অন্য কারো কথা জানিনা, কিন্তু আমি ঠিকই গুরুর উপর ভরসা রেখেছিলাম। চাপের মুখে কীভাবে উঠে দাঁড়াতে হয় এটা ম্যাশের থেকে আর কে ভাল করে জানে!!!
প্রথম ম্যাচের পর সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আশ্চর্যজনক ভাবে আমি প্রথম ম্যাচ হারা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না। একটা ম্যাচই তো মাত্র, সিরিজ তো হারিয়ে যায়নি হাতের নাগাল থেকে। বাঘেরা আহত অবস্থায়ই বেশি আক্রমণাত্নক থাকে। বাঘকে আহত করতে নেই, বাঘকে পরাজিত করতে হলে সরাসরি মেরে ফেলতে হয়। আহত বাঘকে জীবিত রাখলে এরপর আর ঐ বাঘের হাত থেকে রেহাই নেই কারো। সব দুমড়ে-মুচড়ে দিবে।
রূপক কথা হলেও, তাই ই হল কিন্তু। বাঘদের সর্দারই এই দুমড়া-মুচড়ানো মিশনে সবার থেকে বেশি আক্রমণাত্নক ছিল।
ম্যাশকে নিয়ে কয়েকদিন আগেই একজন বলল - সে খুবই গড়পড়তা মানের এক খেলোয়ার, অধিনায়কত্বই আর কেমন - দলে ভুড়ি ভুড়ি পারফর্মার থাকলে যে কেউই সেরা অধিনায়ক হতে পারবে।
মুখের উপর একজনকে কড়া জবাবও দিয়েছিলাম। তবে শান্তিতে ছিলাম না, সঠিক জবাবটা গুরুই দিতে পারবে ভাল করে। গুরু না দেওয়া পর্যন্ত সব জবাবই অপূর্ণ। আজকে তা একদম কড়ায়-গণ্ডায় পূরণ করে দিল।
আজকের ম্যাচের গুরু নামাঃ
ম্যাশ যখন ব্যাটিং-এ নামলো আমরা তখন ধুঁকছি। দলের রান তখন ৪১.৪ বলে ৭ উইকেটে ১৬৯। আগের ম্যাচগুলোতে শেষের দিকে যে রকম ব্যাটিং করেছি আমরা - তাতে ২০০ রানকে মিথলজিক্যাল স্কোর মনে হচ্ছিল। বহু দূরের স্বপ্ন। ভরসা তখন নাসিরই - অন্যরা শুধু তাকে সঙ্গ দিতে পারলেই মোটামুটি ফাইটিং স্কোর হবে।
ম্যাশ আসলো। নাসিরকে সঙ্গ দেওয়াই যেখানে প্রধান কাজ তার, সেখানে এটাকে বানিয়ে ফেলল - নাসির তাকে যোগ্য সঙ্গ দিচ্ছে। দ্বিতীয় বলেই বিশাল ছক্কা। ঐটা ছিল ম্যাশের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৫০ তম ছক্কা।
ম্যাশ প্রথম ছক্কা মারতেই টিভির সামনে থেকে উঠে পড়ি আমি। নিজেকে তখন কুফা মনে হচ্ছিল। উঠলে মনে হয় কিছু রান হবে আজকে। আসলেই তাই হল। ম্যাশ এক ছক্কায় ক্ষান্ত হল না। তিনটা বড় বড় ছক্কার সাথে দুইটা চারও মারলো। ৩৭ মিনিট ক্রিজে থেকে ২৯ বল যখন শেষ ওভারে আউট হয় তখন তার রান ৪৪। দলের রান ২৩৮। মোটামুটি ফাইটিং স্কোর না - বড়সর ফাইটিং স্কোরই করা গেছে ম্যাশের সৌজন্যে।
ম্যাশের ২৯ বলঃ ১, ৬, ০, ০, ০, ০, ৬, ১, ০, ০, ৪, ২, ১, ০, ৬, ২, ৪, ১, ১, ২, ১, ১, ১, ২, ০, ০, ২, ০, ১ = ৪৪ (শুধু বাউন্ডারিই না, সিঙ্গেলে স্ট্রাইকও রোটেট করেছে।)
এরপর শুরু হল আসল খেলা। পুরোপুরি আনপ্রেডিক্টেবল ট্যাক্টিস আর অধিনায়কত্ব।
ইনিংসের শুরুই অ্যাটাকিং ফিল্ডপ্লেসমেন্টের সাথে সাকিবকে দিয়ে। ইংল্যান্ডের দুর্বলতা স্পিন। আজকের পিচ ঐসময় স্পিনকে সহায়তা করছিল। সাকিবকে প্রথম ওভারেই বোলিং-এ আনা শুধু সাহসী পদক্ষেপই না, খেলাকে ভালভাবে পড়তে পারার এক দক্ষতাও ছিল।
