somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তাহাদের আর ফেরা হয় না...

১১ ই জানুয়ারি, ২০১৯ ভোর ৬:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রচন্ড মানসিক অস্থিরতা ও কাজের মাঝে ফারুকের দিনগুলো কেটে যায়। রাত হলে ক্লান্তদেহ টানতে টানতে এলোমেলো পায়ে বাসায় ফেরা। কোনরকম ফ্রেশ হয়ে সোজা বিছানায়। শরীরে ব্যাথা নিয়ে ঘুম হয় না। অথচ ঘুমটা তার জন্য খুব জরুরী, সকালে উঠে দৌড়াতে হবে কাজে। সাথে সাথে ঘুম না এলে সকালে বিছানা ছাড়তে দেরী হওয়া মানে মেট্রো,বাস ও কাজে সব জায়গায় লেট!
মধ্যরাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ফারুক ভাবছিল, কাল কাজে যাবে না। কিন্তু পরক্ষনেই সেই চিন্তা বাদ দেয়। একদিন কাজে না যাওয়া মানে ১২০ ডলার নাই। মাসান্তে দেশে টাকা পাঠাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হবে।
বিল্ডিংয়ের মেইনগেট খোলাই ছিল। কেউ একজন বাহিরে এসে সিগারেট টানছে বলে দরোজার কোনে ছোট পাথর দিয়ে রেখেছে। কড়িডোর পেরিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস শব্দ ভেসে আসছে বিভিন্ন রুম থেকে।ফারুক এসে দাড়ায় কড়িডোরের শেষ প্রান্তের রুমের সামনে।
এ রুমটা ফারুকের। খুব সন্তর্পনে দরোজাটা খুলে পা টিপে টিপে ঘরে প্রবেশ করে ফারুক। পাশের রুমগুলোতে কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ কেউ লাইট অফ করে ফিসফিস করে কথা বলছে দেশে স্বজনদের সাথে।কেউ বা অন্ধকারে হিসেব মেলায় জীবন থেকে আরো একটিদিন চলে গেল, দেশে কবে ফিরবে।
ফারুক জানে তার সহসাই দেশে ফেরা হবে না। প্রবাসে মুক্ত আকাশের নীচে বন্দী কারাগারে থাকতে হবে আরো অনেকদিন। কি হবে এসব দিনফিন গুনে!
গতকালই গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে রঘুবাবু বলছিলেন, বুঝলা মিয়া কমতো দেখি নাই ত্রিশবছরের বন্দী জীবনে।প্রথম প্রথম খালি কান্দন, দেশের লাইগা মায়া, ছয়মাসের পোয়াতি নতুন বউটারে রাইখ্যা আইসা মন খালি পোড়াইতো।সারাদিন কাম কাজ শেষে লম্বা লাইন দিয়া পাবলিক ফোন থিকা দেশে ফোন করতাম আর ফোপাইয়া ফোপাইয়া কানতাম। তখন মুবাইল্ বইলা কিছু আইছিল না। তোমরা মিয়া বড় লাকি।যখন তখন বউ বেটির লগে কথা কও, ভিডিও কল দিয়া পোয়াতি বউয়ের পেট দ্যাহো। বাচ্চা বড় হইছেনি। আমি তো আমার পোলার জন্মের সাত বছর পর মুখ দেখছি।
একটু বিরতি নিয়ে রঘুবাবু ক্যাফে হতে বাহিরে গিয়ে সিগারেট টানেন। গ্লাসের ওপাড় থেকে ইশারায় ডাকেন। আহো একটা বিড়ি টান দিয়া যাও। শালার আইছি ঠান্ডার দেশে বিড়ি আর ভদকা না হইলে কি শরীর ঠিক রাখন যাইব?
রঘুদা শুদ্ধভাষায় কথা বলতে বলতে আঞ্চলিকভাষায় প্যাচগোছ লাগিয়ে কথা বলেন। লোকটার বয়স বোঝা মুশকিল। পেটানো শরীর, লম্বা চওড়া কাধ, হাটেন তরুন যুবাদের মতনই।কিন্ত ষার্টোধ্ব বয়সে এখনো তিনি রোজ ৮ ঘন্টা কাজ করেন একটা বেকারীতে।রুটি বানান। ফারুককে অসম্ভব পছন্দ করেন তার সততা ও কাজের প্রতি নিস্টার জন্য।প্রায় ছুটিরদিন দুপুরে রঘুবাবু চলে আসেন ফারুকের রুমে। নিহার,ফারুক ও কামাল মিলে তাস পেটান। সেই সময়টা দেখার মতন। সবাই পিনপতন নিরবতায় মগ্ন হয়ে তাস খেলে। বোর্ডের মাঝখানে কিছু টাকা মানে ডলার ও কয়েন থাকে।ফারুকের রুমটা শেষপ্রান্তে হওয়ায় রুমের ভেতর সিগারেট টানে সবাই।
তাস পেটানোর মাঝে বোতল খুলে গ্লাসে ভোদকা সার্ভ করে ফারুক। দু'তিন পেগ পেটে যেতেই এদের মাথার তার সহজে ছেড়ে না কিন্তু সাংঘাতিক ইমোশনাল হয়ে পড়ে। নিহার নিরীহ স্বভাবের ত্রিশোর্ধ্ব যুবক,নবাবগঞ্জের কনভার্টেড খৃস্টান। এলবার্ট নাম হলেও পুর্ব নাম নিহার বলতেই সে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে।৪ বছর হলো বিদেশ এসেছে। ফারুক প্রায় লক্ষ্য করে নিহার রাত হলে বেসামাল হয়ে যায়। একদিন ভোদকার ওভারডোজ হওয়াতে নিহার রুমে এসে কেদেকেটে অস্থির।কান্না থামলে ফারুক জিগেস করে, কি হলো নিহার, দেশে কি কিছু হয়েছে!
এ কথা শুনে নিহার আবারো ফুপিয়ে কাদে।
-আমার সব শেষ ফারুকভাই। হারামিটা আরেক বেটারে বিয়া করছে।
বলেই আবার সেকি কান্না।
তো, সে হারামিটা কে ছিল তোমার।

