(গল্পের প্রথম পর্ব)
সেগুনবাগিচা থেকে মিরপুর রোড ধরে হাঁটা শুরু করলাম।
আমি, নাদিম আর পিয়াল। হঠাৎ করে মনে হলো, এভাবে গত দুই তিন বছরে একদিনও ভেজা হয় নি আমার। প্রথম পাঁচ মিনিট কেউ কোনও কথা বললাম না। হুশ করে একটা গাড়ি এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো আমাদের। তাও চুপ করে থাকলাম। অথচ আগে এরকম হলে তিনজন মিলেই ‘নিষিদ্ধ বাংলা ডিকশনারী’ পুরোটাই উগড়ে দিতাম।
সময় অনেকভাবে রঙ বদলায়, আমার কিংবা নাদিমের অফিসের গাড়িও হয়তো এখন ভার্সিটি পড়ুয়া কারো কাপড় মাঝরাস্তার পানি দিয়ে ধুয়ে দেয়। কে জানে, ওরাও তখন খুব সম্ভবত এভাবেই গালি দেয় আমাদের এখন।
আচ্ছা, বৃষ্টিতে ভিজলে তো মাথার চুলগুলো সবসময়ই কেমন নির্লজ্জের মত শরীর দেখানো শুরু করতো আগে। এখন কি হয় না ওরকম? নিশ্চয়ই হয়। ঐ যে, নাদিমের চুলহীন বিশাল কপালটা তো এখন আরো কত বড়।
কিন্তু মোবাইলের ক্যামেরা বের করে টাকের সেলফি তোলা হচ্ছে না কেন?
ভার্সিটির দিনগুলোতে ‘আমরা বড় হয়ে গেছি’ ধরণের ভাব নিয়ে চলতাম একসময়। চেষ্টা করেও পারতাম না বেশির ভাগ সময়েই। কিন্তু এখন কি আসলেই বড় হয়ে গেলাম?
পিয়াল নিজেই আরম্ভ করে।
আমাদের তিন বন্ধুর আড্ডা থেকে শুরু করে সবই বলতে থাকে ধীরে ধীরে। প্রথমদিকের অংশ তো সবই আমাদের জানা। কেমন অহঙ্কারী আর একরোখা ছিলো পিয়াল। কিন্তু ঠিকই ফার্স্ট-সেকেন্ড হতো। পকেটে দুইটা-তিনটা মোবাইল থাকতো। কাউকে ভালো লাগলে দুই একদিনের মধ্যেই হাত করে ফেলতে পারতো ও। খুব ভালো ডিবেট করতো আসলে, এইজন্যই বোধ হয় ওর সাথে কথায়-চলায় কোনও মেয়েই পেরে উঠতো না।
তবে খুব বেশিদিন কারও সাথে থাকতে পারতো না পিয়াল। ওর নাকি একঘেয়ে লাগতো। একটা পর্যায়ে গিয়ে ফোনে কিংবা দেখা করে চুকিয়ে ফেলতো সব। ওর কথা অনুযায়ী বড়জোর একমাস কষ্ট পেতো মেয়েটা। এরপর খুব দ্রুতই হয়তো বিয়ে করে ফেলতো কাউকে না কাউকে। আবার আধুনিকা কেউ কেউ হয়তো ড্রেস চেঞ্জ করার মত করেই রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসটা চেঞ্জ করতো শুধু। ব্যাস, বাকিটুকু আর জানতে চাইতো না পিয়াল। দুনিয়াতে কত গল্পই অজানা থাকে, থাক না আরো কিছু অজানা।
পিয়াল বলতে থাকে...
