ভাদ্রের ভবঘুরে মেঘমালা পড়ন্ত বিকেলের সোনালী-হলুদ আভার সাথে ক্রমশ বিলীন হচ্ছে। শ্রাবণের ডাওর ইস্তফা নিয়েছে দিন কয়েক হলো। ক্যালেন্ডারের পাতায় বর্ষা বিদায় নিয়ে শরতের আগমন ঘটলেও প্রকৃতিতে রয়ে গেছে বর্ষার বিপুল বিচরণ। পানিতে ভরপুর আশপাশের জমি, ডোবা-নালা ও পুকুর। আজ ভাদ্র মাসের দশ তারিখ। সন্ধ্যাটা কেমন জানি নিস্তব্ধ লাগছে অন্য দিনের চেয়ে। বাড়ির পেছনে আমগাছের সারি। জরাজীর্ণ আম গাছটি বর্ষায় বাজ পড়ে নিথর হয়ে আছে। একটু বাতাসেই পড়ে যাবার কথা। পড়ছে না। দাঁড়িয়ে আছে বহাল তবিয়তে। দুপুর হতে কয়েকটি কাক অনবরত ডেকে যাচ্ছে কা কা করে। বিশ্রী ধরনের ডাক। ‘মরার অলক্ষুণে কাউয়া কোত্থেকে আইলো? এ বাড়িতে মরার কে আছে?’ এ বলে রহিমা খাতুন বার কয়েক তাড়া করলেও ফিরে এসেছে তারা।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আসরের নামাজের অযু দিয়ে মাগরিব আদায় করবেন বলে বসে রইলেন রহিমা খাতুন। উঠানে বসে তাসবিহ গুনতে গুনতে পুত্রবধুকে ডাক দিলেন- ‘চন্দ্রবানু! হারিকেনগুলাতে তেল ঢালো, চিমনিগুলা মুছে নাও’। ‘জি আম্মা’ বলে সাড়া দিয়ে মাঝের ঘরে মাচার নিচে রাখা কেরোসিনের বোতল ও দুটো হারিকেন আর একটি পুরোনো লুঙ্গির টুকরা নিয়ে ঘরের বাইরে এসে বসে বসে চিমনি মুছে পরিষ্কার করছে চন্দ্রবানু। মোছা শেষ হলে কেরোসিন দেবে হারিকেনে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সূর্য ডোবার আগেই ঘরে সাঁঝ-চেরাগ দিতে হবে।
চন্দ্রবানুর আসল নাম মরণি। তার জন্মের আগে আরো একভাই ওদুবোনের জন্ম হয়েছিলো। কেউই দুদিনের বেশি বাঁচেনি। এ নিয়ে কম কটুক্তি সহ্য করতে হয়নি চন্দ্রবানুর মাকে। অলক্ষুণে, ডাইনি, বংশের বাতি খেকো আরো কত অপবাদ। প্রথম সন্তান মারা যায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। বংশের প্রথম সন্তান, বংশের বাতি। তার জন্য কী না করেছেন চন্দ্রবানুর দাদী। এ রোগের নাম মুখে নিতে নেই। তিনি নিজে মুখে নেননি, তার সামনে অন্য কাউকেও উচ্চারণ করতে দেননি। পুকুরে জাল ফেলে ভিজিয়ে রেখেছেন বংশের প্রথম বাতির আরোগ্য লাভের জন্য। লাভ হয়নি। শরতের কাকডাকা দুপুরেই ঘুমিয়েছিলো জ্বর আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে। সে ঘুম আর ভাঙ্গেনি। এর পর যে মেয়েটি জন্ম নেয় সে জন্মের পর কাঁদেনি। হাসেওনি। বরং অন্য সবাইকে কাঁদিয়ে সেও আর চোখ খোলেনি। তার পরের মেয়েটিও তাকে অনুসরণ করেছে। ‘বউ, ছেলে হইলে নাম রাখবা দুখু মিয়া আর মেয়ে হইলে রাখবা মরণি। মনে মনে নিয়ত করো। খোদা ফিরে তাকাইলেও তাকাইতে পারেন তোমার দিকে’- শ্বাশুড়ির এ কথায় চন্দ্রবানুর মা নিয়ত করলেন মনে মনে। সেবার পোয়াতি হলে আর আগের মতো বিশ একর জমির ধান ভানতে দেননি চন্দ্রবানুর মাকে। দুধ ডিম খাইয়েছেন রোজ নিয়ম করে।
অগ্রহায়ণের এক আলোকোজ্জ্বল চাঁদনী রাতে মায়ের কোল আলোকিত করে চন্দ্রবানু। ‘কইলামনা, মরনি নাম দিলে আর মরবো না!’- পুর্বনির্ধারিত নামে ডেকেই নাতনীকে কোলে নেয় দাদি।
দু-দুটো ছেলে পক্ষ ফিরে গেছে মরণি নামের কারণে। এটা কোনো নাম হয় নাকি? সর্বশেষ; নামের জন্য এমন চাঁদমুখী মেয়ের মুখ হতে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেননি রহিমা খাতুন। বিয়ের পর তিনি পুত্রবধুর নাম দেন চন্দ্রবানু। দুইটা না চারটা না, একটা মাত্র ছেলে। সন্তান বলতে ওই একটিই। একমাত্র ছেলের বউ তার মনে ধরেছে। তার মনে কন্যাসন্তানের ফারাক পূরণ করেছে চন্দ্রবানু। ছেলের বউকে নিজের মেয়ের মতোই দেখভাল করেন।
মাগরিবের নামাযের আযান পড়েছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রহিমা খাতুন ডেকে বলেন- ‘তারাবালি কই চন্দ্রবানু?’
