বনের নাম আদমপুর।
স্থানীয় লোকজন অবশ্য সেটাকে আদমপুর নামে চেনে না, তাদেরকে পরিচয় দেয়ার সময় বলতে হয় কাউয়ার গলা বিট। এতো অসাধারণ একটা বনাঞ্চলকে কেন কাউয়ার গলা বলা হয়- সেটা আগেও আমার মাথায় ঢোকে নি, এখনো ঢোকে না। ....তা যাই হোক- নামকরণের জটিলতা বাদ দিয়ে আসুন প্রথমে বন সম্পর্কে দু' এক কথা জেনে নেই।
আদমপুরের এই বনভূমি পড়েছে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায়। বলা হয়ে থাকে- রাজাকান্দি রেঞ্জের অন্তর্ভূক্ত এই বন, বাংলাদেশের সব থেকে সমৃদ্ধ অরণ্য (সম্ভবতঃ বনের ইকোসিস্টেমের কথা মাথায় রেখে।); এখানকার স্থানীয়রা- যারা বনে জীবিকার জন্য ঢোকেন- তারা নাকি প্রায়ই এ বনে ভাল্লুক পর্যন্ত দেখতে পান ! আমাদের সাথে একজনের কথা হয়েছিলো- তিনি নিজেও বছর দু'য়েক আগে ভাল্লুকের দেখা পেয়েছিলেন; এগুলো অবশ্য থাকে বনের ভীষণ গহীনে। বিশেষতঃ মৌয়ালদের নাকি প্রায়ই ভাল্লুক দেখবার অভিজ্ঞতা আছে। তাছাড়া ভাল্লুকের সাথে সাথে এ বনে আরো আছে বানর, হনুমান, মায়া হরিণ, উল্লুক.... আর যেখানে হরিণ আছে, সাধারণতঃ সেখানে বাঘও থাকে; তবে পত্রিকায় আমি শুধু মেছো বাঘের কথাই পড়েছি। (তথ্যসূত্রঃ বিডিনিউজ২৪)
রেমা-কালেঙ্গা বনে অন্ততঃ কিছু ওয়াইল্ড লাইফ দেখতে পেলেও (আগের পর্ব দ্রষ্টব্য), এখানে আমরা তেমন কিছু দেখতে পাই নি। দেখবার আশাও অবশ্য ছিলো না- কারণ যে সময়টাতে আমরা আদমপুর বনে ট্রেইলিং শুরু করেছিলাম- সে সময়টা ছিলো ওয়াইল্ড লাইফ দেখার জন্য একেবারেই বেখাপ্পা। তাই জলছড়া ধরে ট্রেইল করে করেই এ পর্যায়ে আমাদেরকে সন্তুষ্ট থাকতে হোল। তবে এখানে একটা ব্যাপার বলে রাখা ভালো- এ বনের ভূমিরূপ রেমা-কালেঙ্গার মত অতটা সমতল নয়, বেশ উচু নীচু; অবশ্য রেমা-কালেঙ্গার মতই এখান থেকেও ত্রিপুরার বর্ডার একেবারেই কাছে; যতদূর মনে পড়ে- মোটামুটি ছয়-সাত কিলোর মধ্যেই।
"...শৈলসানুতে যতক্ষণ প্রথম বসন্তে প্রস্ফুটিত রাঙা পলাশ ফুলের মেলা বসিয়াছে, পাহাড়ের নিচে, উপরে মাঠের সর্বত্র ঝুপ্সি গাছের ডাল ঝাড় ঝাড় ধাতুপফুলের ভারে অবনত, গোলগোলি ফুলের নিষ্পত্র দুগ্ধশুভ্র কাণ্ডে হলুদ রঙের বড় বড় সূর্যমুখী ফুলের মতো ফুল মধ্যাহ্নের রৌদ্রকে মৃদু সুগন্ধে অলস করিয়া তুলিয়াছে-তখন কতটা পথ চলিল, কে রাখে তাহার হিসাব?"
-- আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়
"আবার রৌদ্রদগ্ধ নিষ্পত্র গুল্মরাজি, আবার বনকুসুমের মৃদুমধুর গন্ধ, আবার অনাবৃত শিলাস্তূপসদৃশ প্রতীয়মান গণ্ডশৈলমালা, আবার রক্তপলাশের শোভা।"
-- আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়
" কি সুন্দর ঠাণ্ডা বনবীথি! পাখিরা বোধ হয় এই নির্জন অরণ্যে শিলাতলে শরৎ বসন্তের দিনে, কি গভীর নিশীথ রাত্রে জলকেলি করিতে নামে..."
-- আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়
"নিস্তব্ধ দুপুরে দূরে মহালিখারূপের পাহাড় ও জঙ্গল অপূর্ব রহস্যময় দেখাইত। কতবার ভাবিয়াছি একবার গিয়া পাহাড়টা ঘুরিয়া দেখিয়া আসিব, কিন্তু সময় হইয়া ওঠে নাই। শুনিতাম মহালিখারূপের পাহাড় দুর্গম বনাকীর্ণ, শঙ্খচূড় সাপের আড্ডা, বনমোরগ, দুষ্প্রাপ্য বন্য চন্দ্রমল্লিকা, বড় বড় ভাল্লুক-ঝোড়ে ভর্তি। পাহাড়ের উপরে জল নাই বলিয়া, বিশেষত ভীষণ শঙ্খচূড় সাপের ভয়ে, এ অঞ্চলের কাঠুরিয়ারাও কখনো ওখানে যায় না।"
-- আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়
রেমা-কালেঙ্গা থেকে শ্রীমঙ্গল যাত্রার সময় তোলা কিছু ছবিঃ
(সিথির মত বনপথ ধরে ধরে চলা.... এ রাস্তাটাই শেষমেষ শ্রীমঙ্গল দিয়ে বের হয়েছে)
(এ পুরো পথটাকেই বেতবাগানের রাস্তা বলে। ঘন বেতবাগান আরেকটু সামনে.... ভাগ্য ভালো থাকলে- এ পথে হরিণ দেখা যায় )
(বেতবাগান.... )
(শ্রীমঙ্গল যাবার সে বনপথ হঠাত করেই শেষ হয়ে আসে; আচমকা পথিকের চোখে স্বপ্ন-জগতের মত করে ধরা দেয় কূল-কিনারাবিহীন চা-বাগান....)
