- ফুটপাথ দিয়ে হাঁটিস কেন ভীতুর ডিম কোথাকার? পুরুষ হতে হলে রাস্তা দিয়ে হাঁটবি। এই দেখ্ আমাকে।
কথা শেষ না করতেই ওর গা-ঘেঁষে রং-সাইডে আসা একটা মটর-রিকশা চলে যায়। লাফিয়ে বাঁদিকে সরে আসে অনন্যা।
-এইজন্যেই মেয়েদেরকে জোর করে পুরুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না রে বেকুব।
বেশ কষ্ট করে মাথা ঠাণ্ডা রেখেই বললাম। বুঝে গেছি, বকাঝকা করে লাভ হবে না এই মেয়েকে। গতকালকেই একটা সাইকেলের সাথে ধাক্কা খেয়েছে, তারপর আবার সাইকেল-চালানো ছেলেটার সাথে চিল্লাচিল্লি করেছে রাস্তার মধ্যে। বাজে অবস্থা রীতিমত।
মেয়েটার কোনও ভালো গুণ নেই।
বদমেজাজি, হিংসুক, ঝগড়াটে, নির্বিকার একটা মেয়ে।
নতুন ফোনে কোন রিংটোন সেট করবো সেটা বুঝানোর জন্য একবার একটা গানের দুইলাইন গেয়েছিল অনন্যা, সেটা শুনে রেস্টুরেন্টের অর্ধেক লোক ভুরু কুচকিয়ে তাকিয়েছিলো আমাদের দিকে।
হাসার সময় দুনিয়া কাঁপিয়ে বিকট শব্দ করে হাসে।
কিন্তু… ওর অদ্ভুত সুন্দর বড় বড় দুইটা চোখ। সারাক্ষণ বই পড়ে পড়ে সেই বড় চোখের উপর আরো বড় দুইটা চোখ এখন।
যাদের চোখ সুন্দর তাদের চশমা পড়া অন্যায়। আমাদের যখন অনেক টাকা হবে আমাদের, লেন্স লাগিয়ে নিতে বলবো ওর চোখে।
ও আচ্ছা, আসল কথা তো বললামই না, আমরা দুইজনই ভীষণ বইয়ের পোকা। নজরুল থেকে জীবনানন্দ, বাংলার দুই হুমায়ূন থেকে ভারতের সুনীল কিংবা সূচিত্রা- কোথাও অরুচি নেই।
বছরখানেক আগে প্রোগ্রামিং পরীক্ষার আগের রাতে সিলেবাস জানতে ফোন দেই অনন্যাকে। ও আচ্ছা, আমি মহা ভ্যাগাবন্ড হলেও ও কিন্তু বিরাট ভালোছাত্রী।
ফোন দিয়ে তো আমি তো অবাক, কাঁদছে মেয়েটা।
জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাচ্ছিনা, আবার রেখে দেয়াও যাচ্ছেনা। রীতিমত বিব্রতকর অবস্থা। আবার এমন না যে তার সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব।
অনেকক্ষণ পর যে উত্তর পেলাম সেটা শুনে আমি নিজে হাসবো না কাঁদবো তাও বুঝলাম না।
কান্নার কারণ একটা ইন্ডিয়ান বই... Revolution 2020!!
আকাশ থেকে পড়লাম। এই আঁতেল-নারী গল্পের বইও পড়ে? আবার বই পড়ে কান্নাকাটিও করে?
আমি তো জানতাম ক্লাসে আমি একাই এরকম উন্মাদ!!
