চিত্রা নদীর পাড়ে, নদীর নাম মধুমতি, লালসালুর মত নামকরা বাংলা চলচ্চিত্রের পরিচালক তানভীর মোকাম্মেলের নতুন কাজ এই রূপসা নদীর বাঁকে। মানবরতন মুখোপাধ্যায় নামে একজন কমিউনিস্ট পার্টির নেতার জীবনের গল্প এটি। একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদের যাপিত জীবনের গল্প হোক কিংবা সাধারণ মানুষের গল্পই হোক সময়ের ঘটনাপ্রবাহ, জনজীবন, বিপ্লব, বিদ্রোহ, আন্দোলন, প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তির সম্মিলনে সেটা একটা নির্দিষ্ট সময়কালের গল্প হয়ে যায়। মানবরতন মুখোপাধ্যায়ের গল্পটাও শুধু তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, পার্টি আর দেশের গণমানুষের জন্য জীবনের সুখ-দু:খ এক করে ফেলা নেতার জীবনের কাহিনীটা আরো বেশি করে সময়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে যাবেই। তানভীর মোকাম্মেলের মত গুণী পরিচালকের হাত ধরে সেই জীবন, সেই সময়টা জীবন্ত হয়ে ওঠে দর্শকদের টাইম ট্র্যাভেল করিয়ে নেয়। পুরো নির্মাণটা দর্শকদের এর সাথে একাত্ম করিয়েই ছাড়ে। এই চলচ্চিত্রটি ইতিহাসের অনেক বেশি বাস্তবঘেষা বয়ানের ভালো উদাহরণ হয়ে থাকবে বলেই মনে করি।
১৯৩০, মূলত ১৯৩৫-৩৬ সময়কাল থেকে একাত্তরের শুরু পর্যন্ত সমকালের ঘটনাপ্রবাহ, মূলত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ।বাংলাদেশের কিংবা ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে যারা লেখেন বা সিনেমা বানান তাদের কাছে এই এলাকার কমিউনিস্ট আন্দোলনটা অবহেলিত হয়েছে অনেক, কিংবা একেবারে অবহেলিত না হলেও বলতে গেলে দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের অবদানের ব্যাপারটা বেশিরভাগ নির্মাতাই এড়িয়ে যান বলতে হয়। সেক্ষেত্রে একজন কমিউনিস্টকে নিয়ে মুভি করা বৃত্তের বাইরের চিন্তার ফসল বলতে হবে।
১৯৩৫-১৯৭১ এর মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনের আঁচ এসে গায়ে লাগবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানীদের ভয়ে গ্রামের মানুষের নৌকা পুড়িয়ে দেয়া, বিশ্বযুদ্ধের ফলে ৪৩ সালের দূর্ভিক্ষ, তেভাগা আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, এরপর ৪৬ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ৪৭ এর দেশভাগ, সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ, ৫২র ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট(বাংলার মানুষের অধিকারের চেয়ে নেতাদের মন্ত্রীত্বের দাবী বড়), ৫৮ সালে আইইয়ুব খানের মার্শাল ল, জননিরাপত্তা আইনে বিপ্লবীরা বন্দী, আইয়ুবের পতনের পর রাজবন্দীদের মুক্তি, ৭০ এর নির্বাচন, শেষমেশ ৭১ সালের সর্বাত্মক মুক্তি সংগ্রাম সবকিছুর মাঝে একটা চিন্তার স্রোত শিরার ভেতরে রক্তের ধারার মত বয়ে যায় - 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই। '
থিওরি বনাম মানুষ,
পার্টি বনাম মানুষ
পাকিস্তান বনাম মানুষ
ক্ষমতা বনাম মানুষ
ধর্ম বনাম মানুষ
পাকিস্তান আর ইসলাম কী সমার্থক?
এমন সব দ্বান্দ্বিক অবস্থানের মধ্যে দর্শকদের ফেলে দিয়ে তার মধ্য থেকে সঠিক পন্থাটা বের করে আনেন পরিচালক। এই বিষয়টা সব আর্ট, সব আর্টিস্টের জন্যই প্রকাশের একটা খুবই ভালো অস্ত্র।
.
হ্যা, গল্পটা মানবরতন মুখোপাধ্যায়ের, গল্পটা রূপসা নদীর তীরবর্তী খুলনার মানুষের, গল্পটা নদীর সর্বোপরি সময়ের, রাজনীতির।সময়ের রূঢ় ঘটনাপ্রবাহ মানুষের উপর কী প্রভাব রাখে তা দেখতে গেলে তৃণমূলের মানুষের কাছে গেলে সত্যটা ভালো বোঝা যায়, রাজধানীর নেতাদের থেকে তো সকলেই দেখান, গ্রামের মানুষের লেন্সে এইসব ঘটনার ঘূর্ণাবর্তটাকে আবার নতুন করে দেখে নেয়াটা জরুরি। রূপসা নদীর বাঁকে আমাদের সেইটাই দেখায়।
.
