গত শুক্রবার (২০ মে ২০১৬) শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে পালাকার মঞ্চায়ন করল বিশিষ্ট নাট্যকার সাঈদ আহমদ-এর নাটক 'কালবেলা'। ১৯৬২ সালে ড্রামা সার্কেল 'কালবেলা' নাটকটি প্রথম মঞ্চায়ন করেছিল। ড্রামা সার্কেল এবং নাট্যকার সাঈদ আহমদ-এর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের অংশ হিসাবে দীর্ঘদিন পরে 'কালবেলা' নাটকটি নতুন করে মঞ্চে এনেছে পালাকার। শুক্রবার এটি ছিল পালাকারের প্রযোজনায় 'কালবেলা'র দশম শো।
নাট্যকার সাঈদ আহমদ-এর 'কালবেলা' একটি অ্যাবসার্ড বা অধিবাস্তববাদি নাটক। প্রচলিত জীবনের অর্থহীনতা বা একঘেয়েমিকে পুঁজি করে জাদুবাস্তবতার কৌশল নিয়ে সেই অনর্থক জীবনের অন্তরালের অর্থময় জীবনকে উপলব্ধি করার দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক মিথস্ক্রিয়াকে নানান বর্ণিল বাক্য, সংলাপ, কাহিনী, দৃশ্য ও বিচিত্র ভাবের সংশ্রব আসলে অ্যাবসার্ড নাটক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপ তথা গোটা বিশ্ব জুড়ে অ্যাবসার্ড নাটক তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। ঊনিশ শতকের দু'দুটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে মানুষ আসলে জীবনের জন্য কী কী শিখল? সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চিন্তাশীল কবি, লেখক, নাট্যকারগণ একসময় দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক মিথস্ক্রিয়ার উন্মোচনে অ্যাবসার্ড বা অধিবাস্তবাদের দিকে ঝুকে পড়েন। জাদুবাস্তবতা দিয়ে তখন জীবনের অর্থহীন অনর্থক জীবনকে কিছুটা অর্থময় করার প্রয়াস থেকেই অ্যাবসার্ড লেখনির উপলব্ধি। নাট্যকার সাঈদ আহমদও নাট্যভাবনায় সেই আলোড়নে অালোড়িত হয়েছিলেন।
মানুষের জীবনে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরম্পরা সংঘটিত নানান কিসিমের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংঘর্ষ, রক্তপাত, অশ্রু, অশান্তিকে জীবনের শেষলগ্নে গিয়ে মনে হতে পারে এসব নিছক অর্থহীন ছিল। অথচ জীবনে ফেলে আসা সেসব অর্থহীন সময়কে আর নতুন করে ফিরিয়ে আনার কোনো সুযোগ নেই। মানুষ তখন পিছনের কলংকময় জীবনকে অর্থহীন মনে করে এক অশান্তির ঘোরে প্রলুব্ধ হয়। তখন মানুষ নিজেকে নিয়ে, সমাজকে নিয়ে, রাষ্ট্রকে নিয়ে, মানুষের পরম্পরা সম্পর্কের টানাপোড়ন নিয়ে বড়োই আফসোস করে। আহা জীবন যদি হাসি, ঠাট্টা, প্রেম, বন্ধুত্ব, আনন্দ আর মুখরতায় ভরিয়ে দেওয়া যেত! কত না ভালো হতো! মানুষের সেই অন্তর্জগতের উপলব্ধি নিজের বিবেকের দংশনের কাছেই নিজেকে তখন এক বোধহীন অসার অতৃপ্তি বাসনার ঘেরাটপে অটোমেটিক বন্দি করে। কিন্তু তখন আর বিলাপ করা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না। তখন এই নিরন্তর