মানবদেহের অত্যাবশ্যক অঙ্গ যেমন: কিডনি, লিভার, হৃৎপিন্ড, ফুসফুস ইত্যাদির যেকোনো একটি কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেললে বা নষ্ট হয়ে গেলে জীবনাবসান অবধারিত। কিন্তু এসব অঙ্গ বিকল হলেও অঙ্গ সংযোজনের মাধ্যমে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে আজ বিশ্বব্যাপি। বাংলাদেশে অঙ্গ সংযোজন আইন পাস হওয়ার পর শুধুমাত্র লাইভ রিলেটেড কিডনি সংযোজনে গতি লাভ করেছে-যদিও এ নিয়ে অপপ্রচার আমাদের গতিপথকে পিছিয়ে দিয়েছে। দেশে ইতোমধ্যে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টও শুরু হয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ডোনার সমস্যা বা অরগান দাতার স্বল্পতা অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। ফলে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার রোগী। এসব সমস্যায় যুগান্তকারী আবিষ্কার ক্যাডাভারিক অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বা মরনোত্তর অঙ্গ সংযোজন। এতে একজন ব্যক্তি একসঙ্গে ৫ জন মানুষকে বাচাঁতে পারে। তার ২টা কিডনি ২ জন, ১টা লিভার ১ জনের দেহে, ১টা ফুসফুস ১ জনের দেহে, ১টা হার্ট ১ জনের দেহে প্রতিস্থাপন করে ভিন্ন ভিন্ন ৫জন রোগীকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। অরগান দাতার স্বল্পতা সমস্যা দুর করতে মরনোত্তর অঙ্গ সংযোজন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় ব্যাপক সাফল্য এনে দিতে পাওে, এবং এটা চালু হওয়া দরকার। তবে সবার আগে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও সম্মিলিত উদ্যোগের।
‘ডোনেট অরগান আফটার ডেথ-সেভ লাইভ’ বা ‘মরনোত্তর অঙ্গ দান করুন-জীবন বাঁচান’-স্লোগানকে ধারণ করে গত শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত সোসাইটি অব অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বাংলাদেশ (এসওটি)-র দ্বিতীয় সম্মেলন ও বৈজ্ঞানিক সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা আরো বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশের সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালগুলোর আইসিইউ-তে নানাবিধ সড়ক দূর্ঘটনা, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণসহ বিভিন্ন জটিলতায় বহু রোগী ভর্তি হয়ে থাকে। এসব রোগীদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কিডনি, ফুসফুস, হার্ট, লিভার প্রভৃতি অঙ্গ ৫ থেকে ১৫ ঘন্টা সংরক্ষণ করা গেলেই অকেজো অঙ্গের দেহে প্রতিস্থাপন সম্ভব। এতে হাজার হাজার রোগীর ডোনার সংকটের সমাধান হবার পাশাপাশি মানুষের নতুন জীবনদান করা সম্ভব।
সোসাইটি অব অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক হারুন আর রশিদের সভাপতিত্বে সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, সোসাইটি অব অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক হারুন আর রশিদ, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইউরোলোজিক্যাল সার্জনসের সভাপতি অধ্যাপক এমএ সালাম, বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল আলম, সোসাইটি অব অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বাংলাদেশের সহ-সভাপতি অধ্যাপক একেএম আনোয়ারুল ইসলাম, সাধারন সম্পাদক অধ্যাপক এসএ খান প্রমুখ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর দেশী বিদেশী অভিজ্ঞ অঙ্গ সংযোজন বা ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দিনব্যাপি কয়েকটি বৈজ্ঞানিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের ৩ শতাধিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট চিকিৎসক অংশগ্রহন করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, কিডনি বিক্রি নিয়ে অপপ্রচার আমাদের ক্ষতি হয়ে গেছে, অথচ সেই চক্রের কিছুই হলো না। এসব নেতিবাচক অপপ্রচার আমাদের গতিপথকে পিছিয়ে দেয়। তিনি বলেন, ডোনার সমস্যার সমাধানে মরনোত্তর অঙ্গ সংযোজন এখন জরুরী একটা বিষয়। সোসাইটি অব অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বাংলাদেশ এই গুরুত্বপূর্ন বিষয়টি নিয়ে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, অঙ্গ দান নিয়ে মানুষের মাঝে একটা আবেগ কাজ করে। কেননা, মানুষ মৃত্যুর পরও নিজেকে দেখতে চায়। তিনি বলেন, টেকনোলজিতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, আবার ব্যবহাওে পিছিয়ে যাচ্ছি। টেকনোলজির পাশাপশি আমাদেরকে এখন মানবিকভাবে এগিয়ে যেতে হবে। মোমবাতি সবাইকে আলো দিয়ে যেভাবে নিজে নিভে যায়, আমাদেরকে সেভাবে আলো দিতে হবে। আমার অঙ্গ দিয়ে যদি আর একটা মানুষের জীবন বেঁচে যায়, তবে এটাতো বিরাট বিষয়। তবে যে মরে গেছে তাকে জীবন ভেবে আরেক জনকে মেরে ফেলা-এটাতো ঠিক হচ্ছে না। রাষ্ট্রের এখানে হস্তক্ষেপ দরকার।
সোসাইটি অব অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বাংলাদেশের সভাপতি বিশিষ্ট কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হারুন আর রশিদ বলেন, উন্নত বিশ্বে কিডনি ও লিভার রোগীদের শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ, হৃদপিন্ড, ফুসফুস ও অন্যান্য অরগান শতভাগ ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয় মৃতপ্রায় ব্যক্তির অঙ্গ নিয়ে তা সংযোজনের মাধ্যমে। এ ব্যবস্থায় সফলতার হার শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ। তিনি জানান, বাংলাদেশসহ দক্ষিন এশিয়ায় শতকরা ৯৯ ভাগ কিডনি সংযোজন হয় নিকটাত্বিয়ের কাছ থেকে অঙ্গ ডোনেটের মাধ্যমে। কিন্তু যে পরিমান অঙ্গ বিকল রোগী পাওয়া যাচ্ছে সে হারে নিকটাত্বিয়ের ডোনার পাওয়া যাচ্ছে না। তাই অরগান দাতার স্বল্পতা ও জটিলতা কাটিয়ে উঠতে দেশে ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও বেসরকারী উদ্যোাক্তাদেরকেও এগিয়ে আসা উচিত।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, কোরিয়া, ভারতসহ বিশ্বের দেশের ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিশেষজ্ঞরা এ মূহুর্তে ঢাকায় আছেন এবং সপ্তাহব্যাপি তারা অবস্থান করবেন। কীভাবে ক্যাডাভারিক অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা মরনোত্তর অঙ্গ সংযোজন করা যায় এসব বিষয়ে মিরপুরস্থ কিডনি ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে তিন শতাধিক বাংলাদেশী অররগান ট্রান্সপ্ল্যান্ট চিকিৎসকরা অংশ নেবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:৩৮