[গত ১৫ মে, ২০১২ হাইকোর্টের আদেশে হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল উপন্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা জানানো হয়। এতে বিচলিত হয়ে তৎক্ষণাৎ একটা লেখা লিখতে শুরু করে দেই। লেখা শেষ হবার আগেই মিডিয়ার মারফতে লেখকের নানা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাইতে থাকে। এসব প্রতিক্রিয়া মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক হয় নাই। ফলে, আমি লেখা বন্ধ করে দেই।
হুমায়ূন আহমেদ আর আমাদের মাঝে নাই। তাঁরে স্মরণ করার উপলক্ষ্য হিসাবে লেখাটা পড়তে দিচ্ছি। তবে এই লেখা কোনো ট্রিবিউট না।]
গত ১৫ মে, ২০১২ হাইকোর্টের আদেশে হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জানানো হয়। বাংলানিউজ এই খবরটা কাভার করতে গিয়ে ওই দিন দুপুরে লিখছে:
বঙ্গবন্ধুর হত্যা সম্পর্কিত ভুল তথ্য সংশোধনী না করা পর্যন্ত জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ উপন্যাস প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন হাইকোর্ট।[১] একইসঙ্গে ভুল সংশোধনের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। [নজরটান আমার]
খেয়াল করার বিষয়, নিষেধাজ্ঞা জারি করেই আদালত এখানে নিশ্চেষ্ট নন। যে ‘ভুল’ হুমায়ূন করেছেন সেটা সংশোধনের আদেশ কেন দেওয়া হবে না সেটাও জিজ্ঞেস করছেন। এই সংশোধন অবশ্য বই প্রকাশ হওয়ার শর্তাধীন। যদি বই বের না হয় তো ভুলের সংশোধন আর হবে কোথায়? মনে রাখতে হবে, প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকী যে ‘ভুলে-ভরা’ দুই অধ্যায় বের করেছে সেই ভুল আদালত মেনে নিয়েছেন।[২] সেটা সংশোধনের কথা আদালত বলেন নাই। ফলে, যে সংশোধনের নির্দেশ আদালত দিচ্ছেন সেটা ভবিষ্যমুখী।
এই ভাবীকালের সংশোধনীর আদেশের মধ্যে আদালতের একটি চাপা বাসনা প্রস্ফূটিত। আদালত চান, এই বই লেখা হোক। এখানে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য স্মরণীয়। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এই বই প্রকাশ করা একটি মহৎ উদ্যোগ। আমরা চাই তথ্যগত ভুল যাতে না থাকে’। (প্রথম আলো) তথ্যগত ভুল কিভাবে এড়াতে হবে সেই রাস্তাও আদালত নিজের গরজে বাতলে দিয়েছেন। তথ্য ও শিক্ষা সচিবকে আদালত হুকুম দিয়েছেন ওই ‘ভুলে’র বিষয়ে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আদালতের স্বীকৃত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ও সাক্ষ্যের বিবরণ পৌঁছে দিতে। এতে লেখক ভুল শুধরে নেয়ার সুযোগ পাবেন (বিডিনিউজ) [৩]।
ভুল সংশোধন করতে হবে কেন? কারণ ‘নতুন প্রজন্ম ভুল ইতিহাস জানুক’ সেইটা আদালত চান না। এজাতীয় ভুলের পরিণাম কত নিকৃষ্ট হয় সেটা বোঝাতে আদালত বিষাদসিন্ধুর দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। কারবালার ইতিহাস বিষাদসিন্ধুর মধ্যে যেভাবে লেখা হইছে সেভাবেই তো জানে আম-জনতা। এই জানার সমস্যা হলো, মীর মশাররফ হোসেন তাঁর বিষাদসিন্ধুর মধ্যে ইতিহাস ‘অতিরঞ্জিত করে’ বর্ণনা করেছেন।[৪] এতে ইতিহাস নিশ্চয়ই বিকৃত হইছে। আদালত অবশ্য বিষাদসিন্ধু ছাপা বন্ধ করে দাও—এমন আদেশ দেন নাই। পুরাকালের ভুলভাল নিয়ে আদালত বোধহয় তেমন বিচলিত না। কিন্তু যে ভুল ইদানিন্তন, বিশেষত যে ভুল রাজনৈতিক এবং যে ‘মিথ্যা’ প্রতিষ্ঠাপ্রবণ তারে ঠেকাইতে আদালত মোটামুটি মরিয়া।
