যারের সাথে দেখা হয়েছে, প্রতিবার তিনি একই কথা বলেছেন- ‘ট্রাস্ট মি, তুমি মানসিক কোন রোগী নও! পৃথিবীতে হাতে গোণা কিছু মানুষ আছে তোমার মত.... এটাই তোমাদের শক্তি!’
স্যারের কথা মনে হলেই হৃদয় ভার হয়ে আসে। মানুষের প্রতি ভালোবাসার সংজ্ঞা তাকে নতুন করে শিখিয়েছিলেন তিনি। শরিফুল জানে, শুধু সে একা নয়- তার মত অসংখ্য শিক্ষার্থী, যারা শিক্ষাজীবনে নানা ধরণের সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের পাশে গিয়ে দাড়িয়েছেন প্রফেসর জাহিদ হাসান; ভালোবাসা আর আন্তরিকতার বাণী শুনিয়েছেন তাদের.......
এগুলো ভাবতে ভাবতে হঠাতই বিদ্যুৎ চমকের মত একটা চিন্তা মাথায় এলো শরিফুলের- আসলে জ্ঞানের কোন অর্থ নেই যদি ভালোবাসাকে ঠিকভাবে মূল্যায়ণ করা না হয়! ঐ মহাজাগতিক সভ্যতা ‘থিওরি-অফ-এভরিথিং’ অর্জন করেছিলো খুব সহজে, কিন্তু নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে নি। পারে নি কারণ- অন্যকিছু সে জগতে জয়ী হয়েছিলো- হয়তো সেটা লোভ, হয়তো ঘৃণা, কিন্তু ভালোবাসা নয়- এটা নিশ্চিত! একারণেই তারা সংকেত-বার্তার শেষে মানুষের জন্য সাবধাণবাণী উচ্চারণ করেছে- যেনো মানবজাতি তাদের মত কোন ভুল না করে। যেনো জ্ঞান-বিজ্ঞান আর সভ্যতার পেছনে ছুটতে গিয়ে হারিয়ে না ফেলে ভালোবাসার ঐশ্বর্য!
ভাবতে অবাক লাগে- দূর মহাকাশের এক অতি-উন্নত সভ্যতা আমাদেরকে যা বোঝাতে চেয়েছে, হাসান স্যারের মত মানুষেরা সে একই আলো কত যুগ যুগ ধরে বিলিয়ে গিয়েছেন, যাচ্ছেন!
প্রফেসর শরিফুল ইসলাম স্তব্ধ হয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাইরে শব্দ-জল-হাওয়ার কি অপূর্ব এক পৃথিবী!
আমাদের এই পৃথিবী!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ১০:১৭