মাস তিনেক একসাথে ঘোরাফেরার পর টুম্পা নামের বোকাসোকা মেয়েটাকেও একসময় একঘেয়ে লাগতে শুরু করলো। আর্কিটেকচারে পড়তো ও, হোস্টেলে থাকতো। ওর মা-বাবা সেপারেটেড। তাই বাসার সাথে তেমন একটা স্বচ্ছন্দ যোগাযোগও ছিলো না আসলে।
এভাবেই একদিন বের হতে বললো ওকে পিয়াল। কিছু একটা বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঐদিনই আসলে শেষ করে ফেলতো সব। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো আরেক জায়গায়। আসলো না টুম্পা। ফোন বন্ধ। সারাদিন ফোন দিয়ে পাওয়া গেলো না ওকে। ওর জন্য সুবিধাই হলো ভাবলো পিয়াল। হয়তো নতুন করে বেশি ঝামেলা করতে হবে না। কিন্তু পরের দিন সকালেই টুম্পার ফোন, দেখা করতে হবে।
বারিধারার কাছাকাছি দেখা করলো ওরা দুইজন। টুম্পা খুব আস্তে আস্তে পিয়ালকে ওর সমস্যাটার কথা বলে সেইদিন।
পিয়াল এতদিন শুধু জানতো, দিনেরপর দিন মাথাব্যথার ট্যাবলেট খেয়ে পড়ে থাকতো মেয়েটা। কিন্তু এরকম কোনও কারণ হতে পারে কখনও মাথায় আসে নাই। চশমার পাওয়ার এদিক সেদিক করে, পেইন কিলার খেয়েও কোনও লাভ হচ্ছিলো না। পরে নিউরোলজিকাল রিপোর্টে ধরা পড়ে সমস্যাটা।
এনসেফালাইটিস.....
খুব ভালো চিকিৎসা আসলে নেই এই রোগটার। ব্রেইনের একধরণের ইনফ্লেমেশন দিয়ে শুরু হয়। তারপর মাথাব্যথা আর ছোটখাট মানসিক সমস্যা থেকেই আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যায় মানুষটা এই রোগে। দুর্ভাগা অল্পকিছু মানুষকেই পেয়ে বসে নিরীহ-দর্শন কিন্তু ভয়ঙ্কর এই ভাইরাসটা।
পিয়ালের সেদিন আর বলা হলো না টুম্পাকে যা বলার কথা ছিলো। টুম্পার বাসায় একবার চেয়েছিলো জানাতে, কিন্তু আপত্তি করে মেয়েটা নিজেই। একে তো ওর বাবা-মা আলাদা থাকে, তার উপর অযথা কষ্ট দেয়া দুইজনকেই।
প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় ও ছটফট করতো বেশিরভাগসময়। কোনওরকম ট্রিটমেন্ট করতেও রাজি ছিলো না। বাড়তে থাকে মাথাব্যাথা, পানি খেয়েপেট ভর্তি করে বমি করে ফেলতো মাঝে মাঝে, তাও গলা বারবার শুকিয়ে আসতো এই সমস্যাটার কারণে।
জীবন নিয়ে, আর্কিটেকচার নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন ছিলো টুম্পার। ওর কথার মধ্যে ঐসব হারিয়ে যায় ততদিনে। আর স্বপ্নহীন জীবন খুব ভয়াবহ হয়। ওর বাঁচতে ইচ্ছা করতো না আর।
একদিন ফোনে ওর কথা শুনে কেমন যেন সন্দেহ হয় পিয়ালের। রাত দুইটার সময় ফোন করে ওর রুমমেটকে ডেকে টুম্পার বেডে পাঠায় ও। ধারণা সত্যি ছিলো ঐদিন পিয়ালের, ওর রুমমেট টুম্পার বালিশের পাশে পটাশিয়াম সায়ানাইডের ছোট্ট একটা শিশি খুঁজে পায় সেই রাতেই।