এই মরিয়া ভাবের নজির দেখেন। হুমায়ূনের অলিখিত বইখানার কোন অংশটা ভুল, প্রকৃত সত্যটা কী—এই সব জটিল তথ্যের খতিয়ানও আদালত নিজের গরজে সেরে ফেলছেন। যেমন, রাসেল হত্যাকাণ্ডের যে বিবরণ লেখক দিছেন সেইটা ভুল। প্রকৃত সত্য কী? আদালতের মতে, ‘প্রকৃত সত্য হলো বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে মায়ের কাছে যেতে চাইলে তাকে হত্যা করা হয়। সেই দৃশ্যের বর্ণনার কাছে বিষাদ সিন্ধুও হার মানায়।’
আদালতের এই বক্তব্যে কেমন করে দেয়াল লিখতে হবে সেবিষয়ে সাহিত্যিক নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে। প্রকৃত সত্য তো এই যে, রাসেল হত্যাকাণ্ড বিষাদসিন্ধুর নিষ্ঠুরতাকে হার মানাইছে। তাই, আগডুম বাগডুম করে সে ছবি আঁকলে হবে না। এই মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ড এমন বিষাদঘন কালিতে আঁকতে হবে যেন বিষাদসিন্ধুর ব্যাথাতুর বয়ানও এর কাছে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হুমায়ূন কি করলেন? তিনি ‘শেখ রাসেলের মৃত্যুর দৃশ্যপটটি যথাযথভাবে উপস্থাপন’ করলেন না। অ্যাটর্নি জেনারেলের মতে, ‘এই হত্যাকাণ্ডটি ছিল একটি বীভৎস ঘটনা। কিন্তু হুমায়ূনের বিবরণে সেটা ফুটে ওঠেনি’। (বিডিনিউজ)
অ্যাটর্নি জেনারেলের মনের বাসনা বুঝতে সিগমুন্ড ফ্রয়েড হবার দরকার নাই। তাঁর হাউশ হচ্ছে এই, হুমায়ূন ১৫ আগস্ট নিয়ে একখানা মর্সিয়াগাথা লিখবেন। বিষাদসিন্ধু যেমন জনম জনম ধরে বাঙালি মুসলমানরে কাঁদায়েছে, লেখকের উপন্যাস সেইভাবে—এমনকি ততোধিক লেজে-গোবরে দশায়—আমাদের নাকের পানি-চোখের পানি এক করে দিক। হুমায়ূন দেশের নতুন সভাকবি হউন।
এই সাহিত্য সম্ভাবনায় আদালত এতদূর কাতর যে সন্ধ্যার মধ্যেই আদালতের আদেশ একটা কূটনীতিক টুইস্ট পাওয়া গেল। দিবাভাগে যে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেয়া হয়েছিল সুর নরম করে আদালত সেটা সংশোধন করলেন। দুপুরবেলা অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ভুল সংশোধন না করে দেয়াল বের করা যাবে না। কিন্তু বিকেলে অ্যাটর্নি জেনারেলের বরাত দিয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলছেন, ‘আদালত আশা প্রকাশ করেছে যে, বইটির তথ্যগত ভুল সংশোধন করা হবে। তবে তিনি এও বলেন, আদালতের আশা প্রকাশও আদেশ হিসেবে গণ্য’ (৫)।
সুর বদলানোর ব্যাখ্যা হিসাবে জানা যাচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদ একজন ‘জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক’ এবং ‘শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি’। উপরন্তু, তিনি ‘দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত’। তাই ‘কোনো আদেশ দিয়ে’ আদালত তাঁকে ‘বিব্রত করতে চান না’ (বিডিনিউজ)। অর্থাৎ কোনো ভাবে লেখক বই না লেখার মতো বিগড়ে না যান সেই দিকে আদালতের কড়া নজর। তাই লেখকের গোস্বা ঠেকাতেই বেলাবেলি আদালতের সুর নরম হয়ে আসলো। কিন্তু ভুললে চলবে না যে, মনপসন্দ বই তাঁকে কিন্তু লিখতেই হবে (বিডিনিউজ)।
২.