যাক, আড্ডা মারার জন্য এখন আর আমাকে টিএসসিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছে যেতে হবেনা। মনে মনে অনেক খুশি হই সেদিন।
এখনকার কথা বলি, সকালের দিকে আজকাল আমাদের প্রধান কাজ নীলক্ষেতে নতুন-পুরনো বইয়ের দোকানে হাঁটাহাঁটি করা। আজিজের লিটল-ম্যাগাজিন পাবলিশারদের সাথে কঠিন ভাবের বিষয় নিয়ে আড্ডা দেয়া। নাহলে- রমনায় বিশাল জায়গাজুড়ে যে রেস্টুরেন্টটা খুলেছে ওখানে শরবতের মত মিষ্টি চা-হাতে ঝগড়া করা।
যাহোক, ভার্সিটির গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে মোটামুটি সেটল হওয়ার চেষ্টা তখন আমাদের। মাস্টার্স করার জন্য বাইরের কয়েকটা ভার্সিটিতে আপ্লাই করেছি। আর অনন্যা দেশেই কয়েকটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চেষ্টা করছে।
- ভাল্লাগে না রে বুঝলি, এমনি সময় নীলক্ষেত যেতে প্রায় দেড়ঘণ্টা লাগে, আজকে হরতালের জন্য লাগলো মাত্র ১৫ মিনিট। তোকে তো আর বাসের সিট ছাড়া পাশে পাওয়াই যায়না। আর ইয়ে... তুই তো এদিক আসলে আর চিনিস না আমাকে।
শুনছে নাকি মেয়েটা বুঝতে পারছিনা। মুখভর্তি করে ডালপুরি চিবিয়েই যাচ্ছে। ধুর, আমার বলার কাজ বলে যাই...
- রিকশাই ভালো যা মনে হচ্ছে। হরতালের আগুনে বারবিকিউ হওয়ার ভয় কম। যদিও মটর রিকশাগুলো যখন শোঁ শোঁ করে টানে মাঝে মাঝে বেশ বিরক্ত লাগে। তবু তুই পাশে থাকলে ভালোই লাগে।
- হুম, তারপর?? যে লাইনে যাচ্ছিস এবার জলিলের মত হার্টটা বের করে দেখাবি, তাইতো?? নাকি আবার অন্য কিছু বের করবি?? তুই যে কুত্তা, তোর তো ঠিক নাই।।
দীর্ঘদিনের অভ্যাস থাকার পরও কোনও মেয়ের মুখে এই ধরণের উত্তর শুনে আর কিছু না বলাটাই স্বাভাবিক।
যাহোক, কপালকুণ্ডলার মত আমার সাগরে আত্মাহুতি দেয়ার গল্প n-সংখ্যক বারের মত এবারও ইস্তফা দিতে হলো।
নেশা বড় খারাপ জিনিস, বিশেষ করে চোখের নেশা।
************************************************
ওর জন্মদিন ছিল ৪ জানুয়ারি। ওকে অনেকগুলো বই গিফট করি।।
তার দুদিন পরই সন্ধ্যায় অনন্যার ফোন পেয়ে বের হই। হাতিরঝিলে দেখা করি আমরা।
- হঠাৎ জরুরি তলব…?? কালকে কিছু বলতে ভুলে গিয়েছিলেন নাকি মহারাণী?
ওর দিকে তাকিয়ে চমকালাম। হাতিরঝিলের হাল্কা আলোয় এতক্ষণ খেয়াল করি নি ওর চোখ লাল।
- এইসব বই কেন আমাকে পড়তে দিস?
হঠাট হাতে ধরা বইটা ছুঁড়ে ফেললো আমার মুখের উপর অনন্যা। হ্যাঁ এটা দিয়েছিলাম ওকে ওর জন্মদিনে… হুমায়ূন আহমেদের ‘কৃষ্ণপক্ষ’... আমার পড়া সেরা প্রেমের উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটা।
কিছু না বুঝে আবার তাকালাম ওর দিকে।
এরপর যতগুলা গালি খেলাম একটাও লেখার মত না। সাথে খোলা রাস্তায়ই অনেকগুলো কিল-ঘুষি দেয়ার পর হাউমাউ করে কাঁদলো মেয়েটা কিছুক্ষণ। তখনও কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তবে ওর পরের কথাগুলো মনে থাকবে আমার, সারাজীবন…