আত্ম জিঘাংসার পরিসমাপ্তিকে কিছুটা অর্থপূর্ণ করার এক ঘোরলাগা নেশায় পায় মানুষকে। মানুষ তখন নিজেই নিজের জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরম আত্মউপলব্ধি করার চেষ্টা করে। মানুষের এই সহজাত স্বরূপ উপলব্ধি করার প্রত্যয়কেই তখন দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক মিথস্ত্রিয়ায় জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে অ্যাবসার্ডিটির প্রতি প্রলুব্ধ করে। মানুষ তখন সত্য, প্রেম, সুন্দর, সহজ, সরল এক পরম জীবনের অনুসন্ধান চালায়।
নাট্যকার সাঈদ আহমদ-এর 'কালবেলা' নাটকের কাহিনী, বিন্যাস, ঘটনা, পাত্রপাত্রী, স্থান, কাল, দৃশ্য, বাক্য, সংলাপ, আর জীবনের নানান বৈচিত্র্যের ভেতরে মানুষের সেই হারানো অনর্থক জীবনকে হাসি, ঠাট্টা, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, কৌতুক আর ভাবরসে এক অর্থময় জীবনকে দেখানোর প্রয়াস সুস্পষ্ট। জীবনের পরম সত্যকে আবিস্কারের এক নান্দনিক সৃষ্টি সাঈদ আহমদ-এর নাটক 'কালবেলা'। 'কালবেলা' নাটকের গল্প বা কাহিনী মূলত চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত এক দ্বীপকে ঘিরে। এই দ্বীপ আসলে গোটা বিশ্বজগতেরই রূপক বা প্রতীক স্বরূপ। সেখানে নানান শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে একদল নৃগোষ্ঠী মানুষেরও বসবাস। দ্বীপবাসীর প্রচলিত জীবনের দৈনন্দিন জীবনাচার, রীতি-নীতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, উৎসব, পার্বন অনেকটা কুসংস্কারপূর্ণ। নানান কিসিমের নিছক ও অলীক জিনিসের প্রতি দ্বীপবাসীর প্রগাঢ় বিশ্বাস। সেই প্রচল বিশ্বাসে ঘাই মারা বা ফাটল ধরানো কার সাধ্য?
উপেং পুরোহীত গোটা দ্বীপবাসীকে নানান কিসিমের অলীক জাদুমন্ত্রে একটা প্রাচীন অলীক বিশ্বাসের প্রতি সবাইকে হেমিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মত বশ মানিয়ে রাখেন। পুরোহীতের দেখানো সেই রহস্যময় কারসাজি, ছলনা, মূর্ছনাকে দ্বীপবাসী অন্ধভাবে বিশ্বাস করে। আর উপেং পুরোহীতের সেই ছলনার ভিকটিম হয় এক যৈবতী উর্বশি নারী নিবেদিকা। নিবেদিকাকে দিয়ে উপেং পুরোহিত দ্বীপবাসীর অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে দেবার মিথ্যা ছলনা করান। অনেকটা স্বৈরাচারী কায়দায় উপেং পুরোহীতের সকল ভুংভাং, ঝাড়ফুঁক, মন্ত্র, তন্ত্র, তর্জন, গর্জন, শাসনকে দ্বীপবাসী অন্ধভাবে বিশ্বাস করে। গোটা দ্বীপবাসী যেন উপেং পুরোহীতের নির্দেশিত এক অমোঘ দৈবক্রিয়ার কাছে বন্দি। যৈবতী উর্বশি নিবেদিকা নারীর মাধ্যমে দ্বীপবাসী একসময় জানতে পারে, সাতটা বাজলেই এই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে! প্রলয়ংকরী এক ঘূর্ণিঝড় সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে নশ্বর এই পৃথিবীকে সাতটা বাজলেই পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। দ্বীপবাসীর অনর্থক এই জীবন তখন এক চরম ধ্বংসের মুখোমুখি।
