somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হে অরণ্য কথা কও (ভ্রমণ পোস্ট)

১৫ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মহামতি কনফুসিয়াস বলেছিলেন যে- সৌন্দর্য সবকিছুরই আছে, শুধু সেটা আবিষ্কার করবার দৃষ্টি থাকতে হয়।

সে কারণেই বুঝি- সমুদ্র মানে কারো কারো কাছে একগাদা পানি, আবার কারো কাছে জীবন্ত নীল রত্ন-পাথর, নীলকান্তমণি।
পাহাড় বলতে কেউ বোঝেন উচু মাটির দলা, অন্যদিকে কেউবা দেখেন তাকে বিশাল আকাশের সন্তান হিসেবে!

অরণ্য কারো কাছে শুধুই জঙ্গল, আর কারো কারো কাছে যেন রহস্যময়, নিমগ্ন বনভূমি- যার গভীরে অনন্তকাল ধরে আড়াল হয়ে আছে সৃষ্টির অমেঘ কোন মহাসত্য!

সেরকমই এক গহীন অরণ্যের সন্ধানে সপ্তাহখানেক আগে গিয়ে ঘুরে এলাম বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জ আর মৌলভিবাজার। হবিগঞ্জে উদ্দেশ্য ছিলো রেমা-কালেঙ্গা বন-ভ্রমণ, আর মৌলভিবাজারে গিয়েছিলাম আদমপুরের জঙ্গলে। আজ আপনাদের সাথে রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ভ্রমণেরই কিছু অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেবো। আল্লাহ চাইলে পরের পর্বে আদমপুর!

রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য; চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ

বাংলাদেশে একক বন হিসেবে আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় দক্ষিণ-পশ্চিমের সুন্দরবন, আর তার পরপরই প্রাকৃতিক যে বনভূমির কথা বলা হয়ে থাকে- সেটা হচ্ছে রেমা-কালেঙ্গা। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় এই বনের অবস্থান, যার একটি প্রান্তের নাম রেমা, অপর প্রান্তটি কালেঙ্গা। বন সম্পর্কে একাডেমিক সব তথ্য পাঠকগণ নেটেই পাবেন, তাই শুধু শুধু আর সেদিকে গেলাম না। তবে এ বনের ওয়াইল্ড-লাইফ সম্পর্কে কিছু কথা বোধহয় বলাই যায়, কারণ আমার মত শহুরে মানুষদের জন্য এই বিষয়টা নিঃসন্দেহে আগ্রহোদ্দীপক।

রেমা-কালেঙ্গার বনে পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালীর মধ্যে বিরল প্রজাতির মালায়ন বড় কাঠবিড়ালীর একমাত্র বসবাস এ বনেই। তিন প্রজাতির বানর কুলু, রেসাস আর লজ্জাবতীর দেখা মেলে এ অভয়ারণ্যে। এছাড়াও আছে মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, উল্লুক, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, বন্যশুকর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু ইত্যাদি। বনের সরীসৃপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াস, লাউডগা ইত্যাদি। (তথ্যসূত্রঃ বিডিনিউজ)

আমরা কি কি দেখলাম? আমরা কাঠবিড়ালী দেখেছি কয়েকবার- বাদামী রঙ্গা আর কার্টুনে দেখানো সাদা-কালো ডোরাকাটাগুলোর মত... বানর দেখেছি প্রথমে রেসাস (সাধারণ বানর আমরা যেগুলো দেখে দেখে অভ্যস্ত), এরপর কুলু বানর। উল্লুকের দেখা মেলাটা কঠিন কারণ আমাদের গাইড বললেন- পুরো বনে উল্লুক নাকি আছেই চারটার মত, তবে ডাক শুনেছি সেটার সারাক্ষণ। বানর জাতীয় প্রাণীর মধ্যে আর দেখা হয়েছে হনুমান।

হরিণ আমরা দেখতে পাই নি (হরিণ অবশ্য এতো সহজে দেখাও যায় না), তবে 'লাউডগা' সাপ দেখা গিয়েছে। সবুজ, চিকন দেহের এক সরীসৃপ- গাছ-পাতা-লতার সাথে মিশে থাকে; আমাদের আওয়াজ পেয়ে শরীরের পেছন অংশটুকু টেনে নিয়ে ঝোপের মাঝে হারিয়ে গেলো!

