বিষণ্ন কবির খাতা
তৈমুর রেজা
‘ওপারে আরেক দেশ—ওপারে আরেক দেশ’, অচিন দেশেই কবির ঘর-বসতি হলো। পঞ্চাশের দাঙ্গায় কলকাতা উজাড় হচ্ছে, রাডক্লিফের কলমের খোঁচায় আপন ভূগোল চুরি হয়ে গেল—এক কবি তখন নৌকোয় করে পালাচ্ছেন। কবি জন্মালেন এক আকালের সনে, পাঁজিপুঁথিতে তার নাম ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’, মায়ের দুঃস্বপ্ন গলিয়ে তিনি মাটি ছুঁলেন, যেমন পাথর ফেটে ঝরনার ধারা ফোটে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ অনেক দিনের কবি। শোনা যায়, তাঁকে নিয়ে বড্ড ভুল বোঝাবুঝি। তিনি স্যুররিয়েলিস্ট না কিয়ের্কেগার্দপন্থী—এসব নিয়ে একটা পুঁথিগত ঝগড়া চলছে। কিন্তু এই স্মৃতিকথা পড়তে গিয়ে মনে হলো যেন অন্ধকারে পথ খুঁজতে টর্চ নয়, তাঁরা ব্যবহার করছেন কাতরা। কারণটা বলি।
জীবনীর একটা চলতি মাধুর্য থাকে তার পরম্পরায়। কিন্তু সৈয়দের বইয়ে তার বালাই নেই; এলোমেলো, কোনো সংস্থান নেই, একই কথা ঘুরপথে আবার আসছে। একগাদা খুচরো পয়সা যেন ঝুরঝুর করে পাঠকের গায়ের ওপর এসে পড়ে, তবু আয়নার প্রতিটি খণ্ডই যেমন স্বতন্ত্র পরম আয়না, এই সিকি-আধলির বয়ানও যেন তেমনি—সৈয়দের রূপগরিমার ছাঁচ সেখানে মিলছে।
এই আত্মজৈবনিক রচনাটি আবদুল মান্নান সৈয়দের একটা মানচিত্র, অলিসন্ধি অবধি রেখা টেনে আঁকা। চট করেই সৈয়দকে চিনে নেওয়া যায়; তাঁর শৈশবের উঠোনে পুঁতে দেওয়া বীজ থেকে ঝাপটানো গাছের জন্ম, লেখালেখি সে গাছের ফল। আকালে জন্মালেন, দাঙ্গায় দেশ ছাড়লেন—তারপর নির্জনতায়-অসুস্থতায় কেটে গেল অনেক দিন। আর এসবের তাল ফুটে বেরোল লেখার ফুল। লেখককে সাক্ষী মানছি, ‘...বাংলা ১৩৫০ সাল আর ইংরেজি ১৯৫০ সাল। দু’টিরই মূলে জন্মভূমি হারানোর বেদনা। ...আমি-যে জীবনভোর বিষণ্নতায় ভুগি, ব্যর্থতাবোধে অবিশ্রাম আক্রান্ত, তার মূলে আছে ওই বোধ। জীবনে-যে কিছু করতে পারিনি, বিরামহীন শূন্যতায় ভুগি, আর ওই শূন্যতা ভরাতে অবিরল গদ্য-পদ্য লিখি—সমস্ত কিছুর কেন্দ্রে ওই বেদনা।’
কেবল বোধের তাড়াই নয়, অসুখও চিরকাল তাঁর পিছু লেগে আছে। ভেতরের-বাইরের এই দু’ধারি আক্রমণেই ক্ষ্যান্ত নয় তাঁর শৈশব, নির্জনতার অভ্যাসটাও তাঁর জন্মের মতোই পুরোনো। একটা নিষ্ঠুর চাতালে তাঁর শৈশব যেন হাঁসফাঁস করেছে অনেক দিন, তারপর হঠাৎ লাফ দিয়েছে খাতায়। তাঁর প্রথম নিদর্শন আমরা পাই ১৯৬৭ সালে, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ কাব্যগ্রন্থে। এসব কবিতায় যে উদ্ধত স্বাতন্ত্র্য আছে, তার গোড়াটা স্যুররিয়েলিজমের জমিনে নয়, আছে কবির ব্যথিত শৈশবে, ধারালো মাছের লেজের মতো ঝাপটা দিয়ে দিয়ে যা কবিকে নতুন করে তুলেছে।
