স্যামন মাছের জাম্বো টুকরোটা তোফা রেঁধেছিল। আস্ত হরিন গিলে ফেলা কুমিরের মত হেলে দুলে ফিরে আসছি। হোটেলে গিয়ে গড়িয়ে পড়তে পারলে বাঁচি। তারা ঝিকমিক আকাশ, নিশি রাত, বাঁকা চাঁদ-কোন কিছুই আর মোহ কাড়তে পারছে না। যতটা না ডাকছে পাখির পালকে ঠাসা ফুলো ফুলো সফেদ বালিশ।
দ্বিতীয় দিন। সক্কাল সক্কাল তৈরি হয়ে নিয়ে কংগ্রেস হলের দিকটায় রওনা দিয়েছি। মাঝপথে বন্দুকের দোকানটা দেখে গতকালের গাইড হান্সের কথা মনে পড়লো। সে বলেছিল, ‘একদম গ্রীষ্মের শুরুতে এসো। রাইফেল চালানো শিখিয়ে দেবো। তারপর শিকারে চলে যাবো ঐ ঘন বনের দিকটায়’।
পাহাড়ের সেই ঝোপঝাড়ের দিকে চোখ চলে গেল। উঁচু উঁচু গাছ দিয়ে ঘেরা জায়গাটায় এই ঝলমলে সকালেও জমাট বাঁধা অন্ধকার। সেখানে হরিন, খরগোশ ইত্যাদির সাথে দু’চারটা স্কন্ধ কাটা ভূত আর ফোকলা দেঁতো ডাইনি বুড়ি থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। দেখা গেল, রাইফেলের মালিককেই উল্টো শিকার করে ধরে নিয়ে গেছে। তারপর বড় একটা ডেকচিতে চড়িয়ে মাথার ওপর মশলাপাতি ছিটিয়ে মেজবানি রান্নার জোগাড় করছে। খরগোশ কাঁধে নিয়ে ফেরার বদলে নিজেই হজম হয়ে গেলাম ভূত-পেত্নির পেটে। কি মারাত্মক!
কংগ্রেস হলে ঢুকতেই মনিকা হাত নাড়িয়ে ডাকলো। টিং টিংও আছে দেখছি। ধোঁয়া ওঠা এক কাপ কফি হাতে ওদের পাশে বসে পড়লাম। কড়া ডোজের ক্যাফেইন ছাড়া সেমিনার-কনফারেন্সে টিকে থাকা মুশকিল। প্রতিটা সায়েন্টিফিক প্রেজেন্টেশন নইলে ঘুম পাড়ানি গানের মত ঠেকে। গবেষনা যত উঁচু দরের, ঘুম তত গাঢ় হয়। সহজ সমানুপাতিক অংক।
আর তাই চরম তেতো কফির চুমুকেও চোখ ঢুলুঢুলু। আধবোজা চোখেই চারপাশটা দেখছি। একদম সামনের সারির ক’জন বাদে কেউ ল্যাপটপ টিপছে নির্বিবাদে, কেউ পাশের জনের সাথে চরম আলাপ জুড়েছে নতুন কোনো কোলাবরেশন নিয়ে। আর এরই মাঝে সবার অবজ্ঞা, অবহেলা মেনে কোনো এক বেচারা কত না রাত জেগে খেটেখুটে তৈরি করা স্লাইড দেখিয়ে যাচ্ছে হলের বড় প্রজেক্টরের পর্দায়। এই না হলে বিজ্ঞানী জীবন।
ঘন্টা তিনেক প্রচুর পরিমানে গবেষনা কাজ দেখে দেখে হাঁপ ধরে গেল। উশখুস করছি, এমন সময়ে বহু কাঙ্ক্ষিত বিরতি মিললো। দুদ্দাড় করে বেরিয়ে এলাম টিং টিং আর মনিকার সাথে। আকাশে পালক ওড়ানো মেঘ, নরম রোদ্দুর আর পাতা ঝরানো ঝিরঝির বাতাসে প্রানটা আবার ভিজিয়ে নিলাম যেন।
‘ও দিকটায় যাবে?’, মনিকা শুধালো। ওদিকটা যে কোন দিকটা, না ভেবেই তার পিছু নিলাম। দম আটকানো কংগ্রেস হলটা থেকে খানিকের তরে পালাতে পারলে হয়।
এলোমেলো হেঁটে বড় একটা কাঠের ঘর নজরে এল। কৌতূহলী হয়ে এগোলাম। তাকগুলোতে মোমবাতিরা জ্বলছে আর নিভছে। ঘরের মাঝে ছোট্ট ফোয়ারা জলের কলতানে সরব। শান্ত-সমাহিত পরিবেশ। দেয়ালে নানা রকম আঁকিবুঁকি। ক্রুশ, চাঁদ-তারা, ওম আরো কত কি চিহ্ন। বুঝে নিলাম, আসলে এটা প্রার্থনা ঘর। যে ধর্মেরই হই না কেন, সবার এ ঘরে সমান দাবি। ইচ্ছেমতো হানা দিয়ে নিরিবিলিতে বসে ধ্যান মগ্ন হতে বাধা নেই কোনো। ভাবলাম, শহরের ব্যস্ত পথের ধারে এমন এক আধটা ঘর বসিয়ে দিলে কেমন হতো। অবিরাম ছুটে চলা থেকে দু’দন্ড বিরতি নিলে লাভ ছাড়া ক্ষতি তো কিছু নেই।
পায়ে পায়ে ফেরার পথ ধরলাম। মাঝপথে অবশ্য সবুজ রঙের এক ড্রাগনের সাথে দেখা হয়ে গেল। কে বা কারা তাকে এই বিরান পাহাড়ি ঢালে পাহাড়ায় মোতায়েন করে গেছে। আর সেও ডানা গুটিয়ে ধাতব শরীর নিয়ে চৌকিদার সেজে দাঁড়িয়ে।
‘সারাক্ষন কি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা যায়? সন্ধ্যা ঘনালে একটু বনের দিকটায় উড়ে আসি আর কি। নইলে পাখায় জং ধরে যেত কবেই’। এক চুল না নড়ে ড্রাগনটা খুব স্বাভাবিক স্বরে আউড়ে গেল। হকচকিয়ে গেলেও উত্তরে ভদ্রতা করে কিছু একটা বলতে হয়। মাথা নেড়ে সায় দিলাম, ‘তাই তো, তাই তো। একটানা কোনো কিছুই কি আর ভাল লাগে? চৌকিদারি বলো আর কনফারেন্সই বলো’।
‘এ্যাই সাবরিনা, আর কত সেলফি তুলবে? আমরা কিন্তু চললাম’। এগিয়ে যাওয়া ওদের কাছ থেকে তাড়া আসলো। তারা ড্রাগনের গলা জড়িয়ে ছবি খিঁচে গিয়েছে একটু আগে।
‘আসছি, আসছি...’। সদ্য শুরু হওয়া আলাপে যতি টেনে ফিরে চললাম, কি আর করা।
আজকে তিন নম্বর দিন। এ কয়দিনের বিজ্ঞান যজ্ঞ আজকে দুপুর গড়ালেই ফুরোবে। সকাল থেকেই আল্পবাখ কংগ্রেস হলে একের পর এক দুর্দান্ত গবেষনা কাজ মেলা ধরা হচ্ছে। তথ্য-উপাত্তের বেশুমার ছড়াছড়ি। ঘাড় শক্ত করে বড় বড় চোখে পাই চার্ট, বার গ্রাফ আর স্ট্যাটিসটিক্সের ‘সিগনিফিকেন্ট’ এক, দুই, তিন তারা দেখছি। তারাগুলো এক সময়ে গ্রাফ ফুড়ে বেরিয়ে এসে মাথার চারপাশে সর্ষেফুল হয়ে ঘুরতে লাগলো।
তবে আসল সর্ষেফুল দেখলো অনেকেই। দুর্দান্ত সব প্রেজেন্টেশন শেষে তাদের নানা প্রশ্নবানে ধরাশায়ী করে দেয়া হল। কারো গবেষনার লক্ষ্য নাকি অলক্ষ্যের দিকে মোড় নিয়েছে, কারো বা হাইপোথিসিসটাই নাকি ঠিক নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। মোট কথা, ধসিয়ে দেয়া হল তাদেরকে। হতাশ, আমচু মুখে বসে পড়লো একেকজন। এই পেশাটাই যে এমন। হতাশা নিত্যসঙ্গী। তবুও আশা ছাড়বে না এই লোকগুলো। আগামীকাল ঠিকই ল্যাবকোট চাপিয়ে নতুন উদ্যমে কাজে লেগে যাবে। এই পাগল, ক্ষ্যাপাটে বিজ্ঞানী বাহিনী আছে বলেই রোগ-শোককে এক হাত দেখে নেয়া যায়।
