পা-দানিতে দুই মিনিট ঝুলার পর, শারীরিক স্থিতিস্থাপকতার চরম পরীক্ষা দিয়ে বাসে আধা ঘণ্টা হলো দাঁড়িয়ে আছি। প্রচণ্ড ভিড় আর জ্যাম রাস্তায়।
কানে হেডফোনটা আছে দেখে তাও রক্ষা। পাশের লোকটার আত্মনিঃসৃত-ডিওডোরেন্টে সুবাসিত হয়েও আশিকি থ্রি-তে আবিষ্ট হয়ে থাকতে পারছি।
ওদিকে সামনের সিটে আমার নাইনটি ডিগ্রি কোণে বসা লোকটা যেভাবে নড়ছে, তার কাঁধের দিকেও একচোখে কড়া নজর রাখতে হচ্ছে। বৌ-এর জন্য যা সঞ্চিত, সেইখানে কখন যে আচমকা আঘাত চলে আসে, খোদা মালুম।
যাইহোক, সুসংবাদ হলো, বাস চলতে শুরু করেছে।
তবে কিছুক্ষণ পর বাসের হেল্পার যখন পরপর দুইবার ‘পঙ্গু-শিশু নামেন’ বলে চিৎকার করে উঠলো তখনই বুঝতে পারলাম ভুলটা কোথায় হয়েছে।
আমার যাওয়ার কথা ধানমণ্ডি, পঙ্গু হাসপাতাল আর শিশুমেলার এদিকে চলে আসা মানেই বিরাট গণ্ডগোল।
মাথায়ও হঠাৎ গিট্টু লেগে গেলো, দুইটাকা ফেরত নেয়ার জন্য হেল্পারের কাছে যাবো নাকি জনসমুদ্র পার হয়ে দরজার দিকে যাবো এটা ঠিক করতেই আরো দুইমিনিট লেগে গেলো।
পরে অবশ্য কন্ডাক্টরের কাছ থেকে দুইটাকা আদায় করেই নামলাম।
আস্তে করে একবার ইউরেকা-ও বলে ফেললাম দুইটাকার আনন্দে!!
কিন্তু হেডফোনে ক্যাটরিনার ধুম্মাচালে বাজে না কেন? আচ্ছা সেটা না হোক, রণবীরের বেতমিজ বেতমিজ গানটারই বা কি হলো? এদিকে পকেটজোড়াও কেমন হালকা হালকা লাগছে।
হায়রে। কপাল খারাপ আজকে। তবে এত দুঃখেও বাবাজির হাতের কাজে মুগ্ধ হলাম। মোবাইল থেকে হেডফোনের তার খুলে দুইটা পকেট কিভাবে সাফ করে দিলো!! আর হট্টগোলের মধ্যে ক্যাটরিনা-কারিনারা যে কখন চুপ হয়ে গিয়েছে টেরও পাই নাই।
নাহ, পুরাটা ফাঁকা করে নাই।
আফগানি-বোরখা পড়া আন্টির দেয়া “গোপন রোগের মহৌষধ, ১০০% গ্যান্টি” কাগজটা রয়ে গেছে পকেটে।
গরম গরম লেখাগুলো বাসায় এসে পড়বো বলে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু বিধি বাম।
অতঃপর...
পকেট সম্পূর্ণ ফাঁকা না করার জন্য বাবাজিকে অসীম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দুইটাকার একটা নোট, গোপন রোগের মহৌষধ আর একটা হেডফোন নিয়ে আমার অভিসার-যাত্রা শুরু করলাম। ও আচ্ছা, বলা হয় নি, ফেসবুকের ‘প্রিন্সেস ফারিয়ার’ সাথে আজকে আমার প্রথম ডেট!!