মেছোবাঘ দেখার কোন প্রত্যাশা ব্যাক্তিগতভাবে আমার ছিলো না, কারণ অনুমান করেছিলাম এগুলো নিশ্চই সংখ্যায় খুব কম হবে, তাছাড়া থাকবেও বনের ভেতরের দিকে। তবে হরিণ দেখার আশাটা মনের গহীনে ছিলো। অবশেষে 'দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর মত' করে আমরা 'হরিণ-দেখার সাধ বিষ্ঠায়' মেটাতে সক্ষম হলাম! আমাদের গাইড আমাদেরকে হরিণের 'ল্যাদা' (দুঃখিত পাঠক! এর কোন ভদ্র, অথচ সহজে বোঝার মত প্রতিশব্দ আমি খুজে পেলাম না) দেখালো।

যাই হোক, কথা অনেক হোল, এবার কিছু ছবি দেখা যাক। এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো- বনেরও কিন্তু একটা অন্তর আছে, আছে প্রাণোচ্ছ্বল হৃদয়। ছবিতে অরণ্যের বাইরের রূপটাই শুধু চোখে পড়বে, তার হৃদয়ের সৌন্দর্যটুকু থেকে যাবে ধরা-ছোয়ার বাইরে। রেমা-কালেঙ্গা হোক আর অন্য যে কোন বনই হোক- অরণ্যের সে হৃদয়টাকে স্পর্শ করতে চাইলে আপনাকে সশরীরে সেখানে যেতে হবে।

প্রকৃতির সন্তান মানুষ যখন নিজেই আবার প্রকৃতির কাছে ফেরত যায়, তখন প্রকৃতিও তাকে সেভাবেই বরণ করে। মানবসন্তানের প্রতি গভীর বিশ্বাস থেকেই সে উন্মুক্ত করে দেয় তার অদেখা, গুপ্তরূপের ভান্ডার!



I think that I shall never see
A poem lovely as a tree.



A tree that looks at God all day,
And lifts her leafy arms to pray;

--Trees by Joyce Kilmer



I was taken from there,
from a village of sand and rock
to Araucanía, where the rain pours.
I could feel the reality of my delusion-
that made my home there a jungle.



Since then I have loved with the fragrance of wood
Since, all I had touched
became deep, dreamy forest for good..

--পাবলো নেরুদার 'যেখানে বৃষ্টির জন্ম' থেকে



HERE, O my heart, let us burn the dear dreams that are dead,
Here in this wood let us fashion a funeral pyre
Of fallen white petals and leaves that are mellow and red,
Here let us burn them in noon's flaming torches of fire.



We are weary, my heart, we are weary, so long we have borne
The heavy loved burden of dreams that are dead, let us rest,
Let us scatter their ashes away, for a while let us mourn;
We will rest, O my heart, till the shadows are gray in the west.



But soon we must rise, O my heart, we must wander again
Into the war of the world and the strife of the throng;
Let us rise, O my heart, let us gather the dreams that remain,
We will conquer the sorrow of life with the sorrow of song.

In The Forest by Sarojini Naidu



(নীচে ছড়াটা ভালো দেখা যাচ্ছে না, তবে বনে বেশ কয়েকটা ছড়া চোখে পড়েছে। এ ছড়াগুলোই বনে পানির উৎস)



(পাঠক অনুমান করুন তো এটা কি হতে পারে?......... পিপড়ার বাসা!!!!!!!!)



He skips through the copses singing,
And his shadow dances along,
And I know not which I should follow,
Shadow or song!



O Hunter, snare me his shadow!
O Nightingale, catch me his strain!
Else moonstruck with music and madness
I track him in vain!

In The Forest by Oscar Wilde



(এই ছবিতে একটা কুলু বানর আছে, হয়তো বোঝা যাচ্ছে না...)



(একদল হনুমান...)