- আমি কখনই তোর মত গবেট ছিলাম না। সারাজীবনই অনেক ভালো স্টুডেন্ট আমি। লাস্ট এক বছরে রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বলে ভাবিস না আমি পড়াশোনা করি নাই। শুধু বিরক্তিকর মাথামোটা ব্যাটারি-সার্কিট বাদ দিয়ে তোর জন্য পড়েছি। অবাক হচ্ছিস? শোন, আমি কখনই বইয়ের পোকা ছিলাম না। প্রথমদিকে শুধু তোর সাথে বের হওয়ার জন্য আমি গুগলে ঘেটে একগাদা বইয়ের নাম আর সামারি পড়তাম। মুখস্ত করতাম। আর বইপত্র নিয়ে কথা বলতাম। তারপর যখন সত্যি সত্যি পাগলের মত বই পড়া শুরু করলাম তখন আর তোকে আসল কথাগুলো বলা হয়নাই।
চোখের পানি মুছে একটু থামলো অনন্যা।
- আমি অনেক খারাপ একটা মেয়ে। কারণ বছর দুয়েক ধরেই আমার বিয়ে ঠিক করা। তোর মত কুলাঙ্গার ছেলে না, ঐ সময়েই আমাকে আংটি পড়িয়ে যায় সে। কিন্তু… তোকে কখনো বলা হয়নি, লুকিয়ে রাখা আংটির বদলে তোর দেয়া বইগুলোর দিকে তাকিয়েই আমার রাত কাটে।
রিশাদ, আর ঠিক একমাস পর আমার বিয়ে। তুই যতদিন আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করেছিস, আমি তোকে থামিয়ে গালিগালাজ করলেও পরে সারারাত ঘুম হতো না আমার।
ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব ভীতু একটা মেয়ে আমি, এখনও ওরকম আছি। নিজের এই ভয়টাকে অপছন্দ করি বলেই জোর করে সাহস দেখাতে চাই সবার সামনে।
মাফ করে দিস আমাকে।।
হতভম্ব ভাব কাটে নি আমার তখনও। কিন্তু…
- আচ্ছা, তোর সাথে প্রথম যেদিন কথা হয় ভালোমত, তুই বলেছিলি কি একটা ইংলিশ বই পড়ে তোর মন খারাপ। ঐটা কি ছিল তাহলে? তখন তো বই পড়তি না।।
- মিথ্যা বলেছিলাম সেদিন। ঐ বইটার নাম আমার এক বোনের কাছ থেকে শুনেছিলাম সেদিনই। ফেল্টু মার্কা ছাত্রকে তো আর বলা যায়না; পরীক্ষায় এ প্লাস পাই নাই বলে মন খারাপ।
একথা বলে চোখের পানি নিয়েও হাসলো অনন্যা। সাধারণ চেহারার এই মেয়েটাকে সেদিন যে কেমন লাগছিল সেটা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে ঠিকভাবে বলতে পারিনি। খোদা মানুষের খুব বড় কোনও ভালোকাজের বিনিময়ে অল্প সময়ের জন্য কিছু মুহূর্ত দেন, ঐটা ছিল তেমন একটা মুহূর্ত।
আমার আর কথা শোনার ধৈর্য ছিল না। খুব আস্তে করে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,
- এতদিন যখন কিছু বলতে দিস নাই, আজকে আর না-ই বললাম।
তারপর একমুহূর্তের জন্য, কেবল একমুহূর্তের জন্যই ওর গালে নিজের ঠোঁটটা ছুঁয়ে দিলাম। আর এক সেকেন্ডের জন্য হলেও রক্তে অ্যাড্রেনালিন বাড়তে দেই নি।
পেছনে একবারও না তাকিয়ে ফিরে এলাম এরপর।।
ফিরে তাকালেও খুব একটা ভালোমত দেখতে পেতাম না অবশ্য অনন্যাকে। হাতিরঝিলের আলো-আঁধারি একটা কারণ ছিল। তাছাড়াও… …
জীবনটা গল্প হলে কি অদ্ভুত সুন্দর হতো, তাইনা? সুন্দর একটা ফিনিশিং থাকতো হয়ত। শেক্সপিয়ারের রোমিও-জুলিয়েট কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘কঙ্কাল’ গল্পের মত নাটকীয় না হোক, অন্তুত শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীণের’ মতই শেষ হত না হয়।