সাতটা বাজলেই যেহেতু নশ্বর এই জীবনের ধ্বংস অনিবার্য, তাই দ্বীপবাসী নিজেদের জীবনের অপূর্ণ সাধ, আহ্বলাদ, ইচ্ছা, আকাঙ্খাকে সম্পূর্ণ চাপমুক্তভাবে নতুন করে উপলব্দি করার চেষ্টা করে। তারা নিজেদের পরম্পরা দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, কলহ, যুদ্ধ, সংঘর্ষকে পাশকাটিয়ে জীবনের শেষলগ্নে শৈশবের ফেলে আসা জীবনের নানান আনন্দ, খেলা, ঘটনা ও স্মৃতিকে পুঁজি করে নিজেদর মধ্যে নতুন এক বন্ধুত্বকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে শেষ সময়টুকু কাটানোর ইচ্ছায় মত্ত হয়। অর্থহীন জীবনের ব্যর্থতা ও গ্লানিকে আর দ্বন্দ্বময় না রেখে তারা তখণ বরং দ্বন্দ্বহীন এক আমৃত্যু অর্থময় জীবনের অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে যায়। স্মৃতি হাতড়ে তারা শৈশবের আনন্দময় নানান খেলায় মেতে ওঠে। মোড়লের নেতৃত্বে তার দুই বন্ধু আহম্মদ আর মুনীর ছেলেবেলার সেই প্রিয় ডাঙ্গুলী খেলায় নিজেদের তখন ব্যস্ত রাখে। কিন্তু ছেলেবেলার সেই খেলা বুড়ো বয়সে খেলতে গিয়েও তারা আবার স্মৃতির চোরাগলি ধরে পুরানা কলহে নিমজ্জিত হয়।
ঘটনাচক্রে তখন জেল থেকে পালানো দাগী কয়েদির সঙ্গে দেখা হয় সহজ, সরল জীবন কাটানো শিসদার বংশীধারীর। নির্জন পথে মুখোমুখি তখন একসময়ের দুর্ধর্ষ গুণ্ডা জেল থেকে পালানো দাগী কয়েদি আর ঠিক এর বিপরীতধর্মী সহজ, সরল, স্বাভাবিক সুন্দর, আনন্দময় জীবন কাটানো শিসদার বংশীধারী। কথায় কথায় পরিচয়ের একপর্বে শিসদার বংশীধারী দাগী কয়েদির কাছে গান শোনার বায়না ধরেন। দাগী কয়েদি তখন সহজ স্বীকারোক্তি করেন যে তিনি তো গান গাইতে জানেন না। কিন্তু পরক্ষণেই তার উপলব্ধিতে আসে এক অমোঘ সত্য। জীবনে এই যে এত দ্বীধা, দ্বন্দ্ব, কলহ, সংঘর্ষ, যুদ্ধ, অনাচার, অবিচার, এর কী অর্থ আছে আর! সাতটা বাজলেই তো এই জীবন শেষ। তবু জীবনের পরম লগ্নে যখন এমন একজন সহজ, সরল বন্ধুকে পথে পেলেন, যে করেই হোক তাকে গান শোনানোর ব্যবস্থা করার তাগিদ অনুভব করেন দাগী কয়েদি। তাতে যদি জীবনে সংঘটিত যত পাপ কিছুটা যদি রোহিত হয়, এমন এক প্রবঞ্চনায় আত্মজিজ্ঞাসার কাছে সমর্পিত হয় দাগী কয়েদি।
এই সময় তার কানে ভেসে আসে এক অপূর্ব মনোলোভা নারী কণ্ঠের গান। সেদিকে খুঁজতে গিয়ে দাগী কয়েদি পায় যৈবতী উর্বশি নিবেদিকাকে। নিবেদিকাকে দিয়ে বন্ধুকে গান শোনানোর ইচ্ছেটা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দাগী কয়েদি উপেং পুরোহীতের কড়া ধমকের মুখোমুখি হয়। খবরদার, ওকে ওভাবে নিবেদন করবি না। এমন চেষ্টা চালালে তুই ধ্বংস হয়ে যাবি এমন অভিশাপ দেয় পুরোহীত। অগত্যা কে গান শোনাতে পারে এমন কারো খোঁজে দ্বীপময় ঘুরতে যায় দাগী কয়েদি।