কমিউনিস্ট দলগুলোর জনবিচ্ছিন্নতা এখন যে পর্যায়ে সেই সময় তাদের অবস্থান অতটাও খারাপ ছিলোনা, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তাদের জনসম্পৃক্ততা অনেক ভালো প্রভাব রেখেছে। সিনেমাতেও তার বেশ ভালো চিত্রায়ন ছিলো। আবার বাংলাদেশে কমিউনিজমের চীনপন্থা ও রাশিয়াপন্থায় বিভাজনের চিত্র এবং জনবিচ্ছিন্নতার কিছু কারণ এখানে উপস্থাপন করেছেন। মানববাবুর এক সহ-কমরেড গ্রামে গিয়ে সহজবোধ্য আর প্র্যাকটিকেল ভাষা ব্যাবহার না করে থিওরি নির্ভর আলাপটার পর গ্রামের চাষীদের থেকে 'আপনার চশমার পাওয়ার কত?' - র মত প্রশ্নটা এই বিচ্ছিন্নতার প্রতি একটা তীব্র স্যাটায়ার ছিলো। মানববাবু সেক্ষেত্রে পার্টি বড় বললেও, সাধারণের একজন হয়ে ওঠা, সাধারণের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর দিকে নজর দিলেন বেশি। এরইমাধ্যমে বর্তমান কমিউনিস্ট দলগুলোকে তাদের জনবিচ্ছিন্ন, থিওরি নির্ভর কাল্পনিক ইউটোপিয়ান স্বপ্নে বিভোর না থাকার প্রেরণাও যোগাতে পারে।
.
সিনেমার চিত্রনাট্য, ক্যামেরার কাজ, অভিনয়, মিউজিক সব মিলিয়ে বেশ নান্দনিক উপস্থাপনা বলতেই হবে। মানবরতন মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রে সবচেয়ে বেশি স্ক্রিনটাইম ছিলো জাহিদ হাসান শোভনের, যার সবটাই তিনি তার অনবদ্য অভিনয় দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন। সামান্য কিছু জায়গা বাদে তার অভিনয় একেবারে সাবলিল ছিলো। খায়রুল আলম সবুজ একজন অভিজ্ঞ অভিনেতা হিসেবে আশানুরূপ অভিনয় করেছেন। তাওসীফ জামান তূর্যের অভিনয়টাও চলনসই। মানবের পার্টির অনুসারী এবং থানার ওসির চরিত্রটা সাবলিল ছিলো। আর অনুরাধা চরিত্রটি দিয়ে চলচ্চিত্র জগতে যাত্রা শুরু করা বৈশাখী ঘোষ শুরুটা বেশ ভালো হয়েছে বলতে হবে। চিত্রলেখা গুহকে তার ফর্মে দেখা যায়নি, অনেকটাই খোলসবন্দী লেগেছে।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের পক্ষে যারা কাজ করছিলো তাদের অভিনয়টা অনেকটুকুই মেকী লেগেছে। তারপর জেলখানায় হত্যার দৃশ্যটায় অতিনাটকীতা চলচ্চিত্রটির চাঁদ বদনে কিঞ্চিৎ কলঙ্ক বলা যায়। আরো কিছু খটকার জায়গা ছিলো যেমন ডাকাতিয়া বিলে বাধ দেয়ার সময় জমিদার থেকে কোন প্রবল সক্রিয় বিরোধ নেই বললেই চলে, এইটা স্বাভাবিক লাগেনা। তারপর তেভাগা আন্দোলনের সময় জোতদারদের থেকে কোনরকম সক্রিয় বাধা নেই, পার্টি বললো তেভাগা হবে, হয়ে গেলো? আদতে এত সহজ ছিলোনা তেভাগা আন্দোলনটা। একজন বিপ্লবীর জন্য পারিবারিক বাধাটাও একটা বড় পিছুটান হিসেবে কাজ করে যার তেমন কিছুই সিনেমাতে নেই। তারপর সাধারণ কৃষকের মুখের সংলাপে মাঝেমাঝেই বুর্জোয়া, লেনিন-স্টালিন, কমরেড এর মত শব্দের ব্যাবহার বাস্তবিক লাগেনি। আবার আমার দুইটা খটকার জায়গা হল প্রথমত, দেশভাগের পরের একটা সিনে পাকিস্তানের কারাগারে একজন ইংরেজ বড়কর্তা ভিজিটে আসাটা। দেশভাগের পরে ইংরেজ অফিসার তো এদেশে থাকারই কথা না।
দ্বিতীয়ত, ১৯৭০ এর নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে আওয়ামীলীগ সমর্থিত একটি মিছিলে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীকারের দাবীতে স্লোগান দেয়াটা। আমি বইপত্র পড়ে যতদূর জানি আওয়ামীলীগ যদিও আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বের জায়গাতেই ছিলো কিন্তু ৭১ এর ৭ই মার্চের আগে প্রকাশ্যে তাদের থেকে স্বাধীকারের পক্ষের কোন দাবী তারা করেননি। যাইহোক, এই দুইটা জায়গায় চলচ্চিত্রকার আসলে কি পোর্ট্রে করতে চেয়েছেন সেটা আমার বোধগম্য হয়নি। আমার জানার সীমাবদ্ধতা হতে পারে, চলচ্চিত্রের সীমাবদ্ধতাও হতে পারে। কোন সূত্র থেকে এই দুইটা বিষয় যাচাই করতে পারছিনা।
.