ঘরে ফিরে খুব বেশি চিন্তা ভাবনা করতে হয়নি আমাকে। মাথাটা অদ্ভুত রকমের ঠাণ্ডা ছিল কয়েকটা দিন।
ঐ সন্ধ্যার পর আর যোগাযোগও করি নি অনন্যার সাথে। তবে স্বাস্থ্যবান কয়েকটা বই নিয়ে একঘেয়ে ছয়মাসের একটা জীবন শুরু করলাম এরপরই।
পরের সেশনে GRE পরীক্ষা দিলাম। মোটামুটি স্কোর করে একটা স্কলারশিপও জোগাড় করে ফেললাম।
মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে পরের বছর থেকে মাস্টার্সের ক্লাস ধরতে হবে। হাতে চার মাসের মত ছিল।
খুব সাধারণ ঘরের হয়েও অনেক উচ্চাভিলাষী ছিলাম সবসময় আমি।
তবুও বাবা-মার কথামত খুব সাধারণ একটা মেয়েকে বিয়ে করলাম আমি ঐ চার মাসের মধ্যেই।
আবার হতে পারে মেয়েটা সাধারণ ছিল না। নিজের সস্তা অহঙ্কারের জন্য এটা মনে হত। অনন্যাও একথা বলতো মাঝে মাঝে।
ওর নাম সেতু। মজা করে আমি ওকে ‘পদ্মা সেতু’ বলে ডাকি।
আসলেই সাধারণ মানুষদের জন্য ভালো লাগার অনুভূতি একপ্রকার বিলাসীতা। এই নির্মম সত্যিটা বুঝতে পারি আস্তে আস্তে।
অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কয়েকদিন আগে এক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারলাম অনন্যার বিয়ে হয়ে গেছে, বছরদুয়েক আগে যার সাথে বিয়ের কথা ছিল তার সাথেই। ভালো-খারাপ কিছুই লাগলো না, একটু অবাকও হলাম নিজের অসাড়তায়। এতটা অনুভূতিহীন হয়ে গেছি আমি? রেস্টুরেন্টে কিংবা রাস্তার চায়ের দোকানে, অথবা বৃষ্টি-ভেজা মাতাল দিনগুলোর মত অপূর্ব-সুন্দর মুহূর্ত তো সেতুর সাথে কাটাতে পারিনা কখনও। কই, তবুও তো নিজেকে সুখী ধরে নিয়েছি। নাকি সুখের অভিনয় করছি?
চলতে থাকে সময়।
বছর পার হয়ে যায় ভীনদেশের মাটিতে। ফেসবুকে হঠাৎ একটা মেসেজ আসে-
“আমাকে নাহোক, ছয়মাস পর এসে আমার বাবুটাকে সুন্দর একটা বই দিয়ে যাস… ও যখন পড়তে শিখবে, সেটা যেন ওর পড়া প্রথম বই হয়। I am pregnant”
অনন্যা!!
কথাগুলোর মধ্যে কি ছিল জানিনা, তবুও কেন যেন মনে হলো খুব কষ্ট নিয়ে লেখা কথাগুলো। নিজেকে কি কারণে যেন দায়ী মনে হল।
এত কাজের চাপের ভিতর দেশে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া সেতুও কনসিভ করেছে মাস দুয়েক হলো।
ভার্সিটি গেলাম পরের দিন। কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছি না। ল্যাব মিস দিলাম অকারণে।
ক্যাম্পাসে একটা বেঞ্চে বসে প্রায় আটটা পর্যন্ত কাটালাম। মনে কি যেন খচ খচ করছে। সান্ত্বনা দিলাম নিজেকে, ঠিক হয়ে যাবে দুই একদিনের মধ্যেই।
ঐ উইকেন্ডেই সেতুকে নিয়ে গেলাম মেলবোর্নের বিখ্যাত লুনা পার্কে। ও বেশ আনন্দ করল সারাদিন। খারাপ লাগলো না।
ফিরে আসার সময় প্রায় ঘুমিয়ে পড়ছিল সেতু। আমার হাত ধরে হঠাৎ মনে পড়েছে এমনভাবে বলল;
- আজকে আমরা একটাও ছবি তুলি নাই একসাথে। অন্য সবসময় কিন্তু তোমারই মনে হয়। কাজের বেশি চাপ পড়েছে নাকি আজকাল?