ওদিকে মোড়লের নেতৃত্বে সবাই ডাঙ্গুলী খেলায় মত্ত। কিন্তু নিবেদিকার রহস্যময় আচরণ আর পাগলামিতে দ্বীপবাসী আরো ভীত হয়ে পড়ে। উপেং পুরোহীতের নিবেদিকাকে দিয়ে দেখানো ভুংভাং, অলীক জাদুমন্ত্রকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসে নবাগত শিসদার বংশীধারী। সামান্য এক বাঁশির ফুৎকার দিয়ে গোটা দ্বীপবাসীর সামনেই শিসদার বংশীধারী প্রবল শক্তিধর উপেং পুরোহীতকে অপমান করে বেকুপ করে দেয়। মাত্র এক বাঁশির ফুতে উপেং পুরোহীতের এতদিনের আত্মগড়িমা, ছলনা, কারসাজি নিমিষেই কর্পূরের মত উড়ে যায়। গোটা দ্বীপবাসী তখন শিসদার বংশীধারীর নামে জয়ধ্বনী দেয়। আর উপেং পুরোহীতকে ভর্ৎসনা করে। সেই সব ঘটনার জালে মোড়লের নেতৃত্বে এতক্ষণ যারা ডাঙ্গুলী খেলছিলেন, তারা তাদের ছোট্ট কাঠের কাঠি হারিয়ে ফেলে। মোড়ল সবাইকে হারানো কাঠি খোঁজার অনুরোধ করেন। শিসদার বংশীধারীও কাঠি খোঁজার কাজে খুব সহজেই যোগ দেয়। অগত্য উপেং পুরোহীতও দ্বীপরাষ্ট্রে বসবাসের আশায় সবার সঙ্গে কাঠি খোঁজায় যোগ দেয়।
কোনো এক দ্বীপবাসী যখন সেই কাঠি খুঁজে পায়, নিবেদিকার মাধ্যমে সেই কাঠি হাতে পেয়ে মোড়ল মাটিতে একটি বিন্দু নির্দেশ করে ঘোষণা করেন, এখানেই এই পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। অন্যদের তখন মোড়লের ঘোষিত কথায় সন্দেহ হয়। এক এক করে তারা একজন অপরের কাছ থেকে কাঠি কেড়ে নিয়ে নিজেদের পছন্দমত জায়গায় কাঠি পুতে সেই বিন্দুকে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু দাবি করতে থাকে। আবারো তাদের মধ্যে চিরায়ত কলহ, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, দ্বন্দ্ব জেগে ওঠে।
ঘটনা পরম্পরায় দাগী কয়েদি খুঁজে পায় এক পাহাড়ি ঢুলিকে। ঢুলিকে সঙ্গে নিয়ে সে আসে বন্ধু শিসদার বংশীধারীকে গান শোনাতে। ঢুলির বাজানো তুমুল বাদ্য আর গানের মাঝে শিসদার বংশীধারী জীবনের এক পরম সত্যকে উচ্চারণ করেন। সহজ, সরল দ্বন্দ্বহীন জীবনই অর্থময়, বাকি সব মিথ্যা, অলীক। মানুষের মাঝে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, কলহ, সংঘর্ষ, যুদ্ধ পরম জীবনের কাছে অর্থহীন। গোটা দ্বীপবাসী তখন উপেং পুরোহীতের দেখানো অলীক আজগুবিকে প্রত্যাখ্যান করে শিসদার বংশীধারীর উচ্চারিত নতুন সহজ, সরল পরম আনন্দময় জীবনের দিকে বিনাবাক্য ব্যয়ে ঝুঁকে যায়। এখানেই 'কালবেলা' নাটকটি জীবনের পরম সুন্দরের উপলব্ধির কথা দর্শক শ্রোতাদের নাটকীয় রহস্যময়তা ও জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে মর্মবাণী শোনায়।