প্রথম আলোতে দেয়াল উপন্যাসের দুটি অধ্যায় ছাপা হওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় অনলাইন পরিসরে। হাইকোর্টের প্রতিক্রিয়া এর পরের ঘটনা। এই দুই তরফের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটা তুলনামূলক আলোচনা করা যায়। যাঁরা অনলাইন পরিসরে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন তাঁরা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি বইলাই আমার বিশ্বাস। ফলে, এই তুলনার মধ্যে কোথাও আদালতকে হেয় প্রতিপণ্ন করার কোনো অপচেষ্টা নাই।
প্রথমে অনলাইনে যেসব প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সেগুলো খতিয়ে দেখা যাক। এসব রিঅ্যাকশনের ভেতরের শাঁসটা এরকম: হুমায়ূন তাঁর লেখার মাধ্যমে ‘বদ-লোক’দের প্রতি ‘মমতা’, ‘সেন্টিমেন্ট’ এবং ‘সফট-কর্নার’ তৈরি করছেন। এই তরফের একটি অভিযোগ এরকম: বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বাঁচানোর একটা পদ্ধতি হলো এসব খুনীর প্রতি সফট কর্নার তৈরির চেষ্টা করা। হুমায়ূন তাঁর বইতে এই কীর্তি করেছেন। তাঁর উপন্যাসে বঙ্গবন্ধুর খুনী ফারুককে একজন ‘টাফ গাই, নীতিবান মুক্তিযোদ্ধা’ হিসাবে রেপ্রিজেন্ট করা হয়েছে। অথচ, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র, সেনাবাহিনীর দলিলপত্র, কোথাও ফারুক রহমান মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃত নন। তিনি কলকাতায় রিপোর্ট করেছেন ১২ ডিসেম্বর।’ ফলে, বাংলানিউজে একজন লেখক সিদ্ধান্ত টানছেন, ‘এইভাবেই মিথ্যা ইতিহাস দিয়ে একজন কুখ্যাত খুনীর প্রতি তার সরল পাঠকদের মধ্যে মমতার বোধ জাগানোর অপপ্রয়াস নিয়েছেন হুমায়ূন’ (অমি রহমান পিয়াল, বাংলানিউজ)। [নজরটান আমার]
আরেকটি অভিযোগ হলো পাকিস্তানি সেনার রেপ্রিজেন্টেশন। হুমায়ূন তাঁর লেখায় শামস নামের এক পাকিস্তানি সৈন্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘রাজপুত্রের মতো চেহারা। মাইকেল এঞ্জেলোর ডেভিডে খুঁত থাকলেও তার কোনো খুঁত ছিল না। খাড়া নাক, পাতলা ঠোঁট, মাথার চুল কোঁকড়ানো, আবু লাহাবের মতো গায়ের রং।’ এতে শোকে মূহ্যমান হয়ে আমার ব্লগের একজন ব্লগার প্রশ্ন করছেন, ‘একজন মিথ্যা অলীক মানুষের তুলনা মাইকেল এঞ্জেলোর ডেভিডের সাথে করা হয় তাহলে এটাকে কি তাঁর পাকিস্তানের সৈনিকের প্রতি প্রেম ছাড়া আর কি বলা যায়’ ? (যদ্)[৬] লেখক উদাত্ত প্রশ্ন করছেন, কেন হুমায়ূন আহমেদ ‘বাঙ্গালীর আবেগের সঙ্গে’ জড়িত বিষয় নিয়ে এমন করে ‘তেনা প্যাচালেন’? (কর্নফুলির মাঝি, আমার ব্লগ) অনলাইন পরিসরে লেখকদের একটি বড় অংশের সন্দেহ, এই বই লিখতে গিয়ে হুমায়ূন নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের থেকে ‘আর্থিক’ বা অন্য কোনো ‘সুযোগ’ নিচ্ছেন।
এসব প্রতিক্রিয়ার ভেতরের কাঠামোটি বুঝতে পারা কঠিন নয়। রূপকথা বা ঢালিউডের টিপিক্যাল বাংলা সিনেমাতে ‘নায়ক ভার্সেস ভিলেন’ এই বাইনারির যে ন্যারেশন কাঠামোটি পাওয়া যায় সেটি হুমায়ূনের লেখায় প্রতিফলিত হচ্ছে না। জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সে যে বর্গটি ‘ভিলেন’ হিসাবে চিহ্নিত হুমায়ূন তার একটি মানবিক চেহারা ফুটিয়ে তুলছেন, ফলে সেই ‘শয়তানে’র প্রতিও তাঁর কোমলমতি পাঠকের মনে মমতার সঞ্চার হতে চায়। কিন্তু অনলাইনের বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে এরকম ন্যারেশন অত্যন্ত ক্ষতিকর।