এরপর নিজেই আসলো। আমি তখন ভেবেছিলাম হয়তো শফিউলকে দিবে। ইনজুরি আক্রান্ত মানুষটা এতক্ষণ ক্রিজে থেকে ব্যাট করলো, একটু বিশ্রামের তো দরকারই। ম্যাচের মাঝে ম্যাশের আবার কিসের বিশ্রাম!!! আগে খেলা জয়, তারপর অন্যকিছু।
ইংল্যান্ডের প্রথম উইকেটও নিজেই নিল।
ম্যাশ-সাকিব এই বোলিং জুটিই বল করলো ১৩ ওভার। ইনজুরিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ম্যাশ নিজেই টানা ছয় ওভার বোলিং করে গেলো। শুধু বোলিং করার জন্যই হাত ঘুরায়নি, তিনটা উইকেটও টপাটপ গিলে নিয়েছে।
ইংল্যান্ড খেলাটা আসলে হেরে গেছে ঐ জায়গায়ই। ম্যাশের অদ্ভুত ট্যাক্টিসের ঐ জুটি ১৩ ওভারে ৪ উইকেট নিয়ে ৫০ রান দিয়েছে। আক্রমনাত্নক মানসিকতার অধিনায়করা রান একটু বেশিই কনসিড করে, কিন্তু সাথে সাথে উইকেটও তুলে নেয়।
ম্যাশ ঐ সময়ই খেলাটা ইংল্যান্ডের হাত থেকে বের করে ফেলেছিল। ইংল্যান্ড বারবার ফিরতে চেয়ে আর ফিরতে পারেনি ম্যাচে।
প্রথম স্পেলেই দলের অভিজ্ঞ দুই বোলারের এত ওভার খরচ করে ফেলাটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও - সেই ঝুঁকিতে একদম সফল তারা।
এরপর হাত ঘুরানোর কাজটা ছিল অন্যান্যদের। মাস্টারমাইন্ড গুরু ম্যাশ।
ফিল্ড সেটের কারণে চাপে পড়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। সিঙ্গেলও রেগুলার নিতে না পারায় বাউন্ডারির দিকেই ঝোঁক ছিল তাদের। তাই তাসকিন প্রথম দুই ওভারে একটু বেশি রান দিয়ে ফেলে। ঐ সময়টায়ই একটু চাপে পড়ে যাই আমরা।
বাধ্য হয়েই ম্যাশ তার গোল্ডেন আর্ম নাসির গোল্ডকে অ্যাটাকে নিয়ে আসে। নাসিরও গুরুর আস্থার সঠিক প্রমাণ দেয়। চাপতে শুরু করে ইংল্যান্ডকে। সেই সময়টায়ই আবার তাসকিনকে অ্যাটাকে আনা হয়। ম্যাশ ভালভাবেই জানে কখন কোন বোলারকে কোথায় আনতে হবে, ঐ বোলারকে কেমন সাপোর্টটা দিতে হবে। এবং ঐ ওভারেই তাসকিন বিপদজ্জনক হয়ে উঠতে থাকা জুটিটাকে ভেঙ্গে দেয়।
এই নাসির-তাসকিন জুটিই ছিল পরবর্তী দশ ওভার। ম্যাশ-সাকিব জুটি ইংল্যান্ডকে কক্ষপথচ্যুত করে দিয়েছিল, আর নাসির-তাসকিন জুটি ইংল্যান্ডকে একদম কক্ষপথের বাইরে ছুড়ে দেয়। (এই জুটির পরিসংখ্যান ১০ ওভারে ৩৭ রান ৪ উইকেট) অবশ্যই নাসির-তাসকিন প্রশংসার দাবিদার এর জন্য, কিন্তু মাস্টারমাইন্ডের দক্ষতাই চোখে পড়েছে বেশি। কারণ, অন্য কেউ অধিনায়ক হলে ঐ সময়টায় তাদেরকে এতক্ষণ বোলিং করাতো না।
(সাকিবের এই অসাধারণ ক্যাচকে মনে রাখতেই হবে)
এরপর আরেকটা অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেয় মাশরাফি। ধারাভাষ্যকাররাও এতে অবাক হয়েছিল। অভিজ্ঞ বোলার থাকতে ঐ পুঁচকে সৈকতকে কেন বোলিং-এ আনলো?? কী দরকার ওকে আনার!!
