বিগত দুই দশকে অর্ধেকের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা এই বিএনপিকে লাশ বলতে হচ্ছে কেন, প্রশ্ন উঠতেই পারে। প্রশ্নটির উত্তর এতোকাল স্পষ্ট না হলেও এ বছর এটি তীব্রভাবে স্পষ্ট হয়ে গেছে। পার্লামেন্ট, রাজনীতি, সমাজ এবং ব্যক্তিজীবনেও সর্বহারা হয়ে গেছে বিএনপি। এক দিনে এমনটি হয়নি, মূলত অপরিপক্ক সিদ্ধান্তেই ভেস্তে গেছে মহাপরাক্রমশালী এই দল। হয়তো, উদ্যানের সেই সুসজ্জিত ব্যয়বহুল কবরেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না শহীদ জিয়া। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অপরিসীম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, শ্রদ্ধা নয়, করুণার জন্য তিনি ভিক্ষুকের মতো হাত বাড়িয়ে আছেন- এ দৃশ্য দেখে পাথর মনের কোন মানুষ চোখের পানি ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না, অন্তত আমি পারিনি।
কেউ সাংগঠনিকভাবে বিএনপি করে, কেউ শুধুমাত্র ভোট দেয়/ফায়দা নেয় আর কেউ শুধুমাত্র সমর্থন করে। আমি অতি সাধারণ একজন সমর্থক হলেও সম্প্রতি বিএনপির উপর থেকে আমার সকল প্রকার সমর্থন ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছি। মূলত ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে তাদের অবান্তর আস্ফালন আমাকে সবচে বেশি ব্যথিত করেছে।
ইলিয়াসের প্রতি আমার এক্সট্রা সমর্থন কিংবা ঘৃণা কখনোই ছিলো না। ঢাকা রিজেন্সীর’র শীশাওয়ার্ল্ড-এ মাঝেমধ্যে তার সাথে সাক্ষাৎ হতো, কেমন যেন বালকসুলভ আড্ডা দিতেন। সিলেট লংমার্চে ‘ক্ষমতায় গেলে তাদেরকেও (ক্ষমতাসীন) ডান্ডাবেরি পরানো হবে’Ñ কথাটি শুনে আমার কাছে মনে হয়েছিলো, ইলিয়াসদেরকে সামনের সাড়িতে নিয়ে এলে হয়তো ঘুরে দাড়াতে পারবে বিএনপি। না, হলো না, খালেদা জিয়া নির্ভর করে চললেন মরা সব লিডারদের (মির্জা ফখরুল, ড. মোশাররফ প্রমুখ)।
বাংলাদেশের আধুনিক গণতন্ত্রের ইতিহাসে সরকারীদল ও বিরোধীদলের মহাসচিবদের মধ্যে সবচে মদনমহাসচিব হচ্ছে মির্জা ফখরুল। মান্নানভূইয়া বেঈমানি করলেন, দেলোয়ার চলেই গেলেন। স্বভাবতই বিএনপি চাপের মুখে পড়ে যায়। এমতাবস্থায় একজন কঠোর মহাসচিবের প্রয়োজন ছিলো বিএনপি’র। যিনি ম্যাডামকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করবেন এবং ম্যাডামের নির্দেশকে যথাযথভাবে বিএনপি’র সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে কার্যকর করবেন। অতর্কিতে যখন ফখরুলকে মহাসচিব (ভারপ্রাপ্ত) বানিয়ে বসলেন, অবাক হলাম, হাস্যকর। মহাসচিব কেমন হওয়া উচিত, এটা বোঝার ক্ষমতাও কি এখন আর ম্যাডামের নেই! হতে পারে তিনি ভয়ঙ্করভাবে বিপর্যস্ত, ঘরছাড়া-সন্তানহারা। তাই বলে নুনের জায়গায় তো চিনি খাবেন না। তাহলে, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় মহাসচিবের বেলায় এমন আত্মবিরোধী কাজ করলেন কেমন করে। শুদ্ধভাষায় সুন্দর করে কথা বলা, দেখতেও সুন্দর, সুশিক্ষিত, সার্বিকভাবে মার্জিত এবং নম্রভদ্র- এমন লোককে আর যা-ই হোক, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় মহাসচিব বানাবেন না কোন মূর্খও।