‘খেলতাছে বোধহয় ওই দিকে’। শ্বাশুড়ির কৌতুহলের জবাব সাবলীলভাবেই দেয় চন্দ্রবানু।
তারাবালি রহিমা খাতুনের একমাত্র নাতনি। চন্দ্রবানু ও বাহার উদ্দিনের ঘরের একমাত্র সন্তান। এ কন্যা সন্তানের জন্য কম অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়নি চন্দ্রবানু ও বাহারকে। সামনের ঘরের বিধবা ফুলবানু একদিন কথায় কথায় বলে- ‘কী রহিমা ভাবি, নাতি নাতনির মুখ না দেইখাই মরবা নাকি?’
‘আর কইয়োনা ফুলবানু। কী না করছি আমি কও? পাগলা মামার পানি পড়া পর্যন্ত কাজ হচ্ছে না।’
পাগলা মামা ওরফে পাগলা দরবেশকে এ গ্রামের মানুষ পির মানে। তার ইশারাতেই অনেক বোবা মানুষের স্বরযন্ত্র খুলে গেছে। তার পানিপড়া খেয়ে পোয়াতি হয়েছে শত বন্ধ্যা নারী। সে পাগলা মামার পানি কাজ না করা নারী ছোটখাটো বন্ধ্যা না। এমনই বিশ্বাস ফুলবানুর।
পাগলা মামার পুরো নাম মীর মানিক। লম্বায় ছফুট। শরীরের কেশসমগ্রে পাক ধরেছে। সাদা হয়ে এসেছে মুখের দাড়ি ও মাথার চুল। বয়সে ভারে কিঞ্চিৎ কুঁজো হয়ে এসেছেন। পেছনে হাত দিয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটেন। সাথে থাকে তার এক বা একাধিক শাগরেদ।
‘শোনেন চাচী, এসব অন্ধ বিশ্বাস ছাইড়া বউটারে আর ছেলেটারে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়া যান।’ ঘর থেকে বেরিয়ে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু বুঝতে পেরে পরামর্শ পেশ করে জোহরা।
জোহরা এ বাড়িরই মেয়ে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের পড়ায়। বয়স চব্বিশ পেরিয়ে পঁচিশের ঘরে পা রেখেছে। গায়ের গড়ন ছিপছিপে হওয়ায় তা মনে হয় না। মনে হয় সবে মাধ্যমিক পাশ করেছে।
‘হুন জোহরা, বয়স ম্যালা হইছে। আর কদিন গেলে তোর কপালেও খারাপি আছে। হুইনা থো। মাইয়া মানুষ পড়ালেহা কইরা দুনিয়া উল্টাইতে পারবিনা। এত পইড়াও প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারনি হইলি, কদিন গেলে ঠিকই চুলায় লাকড়ি দিবি। শুধু শুধু বাপের ঘরের বোঝা না হইয়া সংসারী হ বুঝলি?’- জোহরার কথায় টিপ্পনি কেটে মনের জ্বালা মেটায় ফুলবানু।
এদিকে বিয়ের দুবছরের মাথায়ও সন্তানের দেখা না পেয়ে একটু একটু করে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে বাহার। শহরে থাকলেও মনটা পড়ে থাকে গ্রামের বাড়িতে। ঢাকার জিগাতলায় মনেশ্বর রোডের পূর্ব মাথার মোড়ে চায়ের টং নিয়ে বসে বাহার। চা বিস্কুটের সাথে আছে পান সিগারেট। ঢাকা শহরের একাধিক কলেজ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ধানমণ্ডি ও তার আশপাশের এলাকায় হওয়ায় ছাত্রদের বিরাট একটা অংশ জিগাতলার বিভিন্ন দালানে ব্যাচেলর হিসেবে ঠাঁই নেয়। কাঁচাবাজার মসজিদের ইমাম থেকে কলেজ ছাত্র কামাল, মনেশ্বর রোডের লেদার লোকমান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র বদরুল; অনেকেই তার টংয়ের নিয়মিত গ্রাহক। কেউ নামাজে যাওয়ার আগে আদা লেবু দিয়ে এককাপ লাল চা পান করে, কেউবা স্যারের বাসায় পড়তে যাওয়ার আগে ভোরে বা সন্ধ্যায় চায়ে বিস্কুট-রুটি চুবিয়ে খেয়ে যায়। তিন রাস্তার মোড়ে হওয়ায় চলতি পথের শত কাস্টমার তার। ব্যবসাটা তার ভালই চলছে। বাড়ির লোকজন জানে ছেলে ঢাকায় ব্যবসা করে। ইনকাম ভাল। কিসের ব্যবসা তা আর জানতে চায় না। শুধু জানতে চায় ‘তার বউ নাকি বন্ধ্যা?’