এবার আদালতের প্রসঙ্গে আসা যাক। দেয়াল উপন্যাসের বিরুদ্ধে আদালতের অভিযোগ এর থেকে খুবই পৃথক। খুব সতর্কতার সঙ্গে এক্ষেত্রে আদালত ‘সেন্টিমেন্ট’ বা ‘মমতা’র মতো ফেনোমেননগুলো এড়িয়ে গেছেন। যেন সেন্টিমেন্টের মতো ব্যাপার আদালতের আইনি চত্ত্বরে অর্থবোধক হইতে পারে না। তাই সেদিকটায় যাওয়া হচ্ছে না। আদালতের আপত্তি নিরেটভাবে ঐতিহাসিক। মূলত দুটি ঐতিহাসিক বিচ্যুতির দিকে নজর করেছেন আদালত। এক, শেখ রাসেলের মৃত্যুদৃশ্য যথাযথভাবে উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়নি। দুই, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে খন্দকার মোশতাকের ভূমিকা ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
রাসেল হত্যাকাণ্ডের বিবরণে কোথায় ভুল হলো? হুমায়ূন তাঁর বইতে লিখেছেন:
বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূ তাদের মাঝখানে রাসেলকে নিয়ে বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন। ঘাতক বাহিনী দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। ছোট্ট রাসেল দৌড়ে আশ্রয় নিল আলনার পেছনে। সেখান থেকে শিশু করুণ গলায় বললো, তোমরা আমায় গুলি করো না। শিশুটিকে তার লুকানো জায়গা থেকে ধরে এনে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হলো।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার ঘটনার যে-বিবরণ আদালত-কর্তৃক স্বীকৃত সেখানে পাওয়া যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাজের লোক রমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে রাসেলকে হত্যা করা হয়। (বাংলানিউজ)
আদালতের দু’নম্বর আপত্তি সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল বলছেন, এই উপন্যাসে ‘খন্দকার মোশতাককে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে, তিনি এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আগে থেকে জানতেন না। প্রকৃতপক্ষে তিনি ওই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন’।
আদালতের আপত্তি দুটো খতিয়ে দেখলে অবশ্য মনে হয়, আমাদের তুলনা একেবারে ব্যর্থ হয় নাই। অনলাইন বুদ্ধিজীবীদের থেকে খুব তফাতে দাঁড়িয়ে নেই মহামান্য আদালত। কারণ আদালতের ‘আবেগরহিত’, ‘নিরেট ঐতিহাসিক’ আপত্তির তলানিতে সেই ‘নায়ক ভার্সেস ভিলেন’ ডিকটমির হদিস পাওয়া যাচ্ছে। রাসেল হত্যাকাণ্ডের যে বিবরণ হুমায়ূন তাঁর বইতে দিয়েছেন এতে ইতিহাসের ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ যে হয়ে গেল তার দুটি কারণ অনুমান করা যায়। এক, কাজের লোক রমার কাছে থেকে ছিনিয়ে নেওয়া আর বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া এক কথা নয়। হুমায়ূন রমার দোষ বঙ্গবধূদের কাঁধে চাপাইছেন। দুই, ছোট্ট রাসেল আলনার পেছনে গিয়ে লুকানোর মধ্য দিয়ে গোটা জাতির মুখে চুনকালি লেপন করেছে, তার কাপুরুষতা এইখানে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।
আদালতের দ্বিতীয় আপত্তিও একই আবেগ দিয়ে অনুপ্রাণিত। এই উপন্যাসে খন্দকার মোশতাককে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তাতে আদালতের এরকম ‘মনে হচ্ছে’ যে, তিনি বোধহয় এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আগে থেকে জানতেন না। কিন্তু তিনি ওই ষড়যন্ত্রে প্রকৃতপক্ষে জড়িত ছিলেন। ‘মনে হওয়া’ ‘মন কেমন করা’—এসব বক্তব্য আসলে ‘সেন্টিমেন্ট’ ‘সফট কর্নার’ এসব থেকে খুব বেশি দূরের ব্যাপার না। আদালত এমনতর ভিত্তির ওপর অভিযোগ রুজু করছেন কেন? কারণ মোশতাকের রেপ্রিজেন্টেশন অস্বস্তিকর। ভিলেনের চিরায়ত ভূমিকায় তাঁকে ঠিক পড়ে নেয়া যাচ্ছে না। ‘মনে হচ্ছে’ কথাটার মধ্যে আদালতের এই অস্বস্তি ফুটে বেরুচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে মোশতাকের কতখানি ভূমিকা ছিল সেটা স্পষ্ট করে আদালত বলেন নাই। কিন্তু এটা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে। মোশতাক ষড়যন্ত্রকারীদের পালের গোদা ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। আদালত যদি তেমন প্রমাণ দিতে পারেন আমরা খুশি হবো।
৩.