আমি ছোট্ট করে হাসলাম। কিছু বললাম না।
ভুলে যেতাম হয়তো অনন্যার মেসেজ। কিন্তু হঠাৎ মা জানালো বাবার শরীর খারাপের কথা। খুব সিরিয়াস কিছু না। তবে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে।
দেশে তখন সরকার শেষের সময়, চারিদিকে মারামারি, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও আগুন। ইন্টারনেটে দেশের খবর দেখলেই মন খারাপ হয়।
এর মধ্যেই চট করে সিদ্ধান্ত নিলাম- দেশে যাবো। অনলাইনে টিকিটও কেটে ফেললাম। সেতুকে সব বুঝিয়ে, ভার্সিটিতে কোনওভাবে ম্যানেজ করে এক সপ্তাহের জন্য রওনা দিলাম।
এক বছর আগে যখন প্লেনের জানালা দিয়ে ছোট হতে হতে মিলিয়ে যাওয়া বিতিকিচ্ছি দালানগুলো দেখেছি, তখনও মায়া লেগেছিলো। এক বছর পর যখন ছোট্ট বিন্দুগুলো বড় হয়ে হয়ে সেই বিতিকিচ্ছি দালানগুলোয় পরিণত হচ্ছে, অদ্ভুত একটা উত্তেজনা টের পেলাম।
আমার, আমার মা-বাবার, ভাইবোনের মাটি। স্কুলের মাটি, বন্ধুদের মাটি… আর, অনন্যার মাটি।।
সোজা ফার্মগেট চলে আসলাম আমাদের বাসায়। ঢাকার হিসাবে কমপক্ষে ৪৫ মিনিটের রাস্তা। সময় লাগলো মাত্র ১৫ মিনিট।
- বাহ, ভালোই তো।
ছোটভাই আমার কথায় হাসলো শুধু।
দ্রুত কেটে গেল তিন-চারদিন। পঞ্চম দিনে ফোন দিলাম অনন্যাকে, আমার পুরনো নাম্বার থেকে।
এই নাম্বারে ফোন করে এই প্রথমবার কোনও গালি শুনলাম না। আগের থেকে অনেক শান্ত একটা কণ্ঠ।
- কংগ্রেচুলেশন।
- তোকেও।
এইটুকু বলে তিরিশ সেকেন্ড চুপ দুইজনই। বিশ্রী রকমের একটা নীরবতা। ওপার থেকে শুধু ওর ভারী নিঃশ্বাস শুনছিলাম।
একটু ইতস্তত করে বললাম,
- বইটা নাহয় আমার হয়ে তুইই দিয়ে দিস তোর বাবুটাকে। থাকিস কোথায়? বাসায় এসে দিয়ে যাবো?
রীতিমতো আঁতকে উঠলো অনন্যা এই কথা শুনে।
- না না। দরকার নাই। আমি কোথায় আসবো বল্?
- তোর এই অবস্থায় বের হওয়ার দরকার নেই। আমি বরং কাউকে দিয়ে পাঠাই তাহলে।
- না আমি আসবো।
- অসম্ভব।
কয়েক সেকেন্ডের চুপ থাকলো ও; তারপর খুব আস্তে করে বললো-
- কয়েকটা নতুন বই পড়ছি। শুনবি না কাহিনী? চোখে চশমার বদলে লেন্সও লাগিয়েছি, দেখবি না একবারো আমাকে??
সত্যিই, আল্লাহ মেয়েদের কিছু কিছু ব্যাপারে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়ে পাঠান। আমি বই-হাতে রওনা দিলাম পরদিন সকালে শান্তিনগরের দিকে।
*************************************************
জাওয়াদের সামনে যে কঙ্কালসার যে ছেলেটা বসে এতক্ষণ গল্পটা বলছিলো সে ওর ছোটবেলার বন্ধু, রিশাদ।
- তারপর কি হলো?