নাহ, এভাবে আর না। এরপর জোর করেই ওকে নিয়ে গেলো পিয়াল একদিন ডাক্তারের কাছে। কারও বাসায় কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজেই ওকে ভর্তি করালো হাসপাতালে। পিয়ালের অনেক টাকা ছিলো তখন। টিউশনি, কম্পিটিশনের প্রাইজমানি, স্কলারশিপ আর স্টাইপেন্ডের টাকা খরচ হতে থাকলো।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তখন মাথায় ওর একবারও আসেনাই যে এই মেয়েটার সাথে কয়েকদিন আগেই সব সম্পর্ক শেষ করার কথা।
কিন্তু আরেকদিক দিয়ে কষ্ট পেতে থাকে এবার টুম্পা। এই অনিশ্চিত চিকিৎসার খরচ সম্পর্কে ভালোই ধারণা ছিলো ওর। ওর মুখের দিকে তাকানো যেত না একদম।
অনেক বুঝায় পিয়াল, সেরে গিয়ে ভালো একটা ফার্মে টুম্পা কাজ পেয়ে গেলেই সব টাকাপয়সা বুঝে নেবে ও।
কিন্তু নিজেও বুঝতো, কি তীব্রভাবে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে আছে ওরা।
গত পরশুদিন হুট করে পালিয়ে যায় টুম্পা হাসপাতাল থেকে।
ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুজির পর সাইন্স ল্যাবের মোড়েওকে পাওয়া যায় একটা চায়ের দোকানে হেলান দেয়া অবস্থায়। চোখ লাল, গায়ে প্রচণ্ড জ্বর।
মাথা কাজ করছিলো না ঠিকমতো। পিয়াল একা তখন,রাত প্রায় বারোটা। তার উপর গুন্ডামত কয়েকটা ছেলেকে এদিকে আসতে দেখে ভয়ে জমে যাচ্ছিলো ও।
একটা রিকশা পেয়ে তড়িঘড়ি করে ওকে ঐ রাতে ওর বাসায় নিয়ে আসে পিয়াল। আর কিছুই করার ছিলো না। এমনকি পরের দিন সকাল পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে ছিলো টুম্পা। ওর আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিলো সব।
পিয়াল একটানা বলে যাচ্ছে। ওকে থামালাম এবার আমি-
“বন্ধু, একবার তো জানাতে পারতি। আমরা কেউ মারা যাই নাই এখনও।”
“তোদের কথা অনেক মনে পড়তো রে, চিরকুমার সভা ভাঙতে পাড়ে, বন্ধুসভা তো আর ভাঙে নাই। কিন্তু নাদিমের বিয়ের কথা হচ্ছে শুনে কেন জানি আর তোদের জ্বালাতন করতে ইচ্ছা করলো না।”
পিয়াল আবারো শুরু করে।
“কিভাবে যেন ঘটনাটা খুব বাজেভাবে জানাজানি হয়ে যায়। আমার মামা থেকে শুরু করে চায়ের দোকানদার, ফ্ল্যাটের সবাই সমানে যা তা বলতে শুরু করলো আমাকে আর টুম্পাকে নিয়ে, ঐ রাতের পর থেকেই। কেউ আমার কথা তো শুনলোই না, বরং বাবা-মায়ের কান পর্যন্ত চলে গেলো এসব।
টুম্পার কানেও যাচ্ছে সব, ওকে যে হাসপাতালে রাখবো তাও এখন আর পারছি না। হাত পা কেটে বিশ্রী অবস্থা করে ফেলছে। মাথায় বাড়ি দিয়ে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করছে। তাই ওকে খাটের সাথে বেঁধে রেখেছি। আর কি করবো বল না তোরা একটু, প্লিজ...”
আমাদের এই একরোখা বন্ধুটার মুখে এইভাবে কোনও কথা আমি কখনও শুনি নাই। অদ্ভুত লাগতে থাকে আমার। কি বলবো? আমি সান্ত্বনা দিতে পারিনা কাউকে, কেমন হাস্যকর শোনায় তখন আমার কথাগুলো।
“কিন্তু দোস্ত, তোর ঐ কানাডার ফেলোশীপ অফারটার কি হইলো?” নাদিম প্রায় চিৎকার করছে।
“ঐটার সময় তো পার হয়ে গেছে মনে হয়। মেইলেরও রিপ্লাই দেয়া হয় নাই এতশত ঝামেলার মধ্যে”
“তোর ব্যাঙ্ক একাউন্টে কত আছে এক্সাক্টলি বলতো...”