এই নিষেধাজ্ঞার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক সকলেরই বোধহয় নজর এড়িয়ে গেছে। অন্তত মূলধারার গণমাধ্যমে এই কথাটি একদমই তোলা হয় নাই। বাংলাদেশের ইতিহাসে কি আগে কখনও হাইকোর্টের আদেশে সুনির্দিষ্ট কোনো বই বা রচনা নিষিদ্ধ করার ঘটেছে? যেসব বই নিষিদ্ধ হওয়ার সংবাদ আমাদের জানা আছে (লজ্জা, নারী, আমার ফাঁসি চাই, ক) তার সবই সরকারি আদেশে নিষিদ্ধ হয়েছে। বইপত্র সংক্রান্ত হাইকোর্টের একমাত্র নিষেধাজ্ঞা সম্ভবত ‘নোটবই’ ও ‘গাইড বই’য়ের ক্ষেত্রে ঘটেছে। দেয়াল উপন্যাসের এই দুটি অধ্যায় কি তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা লাভ করলো?
কোন্ আইনী প্রণোদনা থেকে দেয়াল প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে আদালত সেটার উল্লেখ করেন নাই। অন্তত গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভাষ্যে এমনটাই দেখা যাচ্ছে। আদালত কি আইন-নিরপেক্ষভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? কোনো আদেশ দিতে পারেন?
১৯৯৩ সালে সরকারি আদেশে লজ্জা নিষিদ্ধ হয়েছিল। এই আদেশ উপলক্ষ্যে সরকারি যে তথ্যবিবরণী প্রকাশিত হয় সেখানে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এই যে: ‘জনমনে বিভ্রান্তি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির অঙ্গনে বিঘ্ন ঘটানো এবং রাষ্ট্রবিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য’ প্রকাশিত হওয়ার জন্য লজ্জা বইটির ‘সকল সংস্করণ’ বাজেয়াপ্ত করছে সরকার।[৭]
গত ২২ মার্চ ২০১২ হাইকোর্ট ‘ধর্মীয় অনুভূতি’তে আঘাত হানার অভিযোগে পাঁচটি ফেসবুক পেজ ও একটি ওয়েবসাইট বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।[৮] আদালতের যুক্তি ছিল, এসব সাইটে যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, তা ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সংবিধান পরিপন্থী (প্রথম আলো)। আদালতের এই আদেশ বুঝতে কিন্তু আমাদের খুব একটা অসুবিধা নেই। যেসব অভিযোগ এখানে তোলা হলো সেসব ব্যাপারে বাংলাদেশের সংবিধানে খুব পরিষ্কার না হলেও কিছু নির্দেশনা আছে।
কিন্তু দেয়াল প্রসঙ্গে হাইকোর্টের আদেশের এরকম আধা-প্রত্যক্ষ কোনো আইনী ভিত্তিও হদিস করা যাচ্ছে না। দেয়ালের বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তি, হাইকোর্টের মতে, এখানে ইতিহাস-বিকৃতি ঘটেছে। ইতিহাসের বিকৃতি যদি কোনোভাবে ঘটেই থাকে তবে কেমন ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ সে বিষয়ে বাংলাদেশের আইনে খোলাসা করে কিছুই বলা নেই। এর পক্ষে পরোক্ষ কোনো ইঙ্গিতও নাই। এই অপরাধটাকে কব্জা করার একমাত্র উপায় হলো কিছু ইল্যাস্টিক সাংবিধানিক বিধির সৃজনশীল ব্যবহার, যেমন ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা’ ‘জনগণের স্বার্থ’ ইত্যাদি। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ অবধি জীবনের সর্বত্র এই সব বিধান নাক গলাইতে সক্ষম।