হতে পারে ম্যাডাম এখন আর স্বাধীন নন। একার বুদ্ধিতে তিনি কিছুই করতে পারেন না, বিলেত থেকে বাধ্যতামূলকভাবে বুদ্ধি গ্রহণ করতে হয়, জোট থেকেও নিতে হয় কিছু আর আশপাশ থেকেও একটু/আধটু। এসব বিচিত্র জায়গা থেকে বুদ্ধি নেওয়াটা দোষের কিছু নয়, বরঞ্চ উপকারী। অন্তত বুদ্ধি যারা দেন, তাদের মন-মানস, কৃতকর্ম তো একটু দেখে নিলেই পারেন।
জামাতের সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠীর ৩০ বর্ষপূতি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মাহমুদুর রহমান। কতো পার্সেন্ট জামাত করলে মানুষ এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হতে পারে! মাহমুদুর রহমানের জন্য তো পুরো বিএনপিটাই দান করে দিয়েছেন খালেদা জিয়া। মোসাদ্দেক আলী ফালু’র হাত থেকে যখন আমার দেশ ফসকে যাচ্ছিলো, তখন পয়সাওয়ালা কোন বিএনপি’র ব্যবসায়ীকে পত্রিকাটি কেনানো যায়নি। অবশেষে পত্রিকাটি গেলো মাহমুদুর রহমানের খপ্পরে। এ পত্রিকা কিনে মালিক পক্ষ আওয়ামীলীগ-বিএনপি আউট করে প্রচুর জামাতি ব-কলমদের রিক্রুট করলো। পত্রিকার সর্বশক্তি দিয়ে জামাতকে প্রমোট করে গেলো এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পত্রিকাটির সার্বজনীন শ্লোগান পরিবর্তন করা হলো ‘সবার কথা বলে’ থেকে ‘স্বাধীনতার কথা বলে’। সরকার সজ্ঞানে একটা পর্যায়ে পত্রিকাটি বন্ধ করে মাহমুদুরকে অ্যারেস্ট করে। তাৎক্ষনিক পুরো বিএনপি পরিচালিত হয় লোকটাকে বাচাতে। এ ব্যাপারে খুব তেজস্বী অন্দোলন সংগ্রাম বিএনপি করলো। অথচ এমনভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করলে সাহারা-কামরুলরা এতোদিন ক্ষমতায় থাকতে পারতো না।
শফিক রেহমানের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ মাহমুদুর রহমানের জন্য ডিবি অফিসের পাশে রাত করে ফুটপাতে বসেছিলেন। আমরা যারা রেহমান সাহেবকে মাত্রাতিরিক্ত পছন্দ করি, তার রোম্যান্টিক ইচ্ছাকে অ্যাপ্রিসিয়েট করি, তারা সত্যিকার অর্থেই লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম- এতো বড়ো লজ্জায় আমাদেরকে ফেলতে পারলেন স্যার? ১/১১’র সুযোগে যিনি মালিক/সম্পাদক হয়েছেন এবং জামাতের পক্ষ থেকে বিএনপিতে দালালি করছেন, সে লোকটা জন্য শফিক সাহেব একমুহূর্ত ব্যয় করুক, সেটা কখনোই চাইনি, কেউই চায় না।
নয়াদিগন্তে নিজামীর ছবি যেখানে ছাপা হয় দুই কলামে, সেই নিউজ আমার দেশ-এ ছাপা হয় তিন কলামে। এ পত্রিকার প্রধান অর্থ-যোগানদাতা তাসনীম জামাতের কী, এটা সবাই ভালো করেই জানেন। বড়ো বড়ো বিএনপি’র সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী জামাতের অর্থে একটু ভালো জীবনযাপনের চেষ্টা করেন। সকল পত্রিকা যখন লেখা ছাপা বন্ধ করে দেয় তখন, শাহ আবদুল হান্নানদের মতো খাটাশদের সাথে তাল মিলিয়ে লেখা চালিয়ে গেছেন ফরহাদ মজহার, ধীরে ধীরে জামাত-প্রভাবিতও হয়ে উঠলেন। আর এই জামাত করা হিযবুত করা ভন্ড দার্শনিকের উপদেশ বিএনপি’র কেন দরকার হয়! মীর কাসেম আলীর রিক্রুট করা রোকন আজ ম্যাডামের অঘোষিত উপদেষ্টা, এ অপদার্থের সাথে পরামর্শ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে ম্যাডাম!