আবার আদমপুরঃ
(শাপগ্রস্ত এক নগরী যেনো; যেনো দূর অতীতে কোন ডাইনীর অভিশাপে পাথর হয়ে যাওয়া এক আশ্চর্য জনপদ.....)
"...কিন্তু অনন্যমনা হইয়া প্রকৃতিকে লইয়া ডুবিয়া থাকো, তাঁর সর্ববিধ আনন্দের বর, সৌন্দর্যের বর, অপূর্ব শান্তির বর তোমার উপর অজস্রধারে এত বর্ষিত হইবে, তুমি দেখিয়া পাগল হইয়া উঠিবে,
দিনরাত মোহিনী প্রকৃতিরানী তোমাকে শতরূপে মুগ্ধ করিবেন..."
-- আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়
"বাতাবী লেবুর ফুল নয়, ঘেঁটুফুল নয়, আম্রমুকুল নয়, কামিনীফুল নয়, রক্তপলাশ বা শিমুল নয়, কি একটা নামগোত্রহীন রূপহীন নগণ্য জংলী কাঁটাগাছের ফুল। আমার কাছে কিন্তু তাহাই কাননভরা বনভরা বসন্তের কুসুমরাজির প্রতীক হইয়া দেখা দিল।"
-- আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়
শেষ কথাঃ
সুইডেন দেশটার অর্ধেকের বেশি অংশ জুড়েই নাকি বন। আমি প্রথম প্রথম শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম- কারণ ইউরোপের প্রসংগ উঠলেই আমার চোখের সামনে গতিময় এক নগর সভ্যতার চাকচিক্যটাই শুধু ভেসে ওঠে; শান্ত, সমাহিত আর নিবিড় বনভূমির কল্পনা নিশ্চিতভাবেই যার সাথে খুব একটা যায় না।
সে দেশেরই একজন বিখ্যাত কবির কথা জানি- যিনি নাকি হেটে মাঝে মাঝেই সেখানকার গহীন অরণ্যে হারিয়ে যেতেন। বনে ঢুকে কবি কি করতেন সেটা পরিষ্কার না, তবে তিনি বেরিয়ে আসতেন কিছু 'নোটস' সাথে করে নিয়ে। বিচ্ছিন্ন আর খন্ডিত সে সব 'নোটস' থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নিত অসামান্য সব কবিতার। তার সাহিত্যের সাথে আমি এখনো ততটা পরিচিত নই দেখে কবিতাগুলোকে আন্দাজেই, শুধুমাত্র এই পোস্টের খাতিরে মহিমান্বিত করাটা ঠিক হবে না। শুধু এটুকু বলা যেতে পারে যে- নোবেল কমিটিকে সে শক্তিমান কবি তার কবিতাগুলো দিয়ে আলোড়িত করতে পেরেছিলেন।
মাঝে মাঝে সেই কবি- ট্রান্সট্রোমারকে আমার প্রচন্ড হিংসা হয়। কি চমতকার একটা জীবন ছিলো তার! বনের গাঢ় সবুজে আত্মাহুতি দেবার উদ্দেশ্যে আনমনে হাটতে থাকা, বাষ্প হয়ে বনের শরীরে মিশে যাওয়া হারানো বৃষ্টিকে খুজে বেড়ানো কিংবা ধ্যানে ডুবে থাকা শতবর্ষী বৃক্ষরাজির আধ্যাত্মিকতার ছন্দময় সমুদ্র-দর্শন... কত অপূর্ব সব অভিজ্ঞতাই না হয়েছিলো তার! সৃষ্টির কত অধরা ঐশ্বর্যই না ধরা দিয়েছিলো শক্তিমান কবির অতিচেতনায়....
কে জানে !! এমন জীবনের প্রত্যাশাতেই বুঝি বহুদূর বাংলার এক নির্জন, নিমগ্ন কবিও জাদুগ্রস্ত কোন সময়ে লিখেছিলেন-
"একদিন আমি যাব দু-প্রহরে সেই দূর প্রান্তরের কাছে,
সেখানে মানুষ কেউ যায় না'ক — দেখা যায় বাঘিনীর ডোরা
বেতের বনের ফাঁকে — জারুল গাছের তলে রৌদ্র পোহায়
রূপসী মৃগীর মুখ দেখা যায়, — শাদা ভাঁট পুষ্পের তোড়া
আলোকতার পাশে গন্ধ ঢালে দ্রোণফু বাসকের গায়;
তবুও সেখানে আমি নিয়ে যাবো একদিন পাটকিলে ঘোড়া
যার রূপ জন্মে — জন্মে কাঁদায়েছে আমি তারে খুঁজিব সেথায়।"
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৬ রাত ১০:৫৭