চেহারা ভালোই, আর ফোনে কথা বলে যেটুক মনে হয়েছে, বড়লোকের আহ্লাদি টাইপ মেয়ে। বাকিটুকু আজকেই দেখা যাবে।
মেয়েটা বাসা থেকে বের হলো কিনা কে জানে। মোবাইল নাম্বার মুখস্ত হওয়ার আগেই দেখা করতে রাজি হওয়াটা আসলে সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য বুঝতে পারছিনা।
আপাতত দুই পাশে চোখ রেখে হাঁটছি। পরিচিত কাউকে খুঁজছি।
জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে অনেকে এদিকটায়। বেশিরভাগেরই হাতের শুরু আছে, কিন্তু শেষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেক জায়গায় দুইটা করে মাথা জোড়া লাগানো।
ইচ্ছা হলো বলি, ভাইরে, দেশে আজকাল নাড়াচাড়া করলে বিল্ডিং পর্যন্ত ভেঙে পড়ে, ওদিকে একটু সাবধান।
কিন্তু সব কি আর বলা যায়?
যাহোক, এদের মধ্যেও খুঁজে যাচ্ছি। পরিচিত কাউকে যদি পাওয়া যায়। লজ্জার মাথামুণ্ডু খেয়ে দুইশ-চারশ যা হোক, আদায় করা যাবে। নাহলে বিরাট বেইজ্জতি হইয়ে যাবে আজকে। দুইটাকা দিয়ে বাদাম চাইলে আজকাল বাদামওয়ালাও প্রথমে রাগ হয়ে তাকায়, তারপর হাত মুঠো করে ৭/৮ টা বাদাম তুলে দেয় হাতে। কাগজের প্যাকেটটা পর্যন্ত দেয়না।
নাহ, পরিচিত কেউ না, তবে খুঁজতে গিয়ে ইরানের এক বিখ্যাত কবির নায়িকাকে পেয়ে গেলাম।
“আগার আঁ তোর্কে সিরাজ বদস্ত আরাদ দেলে-মা’রা
বখালে হেন্দুয়াস্ বখশাম্ সমরকন্দ্ ও বোখারা”
এখানে সেই কবি তার প্রিয়ার গালের একটা কালো তিলের জন্য ইরানের সমরখন্দ্ ও বোখারা নগর দুটি বিলিয়ে দিতে চেয়েছেন। ওদিকে তখন মধ্য এশিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যোদ্ধা তৈমুর। বিখ্যাত তৈমুর লঙ। আসলে তার ছিলো এক পা খোঁড়া, সেই থেকেই ‘ল্যাংড়া’ শব্দের বিবর্তনে তৈমুরের নামের শেষে ‘লঙ’ শব্দটা বসে যায়।
যাহোক, কবিতা শুনে তার সে কী রাগ। কোথাকার কোন কবি এসেছে তার নগর বিলিয়ে দিতে। ডাকো দেখি কবিকে, দরকার হলে তাকেও ‘লঙ’ বানিয়ে দেয়া হবে।
সুন্দরী ছোটখাট এই মেয়েটার গালেও হুবহু সেই কালো তিল।
আর মেয়েটার নাইনটি নাইন পার্সেন্টই ভালো, শুধু আমাকে তাকাতে দেখে কাছে এসে আস্তে করে বললো- ঘণ্টায় ৫০০ দিবেন? দেইখা নেন লাগলে, আমার বয়স মাত্র ২৫।
সটকে পড়লাম দ্রুত। নাহ, যেহেতু প্রেম করতে যাচ্ছি, আরেকটু সাবধানে তাকাতে হবে চারিদিকে এখন থেকে।
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ধাক্কা খেলাম। নায়িকা নয়, প্রিয় পাঠক। সেই কপাল যদি আমার থাকতো।।
তবে তাও ভালো যে অন্ধ ‘ফকির-লঙ’ ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় নি।
