অদৃশ্য একটা কণ্ঠ অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে আমাকে, অনেক অনেক কিছু জানতে চায়। আবার অনেক অনেক গল্পও করে। আমি একের পর এক উত্তর দিয়ে যাই। আর বাকিটা সময় কখনও পাতা উলটানো, নাহয় কলমের খসখস শুনি। এভাবেই আমার দিন কাটে...
আমার বয়স পনের বছর দুই মাস তের দিন। গত দুইমাস ধরে আধা-পাগল এই মানুষটার সাথে আছি। সে আমার দূর-সম্পর্কের ভাই হয়, আমাকে গ্রাম থেকে ঢাকায় তার কাছে নিয়ে এসেছে।
সে আবার লেখক মানুষ। বিরাট একটা উপন্যাস লিখতে বসেছে। আর এই উপন্যাসের নায়িকা নাকি আমার মত, তাই আর কি লেখক-সাহেব মডেল হিসেবে আমাকে ধার করে এনেছে!!
নায়িকার নাম মৃন্ময়ী। সেও চোখে দেখে না জন্ম থেকে-
আমার মতো।।
যে কখনো চোখে দেখার ব্যাপারটা টের পায় নি তার মধ্যে নাকি আলাদা কিছু অনুভূতি কাজ করে।
-যখন স্বপ্ন দেখো, তখন কি হয় আসলে তোমার? কি দেখো?
-অনুভূতিরও কিন্তু রঙ থাকে, রঙ যদি না দেখো, তাহলে আলাদা করতে পার কিভাবে??
-আচ্ছা, যখন অনেক মন খারাপ হয়, তখন মাথার ভেতরে কেমন মনে হয়, বলতো?
এসব আরো কত রকমের প্রশ্নের উত্তর সারাদিন দিতে হয় আমার। উত্তর শুনে কিসব চিন্তা করে, তারপর আবার লেখে মানুষটা। তবে মাঝে মাঝে তার কি যেন হয়, একের পর এক পাতা ছেঁড়ার শব্দ পাই আমি, মনে মনে খুশি হই তখন। পাতা ছেঁড়া মানে নিশ্চয়ই উপন্যাস এগোচ্ছে না ঠিকমত, তার মানেই এখন আমার সাথে গল্প করবে।
কত আজব রকমের গল্প সে শোনায় তার শেষ নেই।
গ্রামে সবসময় আমাকে আটকে রাখতো। আমাকে ঘরের বাইরে যেতে দিত না কেউ। জিজ্ঞেস করলে শুধু বলত, আমি নাকি দেখতে ভালো। পরে আর কিছু বলত না।
পৃথিবীটা যে আসলে কত সুন্দর আমাকে সে-ই জানায়।
যে জন্ম থেকে কিছুই দেখে নি, তাকে মনে হয় দেখার ব্যাপারটা বোঝানো বেশ কঠিন।
যেমন, একবার আমি জিজ্ঞেস করলাম, আকাশ দেখতে কেমন। সে বললো, অনেক বড় আর নীল। নীল কেমন তা তো আর জানিনা। একটু লজ্জা লাগছিল, কিন্তু পরে সেটাও জিজ্ঞেস করলাম। সে আর উত্তর দেয়নি। মায়া লাগছিলো তার জন্য। উত্তর না দিতে পারলে অনেক কষ্ট হতো তার।
সবই তো আমার কাছে নতুন। তাই একটু অন্যভাবে হলেও সে রঙগুলো কিছুটা বুঝাতে পারছে এখন। সবকিছু নিয়ে আমার যেই জগৎ সেটাও নাকি একটা রঙ, তার নাম- কালো।
আবার মন অনেক খারাপ হলে যেমন মনে হয় সেটার নাম নাকি নীল। কিংবা খোলা বাতাসে দাঁড়ালে যখন মন ভালো হয়ে যায় সেটা নাকি সবুজ রঙের মত। পৃথিবীর সব গাছপালাই তাই এই রঙের।
আমি তাকে আরেকটা রঙ জিজ্ঞেস করি প্রায়ই। ঐ যে, যখন অনেক ভালো লাগে, কিন্তু একই সাথে কষ্টের একটা অনুভূতি হয়, কেমন করে যেন বুক কাঁপে তখন।
সে কোনও উত্তর দেয়না আমার এই প্রশ্নের। অদ্ভুতভাবে তাকায়। কেউ আমার দিকে তাকালে আমি বুঝতে পারি।
লেখা যখন শেষের দিকে, তখন থেকেই সে বলতো, উপন্যাসের শেষটা নাকি খুব সুন্দর।
আর... শেষ হলে পুরোটা সে আমাকে পড়ে শোনাবে।
ও আচ্ছা, বলা হয়নি। আমি কিন্তু চাইলে নিজেও পড়তে পারবো কয়দিন পর। ব্রেইল শিখছি। চোখে না দেখতে পারলেও হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছয়টা ফোটা খুঁজে বের করেই পড়া যায়। শহরের মানুষের আসলেই কি সুন্দর বুদ্ধি।
