আমরা যখন শাবিতে ভর্তি হলাম তখন এর ছোট ছোট টিলা আর সবুজ প্রকৃতি দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। এত সুন্দর আমাদের ক্যাম্পাস! সাথে ছোট্ট একটা হা-হুতাশও ছিলো। এত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত ক্যাম্পাসে বিভিন্ন বিষয়ের ছাত্র সংগঠন আছে, কিন্তু একটাও প্রকৃতি বিষয়ক সংগঠন নেই! হা-হুতাশ বেশী দিন করতে হয় নি, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ‘গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটি’র জন্ম আমাদের সে আক্ষেপ দূর করেছে।
সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমি একটি প্রকৃতি বিষয়ক সংগঠনের কাছ থেকে যেটুকু প্রত্যাশা করেছিলাম, গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটি গত প্রায় দুবছর ধরে তার চেয়েও অনেক বেশী করে যাচ্ছে। এই সংগঠনের যে জিনিসটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হলো - তারা সত্যিকার অর্থেই জীবন ও প্রকৃতিকে অনুভব করে। শুধু ‘করার জন্য করা’ এজন্য তারা সংগঠন খুলে বসে নি। জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা অনেক স্মার্ট আর প্রগতিশীল একটা কাজ, সব মহল থেকে সহজেই ধন্যবাদ পাবার মত কাজ। গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটির এতদিনের কাজকর্ম দেখে এটাই মনে হয়েছে তারা ভাব নেয়ার জন্য, স্মার্ট সাজার জন্য বা ধন্যবাদ পাবার জন্য লোক দেখানো কাজ করে না। তারা অন্তর থেকে প্রকৃতিকে অনুভব করে; এবং জীবন ও প্রকৃতির কল্যাণের জন্য তারা সবসময় আন্তরিকভাবে কাজ করে যেতে চায়।
এই তো মাত্র অল্প কিছুদিন আগে তারা বিক্রির জন্য ধরে আনা ৮ টি বক শহরের পাঠানটুলা থেকে পুলিশের সহায়তায় উদ্ধার করে, তারপর পুলিশের উপস্থিতিতে ক্যাম্পাসে বকগুলোকে অবমুক্ত করে। আর আজ চারদিন হলো তারা অর্জুনতলায় আয়োজন করেছে অভিনব এক প্রদর্শনীর। সাপের আলোকচিত্র প্রদর্শনী। ছয়দিনব্যাপী এই প্রদর্শনী চলবে আগামী চার তারিখ পর্যন্ত। প্রদর্শনী শুরু করেই তারা রেকর্ডের খাতায় নাম তুলে ফেলেছে। বাংলাদেশে এত এত বছর ধরে এত এত বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে, কিন্তু শাবি’র গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটির করা এই প্রদর্শনীটিই সাপের আলোকচিত্র নিয়ে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে করা প্রথম কোন প্রদর্শনী।
প্রদর্শনীতে জায়গাটা সাজানো হয়েছে দারুণ বুদ্ধিদীপ্তভাবে। প্রবেশ মুখেই বাঁশ আর কাপড় দিয়ে তৈরি করা বিশাল একটা সাপের মাথা! জিভ বের করে আছে। পুরো প্রদর্শনীর জায়গাটা সাপের মত আঁকাবাঁকা – খেয়াল করলেই দেখা যাবে প্রদর্শনীর জায়গাটা আসলে বিশাল একটা সাপ।
প্রথম দিন প্রদর্শনীতে যাবার পথে ক্যাম্পাসের এক পরিচিত জুনিয়র মেয়ের সাথে দেখা হল, বললাম, 'চল্ সাপ দেখে আসি।'
সে বলল, 'আমি আগেই দেখে এসেছি ভাইয়া। সাপগুলা যা কিউট!'
আমি মনে মনে মুসা আমানের মত করে বললাম, 'খাইছে আমারে!' এই মেয়ে বলে কি! সাপ কিউট?
বেশ কিছু সাপের ছবি সুন্দর ফ্রেমে করে প্রদর্শনী স্থলে সারিবদ্ধভাবে ঝোলানো। ছবিগুলো তুলেছেন বাংলাদেশ, ভারত আর আমেরিকার আলোকচিত্রীরা। প্রতিটা ছবির সাথে সাপগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া। সেখানে স্বভাব, বাসস্থান, খাদ্য, প্রয়োজনীতার সাথে বড় করে লেখা সাপটি বিষাক্ত না, অবিষাক্ত। বিষাক্ত হলে লাল কালিতে লেখা বিষাক্ত। আর অবিষাক্ত হলে সবুজ কালিতে লেখা অবিষাক্ত। মেয়েটির কথা মিথ্যে ছিলো না, বা কথায় মেয়েলি আবেগ ছিলো না। সাপগুলো আসলেই দেখতে ‘কিউট’ লাগছিলো। এতে ক্যামেরাম্যানের যেমন অবদান আছে, তবে বেশী অবদান অবশ্যই রয়েছে সাপের সৌন্দর্যে!
