somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘দলত্যাগী’ নয়, ‘ত্যাগী নেতা’-ই এখন বেশি প্রয়োজন!

০৬ ই মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রেজাউর রহমান রিজভী

সাম্প্রতিক সময়ে ‘ত্যাগী নেতা’ ও ‘দলত্যাগী নেতা’- এই দুটি শব্দ খুব বেশি আলোচিত হচ্ছে। বিশেষত গত বছরের ৫ আগস্টের পর স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই দুটি শব্দ নতুন করে আলোচনায় এসেছে। কারণ এখন আওয়ামীলীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীদের খুঁজে পাওয়াই কঠিন। তাদের অনেকেই ভোল পাল্টে অন্য কোন রাজনৈতিক দলের ছত্র-ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। বিগত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ও ও তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীরা যেভাবে অন্য দল ও মতের নেতা-কর্মীদের উপর ছড়ি ঘুড়িয়েছে ও নির্যাতন করেছে, তার প্রতিফলন হিসেবে তাদেরকে এখন হামলা-মামলার শিকার হতে হচ্ছে। এজন্য জান বাঁচানো ফরজ প্রবাদ মতে এসব নির্যাতনকারী নেতা-কর্মীদের অনেকেই এখন ‘ত্যাগী’ নেতা থেকে ‘দলত্যাগী’ নেতায় পরিণত হয়েছেন ও হচ্ছেন। আরো বিস্তারিত আলোকপাতের আগে দেখা যাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘ত্যাগী নেতা’ এবং ‘দলত্যাগী নেতার’ স্বরূপ কেমন ছিল।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘ত্যাগী নেতা’ এবং ‘দলত্যাগী নেতা’- এই দুই শব্দ যুগে যুগে বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে জনগণের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই দুই বিশেষণ ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ, নৈতিকতা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপের প্রতিফলন করে, যা বাংলাদেশী রাজনীতির জটিলতা ও গতিশীলতাকে প্রকাশ করে।

‘ত্যাগী নেতা’ বলতে বোঝানো হয়, যিনি নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ বা অর্থনৈতিক লাভের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন তার দলের আদর্শ এবং জনসাধারণের কল্যাণ। এইসব নেতারা প্রায়শই স্বাধীনতার লড়াইতে, গণতন্ত্রের পত্তনে বা সমাজের শোষিত-নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের জীবন উৎসর্গ করেন। এই নেতারা তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েও জনগণের জন্য সেবা করেন।

‘ত্যাগী নেতারা’ সাধারণত খুব কমই ব্যক্তিগত লাভের প্রতি মনোনিবেশ করেন। বরং, তারা রাজনৈতিক আন্দোলন, মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই বা ন্যায় বিচারের জন্য তাদের পদচ্যুতির ঝুঁকি নেন। তাদেও নৈতিক মূল্যবোধ এবং সততা জনগণের কাছে তাদের বিশ্বস্ততা ও সম্মান অর্জন করে। তারা যে কোনো মুহূর্তে রাজনৈতিক পদ থেকে সরে গিয়েও জনসেবায় নিয়োজিত থাকতে পারেন এবং তাদের জীবনী ব্যক্তিগত আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর।

অন্যদিকে, ‘দলত্যাগী নেতা’ হলেন সে সব নেতা, যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ, শক্তির লোভ অথবা আর্থিক লাভের জন্য নিজেদের রাজনৈতিক দল বা আদর্শ থেকে সরে যান। এই প্রক্রিয়াটি প্রায়শই রাজনৈতিক দলের ভেতরকার গুজব, অসন্তোষ বা ব্যক্তিগত স্বার্থেও জন্য সংঘটিত হয়। দলত্যাগী নেতারা প্রায়ই তাদের দলের সাথে মতানৈক্য বা তাদের নিজস্ব স্বার্থের খাতিরে অন্য দলে যোগদান করেন বা নতুন দল গঠন করেন।