২.
ফারুকের অস্থির লাগছে। শর্টস পড়ে রুমে পায়চারি করে। জ্বলন্ত সিগারেট পুড়ে শেষ হয় খালি বিয়ারের ক্যানের ওপর।
নিহারের মতন কামালও এসেছে ৪/৫ বছর। নিহার এসেছিল সরাসরি দেশ থেকে টরন্টো। একবছর পরই চলে আসে কুইবেক। কামাল এসেছে নিউইয়র্ক হতে।তার প্রবাস জীবন আরো দীর্ঘ। আমেরিকায় ১৪ বছর ছিল কাগজ ছাড়া। আদৌ কাগজ হবে কিনা সেই ভাবনায় আর পড়ে থাকেনি নিউইয়র্কের জৌলুশময় জীবনের মোহে।সোজা বর্ডার পাড়ি দিয়ে এসেছে এখানে। কামালের বরিশালের বাড়িতে এখন আর কেউ নেই। উনিশ বছর আগে যখন দেশ ছাড়ে তখন মা-বাবা, এক বোন ছিল।উনিশ বছরে একে একে সবাই গত হয়েছেন। শুন্যবাড়িতে বাতি জ্বালানোর কেউ নেই।অন্য আরো ৮/১০ জন প্রবাসীর মতন কাগজ না থাকায় স্বজনদের মৃত্যুর সময় দেখতে যেতে পারেনি। আগামীতে যাওয়া হবে কি না একমাত্র উপরওয়ালাই ভাল জানেন। এরকম পাথর চাপা কস্ট নিয়ে একাকী ব্যাচেলর জীবন কামালের।অথচ মানুষটা দেখলে কেউ বুঝবে না কি ক্ষরনে তার অন্তর পুড়ে যাচ্ছে।
ফারুকের অস্থিরতা বেড়ে যায় কেসের কোন খবর না আসায়। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ভাবে আজই প্রবাসী জীবনের ইতি টানবে। কিন্তু দেশে ফেলে আসা মা,ভাই,বাবা, স্ত্রী - সন্তানদের মুখগুলো মনে পড়তেই শুধু চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মনে মনে কাউন্টডাউন করে ১০০০,৯৯৯,৯৯৮,৯৯৭...
আর ভাবে এদিনের কাউন্টডাউনটা কবে শুন্যের ঘরে এসে পৌছাবে!

১০.০১.২০১৯
মন্ট্রিয়েল
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মত প্রকাশ মানে সহমত।

লিখেছেন অনুপম বলছি, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৭

আওয়ামী লীগ আমলে সমাজের একটা অংশের অভিযোগ ছিলো, তাদের নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। যদিও, এই কথাটাও তারা প্রকাশ্যে বলতে পারতেন, লিখে অথবা টকশো তে।

এখন রা জা কারের আমলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×