২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে নীলু ভাই বিয়ে করেন।
বাসায় কয়েকদিন বেশ চিৎকার চেঁচামেচি হৈ চৈ করার পর সবাই নীলু ভাই এর বিয়ে মেনে নিয়েছিলো। এমনকি আমরা পাড়ার কয়েকজন মিলে নীলু ভাইদের বাসায় প্রায় রাজিও করে ফেলেছিলাম একটা মোটামুটি অনুষ্ঠান করার জন্য।
কিন্তু সেই প্ল্যানও বাতিল হয়ে গেলো কয়েকদিনের মধ্যে। এ কথা ও কথা কানে আসতো, কিন্তু পরিষ্কার করে কিছুই বোঝা যাচ্ছিলো না।
তারপর ঐ বছরেই সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ খুব সুন্দর গোলগাল একটা ছেলে হয় নীলু ভাই-এর। আমি ছিলাম রাতে ঐদিন হাসপাতালে নীলু ভাই-এর সাথে।
কিন্তু ভাবিকে আর শ্বশুরবাড়ি কিংবা বাপের বাড়ি ফিরতে হয়নি, দুইজনকেই বাসা থেকে বের করে দেয়া হয় এরপর।
নীলুভাই আপত্তি করবে ভেবেছিলাম, কিন্তু এটা নিয়ে তিনিও উচ্চবাচ্য করলেন না একদম।
বছর দুয়েকের ভেতর নীলুভাই-এর মা-বাবাও বাসা বদলে চলে গেলেন ওখান থেকে।
*** *** ***
নীলুভাই-এর পরিচয় দেই একটু।
ঢাকা শহরেও যে লুকিয়ে লুকিয়ে গাছ থেকে পেড়ে ফল খাওয়া যায় এটা প্রথম আমাকে দেখান নীলুভাই। আমাকে নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে চোখের পলকে উঠে গেলেন গাছ বেয়ে, তারপর দুইটা আম নিয়ে নেমে এসে দুজন মিলে দৌড়।
হাঁপাতে হাঁপাতে একজায়গায় থেমে নীলু ভাই আমার হাতে একটা দিলেন ;
- এই নে তোর পাহারা দেয়ার মজুরি।
নিজের ভাগ্যকেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। আম্মা শিখিয়েছিলো কেউ কিছু দিলে ভদ্রতা করে প্রথমে ‘লাগবে না’ বলতে, তখন সেটাও ভুলে গেলাম। তখন আমার বয়স ছয় কিংবা সাত। ঐ মুহূর্তেই ঠিক করলাম, বড় হয়ে কলেজ শেষ করে নীলু ভাই-এর বাসার কাজের ছেলে নাহয় ড্রাইভার হয়ে যাবো।
নীলু ভাই তখন তখনই তার আমটা খেয়ে ফেললেন, কিন্তু আমি বাসায় নিয়ে আসলাম। সবাইকে দেখানো শেষে আমার লুকোনো বাক্সে যত্ন করে রেখে দিলাম। দশদিন পর বড় আপুর জন্মদিন ছিল, ভেবেছিলাম ঐদিন সবাই মিলে খাবো, কিন্তু… বেয়াদব ইঁদুর-তেলাপোকাগুলোর জন্য পারলাম না। কষ্টে চোখে প্রায় পানি চলে এসেছিলো ওইদিন।
সবকিছুই কমবেশি আমাকে ট্রেণিং দিতেন নীলুভাই। একদিন মানিক মিয়া এভিনিউ-এর শেষ মাথায় আড়ং এর সামনে আমরা দুইজন দাঁড়িয়ে আছি। একটা মেয়ের আসার কথা। বেশ কয়েকদিন ফোনে কথা বলার পর সেদিন ঠিক করেছি দেখা করব। একা সাহস পাচ্ছিলাম না বলে নীলুভাই-কে নিয়ে যৌথ অভিযান।
- আরে গাধার বাচ্চা গাধা, তোর অভ্যাস যে খারাপ হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছিস? পরে বিয়ের রাতেও বলবি, ও ভাই, একটু দেখায় দাও না।
- থাকো তুমি ঐ আশায়। আর তোমাকে আনবো না।
- রাগ করিস নারে বেকুব। শোন, তোর ঐ লাল খ্যাত রুমালটা বের করে বারবার ঘাম মুছিস না তো। মেয়ে যদি বুঝে তুই নার্ভাস, তাহলেই শেষ। বেশি ঘাম হলে হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে কৌশলে মুছে ফেলবি।