দলত্যাগী নেতারা সাধারণত জনগণের কাছে বিশ্বাস হারান, কারণ তাদের কার্যকলাপ প্রায়শই ব্যক্তিগত লাভের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। এই ধরনের নেতারা তাদের রাজনৈতিক জীবনে বারংবার দল বদল করে বা নতুন দল গঠন করে জনগণের বিশ্বাসকে বারবার আঘাত করে। এই বিশেষণ যারা পান, তাদের রাজনৈতিক যাত্রা প্রায়শই স্বার্থপরতা, অস্থিরতা এবং নৈতিকতার অভাবের সাথে জড়িত থাকে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দলত্যাগী নেতার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলী থেকে। উল্লেখযোগ্য যে কোন নেতা যিনি একাধিক দলে থাকার পর স্বার্থপরতার কারণে বা নির্বাচনী লাভের জন্য দল বদল করেছেন। এমন কিছু নেতা আছেন যারা প্রায়ই দল গঠন বা ভাঙনের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা প্রায়ই জনগণের সমর্থন পায়নি। এরকম নেতার উদাহরণ স্বাধীরতার পর অসংখ্য। এমনকি কাউকে কাউকে তো বলাও হতো যে, যে দলই সরকার গঠন করুন না কেন, সে সর্বদা সরকারেই থাকে। অর্থাৎ দল পরিবর্তন করা, তার কাছে কাপড় পরিবর্তন করার মতোই বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইতিহাস অবশ্য এসব নেতাদেরকে ঘৃণার দৃষ্টিতেই স্মরণে রাখে।

যাই হোক, ‘ত্যাগী নেতা’ ও ‘দলত্যাগী নেতার’ মধ্যে পার্থক্যটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ত্যাগী নেতারা সাধারণত গণআন্দোলনের মাধ্যমে বা জনসেবার মাধ্যমে জনগণের কাছে তাদের মর্যাদা অর্জন করেন। তাদের জীবন ত্যাগ, আত্মত্যাগ ও প্রতিশ্রুতির গল্প বলে, যা ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। তারা ব্যক্তিগত লাভের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন জননিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং সমাজের সমগ্র উন্নতির প্রতি।

দলত্যাগী নেতারা বিপরীত দিক থেকে কাজ করেন। তারা যখন দল বদল করেন বা নতুন দল গঠন করেন, তা প্রায়শই আইনসভায় শক্তির সংক্রমণ বা নির্বাচনী লাভের জন্য। এই কাজগুলো প্রায়শই তাদের দলের ভেতর বা জনগণের মাঝে বিতৃষ্ণার জন্ম দেয়। তাদের এ ধরনের কার্যকলাপ জনতার কাছে প্রায়ই নস্যাৎ হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তাদের ব্যক্তিগত লাভের মাধ্যমে জনসাধারণের কল্যাণের প্রতি ভুল প্রমাণিত হয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনে এই দুই ধরনের নেতার ইতিহাস বিচার করলে, দেখা যায় ত্যাগী নেতারা প্রায়শই জনগণের কাছে দীর্ঘস্থায়ী সম্মান এবং কৃতজ্ঞতা অর্জন করেন। তারা হয়তো সরাসরি ক্ষমতায় আসতে পারেননি বা আন্তঃদলীয় কূটনীতির খেলায় জয়ী হতে পারেননি, কিন্তু তাদের কার্যকলাপ ও আদর্শ দেশের ইতিহাসে ঐতিহ্য হিসেবে স্থান পেয়েছে।

দলত্যাগী নেতাদের ক্ষেত্রে, তাদের কার্যকলাপ জনগণের কাছে সাময়িক লাভ বা অস্থায়ী শক্তি বৃদ্ধির প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এই নেতারা প্রায়ই তাদের ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনের পরেও স্থায়ী জনসমর্থন অর্জন করতে ব্যর্থ হন। যে কারণে জনগণের বিশ্বাস তাদের কাছ থেকে সরে যায়, এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মজীবন প্রায়শই অস্থিরতায় পরিপূর্ণ হয়।

রাজনৈতিক আন্দোলন, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, এবং জনসাধারণের কল্যাণের জন্য কাজ করা ত্যাগী নেতাদের ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যদিকে, দলত্যাগী নেতারা এই সংস্কৃতির বিরোধিতা করেন, কারণ তাদের কার্যকলাপ গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে প্রায়শই আঘাত করে। এই দুই ধরনের নেতার ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রকে বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা দেশের রাজনৈতিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং জনগণের কল্যাণের বিরুদ্ধে বা পক্ষে কীভাবে কাজ করে তা প্রকাশ করে।