“আছে কিছু।”
“কুকুর কোথাকার, ঠিকমত বল...”
“লাখ তিনেকের মত হবে”
“আর দশ লাখ হইলে হয় তেরো লাখ, আর ফেলোশীপটা কোনওভাবে এখন ধরতে পারলে ম্যানেজ হয়ে যাওয়ার কথা সবকিছু। ওরা ভালোই পয়সা দেবে তোকে কানাডাতে যতদূর জানি। প্রথম কয় মাস একটু কষ্ট হবে অবশ্য।”
আমি হা করে তাকিয়েছিলাম নাদিমের মুখের দিকে। কি বলছে ছেলেটা, মোটা মাথায় সব বুঝতে একটু সময় লাগলো আমার।
“আরে একটা ফালতু প্রোগ্রাম আছে সামনে, বেহুদা টাকা নষ্ট। আমাদের সাধের চিরকুমার সভাটা ভাঙার অপচেষ্টা আর কি। ঐ টাকাটা তুই নে আপাতত। বছর দুয়েক পর তুই দেশে ফিরলে সুদে আসলে তোর থেকে নিয়ে নিবো নে যাহ...”
আস্তে করে নাদিমকে বললাম, আসলেই বিয়ে করবি না দোস্ত?
“আরে করবো, করবো। পিয়াল আর তোর মত বেকুব নাকি আমি!! ও দেশে ফিরুক, দুইজন একসাথে বিয়ে করবো। তারচেয়ে বরং টুম্পা ভালো হওয়া পর্যন্ত ঐ জিরো ফিগার মেয়েটার সাথে প্রেম করতে থাকি। পারুল তো মনে হয় মেয়েটার নাম,তাইনা? ধুর, এত মেয়ে দেখা হয়েছে এই পর্যন্ত, নাম পর্যন্ত মনে থাকে না ঠিকমত...”
“তাই কর তাহলে, আর বিয়ে মানেই তো একবারে সবটুকু। তারচেয়ে ধীরে ধীরে সব কর, আগে প্রেমটা করে দেখ কেমন লাগে-” বললাম আমি।
পিয়াল অবাক হয়ে আমার আর নাদিমের কথা শুনছে।
“তোরা ফাইজলামি করিস, তাইনা?” ওর চোখ ছোট হয়ে যাচ্ছে, অনেক রেগে গেলে ও চোখ ছোট করে ফেলতো আগেও।
পিয়ালের মনে হয় শরীরও খারাপ করছে।
“হ্যাঁ দোস্ত, ফাইজলামি করছি আমরা। ফ্রেন্ডশিপ ডেতে সার্কিট ল্যাবে আমরা তিনজন ফাইজলামি করে ইলেক্ট্রিকাল তার দিয়ে একজন আরেকজনের হাতে ব্যান্ড পরিয়ে দিয়েছিলাম, মনে নাই? এটাও তেমন ফাইজলামি, বিশ্বাস কর।”
“আর আমাদের চিরকুমার সভা? এরচেয়ে বড় ফাইজলামি কি আর হয়?”
নাদিম এবার আমার দিকে আঙ্গুল দিয়ে জোরে হাসতে হাসতে বললো-
“দেখ না, আমাদের সবচেয়ে বড় চিরকুমার। কুমারত্বের ঠেলায় বাপ হয়ে গেলো-”
এই কথার উত্তরে ‘আমার কোনও দোষ নাই’ টাইপ কিছু বলা আর নিরাপদ মনে করলাম না। পিয়ালের ঘাড়ে হাত দিয়ে আস্তে করে শুধু বললাম- দোস্ত, বাসায় যা, ফেলোশিপটার ব্যবস্থা কর, যেভাবে পারিস।
তিন বছর পর...