অ্যাবসার্ড নাটকে যে চরম জাদুবাস্তবতা, বিচিত্র ঘটনা পরম্পরা, দৃশ্য, বাক্য, বর্ণ ও সংলাপে এক ঘোরলাগা রহস্য সৃষ্টি করে, তা যেন শেষপর্যন্ত জীবনের পরম সত্যকে অনুসন্ধান করার দিকে গোটা মানবজাতিকেই প্রলুব্ধ করে। সাঈদ আহমদ 'কালবেলা' নাটকে যে দ্বীপবাসীর গল্প শোনান, তা যেন গোটা বিশ্বজগতেরই প্রতিনিধিত্ব করে মানুষকে অনর্থক জীবনের পেছনে না ছুটে অর্থময় জীবন গড়ার প্রতি অবগাহনের আহবান জানায়।
পালাকারের 'কালবেলা' নাটকের দশম শো দেখার পর আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, নাটকটি অত্যন্ত বাস্তবধর্মী এই জগতসংসারের অন্তসারের আড়ালের কথাকেই ফুটিয়ে তোলে। শিসদার বংশীধারী চরিত্রে নূরী শাহ যদিও আমাকে কিছুটা হতাশ করেছেন। তার স্বাভাবিক অভিনয় দক্ষতা ও চৌকশ নাটকে কিছুটা যেন অনুপস্থিত ছিল। যা গোটা নাটকের কেন্দ্রবিন্দুতে একটা ঘাটতি মনে হয়েছে। উপেং পুরোহীতের চরিত্রে আমিনুর রহমান মুকুল চমৎকার অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে তার ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রপড়া ও নতুন স্টাইলে হাঁটার ব্যাপারটি চরিত্র হিসাবে কিছুটা ঘোর লাগায়। ঝোলা থেকে ছলনা ছোড়ার কৌশলটি দারুন। তবুও কোথায় যেন কিছুটা ছন্দপতন ছিল, সেটা কী সংলাপ না মুভমেন্ট না অন্যদের চৌকশ অভিনয়ের ঘাটতি থেকে উত্থিত কিনা বোঝা মুশকিল!
নিবেদিকা চরিত্রে ফারহানা মিঠু দারুন অভিনয় করেছেন। কিন্তু মুকুলের মত তারও কোথায় যেন একটা ঘাটতি অনুভব করেছি। মোড়ল চরিত্রে শাহরিয়ার খান রিন্টু ও তার দুই বন্ধু'র চরিত্রে কাজী ফয়সল ও নিপুন আহমেদের অভিনয়েও সেই জৌলুসটা ধরা পড়েনি! বরং স্বল্প সময়ের উপস্থিতি হলেও ঢুলি চরিত্রে অজয় দাশ বাজি মাত করেছেন। দাগী চরিত্রে সেলিম হায়দারের মধ্যে গতি জড়তার অভাব ছিল। পার্ষদ ও দ্বীপবাসীদের ভেতর থেকে সেই জড়তা ও ছন্দহীনতার আগমন কিনা সেটা বলা মুশকিল!
'কালবেলা'র মঞ্চ পরিকল্পনা যতটা না আমাকে মুগ্ধ করেছে, আলোকসজ্জা ঠিক যেন ততটা হতাশ করেছে। মঞ্চের আকার বা কাঠামোকে আমার কখনো মনে হয়েছে এটা বুঝিবা স্রেফ একটা মাকড়শার জাল! যেখানে সমাজের হাজারো দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, কলহ, সংঘর্ষ, হাসি, ঠাট্টা, প্রেম, বন্ধুত্ব যেভাবে জালের মত পরম্পরা জড়িত, এই মাকড়শার বাসা বুঝিবা সেই রূপক জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। আবার কখনো মনে হয়েছে এটা বুঝি পৃথিবীর ভূগোলের সেই গোলক। কল্পিত দ্বীপের আড়ালে যা গোটা বিশ্বকেই উন্মোচন করেছে। তবে নাটকের কাহিনী ও জনগোষ্ঠীর জীবনাচারের সঙ্গে মিলিয়ে যদি সেখানে কোনো কাঠের নৌকার উপস্থিতি থাকতো, বা কিছু মাছ ধরা জালের দৃশ্যমানতা থাকতো তাহলে হয়তো তা আরো জীবনঘনিষ্ঠ হতে পারতো! কিংবা দু'একটা বাবুই পাখির বাসা যদি কোথাও ঝুলে থাকতো! কারণ দ্বীপবাসী হয়তো সমুদ্রে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে।