আবারো আসা যাক সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহে ‘দলত্যাগী’ ও ‘ত্যাগী’ নেতাদের প্রসঙ্গে। প্রচুর পরিমাণে দলত্যাগী নেতার ফলন এখন আমাদের আশেপাশে দেখা যাচ্ছে। আবার এসব দলত্যাগী নেতাদের কেউ কেউ অনেকে অর্থের বিনিময়ে অন্য দলেও নিজেদের ঠাঁয় করে নিচ্ছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, এসব দলত্যাগীরা লোক দেখানো দলত্যাগ করলেও মন-মননে তারা ভিন্ন রাজনৈতিক ধারণাই পোষণ করে যায়। আর সুযোগ পেলে আশ্রিত দলের ক্ষতি করতেও এসব লোকের বাঁধবে না। অথচ এদের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব বরাবরই উদাসীন। আর তাদের উদাসিনতার জন্যই তাদেরকে পরবর্তিতে ফল ভোগ করতে হয়।

বর্তমান সময়ের এক চলচ্চিত্র নির্মাতা ৫ আগস্টের পর ভোল পাল্টালেও অনলাইনের বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে আওয়ামীলীগ থেকে তার নির্বাচনে নমিনেশন সংগ্রহের বিষয়টি ধ্রুব সত্যের মতো জ¦লজ¦ল করছে। প্রতি পদে পদে তাকে দলত্যাগীর ঘটনা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ফলে তাতে করে তিনি রাজনীতিতে পুনর্বাসন হতে তেমন সুবিধা করতে পারছেন না। সুতরাং, ইন্টারনেটের এই যুগে যে কোন মানুষের অতীত ইতিহাস বের করা কঠিন কিছু না। তাই কোন নেতা বা কর্মী ‘ত্যাগ’ী নাকি ‘দলত্যাগী’ তা বের করাটা অন্তত এই সময়ে কঠিন কিছু না। আর এই বিবেচনা করেই ব্যক্তিকে রাজনৈতিক ভাবে মূল্যায়ন করলে তবেই আমরা নিঃস্বার্থ ও খাঁটি নেতা পাবো। নইলে দ্বিতীয় স্বাধীনতার ফল আমরা ধরে রাখতে ব্যর্থ হবো।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:২৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সামনে বিপুল, বিশাল চ্যালেঞ্জঃ মোকাবেলায় কতটুকু সক্ষম বিএনপি?

লিখেছেন শেহজাদ আমান, ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৪৯



১. ভুল রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, দূরদর্শিতার অভাব

বিএনপি বাংলাদেরশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। লোকবল ও জনপ্রিয়তায় তাঁর ধারেকাছেও নেই অন্যকোনো রাজনৈতিক দল। মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক ধারায় আছে বলেই বাংলাদেশের মধপন্থী ও উদারপন্থী... ...বাকিটুকু পড়ুন

চিঠি।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ রাত ৯:৩০



চিঠি: এক হারিয়ে যাওয়া অনুভূতির নাম

চিঠি—শুধু একটুকরো কাগজ নয়, এটি আবেগের স্পর্শ, অপেক্ষার মধুরতা, ভালোবাসার নিঃশব্দ উচ্চারণ। এক সময় মানুষের ভাব বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম ছিল এই চিঠি। স্বামী লিখতেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ডিফেন্স গ্যালারী Defence gallery

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ রাত ১০:০১

মাগুরায় নির্যাতিত শিশুটির মরদেহ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে হেলিকপ্টার যোগে নিয়ে যাওয়া হলো নিজ বাড়িতে
ঢাকা ১৩ মার্চ ২০২৫ (বৃহস্পতিবার): মাগুরায় নির্যাতিত শিশুটি আজ ১৩ মার্চ ২০২৫ তারিখ দুপুর ০১:০০ টায় সম্মিলিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমা করবেন আরেফিন সিদ্দিক স্যার..

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৪ ই মার্চ, ২০২৫ ভোর ৪:৩৭


আরেফিন সিদ্দিক স্যারের লাশটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দিচ্ছে না। ক্যাম্পাসের সাথেই সংযুক্ত হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে লাশ রাখা। শহীদ মিনারেও শেষ শ্রদ্ধা জানাতে দেবে না, ঢাবির কেন্দ্রীয় মসজিদে হবে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাথর চোখের কান্না- ৩

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৪ ই মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৪:৪১

অন্ধকারের ভাবনা.....

চোখের সমস্যার জন্য নানাবিধ টেস্ট করিয়েছি। যার মধ্যে অন্যতম Ophthalmoscopy, Funduscopy, Optic fundus, OCT (Optical Coherence Tomography এছাড়াও যেহেতু মাথায় যন্ত্রণা থাকে সেজন্য CT Scan এবং MRI করতে হয়েছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×