আবার, অন্যদিকে, নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিচ্ছে সংবিধান। যেসব শর্তে এই স্বাধীনতা সীমিত করা হচ্ছে তার মধ্যে আছে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা’—এই বিষয়গুলো।
হুমায়ূনের ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’ আদালত স্থগিত করতেছেন কোন ধারা-বলে? রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা কূটনৈতিক গোলযোগ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা এখানে শূন্য। অশালীনতার অভিযোগও হুমায়ূনের বিরুদ্ধে এখানে তোলা যাচ্ছে না। বরং আদালত অভিযোগ করেছেন, এই বইতে পর্যাপ্ত বীভৎসতা নাই। রাসেল হত্যাকাণ্ড বাস্তবে যতটা ‘বীভৎস’ এই বইতে তার চেয়ে অনেক ‘সুন্দর’ লাগছে। ইতিহাস-বিকৃতির অপচেষ্টাকে কি অনৈতিক বলা যায়? সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে নৈতিকতা সম্পর্কে যে বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে তা হলো, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্তা গ্রহণ করিবেন।’ কিন্তু দেয়াল উপন্যাসের যতদূর পড়ার সুযোগ হইছে তার মধ্যে গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলার কথা নাই।
সংবিধানের আরেকটি অনুচ্ছেদকে অবশ্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই অনুচ্ছেদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ইতিহাস-চেতনা টের হইতেছে। ২৪ অনুচ্ছেদে লেখা আছে:
বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমণ্ডিত স্মৃতিনিদর্শন, বস্তু বা স্থানসমূহকে বিকৃতি, বিনাশ বা অপসারণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।
এই অনুচ্ছেদটিতে ইতিহাসচেতনা এসেছে বেশ সংকুচিত অর্থে। অভিব্যক্তি থেকে অনুমান করা যায়, মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সংরক্ষণের দিকেই এখানে প্রধান ঝোঁক। ঐতিহাসিক ‘সত্য’ বা ‘তথ্য’-জাতীয় অবস্তুগত বিষয়ের কথা এখানে বলা নেই। কেবল ‘স্মৃতিনিদর্শন, বস্তু বা স্থান’-এর মতো বস্তুগত ইতিহাসের উপকরণ-ই এখানে সংবিধানের উদ্বেগের বিষয়। তবু যদি একে তথ্য বিকৃতির অর্থ অবধি টেনে নেওয়া যায় তবে সেই অর্থেও কি আইনসঙ্গতভাবে দেয়ালের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা যেতে পারে?
এখানে একটি প্রশ্নের মোকাবিলা করাটা বেশ দরকারি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দিকটাতে কেউ খুব একটা মনোযোগ দেন নাই যে, হুমায়ূন ইতিহাস গ্রন্থ লেখেননি। তিনি লিখেছেন উপন্যাস। এর আগে মেহেরজান ছবিটি নিয়ে ব্যাপক হট্টগোলের প্রেক্ষিৎ থেকে ঘটনাটি বোঝা দরকার। ইতিহাস ও সাহিত্য কি একই জিনিস? নাকি এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে? ইতিহাস-আশ্রয়ী সাহিত্যের সঙ্গে ইতিহাস-গ্রন্থের সম্পর্ক কি? ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেরণা থেকে যখন শিল্প বা সাহিত্য রচিত হয় তখন সেটা কি পুরোপুরিভাবে ইতিহাসের অনুসরণ করতে বাধ্য?