এক পা নিয়েই তৈমুর লঙ কত রাজার কাপড় ভিজিয়ে দিতেন, আর আমাদের ‘লঙ’ সম্প্রদায় ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে। আফসোস।।
দেশ ও জাতির দুরাশাজনিত অবনমনের প্রতি গভীর চিন্তাশীল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ কাটিয়ে হাঁটা দিলাম। ২৫/৫০ পয়সা উঠে যাওয়ার পর কখনও ভিক্ষা দিয়েছি বলে মনে পড়েনা।
তবে মাথায় হঠাৎ দুষ্টবুদ্ধি চাপলো। পিছন ফিরে, পকেট থেকে গোপন রোগের বটিকার কাগজটা বের করে ধরিয়ে দিলাম অন্ধ ফকিরের হাতে। যা ভেবেছিলাম তাই, হাতে কাগজটা পেয়েই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো ‘অন্ধ ফকির’।
পকেটমারের কাজে যতটা মুগ্ধ হয়েছিলাম, এর কাজে ততটাই হতাশ হলাম। কে জানে, তাড়া করলে হয়তো উসাইন বোল্টের বেগে ছুটতেও দেখা যাবে একে। বহু কষ্টে ইচ্ছা দমন করলাম।
যেই রেস্টুরেন্টে দেখা করার কথা চলে এসেছি। পরিচিত কাউকে আর পাওয়া গেলো না আর রাস্তায়। তার উপর প্রায় এক ঘণ্টার মত লেট। মিশন মোর দ্যান ইম্পসিবল।
খুব সম্ভবত বসে থেকে, ফোনে না পেয়ে চলে গেছে মেয়েটা। বাস আর পকেটমারের পৈত্রিক-মাতৃক গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে হেডফোনের তারটা যেখানে প্যাঁচ খেয়েছ সেটা ঠিক করতে বসলাম একটু।
এমন সময় দেখি, হেলেদুলে হাঁটিয়া আসছেন প্রিন্সেস ফারিয়া।
প্রোফাইল ফটোতে এতদিন শুধু মুখ দেখেছিলাম, ফুল প্যাকেজ দেখে আজকে আঁতকে উঠলাম রীতিমত।
গালেমুখে স্তরীভূত ব্লাশন-পাউডার, মাথায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা সিরিজ-প্যারালাল কানেকশনের কেশবিন্যাস, ঠোঁট-গাল আর চোখ মিলিয়ে রঙধনুর সাতটা রঙ নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যাবে। ওদিকে প্রিন্সেসের অনাবৃত মেদবহুল বাহুতে একেকবার নাড়া পড়ছে, এবং তাতে ঢেউ খেলছে। আর আমি আতঙ্কিত-অপলক চোখে দেখছি।
মুখ থেকে আরো বেশ খানিকটা নিচে নামার পর অবশেষে কাপড়ের দেখা পেলাম। তারপরের বিবরণটুকু অবশ্য ‘তেঁতুল-বোর্ড’ কর্তৃক ছাড়পত্র পায়নি।
- হাইই, তুমিই তাহলে থানভির, রাইট??
জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে মাথা নাড়লাম।
- নাইস টু মিট ইউ অ্যাট লাস্ট। ওহ গড! তুমি তো দেখি খুব্বি সুইট।
এসব কথা শুনলে উত্তরেও কিছু একটা বলতে হয়, কিন্তু মুখ খোলার সুযোগ তো পেতে হবে।
- দেরি হলো কেন জানো? নাচ বালিয়ে তে সেদিন যে ড্রেস এ মালাইকা অরোরা নেচেছিলো, ওই ডিজাইনের ড্রেসটা পরতে গিয়ে দেখি টাইট হয়ে গেছে। তারপর চেঞ্জ করতে গিয়েই সময় লাগলো। এটা কেমন, বলো তো?
