আমার জীবনে যে কয়জন কাছের মানুষ রয়েছে, তাদের মাঝে দুইজনের একজন হচ্ছেন আমার মা এবং পরের জন, আমার মা। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন। দুইজনই আমার মা। অথচ মজার বিষয় হল, একই শব্দের অন্তরালে দুইজন আলাদা মানুষের বাস। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের এক অনন্য পাওয়া হচ্ছে, আমার মায়ের স্নেহ। একজনের নয়, বরং দুই মায়ের ভালোবাসায় সিক্ত অমি। একজন আমার গর্ভধারিণী। আরেকজন আমার মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার কারিগর। এক মায়ের সাথে রক্তের বন্ধন। আরেক মায়ের আদর মাখা দিক নির্দেশনায় সমৃদ্ধ আমি। আমার ছোট থেকে বড় হওয়ার পেছনে কারো অবদানকেই আমি পৃথকভাবে বিশেষায়িত করতে পারি না। আমার চোখে আমি কারো মাঝে পার্থক্য খুঁজে পাই না।
আজ আমার সেই মায়ের কথা লিখব। যার সাথে কোনও রক্তের বন্ধন না থেকেও তিনি আমার জীবনের একজন অবিচ্ছেদ্য মাতৃ চরিত্র। আজ আমার সেই মায়ের কথা লিখব। যার অমূল্য উৎসাহে আমার জীবনে ঘটে যায় আমূল পরিবর্তন। ক্লাস ফোরের সেই ক্লাসরুমের পেছনের সারিতে বসা আমি যার স্নেহের শক্তিতে প্রথম সারিতে স্থান পাই, তার গল্প।
ছবি আঁকায় আমি তেমন ভালো ছিলাম না। তখন ক্লাস ফোরের ছাত্র আমি। একবার ড্রইং পরীক্ষার খাতা বিতরণের সময় আমায় আঁকা চোখে পড়ে তার। খুব যে ভালো আঁকা হয়েছিল তা নয়। কিন্তু তিনি যেভাবে মুগ্ধ হয়ে সেই ছবি দেখছিলেন তা আমার চোখে এখনও ভাসে। ওহ, বলে নিই। তিনি ছিলেন আমার চতুর্থ শ্রেণির শ্রেণী শিক্ষিকা।
“রোল নাম্বার ২৬ কে?”
“আমি, ম্যাডাম”। দাড়িয়ে বললাম আমি।
“এই ছবি তুমি এঁকেছ আব্বু? অনেক সুন্দর হয়েছে। আমি বাসায় নিয়ে গিয়ে বাঁধিয়ে রাখব”
ব্যাস, মনে হল এই প্রথম কেউ আমার প্রশংসা করল, তাও তিনি আমার শিক্ষক। সকল ছাত্র আমায় কেমন অবাক চোখে দেখছিল। দুই বছর ধরে মুখ লুকানো আমি একদিনেই হয়ে গেলাম ক্লাসের জনপ্রিয়দের একজন। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের মধ্যে ছবি আঁকায় অন্যতম সেরা ছাত্রে পরিণত হই। ক্লাসের মুখ লুকানো সেই আমি হয়ে উঠলাম উৎফুল্ল এবং চঞ্চল। এক মহীয়সী নারী এ ধরার স্বাদ পাইয়েছেন। আরেক মহীয়সী নারী আমায় নতুন করে পরিচয় করালেন সবার কাছে। যদিও তিনি তা স্বীকার করেন না। তিনি বলেন, “তোর জায়গায় অন্য কেউ হলেও একই কথা বলতাম।” আসলেই, তার একেকজন ছাত্র তার কাছে একেকজন সন্তান। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত আমার মায়ের আসনে বসে আছেন তিনি। আমার সেই মা একদিন একটি ফরম নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। তখন আমি ক্লাস সিক্স এর ছাত্র। এসে আমায় ডেকে টেবিলের কাছে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে সেই ফরম পূরণ করে দিলেন। তারপর সেটা তিনি জমাও দিয়ে দিলেন। একটি ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার নিবন্ধন ফরম ছিল সেটা। নিজের টাকা খরচ করে আমার জন্য কিনেছিলেন। যদিও আমার পেছনে এটিই তার একমাত্র খরচ নয়। সেই প্রতিযোগিতায় অবশ্য আমি কোনও পুরস্কার পাইনি। গণিতে ভালো করতাম না বলে আমায় আমার স্কুলের গণিত শিক্ষকের কাছে পড়তে পাঠিয়েছিলেন আমার মা।
যার ফলে আমি গণিতেও ভালো হয়ে উঠি। ক্লাস নাইনে ওঠার পড়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম না। সেখানেও আমার মায়ের ধমক। আমি এখন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। এর অনেক কিছুই এখন তার মনে নেই। কিন্তু আমি মনে রাখব তার প্রতিটি অবদান, আজীবন।
তিনি ইংরেজির শিক্ষিকা ছিলেন। এখনও অবশ্য তিনি শিক্ষকতা অত্যন্ত সার্থকতার সাথে করে যাচ্ছেন। তার কল্যাণে আমি ইংরেজিতে কখনো দুর্বল ছিলাম না। ইংরেজির যে ভিত তিনি গড়ে দিয়েছেন, তার প্রভাব এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতেও প্রকট। আমার স্কুল জীবনে তার আঁচল ছিল আমার মায়ের আঁচল। এখনও, দুঃখ-কষ্টে পড়লে আমি আমার সেই মায়ের আঁচলের ছায়াতে প্রশান্তি খুঁজি। যার হাতের রান্নার স্বাদ পেতে মাঝে মাঝে নিজে থেকেই বলি, “মা, আজকে ভাত খেয়ে যাব”। ভালো কিছু রান্না করলে সবসময় আমার জন্য আলাদা করে রেখে দেন।
আমার বাবার ব্যাবসায়িক লোকসানের কারণে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ি আমরা। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালাতে আমার যখন হিমশিম অবস্থা। তখন আমার ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন আমার এই মা। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় খরচের ভার নিজের কাঁধে নিয়ে নেন। বলতে লজ্জা নেই। এমনকি আমার পকেট খরচাটাও মাঝে মাঝে তিনিই আমায় দেন। আমার যেকোনো সিদ্ধান্তহীনতায় আমার প্রথম পথপ্রদর্শক আমার এই মা। তিনি আমার আরেক স্বর্গ।
ঐ যে বললাম, “আমার ছোট থেকে বড় হওয়ার পেছনে কারো অবদানকেই আমি পৃথকভাবে বিশেষায়িত করতে পারি না”। আরও অনেক কথা লেখার আছে, যা আরেকদিন লিখব। পরিশেষে এটুকুই বলব, আমার দুই মা, আমার দুইটি চোখের মত। একটি চোখ না থাকলে যেমন শারীরিকভাবে আমি অসম্পূর্ণ। তেমনি আমার দুই মায়ের একজনের অবর্তমানে আমার জীবন অসম্পূর্ণ।
১. ২৫ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ১০:১৭ ১