এক।
ছোটবেলা থেকেই আমাদের পরিবার ও সমাজ আমাদের চিন্তাশক্তির একটা সীমারেখা টেনে দেয়। "বেশি পন্ডিতি করতে যেও না/এসব তোমার ভাবার বিষয় নয়/যা বলছি সেটাই করো/এটা এই পর্যন্তই ভাবো" এই ধরনের কথার সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। আমরা আমাদের চিন্তাশক্তির এই নির্দিষ্ট সীমাকে কখনো অতিক্রম করতে চাই না, কিন্তু কেউ যদি তার অদৃশ্য বলয় ভেঙে মুক্তমনা হতে চায় তবে দোষের তো কিছু নেই। মুক্তচিন্তা আসলে কি? প্রচলিত রীতিনীতি ও বিশ্বাসকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও যুক্তির আলোকে তার সত্যতা যাচাই করে মতামত গঠন করা। আমাদের প্রত্যেকেরই মুক্তচিন্তার ও মতপ্রকাশের অধিকার আছে। হতে পারে একজনের মতের সাথে অন্যজনের মতের পার্থক্য, কারো মতের সাথে কেউ পুরোপুরি সহমত পোষণ করতে পারে, কেউ নির্দিষ্ট বিষয়ে সহমত পোষণ করে আবার কেউ সম্পূর্ণ বিপরীত মতেরও হতে পারে। এমনতো কথা নেই যে আমি যা বিশ্বাস করি আপনাকেও সেটাই বিশ্বাস করতে হবে। সবার মত যদি একই রকম হতো তবে আমরা মানুষ হতে পারতাম না, মানুষ বলেই মতের মিল অমিল আছে এবং সেটা থাকবেই। কেউ যদি মনে করে যে প্রচলিত রীতিনীতি বা বিশ্বাস কোন কারন ছাড়াই অন্ধবিশ্বাস কেন করবো, এসবের কোন যুক্তি নেই আমি অন্য ভাবে চিন্তা করবো। সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মন্টু সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী , ঝন্টু নাস্তিক, পন্টু ধর্মনিরপেক্ষ। এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, এখানে কারো সমস্যা হবার কথা না। সমস্যা তখনই হবে মন্টু যদি ঝন্টু ও পন্টুকে জোর করে ধার্মিক বানাতে যায় কিংবা ঝন্টু ও পন্টু যদি মন্টুকে জোর করে নাস্তিক বানাতে চায়। নাস্তিকদের দুইটা শাখা আছে, মূল নাস্তিকরা মনে করে আস্তিকরা একদিন বুঝতে পারবে যে তারা এতদিন ভ্রান্ত ধারনায় বিশ্বাস করে আসছে, তখন তারা নিজেরাই এসব অন্ধবিশ্বাস ছেড়ে মুক্তচিন্তা করা শুরু করবে। তবে এধরনের নাস্তিকরা প্রচলিত বিশ্বাসের অসংগতি গুলো যুক্তির মাধ্যমে তুলে ধরে এবং সবাইকে এসব থেকে বিরত থাকার আহবান করে।
পক্ষান্তরে নব্য নাস্তিকরা মনে করে ঈশ্বর, ধর্ম, মৌলবাদ এইসব অহেতুক অন্ধবিশ্বাসের কোন মানে হয় না, এই আপদ গুলোকে যতো দ্রুত সম্ভব ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। প্রথম পর্যায়ে শুরু হয় যুক্তিতর্ক দিয়ে কিন্তু তা একপর্যায়ে কাদা ছোড়াছুঁড়ির পর্যায়ে চলে যায়। মনে রাখুন, হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে আসা এইসব ধর্মবিশ্বাস প্রতিটা মানুষের রক্তে প্রবাহিত হয়ে আসছে যা এক ফুঁ দিয়েই উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। সেটা করতে যাওয়াও বোকামি। যে মানুষ গুলো উদ্ভট সব নিউজ কিংবা ফটোগ্রাফি দেখে ফেইসবুকে "আমিন-আমিন/সুবহানআল্লাহ-সুবহানআল্লাহ" করতে থাকে, অথচ একবারও এর সত্যতা যাচাই করে দেখার মতো জ্ঞান কারো নেই, তাদেরকে আপনি যুক্তি দিয়ে কিছু বুঝাতে পারবেন বলে মনে হয় না। এরা এদের এই অন্ধবিশ্বাস নিয়েই থাকতে পছন্দ করে। কেউ যদি মনে করে আল্লাহ তার সাথে আছে এবং এটা ভেবে যদি সে মনে শান্তি পায় তবে নিশ্চই কারো কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। এদের মুক্তমনা বানাতে হলে আগে এরা যেন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে, তখন