- আস্তে কথা বল, বেকুব। অনন্যা শুনে ফেললে ঝামেলা করবে সারারাত। এক ফোঁটা ঘুমাতে দেয়না ও।
জাওয়াদ একটু অবাক হয়ে পাশে বসে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। চোখ ঢেকে মাথা নিচু করে বসে আছে মেয়েটা।
বিষণ্ন একটা ভঙ্গি।
তারপর কি হলো শোন্। এটা অবশ্য অনন্যাই বলেছিলো পরে। বাস তখন বোধ হয় মতিঝিল পার হচ্ছিলো। হঠাৎ করেই রাস্তায় বাস থামিয়ে ইট পাথর ছুঁড়ে মারতে থাকে কারা। সবাই মুহূর্তেই ছোটাছুটি করে নেমে যেতে থাকে বাস থেকে। কেউবা জানালা দিয়ে নামার চেষ্টা করে।
কিন্তু ততক্ষণে বাসের সামনের দিকে আগুন ধরে গিয়েছে ভালোমত। দরজার দিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।
ভয়ে জ্ঞান হারাতে থাকে অনন্যা, তবুও কে যেন ওর ভিতর থেকে বলে, যেভাবেই হোক বাঁচতে হবে। অন্তত শরীরের মাঝে বাড়তে থাকা শিশুটির জন্য হলেও। একজনের ভেতর যখন আরেকজন জন্ম নেয়, তখন কিভাবে যেন তার দায়িত্ব বেড়ে যায় অনেকগুণ।
দাঁতে দাঁত চেপে পাশের জানালা খুলে বের হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে অনন্যা। হাতে-পায়ে অনেক জায়গায় ফোস্কা পড়ে গেছে ততক্ষণে। কোনওভাবে এর মধ্যে শরীরটা বের করে ও।
তারপর… তারপর… মাথার একটু সামনে প্রচণ্ড একটা শব্দে দুনিয়াটা দুলে উঠে। অন্ধকার হয়ে যায় ওর সবকিছু।।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে যখন ওকে পেলাম ওর সারা মুখে ব্যান্ডেজ।
আগুনে শরীরের ৫০ ভাগ ঝলসে যায় অনন্যার। ককটেলের বিস্ফোরণে দুই চোখের কর্নিয়া, রেটিনা নষ্ট হয়ে যায়।
আর পেটের নির্দোষ বাচ্চাটাও বেঁচে যায় পৃথিবীতে আসার যন্ত্রণা থেকে।
আর আমি কতবড় কাপুরুষ জানিস? আমি থাকতেই পারলাম না ওখানে বেশিক্ষণ। কারণ যতক্ষণ জ্ঞান ছিলো ও বারবার একটা কথাই ঘুরেফিরে বলছিল;
তোর পায়ে পড়ি, রিশাদ; আমাকে মেরে ফেল্। আমার পেটে সেলাই এখনও নতুন, একটা চামচ দিয়ে গুতাগুতি করলেই ছুটে যাওয়ার কথা। খোদার কসম আমি কাউকে বলবো না।
বই পড়ার সাথে কিভাবে মানুষের চোখের ভাষা পড়তে হয় সেই বিদ্যা এই মেয়েটার বড় বড় চোখেই প্রথম শিখেছিলাম। চশমার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে যে চোখের ভাষা পড়ায় অভ্যস্ত ছিলাম, চশমা ছাড়া সেই ভাষার শব্দগুলো কেমন লাগে সেটা নাহয় একবারের জন্য হলেও দেখতাম।
হাতিরঝিল থেকে দুই বছর আগে ওভাবে চলে না এসে ওকে জড়িয়ে ধরে যদি বলতাম, সামান্য একটা আংটিই তো। সারাজীবন আমাকে কিল-ঘুষি দিলেও আমার সাথেই থাক্…
কে জানে, হয়তো এরকম হতো না তাহলে...
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে অনন্যা সোজা ওর বাবার বাড়ি চলে আসে।
চোখে কালো চশমা আর এখানে-ওখানে পুড়ে সাদা হয়ে যাওয়া ভয়ঙ্কর একটা মুখ। প্রথমদিকে ওর স্বামী আসতো মাঝে মাঝে দেখতে, পরে শুনেছি সে বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছে। পোড়া-অন্ধ মেয়েকে কে আবার ঘরে তুলবে?
জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসে আমারো। অস্ট্রেলিয়া ফেরা হয়না আর। দেশে গণ্ডগোলের মধ্যেই পল্টন, কাকরাইল, ফার্মগেটে হাঁটাহাঁটি করি উদভ্রান্তের মত। এর মাঝে সেতু বাংলাদেশে ফিরে আসে, আমাদের একটা ছেলে হয়। ততদিনে আমার মাস্টার্স কোর্স উইথড্র করে ফেলেছে ইউনিভার্সিটি।
ঘর থেকে বের হতো না অনন্যা আর। আমি মাঝে মাঝে যেতাম। ওর সামনে চুপ করে বসে থাকতাম, চলে আসতাম। কতদিন ধৈর্য রাখা যায় আর? তারপর একদিন গিয়ে হঠাৎ বললাম কালো-চশমা খুলে বসতে আমার সামনে। ও তাই করল কোনও প্রশ্ন না করে, কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছিলো মেয়েটা।
তারপর, ওর বড় কিন্তু শূন্য চোখের দিকে তাকিয়ে ওর গলায় দুইহাত দিয়ে চেপে ধরলাম। শরীরে যা শক্তি ছিল সব এক করলাম। জানিস, ও একটুও শব্দ করে নি। আমার হাত দুটো ধরে ছিলো শরীর শিথিল হয়ে আসা পর্যন্ত। আর আমি বন্ধ হয়ে আসা পর্যন্ত তাকিয়ে ছিলাম ওর পলকহীন চোখে।
তারপর ওর শরীরটা যখন ঠাণ্ডা হয়ে যায় একদম, তখন চলে আসি আমি ওখান থেকে।
শ্রীকান্তের রাজলক্ষ্মী আর দেবদাসের পার্বতীর তুলনা করে ঝগড়া না বাধিয়ে, লাফালাফি-গালিগালাজ না করে অনন্যার মত একটা মেয়ে মূর্তির মত চুপ করে বসে থাকতো, এটাই সহ্য হচ্ছিল না। বন্ধু হিসাবে কিংবা একসময়ের তীব্র একটা ভালোলাগার জন্যই কাজটা করি বোধ হয়।
কিন্তু ও আমাকে আর ছাড়লো না রে।
সারাদিন কথা বলে, ঘরের ভেতর, মাথার ভেতর, সবখানে, সবসময়। আমি খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না। মাঝে মাঝে একটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে আসে, দুইজন মিলে হাউমাউ করে কাঁদে। খুব কষ্ট হয় রে, বন্ধু। খুব কষ্ট হয়।
*************************************************
- ডাক্তার কি বলেছে, ভাবী?
- আগের থেকে ভালো। একসময় তো কাউকে চিনতেও পারত না। নিজের ছেলেকেও না। থানা-পুলিশ বাঁচিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ডাক্তার এনে অনেক কষ্ট করে এই পর্যন্ত আনতে পেরেছি ওকে। কিন্তু পুরোপুরি ঠিক হয় নাই, এখনও ওর মনে হয় অনন্যা আশেপাশেই আছে।
- হুম, আরেকটু সুস্থ হোক, তারপর বরং দেশের বাইরে চলে যান আবার, এতগুলো বছর কষ্ট করলেন।
- কিন্তু এখন কি সমস্যা? সব তো ঠিক হয়ে গেছে এখন। সুন্দর একটা নির্বাচন হল কয়দিন আগে, আইন করে হরতাল-অবরোধও উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কোনও ভাঙচুর হয় না, আগুন জ্বলে না। আর আমাদের ছেলেটাও বড় হচ্ছে, দেশকে চিনতে হবে না ওর?
- কিন্তু এতগুলো কতগুলো বছর হারিয়ে গেল আপনাদের। তা তো আর ফিরে পাবেন না। আর এত ভয়াবহ এত স্মৃতি নিয়েও থাকবেন এখানেই?
দীর্ঘশ্বাস বুকে গোপন রেখে ভালোবাসতে পারেনা সবাই। কয়েকবছর আগে বিয়ে করা ‘সাধারণ’ সেই মেয়েটা পেরেছিল। অসহায় একটা সময়ে, অসহায় একটা স্বামীকে আগলে ধরেছিল। বিশ্বাস করত, ঢাকার রাস্তায় আবার প্রতিদিন যানজট হবে, রাস্তাঘাটে আতশবাজীর বিকট শব্দকে মানুষ ককটেল ভেবে ভুল করবে, তারপর এই নিয়ে মজা করবে নিজেরা নিজেরাই।
খাঁটি বিশ্বাসের অনেক ক্ষমতা। সেতু পেরেছিলো তা কাজে লাগাতে।
- ভাইরে, দেশের উপর রাগ করেই তো ছিলাম অনেকদিন। দেশ নিশ্চয়ই এবার তা শোধ করে দেবে। অভিমান করে যে ভালোবাসা পাওয়া যায় তার চেয়ে তীব্র কি আর কিছু হতে পারে?
অনন্যাও তাই চেয়েছিল সারাজীবন। কিন্তু খোদা তো সবাইকে আর খালি হাতে ফিরায় না।।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:৫৪