ফটো কার্টেসিঃ অন্তর্জাল
হুমায়ূন আহমেদের লেখার যারা ভক্ত, তারা অনেকেই হিমু- মিসির আলি হতে চান। কিংবা কেউ কেউ হয়তো শুভ্র....
সম্ভবত তার এমন কোন বই নেই- যেটা আমি পড়ি নি; সে হিসেবে আমাকেও তার একজন নিবিষ্ট, 'কমিটেড' পাঠক বলা যেতে পারে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য- এতো ডেডিকেটেড একজন পাঠক হয়েও আমার কিন্তু কখনই হিমু কিংবা মিসির আলি হবার ইচ্ছা মনে জাগে নি। কেন, সেটা কে জানে!
তবে পরিস্থিতি কিছুটা পালটে গেলো হুমায়ূন আহমেদ মারা যাবার পর। মনের গভীরে, চিপায়-চাপায় উকি দিতে শুরু করলো হিমু হবার লাজুক, সূক্ষ্ম বাসনা। একসময় যথারীতি আম্মুকে বলেও বসলাম- আমাকে যেনো একটা হলুদ পাঞ্জাবি কিনে দেয়া হয়!
অবশেষে এই ঈদে একটা হলুদ পাঞ্জাবি পেলাম! কিন্তু সাথে সাথেই আবার মাথায় ঘোরা শুরু হোল- শুধু হলুদ পাঞ্জাবি দিয়ে কি হবে, হিমু তো হাটতো খালি পায়ে! তার আবার একজন রূপাও ছিলো। আমার তো সে ধরণের কেউ নেই। তাছাড়া খালি পায়ে হাটাহাটি শুরু করলে কৃমি হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। হিমু হতে গিয়ে কৃমি হওয়া নিশ্চই কোন কাজের কথা হতে পারে না।
যাই হোক- শত জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে একদিন সন্ধ্যায় সে হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে জড়ালাম, বের হলাম ঢাকার রাস্তায়। শুনে অবিশ্বাস্য (এবং কিছুটা হাস্যকর) মনে হতে পারে- শক্তিশালি কোন নেশাদ্রব্য কিংবা হ্যালুসিনেটিং কোন ড্রাগ নয়- সামান্য একটা হলুদ পাঞ্জাবিই আমার মধ্যে প্রবল এক ঘোর তৈরি করলো। রাস্তার সোডিয়াম লাইটগুলোকে দেখে মনে হোল যেনো- হিমুর পাঞ্জাবি থেকে সে বাতিগুলো তাদের রঙ ধার করে নিয়েছে। মাথার উপরের আকাশটাও কি অন্যরকম লাগছে কিছুটা? জোছনা নেই, তারপরো মনের গহীন থেকে ফিসফিস করে কেউ কি গোপনে বলছে- 'আজ এই জোৎস্নায় বিভ্রম ঝরুক, ভালোবাসা ঝরুক.... পৃথিবীর সকল সাধারণ পুরুষ নিজেকে কল্পনা করে নিক- মহাপুরুষ হিমু!'
আবেগের কথা বাদ রেখে বাস্তব সত্যটা এবারে বলি-হুমায়ূন আহমেদ নেই, হিমুকেও আর ফিরে পাওয়াটা সম্ভব না। মনে রাখতে হবে- শুধু হলুদ পাঞ্জাবি পরে আর দু'চারটা পাগলামি করেই কিন্তু হিমু হওয়া যায় না। মহাপুরুষ হবার সাধণা- বড় কঠিন এক সাধণা!
তারপরো আমার চিন্তা করতে ভালো লাগে- কোন এক আশ্বিনী পূর্ণিমায় হয়তো হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে কেউ হাটতে বের হবে। সাঈদ খোকনের নান্দনিক ঢাকা সেদিন ডুবে থাকবে নিশ্চুপ, প্রশান্ত অন্ধকারে; শুধু আকাশে থাকবে হীরক উজ্জ্বল, চোখ ধাধানো পূর্ণচন্দ্র। মহাজাগতিক এক অতি পরিচিত অতিথি হয়ে সে রাতে জোছনা নেমে আসবে এ শহর আর তার মানুষগুলোর চোখের পাতায়। নিম, কৃষ্ণচূড়া কিংবা আকাশমণি গাছ নির্বিশেষে- তাদের কোমল পাতার ফাকফোকড়ে আটকে যাবে ছোট ছোট জোছনার ফুল।
হিমুর মত সে ছেলেটি বুকে গভীর আনন্দ নিয়ে শিষ দিতে দিতে ঢাকার রাস্তা ধরে হেটে বেড়াবে। আনন্দের কারণটা হোল- সে জানে- আর অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই, স্বপ্নবাস্তবতা যখন চরমে- তখন এ পিচঢালা, কালো রাস্তাটিই পালটে হয়ে যাবে ঝিকিমিকি, স্বচ্ছ জলের মায়াবী ময়ূরাক্ষী নদী.....
তাই নকল হিমু যারা আছেন, আপনারা আশা ছেড়ে দেবেন না! একজন হিমুভক্ত হিসেবে আমি আপনাদেরকে সাজেশন দেবো অপেক্ষা করে থাকার; জাদু-জোছনার অপেক্ষা, অপেক্ষা- কোন এক মায়াময় আশ্বিনী পূর্ণিমার।
যে জোছনা অতি সাধারণ কোন মানুষকে-অন্তত এক রাতের জন্য হলেও- মহাপুরুষ হিমু হবার সুযোগ করে দেয়!
"প্রতি পূর্নিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাই
গৃহত্যাগী হবার মত জোছনা কি উঠেছে ?
.......
আমি সিদ্ধার্থের মত গৃহত্যাগী জোছনার জন্য বসে আছি।
যে জোছনা দেখামাত্র গৃহের সমস্ত দরজা খুলে যাবে-
ঘরের ভেতরে ঢুকে পরবে বিস্তৃত প্রান্তর।
প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব আর হাঁটব-
পূর্নিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে।
চারদিক থেকে বিবিধ কন্ঠ ডাকবে- আয় আয় আয়"
--হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮ – ১৯ জুলাই, ২০১২)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ৯:৪০