‘কী ব্যাপার বাহার ভাই? শরীর খারাপ?’- কাঁচাবাজার মসজিদের ইমাম মিজান ভাইয়ের কথায় চমকে ওঠে বাহার। কিছু একটা নিয়ে সে চিন্তিত। ঢাকা শহরে মামা সরকারি সম্বোধনে পরিণত প্রায়। কোনো কোনো দোকানে লেখাই থাকে- ‘এখানে মামা ডাকা নিষেধ’। এ বয়সী সবাই তাকে মামা ডাকলেও মিজান তাকে বাহার ভাই বলে সম্বোধন করে। মিজান কাঁচাবাজার মসজিদের পাঞ্জেগানা ইমাম হিসেবে এখানে থাকলেও তার আরো একটি পরিচয়- সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। আচার আচরণে যেমন মোলায়েম, তেমন বিনয়ী। তার সাথে এ এলাকার সকল ব্যবসায়ীই সম্মানের সহিত সদাচারণ করে।
‘না মিজান ভাই। মনটা একটু খারাপ।’
‘কী সমস্যা বাহার ভাই?’
‘একটু ব্যক্তিগত সমস্যা, কাউকে যে ডেকে একটু পরামর্শ নেবো তাও হয়ে উঠতাছেনা’
‘আমার সাথে বলা যাবে?’
‘আপনি শিক্ষিত মানুষ। আপনাকে বলা যায়।’
টংয়ে এই মুহুর্তে কাস্টমারের চাপ কম। চা পানের স্বল্প সময়ের সংক্ষিপ্ত কথোপকথন শেষে উঠতে উঠতে মিজান বলে- ‘শোনেন ভাই, সন্তান সন্ততি আল্লাহপাকের রহমত। তিনি কাউকে দান করে পরীক্ষা নেন, কাউকে দান না করে পরীক্ষা নেন। ধৈর্য ধরুন, আল্লাহকে ডাকুন। আর কার্ডটি রাখুন। আমার দুঃসম্পর্কের খালাতো ভাই। রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে ইনফার্টিলিটির ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। ইনফার্টিলিটি মানে বন্ধ্যাত্ব। পারলে সময় করে ভাবীসহ একদিন তার চেম্বারে দেখা করুন’। টাকার ভাঁজ থেকে কার্ডটির সাথে বাহারের হাতে চায়ের বিল দিয়ে আজকের মতো বিদায় নেয় মিজান। বাহার একবার ভেবেছিলো আজকে চায়ের দাম নেবেনা। কী মনে করে আর না করেনি। ভেবেছিলো পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলবে ‘মিজান ভাই, আজ চায়ের পয়সা লাগবোনা। এই নেন। রাইখা দেন’।
মিজান ভাই বলবে- ‘না না, কী যে বলেন ভাই। নেন, রাখেন’। এই বলে জোর করে তার হাতে আবার টাকা গুঁজিয়ে দিয়ে হনহন করে হাঁটা দেবে। কিন্তু কী মনে আর পেছন থেকে ডাকেনি বাহার।
বাহারের নিয়মিত কাস্টমারদের একজন কলেজছাত্র কামাল। দেখে হাবাগোবা ধরনের মনে হলেও মুখে চরম চতুর।
‘হুজুরের সাথে কিসের এতো মিষ্টি আলাপ হইলো মামা?’ কোতুহলী ভঙ্গিমায় জিজ্ঞেস করলো কামাল। কামালের সাথে এর আগেও অবসর সময়ে অনেক আলাপ হয়েছে বাহারের। বয়সে অনেক ছোট হলেও কামালের বুদ্ধি ও পরামর্শকে বারবার বাহবা দিয়েছে বাহার। বিষয়টি নিয়ে কামালের সাথেও কিঞ্চিৎ কথোপকথন হলো বাহারের।
‘শোনো মামা। এসব ঝাড়ফুঁক আর পানি পড়ায় বাচ্চা হয়না। বাচ্চা হয় শুক্রাণু আর ডিম্বানুর মিলনে। শুক্রাণু বোঝো?’