শেষ করবো রাতের রেমা-কালেঙ্গা আর তার অভিজ্ঞতাটুকু বর্ণনা করে।
শনিবার রাতে ভাত খাওয়ার পর হাটতে বের হয়েছি- আমি আর আমার দুই যাত্রাসঙ্গী। কয়েকঘর দোকান, সাথে দুর্বল বৈদ্যুতিক আলোয় অভয়ারণ্যের মূল প্রবেশপথ ঘেষেই চলছে ইট ভাঙা। এ সুযোগে বলে নেই রেমা কালেঙ্গা বনে ঢোকবার যে প্রবেশপথ- তার থেকেও প্রায় তিন-চার কি.মি. পর থেকে আসলে মূল বনের শুরু। সুতরাং, 'বন ঘেষে ইট ভাঙা' কথাটা টেকনিক্যালি সঠিক হলেও ফ্যাক্ট আসলে ভিন্ন।
যাই হোক- সারাদিন বনে জঙ্গলে হেটে হেটে আমরা সবাই খুব ক্লান্ত, তাছাড়া পরদিন আবার খুব ভোরে উঠতে হবে ওয়াইল্ড-লাইফ দেখার জন্য। বেলা যত গড়ায়, পশু-পাখি বনের তত গভীরে যেতে থাকে, সুতরাং তাদের দেখতে পারার জন্য সব থেকে পারফেক্ট দু'টো টাইমই হোল সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের সময়টুকু।
আমরা হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে যাবার আগে শেষবারের মত রাতের বন দর্শনের জন্য মূল ফটক দিয়ে ঢুকলাম। কিন্তু বড়জোড় পঁচিশ ত্রিশ কদম আগানোর পরই মনে হোল আর আগানোটা ঠিক হবে না!
চারপাশে দৈত্যাকৃতি সব গাছ- উপরের আকাশটাকে অনেকখনিই আড়াল করে রেখেছে। টুকরো টুকরো নভোমন্ডল যা-ই বা দেখা যাচ্ছে- সেটা অপূর্ব নক্ষত্র-শোভিত, একেবারেই পরিষ্কার। জমাট অন্ধকারের মত গাছেদের গায়ে জ্বলতে থাকা তারার দল ক্রিসমাস ট্রি এর কথা মনে করিয়ে দেয়। দূরে কোথাও আদিবাসিদের কোন একটা উতসব চলছে বোধহয়, ঢাকের বাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে। প্রচন্ড আওয়াজে ডাকতে থাকা নাম-না-জানা পোকামাকড়ের কোলাহলের পরও কি নিমগ্ন, নিস্তব্ধ পুরো বনভূমি ! অদ্ভূত হলেও সত্য- এমন পরিবেশে কি যেনো একটা হয়! সকল যুক্তি, তর্ক অথবা সতর্কতার অতীত হয়ে মানুষ প্রবেশ করতে চায় বনের আরো, আরো গভীরে। এই আকর্ষণের কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই, শুধু তার সত্যতাটুকুকে জানি; প্রচ্ছন্ন হলেও সে অস্তিত্বময়- এটুকু বলতে পারি!

সে রাতে আমাদের আর বনে ঢোকা হয় নি। গহীন অরণ্যের নৈশকালীন সে ক্ষমতাধর রহস্যটাকে- রহস্যের মতই থাকতে দিয়ে আমরা একটা সময় পর হোটেলে ফেরত এসেছিলাম।

"কাল রাতে চিতাবাঘিনী হরিণের মুখের রূপে ফেনিল হয়ে উঠেছিলো
কাল চৈত্রের জোৎস্নায়
রূপালি শিশির বেগুনী ছায়ার দেশে
জাফরিকাটা জানালার রাজ্যে
সবুজ জাফরান রঙের বাতাসের উষ্ণতায়
প্রান্তরে-প্রান্তরে চাদের আলোর কমলা বর্ণের মদিরার ভিতর
এরা দু'জন অরণ্যের স্বপ্ন তৈরী করেছিলো কাল...."

সুন্দরবনের গল্প, জীবনানন্দ দাশ
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৬ রাত ১১:৫০
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবি কখনো কখনো কিছু ইঙ্গিত দেয়!

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৭



গতকাল ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাথে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এর ভার্চুয়ালি কথা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের অফিসায়াল এক্স পোস্টে এই ছবি পোস্ট করে জানিয়েছে।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের পিছনে একটা ছবি ছিল ১৯৭১ সালের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রথম আলু

লিখেছেন স্নিগ্দ্ধ মুগ্দ্ধতা, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



লতিফপুরের মতি পাগল
সকালবেলা উঠে
পৌঁছে গেল বাঁশবাগানে
বদনা নিয়ে ছুটে



ঘাঁড় গুঁজে সে আড় চোখেতে
নিচ্ছিল কাজ সেরে
পাশের বাড়ির লালু বলদ
হঠাৎ এলো তেড়ে




লাল বদনা দেখে লালুর
মেজাজ গেল চড়ে।
আসলো ছুটে যেমন পুলিশ
জঙ্গী দমন করে!





মতির... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×