
অর্ক ফোনটা সুইচড অফ করে রেখেছে। আরে মোবাইল সুইচড অফ করেই যদি রাখবি তো ইউজ করিস ক্যান? বুড়িগঙ্গায় ঢিল দিয়া ফেলা। মেজাজটা চিড়বিড় করতেছে। আজকে মহাশয়ের জন্মদিন। মহারাজ কাল রাত সাড়ে এগারোটায় আমারে গুড নাইট জানায়ে এই যে ফোন বন্ধ রাখছে, আর খোলার নাম নাই। এখন পর্যন্ত উইশ করতে পারিনাই। কেমন লাগে!! ফোন খোলো অর্ক…….প্লীইইজ ফোন খোলো। মন খারাপ, অস্থিরতা, রাগ সব এমনভাবে ভীড় করছে যে মনে হচ্ছে ওকে সামনে পেলে ছিড়ে বিড়ে ফেলতাম। কোন কাজ করতে পারছিনা। একটু পরপর ফোন হাতে নিয়ে রি-ডায়াল। হঠাৎ মনে হোতেই ফোন করলাম ওর অফিসের ল্যান্ড ফোনে। ওর কলিগ কাম বন্ধুকে বললাম ওকে ফোন দিতে। ফোন ধরতেই কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সন্ধ্যা ৭টায় প্রবর্তনায় চলে আসতে বলে ফোন রেখে দিলাম। জানি আসবে…….আসবেই।
প্রবর্তনার এই আড্ডা-য় আজ দ্বিতীয়বার আসা। কি সুন্দর ঘরোয়া পরিবেশ। ফ্লোরে ম্যাট পেতে ছোট্র স্কয়ার টেবিলের চারপাশে কুশন দিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রথমবার এসেছিলাম অর্ক-র সাথেই। সেবার অর্ক-ও প্রথম। আমাকে সে ইনভাইট করেছিলো একসাথে ইফতার করার জন্য। অনেক আলাপের পর দ্বিতীয় দেখা ছিলো সেবার। আমরা কেউ জানিনা আড্ডা-র খাবারের দাম কেমন। দুজনেই সামান্য বেতনের চাকরী করি। দুজনকেই মা, ভাই-বোন-এর ছোট্র ফ্যামিলীকে চালিয়ে নিতে হয়। দুজন সবসময় দুজনের কাছে কষ্টটাকে আড়াল করে স্বতস্ফুর্ত আমি-টাকে তুলে ধরার চেষ্টায় ব্যস্ত থেকেছি। আর তাতে করেই যেন দুজনের কাছে দুজনের আমিত্ব-টাই খুব বেশি পরিচিতি পেয়েছে। প্রথমবার এসে আমরা ইফতারের মেন্যু অর্ডার করার পর অর্ক-র দুঃশ্চিন্তা ছিলো দেখার মত। মনে হোতেই আমি হো হো করে হেসে উঠি। “হাসছো কেন একা একা?” ঝট করে পাশে তাকিয়ে দেখি অর্ক। কখন এসেছে টেরই পাইনি। ধবধবে সাদা রঙ্গের প্যান্টের সঙ্গে আকাশের ধুসর নীল রঙ্গের ফুল স্লীভ শার্টে কি বিষন্ন লাগছে অর্ক-র মুখটা। কেন এত মন খারাপ ওর আজ! “তোমার মনে আছে আমাকে ইফতার করাতে এসে বিল নিয়ে কি চিন্তায় পরে গেছিলে তুমি?” স্বতস্ফুর্ত কন্ঠে ওকে বলি। ও ম্লান হাসে। “আমার ব্যাগে যা আছে তা দিয়েও যদি না হয় তবে তোমার হাতের ঘড়িটা ওদের দিয়ে যাবো”…এই বলে তোমাকে আশ্বস্ত করেছিলাম। হাহাহাহা। “যদিও তোমার পকেট থেকেই পুরো বিলটা দেয়া গেছিলো।“ ওর দিকে তাকিয়ে হাসি আমি স্মিত।
চায়ের অর্ডার দেই। সাথে দুটো ভেজিটেবল সমুচা। চা-টা এরা এত্ত সুন্দর করে সার্ভ করে। চিনি, দুধ সব আলাদা পটে। সাথে দু’কাপ গরম পানি, আর টি ব্যাগ। টুকটুক কথা বলতে বলতে নিজের হাতে চা বানিয়ে পাশের জনকে দেয়া। না চাইলেও রোমান্টিকতার ন্যাকামি হয়েই যায়। দুটো রজনীগন্ধার স্টিক টেবিলে রাখে অর্ক। “কোথায় ছিলো এতক্ষন ওদুটো? দেখিনিতো।