টানা পুরো সকালটা রোলারকোস্টার চলেছে সবার উপর দিয়ে। আমরাও কড়া-মিঠে কথা শুনেছি। প্যাঁচা মুখে তাই বসে আছি হাত-পা ছড়িয়ে। পেটচুক্তি লাঞ্চের পর অবশ্য দুঃখবোধটা সামান্য কমলো।
বাস এসে গেছে। সবার ভেতর হালকা তোড়জোড় দেখা গেল। বাড়ি যেতে পারলে বাঁচে সবাই। হাতে এখনো কিছুটা সময় আছে। বাসটাকে ডানে রেখে বামের পথে এগোলাম। ল্যাভেন্ডার ফুলের ঝোপ ওদিকটায়। ফুলের মাতাল ঘ্রানটাই যেন ভুলিয়ে টেনে নিয়ে গেল। দলছুট হতে দু’বার ভাবলাম না।
ল্যাভেন্ডারের বেগুনী রঙ ছাপিয়ে লাল-গোলাপি-হলুদ আরো হরেক ফুলের দেখা মিললো। ফুলের ভারে নুয়ে পড়া গাছগুলোর গায়ে তামার ফলক ঝুলছে। কাছে গিয়ে পড়তেই চমক লাগলো। নামের নিচে জন্ম-মৃত্যুর তারিখ লেখা। জয়গাটা কি তাহলে কবরস্থান? অথচ দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না। নাকি প্রতিটা মৃত মানুষের নামে একটা করে গাছ লাগানো হয়েছে? মৃত্যুর বিনিময়ে আবার নতুন প্রান। বিয়োগের বনামে যোগ। নিয়মটা বেশ লাগলো।
কব্জির ঘড়িতে কাটাগুলো অতি ধীরে ঘুরছে। এই সুযোগে আরো দু’পা বাড়ালাম। আর তখনি সে উঁকি দিল আড়াল থেকে। হাত বাড়িয়ে মোহনীয় ভঙ্গিতে ডাকছে। মন্ত্রমুগ্ধর মত এগিয়ে গেলাম। নিঁখুত, চমৎকার হাতে গড়া কাঠের ভাস্কর্য। কিন্তু পরের মূর্তিটা দেখেই পিলে চমকে গেল। যেন ক্রোধে উন্মাদ হয়ে উদ্বাহু। এই বুঝি গলা টিপে ধরলো। কোন ভূতের আড্ডায় চলে এলাম রে বাবা। কিন্তু ভয়ের চাইতে কৌতূহলের পাল্লা ভারী। তাই এগোতেই থাকলাম। পরের মূর্তি দেখে আতঙ্কে জমে নিজেই ভূত। লকলকে লাল জিভ বেরিয়ে এসেছে বিরাট হাঁ থেকে। যেন কোটর থেকে বেরোনো হিসহিসে সাপ। কলিজা ঠান্ডা মেরে গেল। ভাস্কর্যগুলো এতটা জীবন্ত করে না গড়লেও তো পারতো। সামনে আরো কয়েকজন। তাদেরকে এগিয়ে গিয়ে দেখে আসতে আর সাহসে কুলালো না।
তবে হঠাৎ করেই বুঝে গেলাম ব্যাপারটা। এরা আসলে মানুষের ষড়রিপু। যে তিনজনকে দেখেছি, তাদের পরিচয় মোহ, ক্রোধ আর লোভ। আর বাকি তিন রিপু, ঐযে অদূরে দাঁড়িয়ে। মোট ছয়টা মূর্তি সার বেঁধে স্থির দাঁড়িয়ে। অথচ মানবজীবনে এরা একেকজন কত বড় অস্থিরতার কারন।
অদ্ভূত পরিবেশটা থেকে পালাতে ঘড়ির দিকে চাইলাম। এবার কাটাগুলো চিৎকার করে বললো, ‘বাস ছাড়েঙ্গা ইয়েহি ওয়াক্ত। তুরান্ত চালো, মালকিন’। মেড-ইন-জার্মানি হাতঘড়িটার এহেন হিন্দি কি উর্দু তুবড়িতে অবাক আমি ঝেড়ে ছুট লাগালাম।
‘কই ছিলে এতক্ষন?’। মনিকা আর টিং টিংয়ের জিজ্ঞাসার উত্তরে বোকাটে হাসি ছুড়ে বাসে চেপে বসলাম।
সশব্দে বাস ছাড়লো। পাতার ফাঁকে রোদের ঝিকিমিকি জানালার কাঁচে হানা দিয়ে আবদার জানিয়ে গেল, ‘আবার এসো আমাদের আল্পবাখে’। (সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০২২ ভোর ৫:০৫