কাপড়ে সূতার ব্যবহারের মিতব্যয়িতায় ‘প্রভা’বিত হলাম।
আবারো শুকনো ঢোক গিলে মাথা নাড়লাম।
- ভালো, খুব ভালো।
আমার পকেটের শূন্যতার খবরটা বলবো কিনা ভাবছি। তবে এই ‘প্রিন্সেস’ খেতে বসলে যে আমার কিডনীগুলোও একে একে বিক্রী করতে হবে সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
- সরি, আমি কথা বলেই যাচ্ছি। তোমার খবর বলো। আমার কিন্তু মন অনেক খারাপ আজকে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় দেখি গালে দুইটা পিম্পলস উঠেছে। বোঝা যায়না তেমন। কিন্তু হাত দিলে টের পাওয়া যায়। দেখো হাত দিয়ে।
- না থাক, এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে হালকা।
প্রথম দিন দেখেই বোধ হয় গাল পর্যন্ত। কিন্তু এই রমণীর পরবর্তী পিম্পলসগুলো যে কোন আনাচে কানাচে উঠবে সেটা ভেবেই শিউরে উঠলাম রীতিমত।
- উফফ, এখানটায় খুবি হট লাগছে। এসি মনে হয় কাজ করছে না, চলো আমরা অন্য কোথাও বসি। এনিওয়ে, তোমার টি-শার্টে এটা চুল নাকি? ওহ মাই গড, এত লম্বা চুল!! কি করছিলে এতক্ষণ তুমি? তোমার চুল তো এত বড় না।
আরে তাইতো!! বাসে ধাক্কাধাক্কিতে প্রায়ই এরকম উপহার রেখে যায় আমাদের এলেকেশী ললনারা। কিন্তু সেই ব্যাখ্যা আর দিতে ইচ্ছা করলো না।
শয়তানি হাসি দিয়ে আস্তে করে বললাম, তাহলে বোধ হয় মাথার চুল না।
- সরি?? শুনতে পারিনি ঠিকমত। আচ্ছা থাক, প্রব্লেম নাই, আমরা এটা পরে ফিক্স করে নিবো। এখন চলো, আমি গরমে পুরো ভিজে যাচ্ছি। তোমার গাড়ি কোথায়?
প্রমাদ গুণলাম আমি। পুরোপুরি ভিজে গেলে তো আবার অন্য সমস্যা হয়ে যাবে, তার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এখন উঠলেও তো বিপদ। মেয়েমানুষ হাত ধরে টানাটানি করলে মহা গ্যাঞ্জাম হয়ে যাবে।
দোয়াদুরুদ পড়া শুরু করবো কিনা ভাবছি।
- অ্যাই শুনো, তোমার ডিএসএলারে আমার একটা ডিপি তুলে দাও না। এডিট করে একটু ফর্সা করে দুই পাশে ঝাপসা করে আমাকে পাঠায় দিও।
লুফে নিলাম কথাটা প্রথমবারের মত।
- ঠিক আছে, ব্যাকগ্রাউন্ডটাও তো বেশ সুন্দর। একটু বসো তাহলে, আমি গাড়ি থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে আসছি। চাইলে পরে এডিট করে চাঁদের মধ্যেও তোমার মুখ বসিয়ে দেয়া যাবে।
প্রথমবার ঠিকমত কথা বলার চান্স পেয়ে আমিও খুশি, চন্দ্রমুখের আশায় মেয়েও খুশি।
আমাকে আর কে পায়? হেডফোনটা যে টেবিলে রেখেছিলাম, সেই কথা একবারো মনে পড়লো না।
তবে হ্যাঁ, ফিরে আসার সময় মনে মনে সমরকন্দের ৫০০ টাকার নায়িকাকে খুঁজলাম। পেলাম না, কাউকে জুটিয়ে ফেলেছে মনে হয় এর মধ্যেই। দুইটাকার নোটটা দিয়ে অন্তত হাত ধরতে দিলেও ধরে দেখতাম কেমন লাগে।
হায়রে, সেটাও তো হলো না এখন পর্যন্ত জীবনে।