কানাডা থেকে আজকে ফেরার কথা পিয়ালের।
ফ্লাইট ম্যানেজ করতে পারে নি টুম্পা আর ওর হাসবেন্ড। নাহলে আজকেই আসতো সবাই।
এয়ারপোর্টে নাদিম, পারুল, আমি আর আমার চার বছরের ছেলে।
আজকে প্রথমবারের মত এয়ারপোর্টে এসেছে আমারছেলেটা। টানা প্রশ্ন করে যাচ্ছে একের পর এক।
“আচ্ছা, ঐ আপুটা আর ভাইয়াটা কাঁদে কেন? ওদেরকি আম্মু বকা দিয়েছে?”
“আব্বু, ঐ আন্টিটার মত হাফ প্যান্ট আম্মু কেনপড়ে না?”
“কারণ আমাদের দেশের মেয়েরা আসলে পরী, বুঝলি।আর পরীরা বড় হয়ে গেলে ওদের অনেক নিয়ম মানতে হয়। সবকিছু পরা যায় না।”
“তাহলে রহিম আংকেলের বড় মেয়েটা কি পরী না? সেদিন জানালা দিয়ে যে দেখলাম ঐ আপুটা ছোট একটা লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে টিভি দেখছে।”
নাদিম আর পারুল মিটিমিটি হাসছে।
আমার পাঁচ বছরের পুত্রের উচ্চতা সবেমাত্রজানালা পার হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর মিনি স্কার্ট পরা তরুণী এখনই তাকে বিচলিত করে ফেললে তো সমস্যা।
“তাহলে ঐ আপু নিশ্চয়ই আসল পরী ছিলো না”
নাদিম কথাটা বললো দেখে রক্ষা। কারণ সম্প্রতি নাদিম আঙ্কেলের দেয়া ব্রিক গেইমের কারণে তার সব কথাই ঠিক এখন আমার বিচ্ছুটার কাছে।
তবে সংক্ষিপ্ত এই টি-টোয়েন্টির দুনিয়াতে মিনিস্কার্ট আস্তে আস্তে মাইক্রো কিংবা ন্যানোতে পরিণত হতে যাচ্ছে। আমার পিচ্চি বান্দরটা কেতখন কি বুঝাবো আমি?
মিনিট পাঁচেক পর পিয়ালকে আসতে দেখলাম।
এই তিন বছরে একটা বৌ আর দুইটা বাচ্চার হাইড্রোলিক প্রেসার পাম্পে আমার মধ্যে কেমন একটা আঙ্কেল ভাব চলে এসেছে। এমনকি আসন্ন সংসারজনিত চিন্তায় বিয়ের আগেই নাদিমের চুলহীন কপাল আবারো বড় হতে শুরু করেছে। কিন্তু পিয়ালকে দেখলাম, তিন বছরে আরো চকচকে।
হিংসায় আমি আর নাদিম কাছে আসামাত্র ওকে থাবড়ানো শুরু করলাম।
কানাডায় গিয়ে পুরোপুরি ভালো হতে টুম্পার প্রায় ছয় মাসের মত লাগে। এই ছয় মাস পিয়াল টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চের কাজ করার পর বাকিটা সময় ওকেই দিতো।
ও চায় নাই, কিন্তু তবুও ঢাকায় আমি আর নাদিম একদিন পিয়ালের ফ্যামিলির সাথে কথা বলি। অনেক কষ্টে ঠাণ্ডা করি সবাইকে।
পিয়ালকে দেশে ফিরে আসতে বলি তখনই। কিন্তু ও রাজি হয়না।
“মাথা খারাপ? আগে টুম্পাকে ভালো দেখে একটা বিয়ে দিয়ে দেই এখানে। মেয়েটার পুরো ফ্যামিলিই তো ডিস্টার্বড। একলা দেশে ফিরলে বেচারিকে আবার কথা শুনতে হবে।”
“মানে কি এসবের?”
“কিসের আবার মানে কি?”
“তুই তাহলে ওকে বিয়ে করবি না?”