২০০১-২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির প্রভাবশালী মন্ত্রীরা কোন এক কারণে বারবার জামাত শিবিরের প্রোগ্রামে অতিথি হয়েছেন। ড. মোশাররফের তো একপ্রকার অভ্যাসেই পরিণত হয়েছিলো জামাতের প্রোগ্রামে যাওয়া। এই কাতারে উৎসাহী আরেকজন আছেন, তিনি জমিরউদ্দিন সরকার। আরো অনেকেই আছেন, একটু কম গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করছি না। আমি নিশ্চিত বিএনপির প্রথম শ্রেণীর অন্তত অর্ধেক নেতা মৃত্যুকালে অসিয়ত করে যাবেন, মগবাজারের সংগ্রাম অফিসপ্রাঙ্গনে যেন তাদের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়...।
জোটকে ৪ থেকে ১৮তে রূপান্তরিত করলো বিএনপি। ৪টি ব্যাতীত ১৪ দলের প্রধানই ভবিষ্যৎ নির্বাচনে জামানত হারাবেন, এ কথা নিশ্চিন্তে বলা যায়। হুজুরদের বড়ো জমায়েত দেখে আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, তাদের জনশক্তিটা এখন ২০০১-এর জায়গায় নেই। মাদরাসার ছাত্রশিক্ষকরা বুঝে গেছেন, তাদের আন্দোলন-রক্তের উপর দিয়ে আমীনীদের গাড়ী হয়, বাড়ী হয়- বৃহৎ মসজিদ-মাদরাসাসমাজের কোন লাভ হয় না। আর ১৮ দলের কয়েকটি দলই চলে জামাতের টাকায়। ইরান নামে একজন লিডার আছেন জোটে, যিনি ভাতটাও খান জামাতের টাকায়।
... কথা অনেক বলার আছে, বন্ধুবান্ধবের সাথে বলি, কিন্তু সবজায়গায় বলা যায় না। আজ কিছু বলে ফেললাম, নরমাল গাড়ী পোড়ানোর মামলায় বৃহৎ বিএনপি’র ব্যর্থতা দেখে। তারপরও প্রিয় বিএনপি’র প্রতি আমার বিরক্তির মাত্রাটা অনুভব করে একটি প্রসঙ্গ বলে শেষ করবো। দেশের সকল প্রকার রাজনীতিকই ১/১১’র রোষানলে পড়েছে, উইদাউট মাহমুদুর রহমান। এই সময়টাতেই তিনি লেখক হয়েছেন, পত্রিকার মালিক হয়েছেন, সম্পাদক হয়েছেন। যদি কেউ বলেন, মাহমুদুর রহমান খুবই সৎ। তাহলে বলবো, হাসিনা-খালেদা কি তাহলে অসৎ? যদি বলেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এ দুই মহিয়সী নারী ১/১১’র চক্রান্তের শিকার, তাহলে বলবো ‘মাহমুদুর রহমান কী এমন সুপ্রীম পাওয়ার যে তার বিরুদ্ধে ১/১১ ওয়ালারা কোন চক্রান্তও করতে পারলো না’! ... নাকি সেই অন্ধকার সময়ে তৎকালীন উদ্দীনসমূহের সাথে মাহমুদুর রহমানের বিশেষ কোন আতাত হয়েছিলো ...!
পরিশিষ্ট : ম্যাডাম, ১০০% দেশের জন্য রাজনীতি করুন। জামাতের হাত থেকে দেশকে বাচানোর লড়াইয়ে আপনিও শামিল হোন। পুরোপুরি জামাত ছেড়ে দিন। বিএনপি থেকে জামাতের সকল দালালকে বহিষ্কার করুন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১২ দুপুর ১:০৮