মনে রাখা দরকার, এই গোটা তর্কেরই কোনো হদিস বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের মধ্যে নেই। এগুলো আইনের চোখে এখনও ‘অপরিজ্ঞাত’ ব্যাপার। সাহিত্যের ইতিহাসে অবশ্য ঐতিহাসিক উপন্যাস বলতে কী বুঝতে হবে, ইতিহাস সেখানে কদ্দুর পর্যন্ত অনুসরণ করা লাগবে সেই বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরেই আছে। সে বিতর্কের মিমাংসা হয় নাই। ভুলে গেলে চলবে না, সাহিত্যে যেটা চালু আছে সেটা আইনী কোনো বিতর্ক নয়। এই বিতর্ক লিটারারি স্টাডিজ-এর অধীত বিষয়।
এই বিতর্কের সূত্র ধরে কয়েকটা ধারণার কথা তোলা যায়। যেমন শিল্পীর স্বাধীনতার সীমা বোঝাতে ‘আর্টিস্টিক লাইসেন্স’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে।[৯] এই কথাটি দিয়ে শিল্পীর যেসব ব্যাপারে স্বাধীনতা আছে বলে কবুল করা হয় তার মধ্যে একটি হলো ‘ডিসটরশন অব ফ্যাক্ট’। শিল্পী নিজের শিল্পকর্মের উৎসকর্ষসাধনের জন্য এমন কাণ্ড করতে পারেন।
যে জাঁরের ঐতিহাসিক ফিকশনে ‘প্রকৃত ইতিহাস’কে অনুসরণ না করে বিচ্যূত করা হয় তাকে সাহিত্যের আলোচনায় বলা হয় ‘অলটারনেট হিস্টরি’।[১০] একে একই সঙ্গে লিটারারি ফিকশন, সায়েন্স ফিকশন ও হিস্টরিক্যাল ফিকশনের একটি সাব-জাঁর হিসাবে দেখা হয়। এরকম উপন্যাসের দৃষ্টান্ত আছে অনেক। ফিলিপ কে ডিকের দি ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসল (১৯৬২) উপন্যাসে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করেছে জার্মানী-জাপান। ফিলিপ রথের দি প্লট এগেনস্ট আমেরিকা (২০০৪) উপন্যাসে এমন এক আমেরিকার দেখা পাওয়া যায় ১৯৪০ সালের নির্বাচনে ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট যেখানে হেরে গেছেন। তার বদলে জয় পেয়েছেন চার্লস লিন্ডারবার্গ যিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদ এবং ইহুদি বিদ্বেষ চাগিয়ে দিচ্ছেন।
মিশেল শ্যাবোর দি ইদ্দিশ পুলিসমেন’স ইউনিয়নে (২০০৭) পাওয়া যায়, প্রত্যূষপর্বেই ইসরায়েল রাষ্ট্রটি ধ্বংস হয়ে গেছে। আর সিনেমার ইতিহাসে বিখ্যাত উদাহরণ হলো কোয়েনটাইন টারানটিনোর ইনগ্লোরিয়াস বাসটার্ড। এই ছবির মূল থিম হচ্ছে সফলভাবে হিটলার-বধ।
আশ্চর্য হলেও সত্য, হুমায়ূনের বই নিয়ে বাতচিৎ করতে গিয়ে আদালত ইতিহাস ও সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে কোনো কথা তোলেন নাই। হুমায়ূন যদি একটা অভিসন্দর্ভ লিখতেন তবে আদালত এই প্রসঙ্গে যা যুক্তি দিতেন সেই একই যুক্তি খাটতেছে দেয়াল উপন্যাসের বেলাতেও। এইটা বেশ অ্যালার্মিং ঘটনা। আদালতের কাছে জানতে চাওয়া দরকার হয়ে পড়ছে যে সাহিত্য ও ইতিহাসের সম্পর্ক তারা কীভাবে নিষ্পত্তি করছেন।
তথ্যসূত্র ও টীকা:
১. প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া দেয়াল উপন্যাসের দুটি অধ্যায় আদালতের গোচরে এনেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এরই প্রেক্ষিতে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ মঙ্গলবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন।
২. http://www.prothom-alo.com/detail/news/256744
৩. আদালতের আদেশে ১২ দিনের মধ্যে তথ্য সচিব, শিক্ষা সচিব ও সংস্কৃতি সচিবকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। (বাংলানিউজ)
৪. Click This Link
৫. Click This Link
৬. ‘পাকি সৈন্য’কে রাজপুত্র বলা যে কত বড় গর্হিত অপরাধ সেটা প্রমাণ করতে ব্লগার মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একদল পাকিস্তানি অফিসারের গ্রুপফটো দেখিয়ে তার নিচে মন্তব্য লিখছেন, ‘এদের মধ্যে কোনটা রাজপুত্তুর?’
৭. Click This Link
৮. Click This Link
৯. উইকিপিডিয়া
১০. Brave New Words: The Oxford Dictionary of Science Fiction (Oxford University Press, 2007) notes the preferred usage of "Alternate History" as well as its primacy in coinage, "Alternate History" was coined in 1954 and "Alternative History" was first used in 1977, pp.4–5.