“ নির্মল বিষ্ময় প্রকাশ আমার কন্ঠে। এবার ওর হাসিটা যেন প্রানবন্ত হয়ে ওঠে। ছুঁয়ে যায় আমার ভেতরটা। তিরতির করে কাঁপতে থাকে সেখানটা। এই হয়। মাঝে মাঝেই এমন অনুভূতিতে আমাকে নাড়িয়ে যায় অর্ক। কেন যে!! এক ঘন্টা পর আমরা বের হই আড্ডা থেকে। চন্দ্রিমার পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তাটা তখন মোটামুটি ফাঁকা। আমরা হাঁটতে থাকি। হঠাৎ ব্রীজটার কাছাকাছি হালকা আলোয় এসে অর্ক বলে “চলো বসি”। পরিচয়ের আট মাসের মাথায় আজ প্রথম অর্ক আমার হাতের আঙ্গুল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। ভালো লাগায় বিভোর হতে থাকি আমি। ওর আর আমার বন্ধুত্বটা কেন জানিনা ওর বন্ধুরা মেনে নিতে পারেনি। তাই আজ ওর আমি ছাড়া আর তেমন কোন বন্ধু নেই। তাই কি আজ ওর এত মন খারাপ? আমি কি পারবো ওর এই শূন্যতাকে ভরিয়ে দিতে?! আমার চোখ ভরে যায় জলে। অর্ক-র দু’চোখ আটকে থাকে সেখানে। ঝাপসা চোখেও আমি সেই দু’চোখে কেবল আমাকেই দেখতে পাই। ও একটা বেশ বড়সর প্যাকেট রাখে আমার কোলে। আমার অবাক বিষ্ফারিত চোখ দেখে এবার অর্ক হো হো করে হেসে ওঠে। এই প্যাকেটটাও এতক্ষন ধরে আমি দেখিনি। আশ্চর্য! প্যাকেটের লাল রঙ্গের র্যাপিং পেপার এর উপর একটু টুকটুকে লাল গোলাপ কুঁড়ি সাঁটা। এক ফোঁটা পানি আমার চোখ থেকে টুপ করে খসে পরে সেই কুঁড়ির গায়। ভালোবাসায় কুতজ্ঞতা জানাতেই যেন। প্যাকেট খুলে দেখি সেখানে একটা সাদা জামদানি। হালকা সোনালি কাজ তার জমিনে। এত শুভ্র রং! আজ দিনটা যেন আমার……এমনই মনে হোতে থাকে। হঠাৎ-ই মন খারাপ হোতে থাকে আমার। সেটা বুঝতে পেরেই হয়তো অর্ক আমাকে টেনে নেয় ওর বুকের কাছটাতে। আমার কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দুটো থেকে যেন শুষে নিতে থাকে ভেতরের সব জমে থাকা কষ্ট!
একটা রিক্সা নেই আমরা। কথার ঝাঁপি খুলে বসি আমি। মনোযোগী শ্রোতা অর্ক। আমার দিকেই তাকিয়ে শুনে যেতে থাকে আমার এলোমেলো সাত-সতের কথামালা। হঠাৎ করেই আমি সামনে একটি মাইক্রোকে এলোমেলোভাবে আসতে দেখি। ফাঁকা রাস্তায় আমাদের রিক্সাটা মাঝ বরাবরই চলছিলো বলা যায়। ডান পাশের ফুটপাথটা হাত দশেক দূরে। মাইক্রোটা কাছাকাছি চলে আসতেই আমি দিকভ্রান্ত হয়ে অর্ককে ধাক্কা দিয়ে রিক্সা থেকে ফেলে দেই। যেন ওকে পৌঁছে দিতে চাই নিরাপদ ফুটপাথে। নিমেষেই মাইক্রোটা অর্কর উপর দিয়ে চলে যায়।
অর্ক ফোন খোলেনা। ও কেন আজ কথা বলবেনা আমার সাথে?! আমি রি-ডায়াল করে যেতে থাকি। আমার রাগ হোতে থেকে প্রচন্ড। রেগে গিয়ে আমি কাঁদতে থাকি। কেন এত অভিমান আমার সঙ্গে?! কি করেছি আমি?! আমি কি জানতাম নাকি যে মাইক্রোটা ওদিকেই ঘুরে যাবে হঠাৎ?! আমিতো বুঝতে পারিনি অর্ক। কেন তুমি রাগ করে আছো অর্ক?! ফোন খোলো প্লীইজ!! অন্তত আজকে!! একবার শুধু এই সন্ধ্যায়!!!
আড্ডা থেকে বেরিয়ে আমি হাঁটতে থাকি চন্দ্রিমার পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তার ফুটপাথ ধরে। গতকালকেই হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছি। আমি জানিনা মাঝখানে কতগুলো দিন চলে গেছে। অর্ক-র জীবনের শূন্যতা ভরতে চেয়েছিলাম আমি। সেদিনের সেই সন্ধ্যা আমার জীবনটাকেই শুন্য করে দিয়ে গেছে। সময়হীন করে দিয়ে গেছে আমার চারপাশ। আমি জানিনা এখন কত রাত। শুধু জানি আজ ৫ই নভেম্বর…আজ অর্ক-র জন্মদিন। আজ দিন-টা শুধুই আমার।