আরে চলে আসছে বোধ হয়, দেখ তো ঐ সবুজ শাড়ি পড়া বনলতা সেন কিনা।
চোখের ইশারা করে নীলুভাইকে পিছনে রেখে আমি সামনে গেলাম।
সংসদ ভবনের উল্টাদিকে চারপাশে নিদারুণ বৈকাল-প্রেম। আর এদিকে আমার বনলতা সেন-পরীক্ষায় পাশ ফেল নিয়ে টানাটানি।
কিন্তু মানিক মিয়ার রাস্তার অর্ধেক পর্যন্ত এসেই বনলতা সেনের জরুরি কাজ মনে পড়ে গেলো। এর আগেও সবার হঠাৎ করেই ‘জরুরী কাজ’ মনে পড়ত নাহয় ‘বাসা থেকে ফোন’ আসতো।
যাইহোক, শুকনা মুখে জীবনানন্দের নায়িকাকে বিদায় দিয়ে দাঁত দিয়ে নখ কামড়ানো শুরু করলাম। তারপর যথারীতি পিঠে সেই পুরনো হাত…
- রবার্ট ব্রুস সাতবার চেষ্টা করে যুদ্ধে জিতেছিল, তোর তো বেটা মাত্র পাঁচবার এই নিয়ে।
কতশত এরকম ঘটনাই আমার কাছে নীলুভাই-এর আসল পরিচয়।
*** *** ***
আমরা পাড়ায় যারা নীলুভাই-এর ভক্ত ছিলাম তারা কয়দিন এই নিয়ে একের পর এক ‘পাড়াটেবিল’ বৈঠক করলাম। দুই একজন স্ট্যাটাস দিয়ে সামাজিক অবক্ষয়-এর জানাজা পর্যন্ত পড়িয়ে ছাড়লো।
আর তারপর? কেউ মেট্রিক, কেউ ইন্টারমিডিয়েট নিয়ে ঘরে বন্দি হয়ে গেলাম। ঘটনার শেষ আছে আমাদের পাড়ায়? পাশের বাসার কুকুরটা একদিন রবিনকে কামড়ে দিলো, এ প্লাস পেয়ে আমাদের ফরিদ শার্ট খুলে রাস্তায় নাচানাচি করলো কিছুক্ষণ। আর… ফিরোজ আঙ্কেলদের বাড়ির তিনতলায় টানাটানা চোখের ধারালো চেহারার মেয়েটা যেদিন আসলো সেদিন থেকে সবাই হঠাৎ করে রূপসচেতন হয়ে গেলো।
কলেজ শেষ করেছি ততদিনে, মেডিকেল কলেজও শেষ করে ইন্টার্নি করছি। নীলুভাই-এর বাসার না হলেও সলিমুল্লাহ মেডিকেলের এমার্জেন্সিতে ‘অবৈতনিক-কাজের ছেলে’র কাজ করছি।
এই মুহূর্তে যেই রোগীর জন্য আটকে আছি সে বাঁচবে না মোটামুটি নিশ্চিত। পালস রেট কমতে শুরু করেছে। ব্রেইন স্ট্রোকের কেস, ইন্টার্নাল ব্লিডিং হচ্ছে। এদিকে আমার ডিউটির টাইম শেষ, আমার পরের জনও চলে এসেছে।
এর মধ্যে নীলুভাই ঢুকলেন। বছর সাতেকের একটা ছেলেকে কোলে করে নিয়ে এসেছেন। ছেলেটার জ্ঞান নেই।
প্রায় পাঁচ বছর পর নীলুভাইকে এভাবে দেখবো ভাবি নাই। ‘কেমন আছেন’ এটা বলার মত অবস্থাও ছিল না। ছেলেটাকে কোনও মতে বেডে শুইয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ।
এপিলেপ্টিক সিজার।।
এই মুহূর্তে খুব সিরিয়াস কিছু না। অল্পক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসার কথা। তাও ডিউটির ডাক্তার আর নার্সকে খেয়াল করতে বললাম।
এরপর নীলুভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম প্রথমবারের মত। এলোমেলো দাঁড়িগোফে একটু অন্যরকম লাগছে, এছাড়া চেহারার তেমন পরিবর্তন নেই। অনেক কিছু জিজ্ঞাস করার জন্য মন ছটফট করছে, কিন্তু কিসের যেন অপরাধবোধ হচ্ছে। একটু পর জিজ্ঞাস করলাম, কেমন আছেন?
ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন নীলুভাই। প্রশ্নটা করে বোকার মত লাগলো নিজেকেই। এরপর কয়েক মুহূর্তের বিশ্রী রকম নীরবতা ভেঙে নীলুভাই নিজেই উঠলেন।
- চল্ রাশেদ, চা খেয়ে আসি।
হাঁফ ছেড়ে উঠলাম নিজেই। বাটারবন আর চা খেতে খেতে নীলুভাইয়ের কাহিনী শুনলাম। কোনরকম লজ্জা সংকোচ ছাড়াই বললেন।
- নাটক সিনেমার প্রেম দেখে সারাজীবন রসিকতা করতাম। কিন্তু জীবন নাটক-সিনেমা থেকে কম না রে।
নওশীনের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর পর ব্যাপারগুলো প্রথম বুঝতে পারি। অল্পসল্প দেখা হতো মেয়েটার সাথে তখন, কিন্তু দুজন যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হই তখন থেকেই ব্যাপারটা সত্যিকার প্রেমে পরিণত হয় আসলে। ও খুব শান্তশিষ্ট ধরণের মেয়ে ছিল। আমার মত ভ্যাগাবন্ড ছেলের সাথে কিভাবে জড়ালো কে জানে। ক্যাম্পাসে পরিচিত হওয়ার কারণে সবাই মোটামুটি জানতো আমাদের কথা।
একসময় ডিবেট করতাম। তারপর কিভাবে যেন রাজনীতিতে ভালোভাবেই জড়িয়ে যাই। দেশে নির্বাচনের আগে তখন গোলমাল চলছে। ওদিকে সরকারি দলের কয়েকজন ক্যাডারের সাথে আমার লেগে গেলো। আমাকে হুমকি ধামকি দিয়ে বেড়াচ্ছে… হুমকি দিয়ে খুব একটা সুবিধাও করতে পারছিল না। বুঝতে পারছিলাম বড়সড় ঝামেলাতে পড়তে পারি। তাই বাইরে বের হওয়া কমিয়ে দিলাম। কিন্তু ঐ শুওরের বাচ্চাগুলো যেভাবে আমার উপর প্রতিশোধ নিলো তা আমার কল্পনারও বাইরে ছিলো।
অবাক লাগছিল শুনতে, নীলুভাইয়ের এত কাছে থেকেও এসবের কিছুই জানতাম না কখনও। হয়তো সেভাবে জিজ্ঞেসই করা হয়নি। কি অদ্ভুত স্বার্থপর আমরা সবাই।
- ওরা কি করলো জানিস আমার উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য? ধানমণ্ডি থেকে নওশীনকে তুলে নিয়ে গেলো। কোথায় আটকে রেখেছিলো দুইদিন জানিনা। এরপর ওকে ছেড়ে দেয় ওরা। কেন ছেড়ে দিলো কে জানে। মেরে ফেললেই মনে হয় ভালো হত ওকে। আমাকে আরো বেশি কষ্ট দেয়ার জন্যই বোধ হয় ওকে ছেড়ে দেয়।
সারা শরীরে অসহ্য ব্যাথা নিয়ে তিনদিন হাসপাতালে ছিলো। আমি একবারও যাই নাই হাসপাতালে ওকে দেখতে। ওর মুখে- শরীরে আঁচড়ের দাগ সহ্য করতে পারতাম না নিশ্চয়ই।
একেবারে ভঙ্গুর হয়ে পড়লাম। নওশীনের বাবা আমাকে ডেকে যাচ্ছেতাই কথা বললো। ঠিকই তো, ক্ষমতাহীন একটা গুণ্ডা ধরণের ছেলে আমি। নিজের দোষে একটা মেয়ের জীবন শেষ করলাম। চলে আসার আগে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন এই ব্যাপারটা নিয়ে মারামারি কিংবা টু-শব্দ যেন না করি।
আমার ইনসমনিয়া হয়ে যায়।
নিজের পায়ের আঙ্গুল নাহয় দেয়ালের টিকিটিকি দেখি, একসময় বিরক্ত হয়ে ঘড়ির ব্যাটারি খুলে ফেলি।
একই ঘটনা রাতের পর রাত ঘটতে থাকে।
- এর প্রায় একমাস পর নওশীন আমার সাথে দেখা করে। চোখের নিচে কালি, শুকিয়ে পাটকাঠি হয়ে গেছে মেয়েটা। ও এসেই প্রথম যে কথাটা বললো তা হলো- রাশেদ, আমি কনসিভ করেছি।
ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, জানিস। মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁত কামড়ে চোখের পানি আটকে রেখেছিলাম। কাপুরুষ হয়ে বেঁচে থাকার কষ্ট অনেক বড়। অনেক বেশি।।
অ্যাবরশনের জন্য বললাম ওকে। কিছুতেই রাজি হলো না ও। বাসায়ও কাউকে বলল না। একমাস চেষ্টা করলাম, ওর এক কথা- দোষ তো বাচ্চাটা করে নি।
- এরপরের ঘটনা তো জানিসই। অনেক ঝামেলা করে মাস দুয়েক পর বিয়ে করলাম ওকে। তা নাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না একদমই।
অনুভূতিগুলো একটু বেশিই দামি ছিলো আমার কাছে। তাই সবসময়ই বিশ্বাস করতাম, আমাদের এতদিনের অনুভূতিগুলো ওর শরীরে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে। এখানে একবিন্দু পাপ নেই।
আর শান্তশিষ্ট বোকা মেয়েটা এতকিছু বুঝলো না। অভিমান করেই বোধ হয় বাচ্চাটাকে রেখেই চলে গেলো। ডেলিভারির সময় এরকম ব্লিডিং হবে আমরা কেউই বুঝতে পারিনি।
- ওর অবস্থা যখন শেষের দিকে ডাক্তাররা আমাকে ওটিতে নিয়ে যায়। ওর রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। আমাদের স্বপ্ন, অভিমান সব একসাথে লাল হয়ে মিশে যাচ্ছে।
আমি শক্ত করে নীলুভাইয়ের হাত ধরে আছি। কাঁদছেন নীলুভাই।
রবার্ট ব্রুসের মত মাত্র সাতবার না, এত হাজারবার হার মেনেও বিজয়ীর অশ্রু সবাই ধারণ করতে পারে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:৪৩