‘বাহার ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়ায়।’
‘ডিম্বানু বোঝো?’
‘বাহার আবারও ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়ায়।’
‘আচ্ছা এতসব বুঝতে হবে না। আমার কোচিংয়ের সময় হয়ে আসছে। কেয়া কোচিংয়ে যাবার জন্য এ পথ দিয়ে এলে আমি তার পিছু পিছু কোচিংয়ে চলে যাব। তার আগেই আলোচনার ইতি টানতে হবে। রজঃচক্র বোঝো?’
প্রসঙ্গ বহির্ভূত চরিত্র-কেয়ার জন্য কেন অপেক্ষা করে কামাল তা বুঝলেও রজঃচক্র শব্দটা তার বুঝতে একটু সময় লাগছে। তবে তার মন হচ্ছে সে বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। বই পুস্তকের ভাষা হওয়ায় হয়তো আগে শোনেনি এভাবে। তবে বিষয়টি সে বুঝতে পেরেছে। তাই ওপর নিচ মাথা নাড়ল।
‘সময় নাই হাতে। কোচিংয়ে যেতে হবে। চক্রের বারো থেকে ষোলতম দিন মামীকে সময় দিও। নিজের মর্জিমতো মাসের শেষ শুক্রবার বাড়ি গিয়ে শনিবার ব্যাক করলেতো হবেনা’। এ বলে হনহন করে মনেশ্বর রোডের দিকে হাঁটা দেয় কামাল। কেয়া আসেনি এখনো। তবুও সে আজ আগেই চলে যাচ্ছে কৌশিক স্যারের কোচিংয়ে।
এবার বাড়ি এসে বেশ কিছুদিন কাটালো বাহার। আশপাশের কলেজে গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলায় বেচাকেনাও এ সময়ে একটু কম। আশপাশের স্যারদের প্রাইভেট কোচিংও বন্ধ। তাই এ সময়টা বাড়তেই কাটালো। ফেরার সময় চন্দ্রবানুকে শহরে নিয়ে যেতে চাইলো সপ্তাহখানেকের জন্য। নিলে যদি ছেলের মনটা একটু ভাল হয় এ জন্য রহিমা খাতুনও বাধা দেননি। মেয়েটারও একটু শহর দেখা হবে এই ভেবে। আগের দিন রাতে চন্দ্রবানুকে ডেকে নিয়ে কোমরে একটা তাবিজ বেঁধে দিলেন। ‘এ তাবিজ ভুলেও খুলবা না’- বলে মৃদু হুঁশিয়ারিও দিলেন রহিমা খাতুন।
ঢাকা থেকে ফিরেছে দিন কয়েক হলো। সেদিন সকালে ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে হঠাত মাথাটা কেমন জানি করে ওঠে চন্দ্রবানুর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বমি আসে মুখে। বমি করার শব্দ শুনে সামনের ঘর থেকে ওপরের পাটির দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ফুলবানু মনে মনে বলে- ‘পাগলা মামার তাবিজ। কাজ না হইয়া যাইবো কই?’
বসন্তের তারাভরা কোনো এক রাতে চন্দ্রবানুর কোল আলোকিত করে এক কন্যা সন্তান। ‘গায়ের রঙটা মায়ের পাইলেও চেহারাটা একদম আমার বাহারের মতো’। এই বলে নাতনীকে কোলে নিয়ে রহিমা খাতুন বলেন- ‘আমার এই বইনটার নাম রাখমু তারাবালি’। বাহারের পছন্দ তামান্না। চন্দ্রবানুর পছন্দ সুলতানা। তামান্না সুলতানা তারাবালি। এই হলো তারাবালির পুরো নাম।
মাগরিবের নামাজ শেষে রহিমা খাতুন আবারো বললেন- ‘ও বউ, তারাবালি কই?’ বউয়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে ঘরের বাইরে আসেন রহিমা খাতুন।
‘ও ফুলবানু, তারাবালিরে দেখছস?’
‘না ভাবি। বিকালে আমার বইনের বাড়ি গেছিলাম। ফিরতে ফিরতে আজান দিলো। বাহারের বউ দেখলাম খোঁজাখুঁজি করতাছে তারাবালিরে। ব্যাপারীরগো নয়া পুকুরের দিকে যায়নাইতো? সাক্ষী না কাটা পুকুর।’
বাড়িতে দালান করার সময় বাড়ির পশ্চিমের জমি থেকে মাটি এনে ভিটে উঁচু করে মিয়াধন ব্যাপারী। মাটিকাটা শ্রমিকরা নতুন পুকুর খননের সময় পুকুরের মাঝে বড় একটা মাটির খ- রেখে যায়। ওটা সাক্ষী। বখশিশ দিলে শেষদিন যাবার আগে ওরা ওটা কেটে দিয়ে যাবে। নইলে সাক্ষী থেকে যাবে এভাবেই। এসাক্ষী পরে বলি নেবে। এমনটিই সবসময় বলে বেড়ায় ফুলবানু। অতিমাত্রায় মিতব্যায়ী মিয়াধন ব্যাপারী বখশিশ না দেয়ায় শ্রমিকরা সাক্ষী না কেটেই চলে যায়।
সন্ধ্যা পেরিয়ে আঁধার ঘনিয়ে এলো। তারাবালিকে খোঁজার জন্য বাড়ির সবাই নেমে পড়েছে। মতি মিয়া তার টর্চ দিয়ে শনপাতার বনে দেখছে। তার ভাষ্যমতে এ লাইট দিয়ে এক মাইল দূরের নিশানাও দেখা যাবে। এ লাইট তার ভাই সুদূর বিলেত থেকে পাঠিয়েছে। এ শনপাতার বনে তারাবালি থাকলে সে অবশ্যই দেখতে পেতো। নেই।
বাড়ির সামনের ধানক্ষেতেও দেখা হলো হাঁটু পানিতে নেমে। নেই।
মতি মিয়ার ছোট মেয়ের সাথে তারাবালির বেশ খাতির। ক্লাস ফাইভে পড়ে সে। নাম রেণু। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো- শেষবার কোথায় তারাবালিকে সে দেখেছে।
‘ব্যাপারীগো পুকুর থেইকা আমি যখন হাঁস তুলে আনতে গেছিলাম, তারাবালিও আমার পেছন পেছন গেছিলো?’
‘গেছিলো মানে? তোর পিছু পিছু আবার আসেনাই?’ রেণুর কথার পিঠে আবার পালটা প্রশ্ন করে জোহরা।
‘তা দেহিনাই। আমি হাস নিয়ে চইলা আইলে সেওতো আমার পেছন আসার কথা’। এই বলে গলাটা ভারি করে তোলে রেণু।
‘তোদের হাস কয়টা?’
কাঁদো কাঁদো গলায় রেণু উত্তর দেয়- ‘দশটা। বড় হাঁস চারটা। বাচ্চা ছয়টা।’
এক দৌড়ে রেণুদের হাঁসের খোয়াড়ের দিকে যায় জোহরা। হারিকেনের আলোতে এক এক করে গুণে দেখে একটা বাচ্চা হাঁস কম।
‘হাঁস একটা কম গো!’ এই বলে বাড়ির পশ্চিমের পুকুরের দিকে ছুটে জোহরা। তার পিছু নেয় বাড়ির সবাই। এক তারাবালির জন্য আজ আকাশ বাতাসও কাঁপছে। মতি মিয়া পেছন থেকে হাঁক ছাড়লেন- ‘এই অন্ধকারে হারিকেন দিয়া কিছু দেখবিনা। সর, আমারে সামনে যাইতে দে। আমার লাইট দিয়া এক মাইল দূরেও দেখা যাইবো’। এই বলে ভিড় ঠেলে সামনে এসে পুকুরের উত্তর পাড় থেকে দক্ষিণ পাড়ে বন্দী পানির প্রতিটি ঢেউ সে দেখতে লাগলো। তার চোখের সাথে সমানতালে ঘুরছে বাড়ির সকলের চোখ। হঠাৎ, মতি দেখে দক্ষিণ পাড়ের কোণায় একটি হাসের বাচ্চা। কাকে যেন ইশারা করে বললো পাড় দিয়ে হেঁটে গিয়ে হাঁসের বাচ্চাটি তুলে আনতে। কী মনে করে আবার হাঁসের দিকে লাইট মেরে একটু কুঁজো হয়ে তাকালো। এরপর ‘ওরে তারাবালিরে’ বলে চিৎকার করে লাইটটা মাটিতে ফেলে পুকুরে ঝাঁপ দিলো।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৪১