এরাই ভেবেচিন্তে বের করবে এরা যা বিশ্বাস কতে তা ঠিক নাকি ভুল। আপনি আপনার যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে থাকুন যে এটা অন্ধবিশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়, কিন্তু তাই বলে আপনি কোন ব্যক্তির কিংবা কোন গোষ্ঠীর বিশ্বাসে আঘাত হানতে পারেননা। আমি এমন কিছু লেখা পড়েছি যারা মুক্তচিন্তার নামে ধর্মকে নিয়ে অশ্লীল সব লেখা লিখে গেছেন। যারা মুক্তচিন্তার নামে এভাবে অযৌক্তিক এবং অশ্লীল শব্দ লেখায় ব্যাবহার করতে পারে তারা আর যাই হোক মুক্তমনা নয়। এরা মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত এবং এদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিৎ। একটা ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে, এক ধর্মের অনুসারীরা মুক্তমনা নাম ব্যবহার করে অন্য ধর্মকে যেন আঘাত করতে না পারে।
দুই।
আমাদের সমাজের একটা বড় অংশেরই ধর্ম বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান নেই। এরা ধর্মগ্রন্থ গুলো পড়ে কিন্তু অর্থ বুঝেনা কিংবা পড়েই না অথচ তারা ধর্ম সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু শুনলেই লাফিয়ে উঠবে। এরা ধার্মিক নয় কিন্তু ধর্মান্ধ। যেহেতু এরা ধর্মগ্রন্থ বুঝে না তাই এরা একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর উপর নির্ভর করে থাকে যারা তুলনামূলক ভাবে ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে ভাল জানেন। এই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে সাধারণ মানুষ অন্ধের মতো বিশ্বাস করে, আর এখান থেকেই শুরু হয় যতো সমস্যা। এই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ তখন সাধারণ মানুষের সরল ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগায় নিজেদের উদেশ্য হাসিল করার জন্য জন্ম দেয় উগ্র মৌলবাদের। কেউ শুরু করে রাজনীতি, কেউ শুরু করে মাজার ব্যবসা অথবা কেউ শুরু করে পীর ব্যবসা। সাধারণ মানুষ যেহেতু ধর্ম সম্পর্কে ভাল জানে না তাই এরা উগ্র মৌলবাদে সমর্থন দিতেও দ্বিধা করে না। ধর্ম সমাজের খুবই স্পর্শকাতর বিষয় তাই অন্যরাও এটা নিয়ে তেমন ঘাটাতে চায় না।
উগ্র মৌলবাদীদের বড় শত্রু হল মুক্তমনারা। যেহেতু মুক্তমনারা ধর্মে বিশ্বাসী নয় তাই খুব সহজেই এদের ফন্দিফিকির ধরে ফেলে ও সেটা সবার মাঝে প্রচার করে। খোজ নিয়ে দেখুন উগ্র মৌলবাদী নেতার উগ্র মৌলবাদী হবার পিছনে তাদের ব্যক্তি স্বার্থ লুকিয়ে আছে। ব্যক্তি স্বার্থের জন্য ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ সরল ধর্মপ্রাণ মানুষদেরকে ভুল পথে পরিচালনা করে, এমনকি মানুষ খুন পর্যন্ত করায়।
আমরা দেখেছি, এই সকল উগ্র মৌলবাদীদের হাতে যে কেবল মুক্তমনারাই নিহত হয়ে তা কিন্তু নয়, নিজেদের ধর্মের ভিন্নমতাবলম্বীরাও হত্যা হয়েছে। মনে রাখুন, মানবের কল্যাণের জন্যই ধর্ম। ধর্মের নামে যদি মানুষই হত্যা করা হয় তবে সেটা ধর্ম হতে পারে না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি, মানুষ যে যেই ধর্মে বিশ্বাসী সে যদি ধর্মান্ধ না হয়ে তার নিজ ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চলেন এবং ধার্মিক হন তবে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হয়ে উঠবে।
সামুতে আমার প্রথম লেখা এটি। আমার লেখার সাথে অনেকেরই মতের মিল হবে না, এবং সেটাই স্বাভাবিক।