সেদিন বৃষ্টি ছিলো। সে বলে, শহরের সবকিছুই রুটিন করা, শুধু বৃষ্টি ছাড়া। খুব ইচ্ছা করতো ভিজতে, তাই বের হয়ে পড়লাম।
চাইলেই তো আর একা একা রাস্তায় আমার হাঁটা সম্ভব না, তাই তার হাত ধরেই বের হলাম ভিজতে।
আমি কখনও এভাবে ভিজি নাই। গ্রামে যখন ছিলাম, বৃষ্টি পড়লে কেউ একজন আমাকে জানালার পাশে দাঁড় করিয়ে দিতো। হাত দিয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখতাম। এটুকুই শুধু।
এত সুন্দর কেন সবকিছু?? পাশ থেকে জাদুকরী কণ্ঠটাও সেদিন বেশি ভালো লাগছিলো।
- বলেছিলাম না তোমাকে একদিন, সবুজ হলো মন ভালো হয়ে যাওয়া, আজকের সবুজ আরো স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধতা কি জানো তো? চোখ বড় বড় করে তুমি যখন আমার গল্প শোনো সেটাই স্নিগ্ধতা। আমার উপন্যাসের নায়িকা মৃন্ময়ী যখন তার ভেজা চুল খুলে অন্য স্বাভাবিক মেয়েদের মত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অযথা আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে সেটাই স্নিগ্ধতা।
- কদম ফুলের নাম শুনেছো? বর্ষার এই ফুলটা কোনও কাজে দেয়না। কিন্তু তাও কিছু মানুষ সারা বছর ধরে এর জন্য অপেক্ষা করে, কেন জানো? কারণ বর্ষার প্রথম কদম ফুল কোনও প্রেমিক তার প্রেমিকাকে উপহার দিলে তাদের সম্পর্ক কখনও ভাঙে না।
কদম দেখতে কিরকম আমি এখনও জানিনা। কিন্তু জানেন, সেই মুহূর্তে একটা কদম ফুলের জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারতাম।
ঝুম বৃষ্টি পড়ায় একটা সুবিধা হয়েছে, সে আমার চোখের পানির সাথে বৃষ্টির পানি আলাদা করতে পারছে না। কিন্তু লেখকরা তো শুনেছি অনেককিছুই পারে, যদি ধরে ফেলে আমি কাঁদছি??
ইশ, কি লজ্জার একটা ব্যাপার হবে।।
পরিচিত অদৃশ্য কণ্ঠ তখনও বলে চলছে;
- আমাদের সামনে দিয়ে রিকশায় করে যে দুজন ঝগড়া করতে করতে যাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছো?? এরা কিন্তু আসলে খুব আনন্দ করছে। আমি সিওর একটু পর এরা দুইজনই হাত ধরে বৃষ্টির গান করতে করতে যাবে। একটা রিকশা নিয়ে যাবে নাকি এদের পেছন পেছন??
একটা পরিচিত গন্ধ পেলাম হঠাৎ। গ্রামে আমাদের ঘরের পাশ দিয়ে যখন পাড়ার ছেলেরা চলত, তখন সিগারেটের এই গন্ধটা পাওয়া যেত।
অস্বস্তি লাগছে, কেউ বা কারা যেন দেখছে, যারা চোখে দেখে না তাদের এই চেতনাটা প্রবল থাকে।
কিন্তু সে যখন তাকায় এমন মনে হয় না তো। তাহলে?
একজন না, কয়েকজন হবে ওরা। আমি হাত ধরে ছিলাম তার, প্রথমে অনেকক্ষণ টানা-হেচড়া করে আমাকে দুই পাশ থেকে দুজন ধরে আলাদা করে ফেললো। পাগল-এর মত চিৎকার করছিলাম শুধু, কিন্তু কেউ ছাড়লো না আমাকে। সে তো বলতো বাইরের রঙিন পৃথিবী অনেক সুন্দর, এমন করলো কেন তাহলে ঐ লোকগুলো?
খুব জোরে আরেকটা চিৎকার শুনলাম খুব কাছ থেকে। অনেকদিন ধরে মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করা, ভালোলাগা, প্রতিদিন আমার ছোট্ট পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের কণ্ঠ ছিল ওটা। শেষবারের মত আমার নাম ধরে চিৎকার করেছিল সে।
টানা-হেঁচড়া চললো কিছুক্ষণ। বৃষ্টির মধ্যে ছেঁড়া জামা-কাপড়ের জন্য শীতেও কাঁপছিলাম। তারপর জোরে ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফেলে দিল কোথায়। তারপর......
ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। পিষে ফেলছিলো আমার শরীরটাকে। জানিনা কি হচ্ছিলো আমাকে নিয়ে, কিন্তু এত কষ্ট ছিল এই আমার জন্য? আচ্ছা, এই অনুভূতির রঙ কি?
নাকি আমার-লেখক আমাকে এতদিন মিথ্যা বলত পৃথিবী নিয়ে?
ঠিক তখনই এক মুহূর্তের জন্য আমার পনেরো বছরের জীবনে সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো।
খুব আস্তে করে ঝাপসা চোখের সামনে কিছু অন্যরকম লাগল। সারা শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণার মধ্যেও অনেক রঙ এর পার্থক্য বুঝতে পারলাম ঐ কয়েকটা মুহূর্তে।
বুঝতে পারলাম, জীবনে প্রথমবারের মত দেখতে পেরেছি আমি। পৃথিবী দেখলাম, নিজেকে দেখতে পারিনি, তবে নিজের উপর লেপ্টে থাকা শরীরগুলো দেখলাম।
সুন্দর পৃথিবীতে আমার প্রথম এবং শেষ দৃশ্য।। এরপর আমি মারা গেলাম।
*********************************
ডাক্তারের চেম্বারে এটুকু বলেই মেয়েটা জ্ঞান হারালো।
তিনদিন ধরে মেয়েটাকে কিছু খাওয়ানো যায়নি। এই মুহূর্তে স্যালাইন পুশ করার নির্দেশ দিলেন ডাক্তার।
- Cotard delusion, কিংবা corpse walking syndrome.
- সরি?
- নিউরোসায়েন্সে বিরল ধরণের একটা অসুস্থতা। রোগী নিজেকে মৃত মনে করে, আশেপাশের কোনকিছুতেই সাড়া দেয় না। নিজেকে মৃত ভেবে কোনও রকম খাবার খায় না। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না খেয়ে মারা যায়।
- আর দেখার ব্যাপারটা? ও তো বললো জন্ম থেকেই অন্ধ।
একটু নড়েচড়ে বসলেন ডাক্তার।
- আমার ধারণা মেয়েটা সত্যিই দেখতে পেয়েছিলো। একটা জার্নালে পড়েছিলাম ব্যাপারটা, এটা নিয়ে এখনও গবেষণা হচ্ছে। মৃত্যুর একদম কাছে গিয়ে ফিরে আসে এবং জন্ম থেকেই অন্ধ, এমন অনেকেই দাবি করেছে তারা ঐ মুহূর্তে দেখতে পায়।
আবার অনেক গবেষণা বলে, সেই মুহূর্তে কিছু হরমোন তৈরি হয়, যা পরিবেশের সাথে মিল রেখে এক ধরণের ছবি পাঠায় ব্রেইনে।
তবে যেটাই হোক, বেচারিকে পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত দৃশ্যটাই দেখতে হয়েছে। ব্যাপারটা ও সহ্য করতে পারেনি।
দুইদিন আগে ফার্স্ট প্রফের রেজাল্ট দিয়েছে রাহাতের। এনাটমিতে পাস নাম্বার আসে নাই। মন খারাপ করে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে কালশীর ভেতরের দিকটায় চলে গিয়েছিল সে। সেখানেই অচেতন রক্তাক্ত অবস্থায় মেয়েটাকে পায়। হসপিটালে একদিন পর জ্ঞান ফিরে, তারপর এলোমেলো কথা শুরু করে মেয়েটা। সেখান থেকেই ওকে সোজা এই নিউরো-স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে আসে রাহাত।।
পাশের রুমের বেডে মেয়েটাকে স্যালাইন দেয়া হয়েছে।
- মেয়েটা কি সারভাইভ করবে?
- হ্যাঁ, তবে যে অবস্থা, জীবনে স্বাভাবিক হতে পারবে বলে মনে হয়না। তবুও দেখেন কি হয়।
নাম না জানা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে রাহাত।
টুকটাক গল্প-উপন্যাস লেখা একজন বোধ হয় এভাবেই তাকিয়ে থাকত কয়দিন আগেও।
এই গল্পে, কিছু চোখ অসহায় হয়ে কেবল তাকিয়ে দেখে, কিছু চোখ হারিয়ে যায় কোথায় যেন...
আর কিছু অন্ধকার চোখ, আরো অন্ধকার হয়ে একসময় হারিয়ে যায়, অসমাপ্ত মৃন্ময়ীর গল্পের মত।।