“তুই কি গাঁজা খেয়ে ফোন করছিস, কুকুর? বেহুদা একটা মেয়ের লাইফ নষ্ট করবো? বিয়ে করে পেট ভর্তি করে খাওয়াবো কয়দিন, সে-ও প্রতিদানে পেটভর্তি বাচ্চা দিয়ে ঘর বোঝাই করে ফেলবে, আর দেখা যাবে আমি অন্যান্য মেয়েদের সাথে ঢ্যাংঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছি।”
“তাহলে এতদিন করলি কি টুম্পার সাথে? আর ওকেই বা রাজি করাবি কিভাবে? ও তো আর কাউকে বিয়ে করবে না..."
"সেটা আমার উপর ছেড়ে দে, মুখের কথায় চিড়া-গুড়-মুড়ি সবই আমি ভেজাতে পারি।"
সুশীল পাঠকদের জন্য স্কাইপের এই আলোচনাটা এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। এরপর পিয়াল যতই বুঝায় নাদিমকে আর আমাকে, নাদিম মেশিনগানের গুলিবর্ষণের মত গালিবর্ষণ করতে থাকে।
তবে টুম্পার অসুখের সময়টাতে পিয়াল দুইটা বছর কেন ওভাবে বদলে গিয়েছিলো সেই হিসাব আমরা কেউ মিলাতে পারি না এখনও। এমনকি কিভাবে ও টুম্পাকে আরেকজনের সাথে বিয়ে করার জন্য রাজি করে ফেললো তাও এখন পর্যন্ত আমাদের অজানা। ওকে জিজ্ঞেস করে ঠিকঠাক উত্তরও পাইনা।
“এত প্রেম তখন যেমন ছিলো, পরেও থাকবে”- এটাই বোঝানোর চেষ্টা করলাম ওকে অনেক।
“প্রেম পর্যন্ত ঠিক আছে, তাও খুব বেশি হলে তিনমাস, কিন্তু বিয়ে!! সর্বনাশ...!! টুম্পার জন্য লাগবেগাধাগুধা টাইপ ছেলে, দুইজন মিলে পূর্ণিমা দেখবে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে শুনে চোখেরপানি ফেলবে। এই ভার্সিটিতে আছে ওরকম আমার একপরিচিত। ওদের ফিটিং করে দেয়ার চেষ্টা করছি দাঁড়া...”
আমার আর নাদিমের বিশ্বাস হয় না পিয়ালের এসব কথা। পিয়াল কি আসলেই পছন্দ করতো না টুম্পাকে? নাকি জোর করে নিজের সাথে খেলতো? একসাথে টোয়েন্টি নাইন খেলে, টং-এর আড্ডায় কত কত সময় পার করেছি আমরা, অথচ তাও কিছুই জানিনা মনে হয় ওর সম্পর্কে।
নাকি আমরা অনেক সাধারণ ওর তুলনায়? যারা একটু স্থির জীবন কাটানোর জন্য অবলীলায় কত স্বপ্নের চিরকুমার সভার সদস্যপদও ত্যাগ করতে পারি।
বলেছিলাম তো আগেই, ভীষণ একরোখা পিয়াল। টুম্পা ভালো হয়ে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই ওর বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললো নিজেই। ওর এক বন্ধু,নাম রেজওয়ান। পিএইচডি করছিলো কানাডাতেই। দুই বছরের মধ্যেই ডক্টর রেজওয়ান হয়ে যাওয়ার কথা।
তার সাথেই টুম্পার এংগেজমেন্ট করালো পিয়াল। টুম্পার বাবা-মা'র সাথেও কথা বললো, নিজেই সব বুঝিয়ে বললো। তবে বোঝানোর সবটুকু যে সত্যি ছিলো তা অবশ্যই না।
এংগেজমেন্টের পর দেশে এসে ঘুরেও গেছে একবার টুম্পা আর ওর বর। আমি আর নাদিম যাই নাই দেখা করতে তখন টুম্পার সাথে। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিলো পিয়ালের উপর।
এয়ারপোর্টের সিআইপি লাউঞ্জে আমরা পাঁচজন এখন। মাথার পেছনে একটা চাটি মেরে পিয়াল বললো, টুম্পারা আসুক, চল এবার সবাই মিলে কক্সবাজার যাই।
“কে নিয়ে যাবে, তুই? আমার টাকা এভাবে মেরে দেয়ার চেষ্টা, নাহ?” নাদিম বললো।
“বিয়েটা শেষ করি আগে আমরা, ওর মাথা যেভাবে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, আমার বাসা থেকে যেকোনও দিন ওর টাক দেখে আমাদের বিয়ে আটকে দিবে মনে হচ্ছে”
অনেকক্ষণ পর পারুল মুখ খুললো।
আমি মৃদু আপত্তি জানালাম ওর কথায়,
“কি যে বলো না বলো এসব।
ছেলেদের আসল রূপ হচ্ছে ভুড়ি আর টাকে, মেয়েদের শোভা হলো কোমরের বাঁকে।”
“আসছেন আমার কবি...”
“তোর টাকা পাবি রে নাদিম, আমার তো খরচেরই জায়গা নাই, কানাডার মেয়েগুলা তো আর বঙ্গ-ললনাদের মতন না। ছোটখাট জিনিসপত্র পেলেই বিরাট খুশি হয়” – বলে পারুলের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচালো পিয়াল একবার।
“নাহ, কক্সবাজার না, একে তো ভীড়, তার উপর আমজনতার দৈহিক ত্যাগে লোনা পানি দিন দিন আরো নোনা হয়ে যাচ্ছে, এত বড় টয়লেট আর কয়টা আছে দেশে বল?”
“তাহলে সিলেট?”
“হুম, সেটা যাওয়া যেতে পারে। তার আগে বল, কালকে টুম্পা আর আর হাসবেন্ডের জন্য কিরকম সারপ্রাইজ থাকবে?”
আমরা প্ল্যান করতে থাকি। ছেলেমানুষি কিন্তু মজার সব প্ল্যান। আমি আঙ্কেল হয়ে গেছি তো কি হয়েছে? আমার মাথা থেকেও উদ্ভট মজাদার সব আইডিয়া আসতে থাকে।
সময় ফিরে আসে বারবার।
অনেক বছর আগের চিরকুমার সভার আড্ডাই ফিরে এসেছে যেন আমাদের মধ্যে আজকে।
আমার কথাঃ
ধৈর্য ধরে গল্পটা যারা পড়েছেন তাদের বলি, এইটুকু না পড়লেও কোনও ক্ষতি নেই। এটা গল্পের অংশ না, আমার নিজের ভিতরের কথা।
এই গল্পের সবাই কাল্পনিক হলেও, এরা সবাই আমার চারপাশেই বাস করে। আমার খুব ইচ্ছা আমার এরকম কিছু বন্ধু থাকবে। আমি জানি, আমি নাদিমের মত বিশাল মনের না, পিয়ালের মত প্রতিভাবানও আমি না। বন্ধু হিসেবে আমি অনেক বেশি সাধারণ, আমার মনও অনেকটা নীচু প্রকৃতির বোধ হয়। কিভাবে বন্ধুত্ব মূল্যায়ন করতে হয় আমি জানিনা। আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বারবার দেখিয়ে দেয়া হয়, আমি তবুও বের হতে পারি না এর থেকে।
এই কারণেই বন্ধুত্ব আর ইমোশনের মধ্যে গণ্ডগোল করে মানুষকে কষ্ট দেই আমি, নিজেও কষ্ট পাই। আমার অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝে এটা একটা।
গল্পের নাম প্রসঙ্গে বলি, আমি জীবনের প্রথম সিলেটে যাই যে ট্রেনে- সেটার নাম ছিলো জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। তখন আমি ক্লাস ওয়ান বা টু-তে পড়ি। এরপর অনেকবার ঐসব জায়গায় আমার বন্ধুদের সাথে নিজেকে কল্পনা করেছি, কিন্তু আর যাওয়াই হয় নাই কখনও। আমি চাই আমার গল্পের সবাই জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের ঝিকঝিক শুনতে শুনতেই সিলেট যাক।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২৬