অ্যাবসার্ড নাটকে আলো নিজেই একটি শক্তিশালী ক্যারেক্টার। আলোর নাচন যতটা রহস্যময় হবে, নাটকের পাত্রপাত্রী, ঘটনা পরম্পরা, দৃশ্যের পর দৃশ্য ততই দর্শক-শ্রোতাদের মনোজগতে ধাধার ঘোর লাগাবে। আলো'র সেই খেলাটার কিছুটা ঘাটতি আমি অনুভব করেছি। অথবা হতে পারে নাটকের নির্দেশক আলো'র চেয়ে বাস্তবের চরিত্রগুলোকে আরো বেশি জাদুবাস্তবতার ঘেরাটপে আটকাতে চেয়েছেন। তবে আলোক পরিকল্পনায় আরো একটু মনোযোগী হবার দাবি রইল। 'কালবেলা' নাটকের মিউজিক ডিজাইন চমৎকার। কিন্তু পারফর্মারদের পরিবেশনায় কোথায় যেন সুস্পষ্ট কিছু ঘাটতি অনুভব করেছি। পাশাপাশি নৃত্য পরিবেশনে তাল, লয়, ছন্দ, গতি আরো যতটা চৌকশ হওয়া উচিত, তত ভালো। এই জায়গায় হয়তো প্রশিক্ষণের ও নিয়মিত অনুশীলন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই!
তবে এই কথাগুলো কেবল চূড়ান্ত পারফেকশনের কথা বিবেচনা করেই বলা। এমনিতে পালাকারের পরিবেশনা সবসময় দর্শক শ্রোতাদের উপেং পুরোহীতের মত জাদুমন্ত্রে মুগ্ধ করে। 'কালবেলা'ও হাউজফুল দর্শকের চিত্ত আকর্ষন করেছে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। 'কালবেলা' নাটকে মোড়লের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহরিয়ার খান রিন্টু, মোড়লের দুই বন্ধু আহম্মদ চরিত্রে কাজী ফয়সল ও মুনীর চরিত্রে নিপুন আহমেদ। ঢুলী চরিত্রে অজয় দাশ, দাগী চরিত্রে সেলিম হায়দার, শিসদার বংশীধারী চরিত্রে দোস্ত মোহাম্মদ নূরী শাহ, উনেন চরিত্রে লিয়াকত লিকু। আর নিবেদিকা চরিত্রে ফারহানা মিঠু ও উপেং চরিত্রে আমিনুর রহমান মুকুল অভিনয় করেছেন।
'কালবেলা' নাটকটির রচয়িতা বিশিষ্ট নাট্যকার সাঈদ আহমদ। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন আমিনুর রহমান মুকুল। নির্দেশনা উপদেষ্টা ছিলেন নাট্যজন আতাউর রহমান ও মঞ্চ উপদেষ্টা ছিলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। নাটকটির মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন অনিকেত পাল বাবু, আলোক পরিকল্পনায় ছিলেন ঠাণ্ডু রায়হান, আবহ সংগীত পরিকল্পনায় অজয় দাশ, কস্টিউম ডিজাইন করেছেন লুসি তৃপ্তি গোমেজ। মঞ্চ থিয়েটারে পালাকার সবসময় ভিন্নধর্মী নাটক নিয়ে দর্শকের হৃদয় জয় করে। পালাকারের 'কালবেলা' অ্যাবসার্ড নাটকটিও হাউজফুল দর্শককে আলোড়িত করেছে বলেই আমার বিশ্বাস। 'শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়'-এর মত পালাকারের 'কালবেলা' নাটকটি ভবিষ্যতে আরো চৌকশ পরিবেশনায় সবাইকে জীবনের পরম সত্যকে অনুধাবনের নিরন্তর সঙ্গী করবে এই কামনা করি। জয়তু পালাকার। জয়তু মঞ্চ নাটক।
.......................
২৩ মে ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৬ ভোর ৬:৪৩