পুরো চলচ্চিত্রে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো ফোকাসে না থাকাটা স্বাভাবিকই ছিলো বলে মনে করি। পুরো সিনেমায় মানব - অনুরাধার মিষ্টি সম্পর্কটা সিনেমার বিপ্লবী আমেজের মাঝে রোমান্টিক আমেজ মিশিয়ে দেয়। তার সাথে 'দূর হতে আমি তারে সাধিব, গোপনে বিরহডোরে বাধিব' - এর মত রবীন্দ্রসংগীত এই আমেজে নতুন মাত্রা এনে দেয়। তারপর অনুরাধার বিয়ের পর মানবের, ' কি গাবো আমি কি শোনাবো আজি আনন্দধামে' গাওয়ার চেষ্টার দৃশ্যটা অনবদ্য। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যাবহার এত সুন্দরভাগে করা হয়েছে যে ভালো না লেগে পারেইনা। সঙ্গীত পরিচালক যিনি ছিলেন তাকে স্যালুট জানাতেই হয়।
.
রূপসা নদীর বাঁকে - তে ইতিহাসের পুনঃনির্মাণে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছে সম্ভবত অতীতের সব ঐতিহাসিক স্থিরচিত্রগুলো। ১৯৪৩ এর দূর্ভিক্ষ থেকে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সবগুলো ঐতিহাসিক ঘটনার স্থিরচিত্র, ক্লিপের ব্যাবহারে ইতিহাসের নির্মাণটা আরো বাস্তব হয়ে ফুটে ওঠেছে। আরো কয়েকটা সিনের কথা না বললেই নয়, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ থেকে ক্যামেরা সরে যেতে যেতে মানব বড় হয়ে যায়, আনন্দমঠের থিওরি থেকে যেন বাড়তি কিছু মানবের মধ্যে আছে। স্বতন্ত্র কিছু, যেটা তার একটা সংলাপের মধ্যে জানা যায়। অনুশীলন সমিতি আর আনন্দমঠই বিপ্লবের শেষ কথা নয়। এর থেকে উত্তরণ দরকার। তারপর জেলখানায় 'পানি পানি' বলে একজন কয়েদীর গোঙানোর সিনের পর বৃষ্টির সিকুয়েন্সটা। এবং সবশেষে মানবের মৃত্যুর সময় শুরুর দিকে মানবের গাওয়া গানের নস্টালজিয়া ফিরে আসা
' একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি' যেন একটা জীবনচক্র পূর্ণ হল। জীবনটা যেন বৃত্ত, চক্রপূর্ণ হয় জীবনের।
.
এখন যদি বলি চলচ্চিত্রটি আপনি কেন দেখবেন?
এই ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ তো সকলেই বই পড়ে কমবেশি জানি। তাহলে বলতেই হবে, বইয়ে পড়ে হয়তো সকলেই জানি কিন্তু কেউই দেখিনাই। তানভীর মোকাম্মেল আমাদের সেই দ্রোহী সময়ের মধ্যে নিয়ে যাবেন। ব্যক্তির গল্পের মধ্য দিয়ে সাধারণের লেন্সে দেখাবেন সামগ্রিক ইতিহাসের নানান বিবর্তন। সর্বোপরি রাজনীতি হোক, পার্টি হোক, আর্ট হোক সেটা সাধারণের জন্য, সাধারণের পক্ষে, সাধারণের কণ্ঠ হয়ে ওঠে কিনা সেটাই আসল কথা। রূপসা নদীর বাঁকে একান্তই সাধারণের - আপনার, আমার সবার। সামান্য কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়েও অনন্যসাধারণ একটি নির্মাণ এই সিনেমাটি। আকালের সময়ে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সিনেমা দেখেও আফসোস করিনাই, তৃপ্তিই বোধ করছি বলতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:২৭