সৈকত প্রথম বলে চার খাওয়ার পর ধারাভাষ্যকাররাও মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করেছিল, তখনই সব হাসি শেষ অবশ্য - ঐ পুঁচকে পোলাই চার খাওয়ার একবল পরেই উইলিকে ফিরিয়ে দেয়। সেটাও আবার ক্ল্যাসিক অফস্পিন-বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান অ্যাকশনে।
ম্যাশের আক্রমণাত্নক মানসিকতার আরেক নমুনা। ইংল্যান্ডের ৮ উইকেট নাই, ক্রিজে আছে দুই বোলার। ঐ সময় কি কেউ অ্যাটাকিং ভাবে চিন্তা করবে? আরামেই তো খেলা যাবে। কিন্তু মাশরাফি কি আর আরামের লোক? দেখতেছিল উইলি অফস্পিনে সুবিধা করতে পারছে না - ওকে দ্রুত আউট না করলেও সমস্যা করতে পারে - তাই মোসাদ্দেককে আনলো। এবং উইলি সমস্যা করার আগেই শেষ।
শেষ উইকেটটা বেশ ভুগিয়েছে যদিও। তবে শেষটা মাশরাফি নিজেই করেছে। এখানেও রিস্ক ছিল, ব্যাটসম্যানকে হিট করার সুযোগ দিয়েছিল একটা। টেইল-এন্ডার ব্যাটসম্যান এভাবে রান পেলে ওভার কনফিডেন্ট হয়ে উঠে। বল না বুঝেই সমানে ব্যাট চালায়। তাই সুন্দর করে একটা কাটার দিল বলকে হিট করার জন্য। শেষ এরপরই সব।
মাশরাফি শুধু ব্যাট-বলেই না, ফিল্ডেও যেরকম এগ্রেসন দেখিয়েছে - সেটা অনেকদিন দেখিনি। আর মাশরাফি আগ্রাসী মনোভাবে থাকলে দলের শরীরী ভাষাই বদলে যায়। প্রমাণ - বাটলার আউট হওয়ার মাশরাফি আগ্রাসী উদ্যাপন। ঐটা দেখে ঠান্ডা স্বভাবের মাহমুদুল্লাহ্রও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠা।
বোলিং স্ট্যাটঃ ৮.৪-০-২৯-৪
প্রথম স্পেলঃ ৬-০-২১-৩
দ্বিতীয় স্পেলঃ ২-০-৭-০
তৃতীয় স্পেলঃ ০.৪-০-১-১
দলে শুধু পারফর্মার থাকলেই হয় না, পারফর্মারকে ঠিক ভাবে ব্যবহার করাও জানতে হয়। পারফর্মারের সাথে সাথে এদেরকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার মত নেতাও থাকতে হয়। এটা বাংলাদেশে মাশরাফির থেকে ভাল আর মনে হয় না কেউ জানে।
ম্যাশফলকঃ
আজকের ম্যাচে মাশরাফি কিছু মাইলফলক ছুয়ে ফেলল।
অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি জয়।
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ ছক্কা মারার রেকর্ড।
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চবার (১১ বার) ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হওয়া।
(ইশশ! ইনজুরিতে না থাকলে সবগুলোর টপেই থাকতো ম্যাশ নিশ্চিত।)
ওল্ড ইজ গোল্ড - নাসির গোল্ডঃ
ম্যাশ স্তুতি করতে গিয়ে নাসিরকে ভুললে চলবে না। ভারত সিরিজ থেকে নাসিরের একটা বিশেষণ তৈরি হয়েছিল। নাসির হল ম্যাশের গোল্ডেন আর্ম। যতবার ম্যাশ নাসিরের হাতে বল তুলে দিয়েছে ততবারই নাসির সফলতা এনে দিয়েছে।
আজকে ১০ ওভার বল করে ২৯ রান দিল মাত্র। কৃপণ মানে, মহা কৃপণ মনোভাব ছিল নাসিরের বোলিং-এ। জানিনা - এই কৃপণতার কারণে তাকে না আবার কোন শাস্তি দেয় পাপন আঙ্কেল। হয়তো বলে বসতে পারে - সমগ্র বাংলাদেশের সব মেয়েই নাসিরের গার্লফ্রেন্ড - তাই তাকে বাদ দেওয়া হল দল থেকে।
নাসিরের পারফর্ম এর থেকে বেশি ভাল ছিল ব্যাটিং-এ। ২৭ বলে ২৭ রান হয়তো অনেকের কাছে তেমন কিছুই না। কিন্তু সে এই ২৭ বল টিকে ছিল দেখেই ম্যাশ ঐদিক দিয়ে রান করতে পেরেছে। স্ট্রাইক রোটেড করেছে নিয়মিত। বুঝে খেলা যাকে বলে সেটার প্রমাণই দিয়েছে নাসির। ম্যাশ যখন হিট করেছে সে তখন সিঙ্গেলে খেলেছে। আবার ম্যাশ বল ডট দিলে সে হিট করেছে। এইজন্যই রানটা ১৬৯ থেকে ২৩৮ এর পৌছাতে পেরেছিল। শেষ ৫০ টা বল বলতে গেলে নাসির ছিল বলেই খেলা গেছে।
বাংলাদেশের সেরা ফিনিশার সে - কেন সে সেরা তার প্রমাণ করলো। নাসির না থাকলে হয়তো আজকের ম্যাচে ২০০ রানও হত না। (তার রিপ্লেসমেন্টে যেই লিজেন্ড আসছিল দলে, সে হয়তো এখন রিটায়ারমেন্ট স্পিচ রেডি করছে। বুড়া মানুষ আর কত খেলবে!!!)
মাশরাফি আজকের ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হলেও - সেরা পারফর্মার নাসির। (মাহমুদুল্লাহ্র ৭৫ রানটাও ভুলে যাওয়া চলবে না।)
ম্যাচের খুঁত সমূহঃ
জিতেছি বলেই যে সমালোচনা করা যাবে না - তা তো না।
কিছু কিছু ভুল ছিলই।
১। ব্যাটসম্যানদের অতিরিক্ত শট খেলার প্রবণতা।
২। সিঙ্গেল নেওয়ার প্রতি আগ্রহ না থাকা।
৩। ব্যাটিং-এর তিন নম্বর পজিশন। সাব্বির তিনে পারফেক্ট হলেও - সৈকতের খেলার ধরণে তাকেই তিন নম্বরে নামালে ভালো।
৪। টেইল-এন্ডারদের ব্যাটিং-এর বেসিক সম্পর্কে ধারণা না থাকা। আজকে মাশরাফি সহ ৯ ব্যাটসম্যান থাকায় রক্ষা। কিন্তু প্রতিদিন এমন হবে তার নিশ্চয়তা নেই।
৫। ব্যাটসম্যানদের সেট হয়ে উইকেট গিফট করে আসা। এটা অনেক বড় অপরাধ।
আক্ষেপঃ
১। মুস্তাফিজ।
২। ম্যাশের ৫০ না হওয়া।
৩। ম্যাশের ৫ উইকেট না পাওয়া।
ম্যাচ শেষে নিজের পারফর্মেন্স নিয়ে মাশরাফির বক্তব্যঃ
I'am happy that I got the wickets as well. I played my natural shots and I was lucky that it came off. Mahmudullah has been really playing well for us from the past one year. Nasir was unlucky
ম্যাচ তো বাংলাদেশ কতই জিতে - এ নিয়ে এত্ আবেগ কেন? আবেগের কারণ আজকে মাশরাফির বিধ্বংসী রূপ, তার ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হওয়া। কতদিন পর ম্যাশ ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হল। আজকে আবেগ না দেখালে কবে দেখাব??
তবে আরেকটা বড় কারণ হল - আজকে বাংলাদেশ খেলেছে অভিজ্ঞ একটা দলের মত(৪১.৪ ওভারের পর থেকে)। আর ইংল্যান্ড আন্ডারডগের মত। সাউথ আফ্রিকা, ইন্ডিয়া, পাকিস্তানকে সিরিজ হারালেও - বাংলাদেশ কিন্তু ঐগুলোয় ফেভারিট ছিল না। এই প্রথমবার আমরা আসলেই জেনুইন ফেভারিট।
পরের ম্যাচটা এখন ফাইনাল ম্যাচ। সিরিজের আকর্ষণ এখন অনেক বেড়ে গেল। রুদ্ধশ্বাস একটা ম্যাচের অপেক্ষা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৬ ভোর ৫:২৪