এই স্মৃতিকথার পৃষ্ঠায় তাই কবির দেখা মেলে, কবিকে যেন ছুঁতে পারি, তাঁর কবিতার অক্ষরগুলোর পেছনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বিষণ্ন ছেলেটাকে চিনতে পারি। কবির দেখা পাই, কবিকে পাই। কারণ কবি অন্তর দিয়ে বলেছেন। যেমন আত্মজীবনী লেখার একটা বাঁধানো রাস্তা আছে—তমিজের ষোলআনা গাঁটে রেখে গোঁফের ফাঁকে কথা ঝুলিয়ে রাখা—তেমন বাহারি ফুলতোলা বচন কবির মুখে নেই। জীবনের ঝোঁপ থেকেই যেন তিনি গান করছেন, সুর তুলছেন। ভাষাটা এমন আদিম হওয়ায় আব্রুর রবরবা হয়নি, হঠাত্ দমকা একটা অহংকারী বাতাসে অক্ষরগুলো ছেয়ে গেছে, কিন্তু তেমন অহংকার নয়, যার গোড়ায় থাকে লজ্জা কি শ্লাঘা। যেন অহংকারের একটা সমাজ-রহিত মূল্য আছে।
দশজনকে ভালো কি মন্দ বলে বুঝে নেওয়ার একটা সামাজিক পথ আছে। কিন্তু সৈয়দ অর্বাচীন বয়সেই এমন নির্জন, আর বয়সকালে এতটা অসামাজিক যে সেসব ছাঁচে বানানো ভালো-মন্দের টোপর তাঁর পরতে গরজ নেই। তাই সততার ঘ্রাণ আত্মকথায় থেকে গেল। অবশ্য তাঁর আবডালে কোথাও খেদ লুকিয়ে আছে, অবসরমতো প্রকাশ পায়; যে স্বীকৃতি তিনি পাননি কিন্তু পেলে বেশ হতো—তেমন খেদ তিনি অবস্থামতো প্রকাশ করেছেন।
সৈয়দ নানা মাত্রায় হেঁটেছেন, যেমন কবিতার পথে, তেমনি গল্পে বা গবেষণায়, কিন্তু শেষ অবধি তিনি কবি। এই বিজ্ঞপ্তিটি প্রায় সব মাধ্যমেই তিনি টাঙিয়ে রেখেছেন। তবে সব পথেই তিনি একটু আত্মভোলা ধরনের, লেখালেখির বউছি খেলায় তিনি নিজেই বুড়ি। স্মৃতিকথার একটা ঐতিহাসিক মূল্য থাকে, লেখকের সময় যেন সেখানে একটা পাকা ছাপ ছোপ রেখে যায়, কিন্তু মান্নান সৈয়দের বয়ানে সময় ফরসা হচ্ছে না খুব। কুয়াশার মধ্যে কেবল তিনিই হাঁটছেন, আর ক্যামেরা ট্র্যাক করে শুধু তাঁকেই ধরছে, কোন পথ কোন রাস্তা, কেমন বাড়িঘর—এসব কিছুই গৌণ আর অস্ফূট।
স্মৃতিকথার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে অনেকগুলো সাক্ষাত্কার। আলাপে যেসব প্রশ্ন উঠেছে তার ছিরি-ছাঁদ নেই বললেই চলে, প্যাকেজ প্রশ্ন, রেডিমেড। প্রশ্নের গভীরতা নেই; কবিতা এমন কেন, এটা কেন নেই, ওটা কেন আছে—টাইপের গাদা-গাদা প্রশ্ন। এ রকম আলাপের মধ্যে কবির তালাশ করা সহজ নয়। কবি যথাসাধ্য পেখম মেলতে চেয়েছেন, কিন্তু আলাপ তো আর একতরফা হয় না।
তবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে পাঠক কবির মধ্যে ডুব মারার একটা সুযোগ পেয়েছেন। আলাপের শেষ দিকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কবিকে বলছেন, ‘তুমি এক ধরনের বিষাদগ্রস্ত মানুষ। যেকোনো কারণেই হোক, জন্মগত বা প্রথম জীবনের নানা বৈরী ঘটনার আঘাতেই হোক...।’
কবির রহস্যের উৎস এখানেই, যেমন মহাদেব সসাগরা গরল পান করে নীলকণ্ঠ হলেন, কবির জন্য সেটাই রাজকীয় পথ।
আবদুল মান্নান সৈয়দের এই স্মৃতিকথার ভাষা সুন্দর আর বিষণ্ন। ভারী হয়ে জমে থাকা ভাষা ধরে হাঁটলে মনে হয় যেন তুষারাবৃত পথে হাঁটছি। এই ভাষা ধরেই কবির শীতল উৎসের দিকে এগোনো ভালো। তাই, কবিকে অভিবাদন।
ভেসেছিলাম ভাঙা ভেলায়—আবদুল মান্নান সৈয়দ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সূচীপত্র, ঢাকা প্রচ্ছদ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি ১৬০ পৃষ্ঠা ২৯৫ টাকা