লাউডুগি সাপ, কালনাগিনী সাপ, কেউটে সাপ- এদের কথা এত বই-পত্রে এত পড়েছি, এত শুনেছি যে দেখার খুব ইচ্ছা ছিলো। গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটির কল্যাণে এই প্রথমবারের মত তা দেখার সুযোগ হলো। আগে ভাবতাম কেউটে আর গোখরা বুঝি একই সাপ। আসলে ভিন্ন ভিন্ন দুটি সাপ। প্রদর্শনীতে এসে ভুল ভাঙ্গলো।
লাউডুগি সাপ সম্পর্কে গল্প শুনেছি, সবুজ রঙ্গের চিকন এই সাপ লাউগাছের সাথে মিশে থাকে। একবার এক মহিলা যখন ভুল করে লাউয়ের ডগা মনে করে ছিড়তে লেজে টান দেয় সাথে সাথে লাউডুগি সাপটা মহিলাটিকে কামড়ে দেয়। আর মহিলাটি প্রবল বিষে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। কিন্তু প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখলাম লাউডুগি সাপ অবিষাক্ত সাপ। তার মানে গল্পটি একটি গালগল্প ছিলো। তবে সব চেয়ে অবাক হয়েছি কালনাগিনীর বিষ নেই জেনে! ছোট বেলায় বাংলা সিনেমায় যে ভয়ঙ্কর বিষাক্ত কালনাগিনী সাপ দেখতাম আসলে তা নাকি অবিষাক্ত! ভাবা যায়? তবে কালনাগিনী সাপ দেখতে অনেক সুন্দর। কালোর মধ্যে সাদা সাদা লাল লাল দাগ। দেখলে মনে হয় ছোটদের খেলনা সাপ।
কালনাগিনীর পরেই আমার কাছে সুন্দর লেগেছে পাহাড়ি সাপের ছবিটি। সাপগুলোর পরিচিতি পড়ে জানতে পারলাম সাপেরা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য, ইঁদুর মেরে ফসলের ফলন বাড়ানোর জন্য, এমনকি বিষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঔষধ তৈরির জন্য তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
সে দিন প্রদর্শনীতে সাপের ছবি দেখছিলাম। এমন সময় কলকল খলখল করতে করতে 'কিন' স্কুলের গোটা সাত আটেক ছোট ছেলেমেয়ে প্রদর্শনীর জায়গায় ঢুকলো। ঢুকেই তারা জায়গাটা চঞ্চল করে ফেললো। ছবি দেখতে দেখতে সশব্দে বিস্ময় প্রকাশ করছিলো, একজন আরেকজনকে টেনে নিয়ে আরেক প্রান্তের কোন সাপের ছবি দেখিয়ে আনছিলো, পরিচিত কোন সাপ দেখে ‘এইটা আমাদের বইতে আছে’ বলে চেঁচিয়ে উঠছিলো, ‘ঐ সাপটা আমি একদিন আমাদের বাড়ীর পিছনে জংগলে দেখেছি’ বলছিলো, তারপর তারা শুরু করলো কোন সাপ বেশী সুন্দর সে বিষয়ে মন্তব্য করা। একজন একটা সাপকে সবচেয়ে সুন্দর বলে ঘোষণা দেয়, তখন আরো কয়েকজন তার প্রতিবাদ করে অন্য একটি সাপকে সবচেয়ে সুন্দর সাপ বলে ঘোষণা দেয়। প্রথমজন মানতে চায় না বলে তারা তাকে টেনে নিয়ে যায় তাদের কাছে সবচেয়ে সুন্দর সাপের কাছে- সে দেখুক, দেখে তুলনা করে নিক কোন সাপ বেশী সুন্দর! এভাবে বেশ কিছুক্ষণ হুটোপুটি চলল। আমি চিন্তা করলাম, অনিমেষ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা এই ব্যতীক্রমধর্মী প্রদর্শনীর আয়োজন করে পুরো মাত্রায় সফল। ছোট ছোট বাচ্চারা সাপের ছবি দেখতে দেখতে কোন সাপ বেশী ভয়ঙ্কর এটা নিয়ে তর্ক করছে না, তারা তর্ক বিতর্ক করছে কোন সাপ বেশী সুন্দর এই নিয়ে। পরিবর্তনটা কি টের পাওয়া যায়?
কালকে ক্যাম্পাসে আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটবে। গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটির আমন্ত্রণে ক্যাম্পাসে আসবেন বিজ্ঞানী তানিয়া খান। বিজ্ঞানী তানিয়া খানের অনেক অর্জন -
১. বাংলাদেশে হাত-পাবিহীন উভচর প্রানি 'চিকিলা' তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন।
২. 'ওয়ারটি ফ্রগ' নামক এক প্রকার ব্যাঙের সন্ধান তিনিই প্রথম পান।
৩. সারা বাংলাদেশে কয়েকজন ব্যক্তি আছেন যারা 'সাপ' নিয়ে গবেষণা করেন, তিনি তাদের একজন। মেয়ে হিসেবে চিন্তা করতে গেলে তিনি একমাত্র!
০৩-১০-২০১৩, বৃহস্পতিবার বিকেল ৫-১৫তে ‘এ’ বিল্ডিং-এর গ্যালারি রুমে আয়োজিত হতে যাওয়া সেমিনারে তিনি জানাবেন কীভাবে তিনি সাপ নিয়ে কাজ করা শুরু করলেন, মেয়ে হিসেবে কী কী বাধা তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে, জানিয়ে দিবেন কীভাবে বিষাক্ত সাপ চিহ্নিত করতে হয় এবং জানাবেন সাপ ধরার কিছু সাধারণ কৌশল।
গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটির জন্য শুভকামনা। অনেক দূর এগিয়ে যাও গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটি।