সকালে ঘুম ভাংলো অনেক দেরী করে। বিছানার পাশে রাখা মোবাইলে সময় দেখাচ্ছে বেলা সাড়ে এগারোটা বাজচ্ছে। আমার ছুটির সকাল। দুনিয়ার অলসতা পেয়ে বসেছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষন মটকা মেরে শুয়ে থাকি। পেটের ভেতর ক্ষুধার অজগর সাপটা মোচড় দিতে উঠতে হলো।
ল্যাপটপে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে। আমার বেলা যে যায় সাঝবেলাতে..! গানটা শুনে নিজে নিজে হাসলাম।দুপুরে কেন সাঝবেলার গান! গান গানই। গানের কথায় সকাল দুপুর কিংবা সাঝবেলাই বা কি! গান শুনতে শুনতে ব্রেডে জেলি, চীজ মেখে আরাম করে বসি লিভিংরুমে। সেদ্ধ ডিমে কামড় দিতে দিতে গতরাতে অর্ধেক পড়া 'আনন্দবেদনার কাব্য' বইয়ের পাতা উল্টাই। হুমায়ুন আহমেদের কবি গল্পটা আমার অসম্ভব প্রিয়। আবারও পড়তে থাকি। প্রেসের মালিক সিরাজ সাহেব রেগে আছেন। ঝড় বাদলের দিন।প্রুফ রিডার আসেননি।মেশিনম্যান অলস হয়ে বসে আছে। সিরাজ সাহেবের ভেতরেও তুমুল ঝড়। আজ রাতটা কাটাবেন বিন্তির বাসায়। কিন্তু প্রুফরিডার জোবেদ আলীর জন্য সব কেমন ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে। অনেক রাত করে জোবেদ আলী প্রেসে আসেন। রাগী রাগী চেহারা করে রাখা সিরাজ সাহেব তেমন কিছুই বলতে পারলেন না। যতোটা মেঘ করে রেখেছিলেন চেহারায় তার বিন্দুমাত্র বর্ষন করতে পারলেন না। জোবেদ আলী " স্যার " বলতেই সিরাজ সাহেবের রাগ জল হয়ে যায়।খাতির করে বসিয়ে উলটো জোবেদ আলীকে চা খাওয়ান।
পড়তে পড়তে এখানে এসে দুধ চায়ের কথায় আমারও খুব চা খেতে ইচ্ছে হলো। হুমায়ুন আহমেদ তার গল্প- উপন্যাসে সবাইকে চা খাওয়ান। অনাবাসী জীবনে খুব মিসড করি কারওয়ান বাজারে ফুটপাতে শামীমের চা, নারায়ণগঞ্জে আলমকেবিনের চা, কালিরবাজারের স্বর্নপট্টির গুপচিগলিতে পরানবাবুর চা, দুইনাম্বার গেইটের বটতলায় অতুলের চা কিংবা কালেভদ্রে বোস কেবিনের চা । আহা কতদিন প্রিয়সহকর্মী ও বন্ধুদের সাথে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চা খাই না! এখানে প্রতিদিন অন্তত তিনবেলা কফি খাওয়া হয়। কড়া কফি আমার অপছন্দ। স্টারবাকের লাতে, টিমহর্টনের ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা কফি খুব পছন্দের। ফ্লেভারটা মিস্টি বলেই আয়েশ করে খাই।
চা খাবো বলে আগস্ট মাসে বাসার জন্য টেটলি এবং রেডলেবেল চায়ের দুটো ঢাউশ সাইজের বক্স কিনেছিলাম। দুটোতে ছিল ২০০ প্যাকেট চায়ের পাতা।মনে হয় না সেখান হতে ৮/১০ বার চা খাওয়া হয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ আমার অবেলার সকালে চা খাওয়া উস্কে দিয়েছেন। মাইক্রোওভেনে মগে হটওয়াটার ও রেডলেবেলের প্যাকেট দিয়ে ২ মিনিট অপেক্ষা করতে করতে কবি গল্পটা শেষ করার পর মনটা বড় বিষন্ন হয়ে যায়। অভাব অনটনের সংসারে মা মরা মেয়েটা জ্বরে বাবার কাছে কলা খেতে চেয়েছে। মাসের মাঝামাঝি সময় জোবেদ আলীর হাতশুন্য। সিরাজ সাহেবও তাকে সহজে টাকা দিবে না জেনে অনেকরাত পর্যন্ত শুধু ১০টি টাকার জন্য জোবেদ আলী প্রুফ দেখে ঝড় বাদলের মধ্যে যখন রাস্তায় নামেন তখন অতোরাতে দোকানপাট সব কিছু বন্ধ। মন খারাপ করে বাসায় ফেরেন জোবেদ আলী।পকেটে টাকা থাকার পরও অসুস্থ মেয়েটার জন্য কলা কিনতে না পারার বেদনায় একজন অক্ষম বাবার ভেতরের ক্ষরন আমাকেও ছুয়ে যায়।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বিছানার পাশে বিশাল উইন্ডোর ভারী পর্দা সরিয়ে আকাশ দেখি। মন্ট্রিয়েলের আকাশটাও আজ কেমন মনমরা, ঘোলা হয়ে আছে। জোবেদ আলীর বেদনা শুধু আমাকে ছুয়ে যায়নি মন্ট্রিয়েলের আকাশকেও যেন ছুয়েছে।
১৩.০৩.২০১৯
মন্ট্রিয়েল
কুইবেক,কানাডা